জায়নবাদি কুটচাল বনাম আরবনেতাদের হালচাল

প্রকাশ : ০৩ ডিসেম্বর ২০২৩, ১৭:১৪

ড. মোঃ কামরুজ্জামান

 

হিব্রু ‘জিয়ন’ শব্দ থেকে জায়নবাদের উৎপত্তি। আবার জয়ন জেরুজালেমের একটি পাহাড়ের নাম। ইহুদিদের ধারণামতে, জেরুজালেমের মসজিদে আকসার অদূরে তাদের একটি উপাসনালয় আছে। এটির পুন:নির্মাণ করে সেখানে তারা বসতি স্থাপন করতে চায়। এ উপসনালয়কে ঘিরে তারা ফিলিস্তিনে একটি ইহুদি রাষ্ট্র কায়েমের পরিকল্পনা করে। 

ফিলিস্তিন হলো সমস্ত পৃথিবীর মধ্যস্থল-যাকে বিশে^র রাজধানীও বলা যেতে পারে। সুতরাং এখানেই তারা স্থায়ী হয়ে গোটা পৃথিবীর কর্তৃত্ব করতে চায়। ইহুদিদের কোনো স্থায়ী ভূমি ছিল না। সারা দুনিয়ায় তারা ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল। তথাপিও তাদের এ লক্ষ্য অর্জনে তারা একযোগে কাজ করে যেতে থাকে। আপন অবস্থান থেকে এ মিশন বাস্তবায়নে তারা ধাপে ধাপে অগ্রসর হয়। এ হিসেবে জায়নবাদের ইতিহাস অতি প্রাচীন। ইউরোপের বিভিন্ন দেশে এটি বিভিন্ন নামে বিকশিত হয়েছে। বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের রুপ ধারণ করে তারা বিস্তৃত হয়েছে। 

নিজেদের গোপন অভিপ্রায় ও স্বকীয়তা ঠিক রেখে তারা সমাজের সাথে মিশে গিয়েছে। যার যার অবস্থান থেকে সাধ্যমত তারা তাদের কাজ করে গেছে। অতীতে বনি ইসরাইলের উপর আকাশ থেকে মান্না ও সালওয়া নামক খাদ্য নাযিল করা হয়েছিল। 

বলা হয়ে থাকে, এ খাবার খেয়েই জাতিতে তারা খুব মেধাবী ও কৌশলী হয়েছে। তাদের কুটকৌশল ইউরোপের বিস্তৃত খ্রিস্টানজগতকে ভেঙ্গে টুকরো টুকরো করেছে। তাদেরকে ক্রুসেডে জড়িয়ে সংকটে ফেলে দিয়ে গোটা ইউরোপকে তারা অদৃশ্য নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে। দেশে দেশে তারা বিশ্বমানের নেতা, সংগঠক ও রাজনীতিক পয়দা করেছে। দেশ বিদেশে  তারা গবেষক, সাহিত্যিক ও বুদ্ধিজিবি তৈরী করেছে। এক্ষেত্রে তারা ব্যাপকভাবে নারী ও অর্থ বিনিয়োগ করেছে। তাদের কুটকৌশলের মাধ্যমে আধুনিক শক্তিশালী খ্রিস্টানদেরকে তারা কুপোকাত করেছে। ফলে ইহুদিঘাতক হিসেবে পরিচিত অনেক নামি দামি খ্রিস্টান নেতা ইহুদিদের পক্ষে ত্রাতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। এমনি দুজন খ্রিস্টান সদস্যের নাম হলো সাফটেসবারি ও পালামারস্টন। এদুজন খ্রিস্টানই সর্বপ্রথম ফিলিস্তিনে ইহুদি কলোনি প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব উত্থাপন করে। তৎকালিন বিখ্যাত সব কবি, সাহিত্যিক, রাজনীতিক ও বুদ্ধিজীবী এ প্রস্তাবকে সমর্থন করেন। 

