জায়নবাদি কুটচাল বনাম আরবনেতাদের হালচাল

(দ্বিতীয় পর্ব) ২ ডিসেম্বরের পর

প্রকাশ : ০৮ ডিসেম্বর ২০২৩, ১২:২৫

ড. মো. কামরুজ্জামান
লেখক ড. মো. কামরুজ্জামান

জাতিসংঘের বণ্টিত নিয়মে জেরুজালেম কারো জন্য নির্ধারিত ছিল না। এটি যেহেতু মুসলিম, ইহুদি এবং খ্রিস্টানদের পবিত্র স্থান তাই এটা ছিল একটি আন্তর্জাতিক নগরী। যদিও এ বণ্টন মুসলিমরা মেনে নেয়নি। এ জেরুজালেমেই অবস্থিত মুসলমানদের প্রথম কেবলা মসজিদে আকসা। কিন্তু বর্তমানে এই জেরুজালেম এবং মসজিদে আকসা ইহুদিরা দখল করে নিয়েছে। ফিলিস্তিনে দুটি রাজনৈতিক দল আছে। একটির নাম হামাস, আরেকটির নাম ফাতাহ। হামাস হলো ইসলামপন্থি সবচেয়ে জনপ্রিয় দল। আর ফাতাহ হলো সেক্যুলারপন্থি দল। হামাস গাজার নেতৃত্ব দেয়, আর ফাতাহ রয়েছে পশ্চিম তীরের নেতৃত্বে। নির্বাচনে হামাস জয়ী হলেও বর্তমানে ফিলিস্তিনের সরকারি ক্ষমতা রয়েছে ফাতাহর হাতেই। 

ফাতাহ মূলত ইসরাইলের আনুক‚ল্য নিয়েই বেঁচে আছে। গাজাবাসীর জন্য সাহায্য করতে হলে সেটা সরাসরি তাদের হাতে যায় না। এটা পশ্চিম তীরের সরকার তথা ফাতাহর কাছে যায়। যা গাজাবাসীর কোনো উপকারে আসে না। বরং পশ্চিম তীরের উন্নয়নে ফাতাহ সরকার সেটা ব্যয় করে। গাজা শহরটি পুরোটাই চারদিক থেকে অবরুদ্ধ। গাজার তিনদিকেই ইসরাইল। আর একদিকে ভ‚মধ্যসাগর। যার নিয়ন্ত্রণে রয়েছে ইসরাইলের গানশিপ সদস্যরা। গাজার একটু অংশ মিসরের সঙ্গে সংযুক্ত যাকে রাফা সীমান্ত বলা হয়। 

ড. মুরছি সরকারের সময়ে মিসরের ঐ বর্ডার গাজাবাসীর জন্য খোলা থাকত। মুরসি সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করে মিসরের ক্ষমতায় আসীন হন আব্দুল ফাত্তাহ সিসি। তিনি ক্ষমতায় আসীন হয়ে উক্ত সীমান্ত বন্ধ করে দেন। ফলে চারদিক থেকে গাজাবাসী অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে। 

ইসরাইলিদের করুণার উপর নির্ভর করেই গাজাবাসীর জীবনটা অতিবাহিত হয়। হামাসের সংগ্রামী চেতনায় ফিলিস্তিনিদের হারিয়ে যাওয়া স্বাধীনতা ফিরে আসার স্বপ্ন আজো বেঁচে আছে। পশ্চিমা মিডিয়া তাদের সম্পর্কে সবসময় নেতিবাচক সংবাদ প্রচার করে। হামাসের সদস্যদের তারা সন্ত্রাসী ও উগ্রপন্থি হিসেবে উপস্থাপন করতেই ব্যস্ত সময় পার করে সারাক্ষণ।

মূলত গাজা নিয়ে ইসরাইলের রয়েছে এক মহাপরিকল্পনা। ৭ অক্টোবর ২০২৩ এর সকালে হামাস আকস্মিকভাবে ইসরাইলের অভ্যন্তরে এক হামলা চালায়। সেদিন থেকে আজ পর্যন্ত ইসরাইল গাজায় হামলা অব্যাহত রেখেছে। এ হামলায় ইসরাইল হামাসযোদ্ধাদের কোনো ক্ষতি করতে পারছে না। হামাসের কৌশলের কাছে বিশে^র অজেয় শক্তি ইসরাইল লজ্জাজনক ধরাশয়ী হয়েছে। সুউচ্চ ভবন ধ্বংস আর নিরীহ শিশু ও নারী মারা ছাড়া অন্য কোনো সাফল্য ইহুদিরা পাচ্ছে না। 

