সোনালি অতীতের ফিলিস্তিন এবং আজকের নির্মমতা

প্রকাশ : ৩০ অক্টোবর ২০২৩, ১২:২৫

ড. মো. কামরুজ্জামান
ড. মো. কামরুজ্জামান

খ্রিস্টপূর্ব তিন হাজার বছর আগের কথা। ফিলিস্তিনে জন্ম নিয়েছিলেন ইসহাক (আঃ), ইয়াকুব (আঃ), ইইসুফ (আঃ), যাকারিয়া (আঃ) ও ঈসা (আঃ)সহ অনেক নবী ও রাসুল (স.)। ফিলিস্তিনের পার্শ্ববর্তী দেশ জর্ডানে জন্মগ্রহণ করেছিলেন নূহ (আঃ), লূত (আঃ) ও আইউব (আঃ)। আরেক পার্শ্ববর্তী দেশ লেবাননে জন্ম নেন সালেহ (আঃ)। আর পাশের দেশ মিসরে জন্ম নেন মুসা, হারুন ও শুয়াইব (আঃ)। এসকল নবী-রাসুল (স.) ছিলেন সমসাময়িক যুগের পথপ্রদর্শক ও সংশ্লিষ্ট দেশের জনপ্রতিনিধি। ইতিহাস অধ্যয়নে জানা যায়, ইয়াকুব (আ.)এর বংশধরেরা খ্রিস্টপূর্ব তেরোশো বছর যাবৎকাল ফিলিস্তিন শাসন করতেন। দাউদ (আ.) তাঁর শাসনামলে জেরুজালেমে বায়তুল মুকাদ্দাস নির্মাণ কাজ শুরু করেছিলেন। আর তাঁর পুত্র সুলায়মান (আ.) নির্মাণ কাজ শেষ করেছিলেন। এ মসজিদেই মিরাজের রজনীতে সকল নবীর আগমন ঘটেছিল। আর শেষ নবী মুহম্মদ (স.)এর ইমামতিতে নামাজ অনুষ্ঠিত হয়েছিল।

দাউদ (আ.)এর মৃত্যুর পর ফিলিস্তিনের শাসনভার গ্রহণ করেন তাঁরই পুত্র সুলাইমান (আ.)। আর এতসব কারণেই ফিলিস্তিন, জেরুজালেম ও বায়তুল মুকাদ্দাস মুসলিমবিশ্বে পূণ্যভূমি হিসেবে পরিচিত। নবী সুলাইমান (আ.)এর পরে ইতিহাসের গতিধারায় ফিলিস্তিনে ইহুদি, খ্রিস্টান ও মুসলমানরা বসবাস করতে থাকে। কিন্তু ইহুদিরা তাদের স্বভাবজাত বৈশিষ্ট্যের মাধ্যমে অন্যদের পাত্তা না দিয়ে নিজেরা জুদাহ নামে একটি রাষ্ট্র গঠন করে। জেরুজালেমকে তারা রাজধানী ঘোষণা করে। এতে খ্রিস্টান এবং মুসলিমগণ ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। ১৩২ সালে খ্রিস্টান রাজা কনস্টানটিন (রোমান স¤্রাট) ইহুদিদের জেরুজালেম থেকে বিতাড়িত করে। ফিলিস্তিন ঈসা (আ.)এর জন্মভূমি হওয়ার কারণে খ্রিস্টানদের কাছে সেটি হয়ে ওঠে বিশেষ পূণ্যভূমি। অবশ্য সপ্তম শতাব্দীতে রোমানরা মুসলিমদের কাছে পরাজিত হয়।

ফিলিস্তিন চলে আসে আবার মুসলিম শাসনের অধীনে। এ সময় থেকে পরবর্তী ১২০০ বছর পর্যন্ত ফিলিস্তিন ছিল স্বাধীন এক মুসলিম জাতিরাষ্টের নাম। হাতে গোনা মাত্র কয়েকজন ইহুদি এ সময় ফিলিস্তিনে বসবাস করত। রোমানদের কাছে পরাজিত হয়ে ইহুদিরা ইউরোপ ও আমেরিকার বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়ে। নীতিভ্রষ্টতার কারণে কোনো দেশেই তাদের জায়গা হয়নি। ভ‚মিহীন যাযাবর-রিফিউজি হিসেবে বিভিন্ন দেশের বস্তিতে তারা বসবাস করতে থাকে।