অবশ্য আধুনিক জায়নবাদের উত্থান ঘটে ১৮৮০ সালে। নাকান বেরেনবুয়ান নামে এক অস্ট্রিয়ান ইহুদি ইহুদিজাতিকে জেরুজালেমে ফিরে যাওয়ার জন্য একটি আন্দোলনের প্রস্তাব দেন। অস্ট্রিয়ান আরেক তুখোড় সাংবাদিকের নাম হলো ড. থিওডর হার্জেল। ১৮৯৬ সালে তিনি ‘দ্যা জুয়েশ স্টেট’ নামে এক গ্রন্থ রচনা করেন। এ বইতে তিনি ইহুদিমুক্তিআন্দোলনের রুপরেখা প্রণয়ন করেন। আর তার নেতৃত্তে¡ গঠিত হয় ‘ইন্টারন্যাশনাল জায়োনিস্ট অর্গানাইজেশন’। ইউরোপ, আমেরিকা ও রাশিয়ায় এ আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। বিভিন্ন কাঠামোতে ইহুদিরা নানা সংগঠন গড়ে তোলে। প্রত্যক্ষভাবে তারা গড়ে তোলে আন্তর্জাতিক নানা সংগঠন। ইহুদি কংগ্রেস,  আন্তর্জাতিক জায়নিস্ট লীগ, বেরিহাহ মুভমেন্ট, হাগানাহ ইত্যাদি তাদের প্রতিষ্ঠিত প্রত্যক্ষ সংগঠন। আর পরোক্ষভাবে তারা গড়ে তুলেছে ইন্টারন্যাশনাল মনিটরি ফান্ড, ওয়ার্ল্ড ব্যাংক, ইন্টারন্যাশনাল রেড ক্রস, ইউএনডিপি, ইউনিসেফ, ইউনেস্কো, জুয়েশ ন্যাশনাল ফান্ড ইত্যাদি। ড. থিওডর হার্জেলের নেতৃত্বে ১৮৯৭ সালের আগষ্টে সুইজারল্যান্ডে দুদিনব্যাপী এক আনুষ্ঠানিক ইহুদি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। 

আধুনিক বিশ্বে এটাই ছিল ইহুদিদের প্রথম আনুষ্ঠানিক কোনো আন্তর্জাতিক সম্মেলন। এ সম্মেলন থেকেই আন্তর্জাতিকভাবে ইহুদিবাদের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয়। বিশ্বের ৩০টি ইহুদি সংগঠনের ৩০০ জন নেতা ইহুদিবাদকে প্রাতিষ্ঠানিক রুপ দেয়। গোটা দুনিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করতে তারা পরিকল্পনা কষতে থাকে। স্থায়ীভূমি ক্রয় করতে তারা গঠন করে ‘জুয়েশ ন্যাশনাল ফান্ড’। ফিলিস্তিনিদের কাছ থেকে জমি কিনতেই তারা এ ফান্ড ব্যবহার করে। এ সময় থেকে তারা রিফিউজি ও ভিখারি হিসেবে অল্প অল্প করে ফিলিস্তিনে আগমন শুরু করে ও সেখানে তারা বসবাস করতে থাকে।  

১৯১৫ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়। যুদ্ধে দুটি পক্ষে অনেকগুলো রাষ্ট্র ছিল। প্রথম পক্ষে ছিল উসমানিয় সাম্রাজ্য, অষ্ট্রিয়া-হাঙ্গেরি, বুলগেরিয়া ও জার্মানি। দ্বিতীয় পক্ষে ছিল ব্রিটেন, ফ্রান্স, সার্বিয়া, জাপান, ইতালি, রুমানিয়া, রাশিয়া ও আমেরিকা। যুদ্ধে প্রথম পক্ষ হেরে যায়। ফলশ্রুতিতে উসমানিয় সাম্রাজ্য ভেঙ্গে যায়। উসমানিয় সাম্রাজ্য মানেই মুসলিম বিশ্ব। 