গত পাঁচ সপ্তাহের হামলায় গাজার ৭ লাখ শিশুকে তারা উদ্বাস্ত বানিয়েছে। তারা মূলত গাজা থেকে মুসলিম শূন্য করতে চায়। তারা শিশু ও নারীদের গাজার উত্তর সীমান্তে যেতে বলে সেই উত্তর সীমান্তেই বিমান হামলা চালাচ্ছে। আবার দক্ষিণ দিকে সরে যেতে বলে দক্ষিণ দিকেই হামলা করছে। এ পর্যন্ত নিহত ফিলিস্তিনিদের দুই-তৃতীয়াংশই নারী ও শিশু। 

শিশু হত্যার উদ্দেশ্য হলো, শিশুরা যাতে যোদ্ধা না হতে পারে। আর নারী হত্যার উদ্দেশ্য হলো, ফিলিস্তিনিরা যাতে নির্বংশ হয়ে যায়। গাজার অধিবাসী সংখ্যা প্রায় ২৫ লাখ। এই ২৫ লাখ মুসলমানকে তারা গাজা থেকে বের করে দিতে চায়। কট্টর এক ইহুদি মন্ত্রী গাজাবাসীকে মিসরের সিনাই উপত্যকায় পাঠিয়ে দেয়ার প্রস্তাব করেছে। অতঃপর মুসলিমশূন্য গাজার জমি ইসরায়েলি সেনাদের মধ্যে বণ্টন করার প্রস্তাব করেছে। ইতোমধ্যে মিসরের সিসি সরকারকে ইসরাইল এ প্রস্তাব জানিয়ে দিয়েছে। বিনিময়ে মিসর কর্তৃক বিশ্ব ব্যাংকের কাছ থেকে নেয়া ১৬ হাজার কোটি ডলার মওকুফের টোপ দেয়া হয়েছে। 

কোনো কোনো ইহুদি নেতা গাজার মুসলিম জনতাকে আয়ারল্যান্ড, স্কটল্যান্ড কিংবা চীনের মরুভ‚মিতে নির্বাসনের প্রস্তাব করেছে। আবার কারো মতে ২৫ লাখ সংখ্যাটা খুব বেশি নয়। সুতরাং পারমাণবিক বোমা মেরে এ সংখ্যাটাকে মেরে ফেলার প্রস্তাব করেছে! ইসরাইল সরকার ফিলিস্তিনিদের বিতাড়িত করে সেখানে প্রবল প্রতিপত্তি স্থাপন করতে চায়। সেখানে আমেরিকা ও ইসরাইল যৌথ সামরিক ঘাঁটি স্থাপনের পরিকল্পনা করেছে। এর মাধ্যমে তারা গোটা বিশ্বকে পদানত করতে চায়। আরববিশ্বকে তারা হাতের মুঠোয় নিয়ে কৃতদাসে পরিণত করতে চায়। ইসরাইলের এক গোপন নথি ফাঁস হলে বিশ্বমিডিয়ায় তাদের এ পরিকল্পনা প্রকাশ পায়। 

আন্তর্জাতিক মিডিয়া সূত্রে বলা হয়েছে, গাজার তলদেশে তেল ও গ্যাসের মজুদ রয়েছে। ইসরায়েলের বারোটা কোম্পানি গাজায় তেল ও গ্যাস অনুসন্ধানে প্রস্তুত রয়েছে। ইসরায়েল বর্তমানে মূলত আরব বিশ্বের তেলের উপর নির্ভরশীল। 

এমতাবস্থায় তারা যদি গাজার তলদেশ থেকে তেল ও গ্যাস উত্তোলন করতে পারে তাহলে তারা এক্ষেত্রে স্বনির্ভর হয়ে যাবে। বর্তমানে ইসরাইল আরব বিশ্বের মুখাপেক্ষী হলেও তখন আর মুখাপেক্ষী থাকবে না। 

গাজায় প্রতিদিন শতশত নিরীহ মানুষের মৃত্যু হচ্ছে। গাজার চারদিকে অসহায় নারী ও শিশুর মরদেহ ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে। অনেক মরদেহ পচে গলে গন্ধ ছড়ালেও দাফন-কাফনের ব্যবস্থা করা যাচ্ছে না। দখলদার ইহুদিরা লাশ ও রোগীবাহী অ্যাম্বুলেন্সে হামলা করছে। 

শরণার্থী শিবিরেও তারা হামলা চালাচ্ছে। ট্যাংক ও সাঁজোয়া যান দিয়ে হাসপাতালের পথ বন্ধ করছে। গাজার ৩৬টি হাসপাতালের সবকটিই প্রায় ধ্বংসস্ত‚পে পরিণত হয়েছে। তাদের হামলা থেকে পানির ট্যাংক ও গ্যাস পাম্পও রক্ষা পাচ্ছে না। হাজার হাজার শিশুর কান, নাক ও গাল ফেটে রক্ত পড়ছে। অগণিত শিশুর দেহ ও মাথা থেতলে যাচ্ছে। তাদের আর্তচিৎকারে আকাশ-বাতাস ভারী হয়ে উঠছে। লোমহর্ষক এসব দৃশ্যে খোদ ইসরাইলের অভ্যন্তরে সাধারণ ইহুদিরা প্রতিবাদে রাস্তায় নামছে। যুদ্ধ বন্ধে নেতানিয়াহুর বাড়ি ঘেরাও করছে। 