সৃষ্টিলগ্নের ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে, ইহুদিদের স্থায়ী কোনো বসতভিটা ছিল না। তারা কোনো জাতির সঙ্গেই মিলেমিশে বাস করতে পারেনি। তাই এভাবেই তারা নির্বাসিত জীবনযাপন করতে থাকে। ওদিকে সৃষ্টির শুরু থেকে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো ছিল প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর। তাই ইউরোপ-আমেরিকার লোভাতুর দৃষ্টি ছিল এসব দেশের প্রতি। তাই পূর্ব থেকেই মধ্যপ্রাচ্যে তাদের একটি মিত্র ও বন্ধু রাষ্ট্র গঠনের বাসনা ছিল। ওদিকে যাযাবরি জীবন থেকে মুক্তির জন্য ইহুদিরাও একটি স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের পরিকল্পনা করতে থাকে। আর এ লক্ষ্যে তারা গড়ে তোলে ‘জায়নবাদি সংগঠন’। একদিকে ইউরোপ-আমেরিকার বাসনা, অন্যদিকে ইহুদিদের পরিকল্পনা ত্বরান্বিত করতে থাকে ইহুদি রাষ্ট্র গঠনের প্রস্তুতি।


সপ্তম শতাব্দী থেকে ঊনবিংশ শতাব্দী। দীর্ঘ ১২০০ বছর। সুদীর্ঘ এ সময় পর্যন্ত ফিলিস্তিন বাংলাদেশের ন্যায় একটি মুসলিম জাতিরাষ্ট্র হিসেবে বিশ্বে পরিচিত ছিল। সেখানে মুসলিমদের পাশাপাশি খ্রিস্টান এবং স্বল্পসংখ্যক ইহুদিও বসবাস করত। ১৮৭৮ সাল পর্যন্ত ফিলিস্তিনে ইহুদিদের সংখ্যা ছিল মাত্র ৩.২ শতাংশ। ১৯১৪ সালে সংঘটিত প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ফিলিস্তিন ছিল উসমানীয় সা¤্রাজ্যের অধীনে। আর উসমানীয় সা¤্রাজ্য ছিল ব্রিটিশ বলয়ের বিরুদ্ধে। এ যুদ্ধে ব্রিটিশবলয় বিজয়ী হয়। ফলে উসমানীয় সা¤্রাজ্য ভেঙে যায়। আর ফিলিস্তিন চলে যায় ব্রিটিশদের অধীনে।

১৯১৭ সাল থেকে ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত ব্রিটিশকর্র্তৃক ফিলিস্তিন শোষিত হয়। ব্রিটিশরা ফিলিস্তিনিদের একটি স্বাধীন রাষ্ট্র উপহার দেয়ার মিথ্যা আশ্বাস দেয়। এ আশ্বাসের উদ্দেশ্য ছিল ফিলিস্তিনে তাদের শাসনসীমা দীর্ঘায়িত করে ইহুদিদের প্রতিষ্ঠিত করা। এরই মধ্যে যুদ্ধ চলমান অবস্থায় ইহুদি বিজ্ঞানী ড. হেইস বেইজম্যান দুর্লভ বোমা তৈরি করেন। যা ব্রিটিশদের যুদ্ধজয়ে ব্যাপক ভ‚মিকা রাখে। এ ভ‚মিকার উপহারস্বরূপ ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী বেলফোর ফিলিস্তিনকে ইহুদিদের হাতে তুলে দেয়ার জোর প্রস্তুতি নিতে থাকে। শুরু হয় ইহুদি বসতি স্থাপনের কার্যক্রম।

১৯২২ সালে ইউরোপ-আমেরিকা থেকে জাহাজ ভর্তি ইহুদিরা ফিলিস্তিনে আসতে শুরু করে। আর তাদেরকে পুনর্বাসন করতে অর্থজোগান দিতে থাকে ব্রিটিশরা। এ দীর্ঘ সময়ে ইঙ্গ-মার্কিন শক্তি ফিলিস্তিনকে আরব ও মুসলিম শূন্য করার কাজটি ভালোভাবে সেরে নেয়। ১৯৪৮ সালে ব্রিটিশরা ফিলিস্তিন ছেড়ে চলে যায়। কিন্তু ততদিনে ইহুদিরা ফিলিস্তিনের মাটির গভীরে শিকড় গেড়ে বসে। ১৯১৮ সালে ইহুদিদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে ২০ হাজারে উন্নীত হয়।