বিজয়ী পক্ষ পরাজিত মুসলিম বিশ^কে ভাগ বাটোয়ারা করে নেয়। ফিলিস্তিন চলে যায় ব্রিটিশের ভাগে। ফলে ব্রিটেন ফিলিস্তিনে বসতি স্থাপন শুরু করে। সেখানে ব্রিটেনের রাজত্ব স্থায়ী হয় ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত। এ দীর্ঘ সময়ে ব্রিটেন ফিলিস্তিনের মাটির গভীরে তাদের শিকড় গেড়ে ফেলে। আডলফ হিটলার ছিলেন অস্ট্রীয় বংশোদ্ভূত জার্মান রাজনীতিবিদ। 

প্রথম বিশ্বযুদ্ধে তিনি সৈনিক হিসেবে জার্মনির পক্ষে অংশগ্রহণ করেছিলেন। তাকে নাৎসিবাদের প্রবক্তা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তিনি ১৯৩৩ থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত জার্মানির চ্যান্সেলর ছিলেন। ১৯৪১ সালে জার্মানিতে ঘটে হলোকাস্টের ঘটনা। 

হলোকাস্ট হলো একটি জেনোসাইড বা গণহত্যা। এর সরল অর্থ ইহুদি নিধন। হিটলারের নেতৃত্বে এ নিধন সংঘটিত হয়। এছাড়া জার্মানির অধিকৃত অন্যান্য দেশেও এ নিধন সংঘটিত হয়। ইতিহাসখ্যাত এ গণহত্যায় নিহতের সংখ্যা ছিল ৬০ লাখ ইহুদী। তবে প্রকৃত সংখ্যা ছিল এর চেয়ে অনেক বেশি। ইহুদী গবেষকদের মতে, এ গণহত্যায় নিহতের সংখ্যা ছিল ১ কোটি ১০ লাখ। এ গণহত্যাটি চলমান থাকে ১৯৪১ সাল থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত। 

আধুনিক ইউরোপের ইতিহাসে এ গণহত্যাটি হত্যা ছিল সবচেয়ে নৃশংস ও ভয়ঙ্কর বড়ো গণহত্যা। জার্মান ব্যুরোক্র্যাসির (আমলাশ্রেণী) সবগুলো শাখা এই গণহত্যার সাথে জড়িত ছিল। এ সময়ে জার্মানির অর্থ মন্ত্রণালয় ইহুদিদের সকল সম্পদ বাজেয়াপ্ত করে। জার্মান প্রতিষ্ঠানগুলো ইহুদীদের চাকরিচ্যুত করে। 

বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ইহুদিছাত্র ভর্তির ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। অধ্যয়নরত ইহুদি ছাত্রদেরকে ডিগ্রি প্রদান বন্ধ করে। চাকুরীরত ইহুদী প্রফেসরদেরকে চাকরিচ্যুত করে। এ সময়ে শুধু জার্মানিতেই বসবাস করতো ৯০ লাখ ইহুদি। যার মধ্যে ৬০ লাখ ইহুদীকে হত্যা করা হয়। ইহুদি নাগরিকদেরকে বিভিন্ন ক্যাম্প ও কারাগারে বন্দী করা হয়। কারাগারের মধ্যেই তাদেরকে ধাপে ধাপে নির্যাতন ও হত্যা সম্পন্ন করা হয়। 

১৯৩০ এর দশক থেকেই ইহুদীদের আইনি, অর্থনৈতিক ও সামাজিক অধিকার চরমভাবে সীমিত করা হয়। জার্মানি ১৯৪০ সালে নরওয়ে, নেদারল্যান্ড, বেলজিয়াম ও ফ্রান্স দখল করে নেয়। ১৯৪১ সালে দখল করে নেয় যুগোশ্লাভোকিয়া ও গ্রিস। এ সমস্ত দেশেও ইহুদিদের বিরুদ্ধে ব্যাপক পদক্ষেপ নেয়া হয়। এ সময় ইতালি সরকার ইহুদিদের সরকারি চাকরি ও স্কুলে প্রবেশের সুযোগ বন্ধের এক আইন পাশ করে। এসময় ইতালীয় লিবিয়ায় মোট জনসংখ্যার ২৫ ভাগ ছিল ইহুদি। সেখানে তাদের ৪৪টি উপসনালয় ছিল। 