ইসরায়েলের পশ্চিমা মিত্ররা এ গণত্যার বিরুদ্ধে ফুঁসে উঠছে। সাধারণ ইহুদিরা নিরাপদ জীবনযাপন করতে সাইপ্রাস পাড়ি জমাচ্ছে। ফিলিস্তিনে হামলা বন্ধে আন্তর্জাতিক বিশ্ব ইসরাইলের ওপর চাপ প্রয়োগ করছে। ফিলিস্তিনি শিশুদের রক্ত পশ্চিমা বিবেককে জাগিয়ে তুলেছে। কিন্তু আফসোস আরব বিশ্বের মুসলিম নেতাদের জন্য! তাদের বিবেক আজও জাগ্রত হলো না! অথচ তারা জাগলেই ইসরাইল থেমে যেত। 

তাদের একটি মাত্র উদ্যোগ ফিলিস্তিনি শিশুদের পথচলা সহজ হতো। আর সেটা হলো, ইহুদি দখলদারদের বিরুদ্ধে আরবনেতাদের ঐক্যবদ্ধ হওয়া এবং ফিলিস্তিনিদের বৈধ স্বাধিকারের প্রতি সমর্থন দেয়া। বৈধ স্বাধিকার অর্জন করতে ফিলিস্তিনিরা দীর্ঘ ৭৪ বছর ধরে তাদের রক্ত ঝরাচ্ছে। কিন্তু আরব নেতাদের নীরবতা ও বিলাসিতার কারণে তারা তাদের বৈধ স্বাধীনতা ফিরে পাচ্ছে না।

গত ১১ নভেম্বরে আরবলিগ ও ওআইসিভুক্ত ৫৭টি মুসলিম দেশের নেতারা করণীয় নির্ধারণে সৌদি আরবে এক বৈঠকে মিলিত হয়েছিলেন। গোটা মুসলিম দুনিয়া অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় ছিল। তারা ভেবেছিল, এই বুঝি মুসলিম নেতাদের সম্ভিত ফিরে এসেছে। তারা হয়তো এবার ইসরায়েলের গণহত্যার বিরুদ্ধে হুঙ্কার দিবে। কিন্তু না! তাদের ভ‚মিকায় গোটা মুসলিম উম্মাহ হতাশ হয়েছে। তারা কার্যকরী কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারেননি। শুধু যুদ্ধ বন্ধে নিন্দা ও কিছু নসিহতপূর্ণ কথা পেশ করেছেন! তাদের এমন নিন্দা ও নসিহত নতুন কিছু নয়। 

গত ৭৪ বছর ধরেই বিশ^বাসী এমন নিন্দাই প্রকাশ করেছেন। কিন্তু এতে ফিলিস্তিনিরা তাদের স্বাধিকার ফিরে পায়নি। আর গণহত্যাও বন্ধ হয়নি।
ইহুদি কারাগারে মুসলিম নারীরা যখন গণহারে ধর্ষিতা হচ্ছে, মুসলিম নবজাতক শিশুদের রক্তে যখন ফিলিস্তিন রঞ্জিত হচ্ছে, ঠিক তখন আরব শাসকরা ইহুদিদের পায়ে কদমবুছি করছে! বংশীয় রাজত্ব রক্ষায় তারা ইসরাইলি অনুকম্পার দ্বারস্থ হচ্ছে। সারিকা আর রোনালদোদের নিয়ে ফুটবল উৎসবে মেতে উঠছে! রাজ প্রাসাদের অন্তঃপুরে নারী ও মদের আসর বসছে। আর এসব রাজা-বাদশাদের নারীর জোগানদাতা হলো এ ইসরায়েল। 

ইসরায়েলি নারীরা বিশ্বের সবচেয়ে সুন্দরী বলে খ্যাত। এসব ইসরাইলি কিশোরীরা পালাক্রমে রাজপ্রাসাদে রাজাদের শয্যাসঙ্গী হচ্ছে। এক্ষেত্রে তাদের সবচেয়ে বড় উদ্দেশ্য হলো, ইসরায়েলের বিরুদ্ধে তারা যেন টুঁ শব্দটি পর্যন্ত না করে। রাষ্ট্র ক্ষমতা স্থায়ীকরণ আর নারী আসক্তের কারণে আরবনেতারা তাই ইসরায়েল রাষ্ট্রের বিরোধিতা কওে না। উল্লেখ্য, নারী বিনিয়োগ বাণিজ্য থেকে ইসরাইল প্রতিবছর ৫০০ মিলিয়ন ডলার আয় করে।

লেখক : অধ্যাপক, দা’ওয়াহ অ্যান্ড ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া ও নির্বাহী সদস্য (জাশিপ)
Email: dr.knzaman@gmail.com

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

লেখকদের নামঃ