১৯২৩ সালে এ সংখ্যা গিয়ে দাঁড়ায় ৩৫ হাজারে। ১৯৩১ সালে এ সংখ্যা এসে পৌঁছায় ১ লাখ ৮০ হাজারে। আর ১৯৪৮ সালে এ সংখ্যাটি উন্নীত হয় ৬ লাখে। ঠিক এ দীর্ঘ সময় ধরে ইহুদিরা ব্রিটিশদের নেতৃত্বে প্রশিক্ষিত শক্তিশালী সন্ত্রাসী সংগঠন গড়ে তোলে। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় চলতে থাকে ফিলিস্তিনি মুসলিমদের উচ্ছেদঅভিযান। আর দ্রæততার সঙ্গে চলতে থাকে ইহুদিদের বসতিস্থাপন। ফলে ২০ লাখ বসতির মধ্যে ইহুদির সংখ্যা দাঁড়ায় গিয়ে ৬ লাখে। এভাবে স্বাধীন ইহুদি রাষ্ট্র গঠনের কাজ এগিয়ে যেতে থাকে দ্রæতগতিতে। অবৈধ ও অযৌক্তিক রাষ্ট্রটি আন্তর্জাতিক বৈধতা পেতে জোর লবিং চালাতে থাকে। ওদিকে ১৪ মে ১৯৪৮। ফিলিস্তিন থেকে ব্রিটিশ রাজত্ব শেষ হওয়ার কথা। সুতরাং যা করার করতে হবে অতি দ্রæত। ইহুদি-ব্রিটিশের জোর লবিং বিষয়টিকে নিয়ে যায় তাই জাতিসংঘে। আর ব্রিটিশ-আমেরিকা নিয়ন্ত্রিত জাতিসংঘ ১৯৪৮ সালে ফিলিস্তিন নিয়ে ‘দ্বিজাতিতত্ত’¡ প্রস্তাব পাস করে। প্রাচীন ফিলিস্তিন ভেঙে তৈরি হয় ফিলিস্তিন ও ইসরায়েল।

ভারত, পাকিস্তান ও ইরান এ প্রস্তাবের বিরোধিতা করে। কানাডা, চেকো¯øাভাকিয়া, পেরু, গুয়েতেমালা, নেদারল্যান্ডস, রাশিয়া, আমেরিকা ও উরুগুয়ে ফিলিস্তিনকে বিভক্ত করার পক্ষে প্রস্তাব দেয়। মোট জনসংখ্যার এক-চতুর্থাংশ হয়েও ৫৭% ভ‚মি পায় ইহুদিরা। আর মাত্র ৪৩% পায় ফিলিস্তিনিরা। এভাবেই পশ্চিমা নিয়ন্ত্রিত জাতিসংঘের মাধ্যমে পাস হয়ে যায় একটি অবৈধ ও অযৌক্তিক প্রস্তাব। প্রতিষ্ঠিত হয় একটি অবৈধ রাষ্ট্র। 

এ সিদ্ধান্তের পরপরই ফিলিস্তিনে নেমে আসে ইহুদিদের ভয়াবহ আগ্রাসন। এ আগ্রাসনে তিনমাসেই নিহত হয় ১৭০০ মুসলিম। দিনে দিনে বেড়েই চলে তাদের নিষ্ঠুরতা। একটি দিনের জন্যও শান্তিতে ঘুমাতে পারেনি নিরীহ-নিরস্ত্র ফিলিস্তিনিরা। এ নির্মমতার মধ্যেই ইহুদিরা ইসরায়েলের স্বাধীনতা ঘোষণা দেয়। ১৯৪৮ সালের ১৪ মে। রাত তখন ১২টা ১ মিনিট। ইসরায়েলকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা করে ইহুদি নেতা দাভিদ বেনগুরিয়ান। এ ঘোষণার মাত্র ১০ মিনিট পর ইসরায়েলকে স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি প্রদান করে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রুমান। অতঃপর স্বীকৃতি দেয় সোভিয়েত ইউনিয়ন, ব্রিটেন ও রাশিয়া। এ স্বীকৃতির ঠিক ১ ঘণ্টার মধ্যেই আরব-ইসরায়েল যুদ্ধ শুরু হয়। ইহুদি সৈন্যরা ফিলিস্তিনের ৫০০টি গ্রামের ৪০০টিই জনশূন্য করে দেয়।