১৯৪২ সালে নাৎসিরা সেগুলো দখল করে নেয়। তাদেরকে সেখান থেকে উচ্ছেদ করা হয়। তাদেরকে জোর করে বিভিন্ন শ্রমশিবিরে পাঠানো হয়। অধিকাংশ ইহুদি শ্রমশিবিরে রোগে-শোকে ও অনাহারে মৃত্যুবরণ করে। বেঁচে যাওয়া ইহুদিরা ইউরোপের বিভিন্ন রাষ্ট্রে মানবেতর জীবন যাপন করতে থাকে। তারা নিজেদেরকে বড়ো অসহায় জাতি ভাবতে থাকে। তারা উদ্বাস্তু জীবন থেকে বেরিয়ে আসার পথ খুঁজতে থাকে। তাদের কাছে তাই প্রয়োজন ছিল একটি স্থায়ী স্বাধীন রাষ্ট্র। 

ফিলিস্তিন মধ্যপ্রাচ্যের একটি দেশ। এর পূর্বে রয়েছে লেবানন, সিরিয়া, ইরাক, জর্ডান ও সৌদি আরব। এর পশ্চিমে রয়েছে মিসর। উত্তর-পশ্চিমে ভ‚মধ্যসাগর। এ সাগরের তীরে রয়েছে সাইপ্রাস, তুরস্ক, গ্রিসসহ ইউরোপীয় অন্যান্য দেশ। এক সময় ফিলিস্তিন ছিল শান্তিময় এক মুসলিম আবাসভূমি। ছিল বিশাল এবং বিস্তীর্ণ এক ভূখন্ড। কিন্তু ১৯৪৮ সালে ফিলিস্তিনের ভাগ্যাকাশে এক কালোমেঘ জন্ম নেয়। এ সময়ে পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী বিভিন্ন দেশ থেকে ইহুদিরা ফিলিস্তিনে জড়ো হয়। খ্রিস্টানদের হাতে নির্যাতিত ইউরোপীয় ইহুদিরা এখানে উড়ে এসে জুড়ে বসে। 

ব্রিটেন নিয়ন্ত্রিত ফিলিস্তিনে তখন জনসংখ্যা ছিল ২০ লাখ। যার মধ্যে ইহুদি সংখ্যা দাঁড়ায় ৬ লাখে। জাতিসংঘ সরাসরি ফিলিস্তিনকে ভেঙ্গে দুটি রাষ্ট্রে বিভক্ত করে। ফিলিস্তিনের পেটের  মাঝখানে জন্ম দেয় ইসরাইল নামক অবৈধ রাষ্ট্রের। ফলে ফিলিস্তিন ভেঙে দুটি অংশ হয়ে যায়। একটার নাম হয় ইসরাইল আর অপরটি ফিলিস্তিন। ফিলিস্তিন অংশে দুটি এলাকা নির্ধারিত হয়। একটা হলো গাজা, আরেকটা হলো পশ্চিম তীর। 

ফিলিস্তিনের ভৌগলিক অবস্থান অনেকটা উপমহাদেশের মতো। ধরা যাক, পূর্ব পাকিস্তান তথা বাংলাদেশ হলো গাজা। পশ্চিম পাকিস্তান তথা আজকের পাকিস্তান হলো পশ্চিম তীর। আর মাঝখানে বিশাল ভারত হলো অবৈধ ইসরাইল রাষ্ট্র। গাজার আয়তন মাত্র ৩৬০ বর্গ কিলোমিটার। গাজা থেকে পশ্চিম তীরে যেতে হলে ইসরাইল অতিক্রম করেই যেতে হয়। 

বাকি অংশ পড়ুন ৮ ডিসেম্বর

লেখক: অধ্যাপক, দা'ওয়াহ এন্ড ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া ও নির্বাহী সদস্য (জাশিপ), Email: dr.knzaman@gmail.com

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

লেখকদের নামঃ