ইহুদি, ফরাসি আর ব্রিটিশ শক্তির কাছে সমন্বয়হীন এবং নেতৃত্বশূন্য আরবরা যুদ্ধে পরাজিত হয়। সম্পূর্ণ ফিলিস্তিন দখল করে নেয় ইসরায়েল।  ফিলিস্তিনের অর্ধেকেরও বেশি মানুষ শরণার্থীতে পরিণত হয়। সাত লাখ মুসলিম বাড়িছাড়া হয়। তারা লেবানন, সৌদি আরব, মিসরসহ বিভিন্ন দেশে শরণার্থী হিসেবে জীবনযাপন করে। আজো তারা ফিরে পায়নি তাদের বাড়িঘর। সেই থেকে ফিলিস্তিনিরা আজো পর্যন্ত নিজ দেশে হয়ে আছে পরবাসী।

আন্তর্জাতিক সব রীতি-নীতি উপেক্ষা করে ইসরায়েল প্রতিনিয়ত নির্মাণ করেই চলছে দেয়াল। চালিয়ে যাচ্ছে তাদের আগ্রাসী অভিযান। অব্যাহত রেখেছে তাদের উচ্ছেদ অভিযান। জবরদখল আর নৃশংসতায় ফিলিস্তিন এখন পরিণত হয়েছে এক ভয়ংকর মৃত্যুক‚পে। আর রমজান মাস এলেই ইসরায়েল মুসলিমদের ওপর তাদের এ নৃশংসতা বাড়িয়ে দেয়। এর প্রতিবাদে বিশ্ববাসী শুধু নিন্দা করেই শেষ। ঘটেছে সাময়িক যুদ্ধবিরতি। এমন নিন্দা আর যুদ্ধবিরতি নতুন নয়। হামলা আর যুদ্ধবিরতির ঘটনা ১৯৪৮ থেকেই চলমান। বিশ্বনেতাদের নিন্দায় ফিলিস্তিনিরা পায় না তাদের অধিকার ও প্রতিকার। মুসলিমরা কোনোদিন পায়নি কোনো সুবিচার। বিশ্বনেতারা কখনো তাদের ক্ষয়ক্ষতির হিসাব করেনি। আর এক্ষেত্রে আরব বিশ্বের ভ‚মিকা সবচেয়ে বেশি লজ্জাজনক।

ইসরায়েলের বর্তমান জনসংখ্যা ৮৬ লাখ ৭১ হাজার ১০০ জন। আর ২৫টি আরবদেশের জনসংখ্যা প্রায় ৩৫ কোটি। এ বিশাল জনসংখ্যার নীরবতা ইসরায়েলকে করে তুলেছে অধিক আগ্রাসী। ফিলিস্তিন সমস্যা সমাধানে আরবনেতাদের কোনো ভ‚মিকাই নাই। বরং অতীত ভুলে আরবরা একে একে ইসরায়েলের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছে বিভিন্ন মিত্রচুক্তিতে। আর এর বিনিময়ে মুসলিম নেতারা পেয়েছেন বিভিন্ন পুরস্কার। এসব নেতার মধ্যে দৌড় প্রতিযোগিতায় সর্বপ্রথম নাম লিখিয়েছিল মিসর। ১৯৬৭ সালের এক যুদ্ধে মিসর এবং জর্ডান ইসরায়েলের কাছে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়।

পরাজিত এ মিসরই ১৯৭৮ সালে সর্বপ্রথম ইসরায়েলের সঙ্গে চুক্তিতে আবদ্ধ হয়। মিসরের প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাত ইসরায়েলের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মেনাখেম বেগিনের সঙ্গে গোপন মিটিং করেন টানা ১২ দিন। ১৯৭৮ সালে আনোয়ার সাদাতকে দেয়া হয় নোবেল পুরস্কার। আর বিনিময়স্বরূপ ১৯৭৯ সালে মিসরই সর্বপ্রথম ইসরায়েলকে স্বীকৃতি প্রদান করে। এরপর চুক্তির দৌড়ে দ্বিতীয় স্থানে এগিয়ে আসে আর এক পরাজিত আরব দেশ জর্ডান। এ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় ১৯৯৪ সালে। এরপর ইসরায়েলের সঙ্গে স্বাভাবিক ক‚টনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করেছে সৌদি আরব, বাহরাইন, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ওমান, সুদান ও মরক্কো। 


এই হলো ফিলিস্তিন বিষয়ে আরববিশ্বের অবস্থান! এটাই হলো প্রাচীন মুসলিম ফিলিস্তিনের বর্তমান নির্মম বাস্তবতা। ফিলিস্তিনিদের মাটিতে জাতিসংঘ জায়গা করে দিল ইহুদিদের। কিন্তু ফিলিস্তিনিদের প্রতিশ্রæত রাষ্ট্রটি আজো প্রতিষ্ঠিত হলো না। ১৯৭৪ সাল থেকে জাতিসংঘের পর্যবেক্ষক মর্যাদায় আছে ফিলিস্তিন ভ‚খÐটি। স্বাধীন রাষ্ট্রের মর্যাদা ফিলিস্তিন আজো পায়নি। ফিলিস্তিনিদের দাবি হলো, তাদের দেশকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে মর্যাদা ও স্বীকৃতি দেয়া হোক।

জাতিসংঘের সদস্যরাষ্ট্রের পদ দেয়া হোক। যাতে দেশটি জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে প্রতিনিধিত্ব করতে পারে। জাতিসংঘের কোন প্রস্তাবের পক্ষে বা বিপক্ষে ভোট দিতে পারে। জাতিসংঘের নির্বাহী পদে নিজেদের প্রার্থী দাঁড় করাতে পারে। তারা শুধু ১৯৪৮ সালে জাতিসংঘ কর্তৃক বণ্টিত ৪৩% ভ‚মিটুকুই ফেরত চায়। যার সবটুকুই ইসরায়েল তাদের কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছে। আর এ ভ‚মিটুকু ফেরত পেতে প্রয়োজন জাতিসংঘের সদিচ্ছা। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের ন্যূনতম ৯টি রাষ্ট্র ভোট দিলেই কেবল এই মর্যাদা অর্জন করবে ফিলিস্তিন।

নিরাপত্তা পরিষদে ভোটের ক্ষমতাসম্পন্ন পাঁচটি স্থায়ী সদস্যরাষ্ট্র হলো: যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, ফ্রান্স, রাশিয়া ও চীন। বাকি অস্থায়ী দশটি রাষ্ট্র হলো: ভারত, জার্মানি, ব্রাজিল, দক্ষিণ আফ্রিকা, পর্তুগাল, লেবানন, বসনিয়া-হার্জেগোভিনা, নাইজেরিয়া ও কলম্বিয়া। অর্থাৎ স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের মর্যাদা পেতে হলে: ১. উল্লেখিত ১৪টি রাষ্ট্রের মধ্য হতে নয়টি রাষ্ট্রের ভোট পেতে হবে। ২. স্থায়ী ৫ সদস্য রাষ্ট্রের কোনো একটি সদস্য দেশ ভেটো দেবে না। ৩. নিরাপত্তা পরিষদে গৃহীত এ প্রস্তাব সাধারণ পরিষদে উত্থাপিত হবে। ৪. সাধারণ পরিষদের ১৯৩টি রাষ্ট্রের মধ্যে ১২৮টি রাষ্ট্রের সমর্থন পেতে হবে। তবেই কেবল ফিলিস্তিন একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের মর্যাদা পাবে। আর এ মর্যাদা পেতে দীর্ঘ ৭৩ বছর ধরে রক্ত ঝরাচ্ছে ফিলিস্তিনিরা। ফিলিস্তিনিদের এ দাবি নিরাপত্তা পরিষদে আটকে আছে ১৯৪৮ সাল থেকে।

মূলত: ফিলিস্তিন ইসরায়েলের উচ্ছেদ চায় না। তারা শুধু বাঁচতে চায়। ইসরায়েলের উচ্ছেদ মানেই হলো ইউরোপ-আমেরিকা মহাদেশের উচ্ছেদ। এটা বিশ্বের কারো পক্ষেই সম্ভব নয়। এছাড়া ইসরায়েল একটি পারমাণবিক শক্তিধর দেশ। তাদের রয়েছে বোমারু বিমান, মিসাইল বোট, প্যাট্রোল বোট, সাবমেরিন ইত্যাদি। এর বিপরীতে ফিলিস্তিনের গুলতি, পাথর আর কিছু মাছ ধরার নৌকা ছাড়া কিছুই নেই। বিগত সাত দশকের অধিক সময় ধরে উচ্ছেদ অভিযানে নিষ্পেসিত ফিলিস্তিনিরা এখন বড়ই ক্লান্ত। আকাশপথে ঝাঁকে ঝাঁকে বোমারু বিমানের হামলা, স্থলপথে ট্যাংক, গানবোট আর কামানের গেলাবর্র্ষণ প্রতিনিয়ত উড়ে যাচ্ছে ফিলিস্তিনিদের হাত, পা, চোখ ও কান। থেতলে যাচ্ছে তাদের মাথা। আর ঝলসে যাচ্ছে দেহ ও মুখ। বহুতল ভবন নিমিষেই মিশে যাচ্ছে মাটির সঙ্গে।

প্রতিদিনের মিডিয়ায় ভেসে আসছে ফিলিস্তিনি অবুঝ শিশুদের নিষ্পাপ আর্তনাদ। অথচ ৮০০ কোটি বিশ্ববিবেক চুপচাপ! প্রতিবাদী পাথর কিংবা গুলতিটাই সরবের বিষয়বস্তু হয়ে দাঁড়িয়েছে বিশ্বমিডিয়ায়। সেখানেই ষড়যন্ত্র আর সন্ত্রাস খুঁজে পায় পশ্চিমা মিডিয়া! আর ঝাঁকবাঁধা বোমারু বিমান, ট্যাংক, আর কামানের হামলা হলো ইসরায়েলের আত্মরক্ষার অধিকার!! হায়রে মানবতা! হায়রে বিশ্ববিবেক! হায়রে জাতিসংঘ! বিশ্ববিবেকের কাছে প্রশ্ন হলোÑ পৃথিবীর মোট আয়তন ৫১,০০৯৮,৫২০ বর্গকিমি। আর স্থলভাগের আয়তন ১৪,৮৯,৫০,৩২০ বর্গকিমি।

আর বিশ্বের মোট জনসংখ্যা ৭৭১ কোটি। ফিলিস্তিনের আয়তন ৬,০২০ কিমি। আর জনসংখ্যা ৫১ লাখ। এতবড় বিশাল পৃথিবীতে এই সামান্য ৫১ লাখ ফিলিস্তিনির কি বাঁচবার অধিকার নাই? জাতিসংঘের কাছে প্রশ্ন; কোন কারণে ভূমিহীন-যাযাবর ইহুদিজাতিকে পরের জায়গায় অন্যায়ভাবে প্রতিষ্ঠিত করা হলো? ফিলিস্তিনিদের মাটিতে কেন তাদের ভাগ দেয়া হলো? এর পেছনে কী কারণ থাকতে পারে? কারণটা কি তাহলে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, মানবিক নাকি ধর্মীয়? ঠিক যে কারণে অবৈধভাবে ইহুদিদের প্রতিষ্ঠিত করা হলো; ঐ একই কারণে ফিলিস্তিনিদেরও দিতে হবে তাদের বৈধ স্বাধিকার। দিতে হবে তাদের ন্যায্য স্বাধীনতা। ফিরিয়ে দিতে হবে তাদের স্বাধীন রাষ্ট্র। আর এ ব্যাপারে সবচেয়ে বেশি ভ‚মিকা  রাখতে হবে মুসলিমবিশ্বকে। ঐক্যবদ্ধভাবে এগিয়ে আসতে হবে আরববিশ্বকে। তাদের বিলাসী জীবন পরিহার করতে হবে। আন্তঃঅবিশ্বাস আর অনৈক্য দূর করতে হবে। স্বজাতির করুণ আর্তনাদে দীপ্ত ও সাহসী হতে হবে। জাতীয় চেতনায় হতে হবে উজ্জীবিত। চাপ প্রয়োগ করতে হবে জাতিসংঘকে। নিশ্চিত করতে হবে স্বাধীন ফিলিস্তিনের। প্রতিষ্ঠিত করতে ফিলিস্তিনিদের নিরাপত্তা। আর এ দায়িত্ব নিতে হবে জাতিসংঘকেই।

আরবদের মনে রাখতে হবে, ফিলিস্তিন সমস্যার সমাধান না হলে তাদের আয়েশি নেতৃত্ব ধ্বংস হবে। গোটা আরববিশ্বকে ফিলিস্তিনিদের ভাগ্যদশার শিকার হতে হবে। আর তাদের নির্মম পরিণতি দেখার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে পশ্চিমাবিশ্ব।


লেখক: অধ্যাপক, দা’ওয়াহ অ্যান্ড ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া ও নির্বাহী সদস্য (জাশিপ), Email: dr.knzaman@gmail.com

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

লেখকদের নামঃ