বঙ্গবন্ধুকে হত্যা :কেন ১৫ আগস্টকে বেছে নেয় খুনিরা

প্রকাশ : ১৫ আগস্ট ২০২৩, ১৭:৫১

হীরেন পন্ডিত
মানবসভ্যতার ইতিহাসে ঘৃণ্য ও নৃশংসতম এই হত্যাকান্ডের মাধ্যমে কেবল বঙ্গবন্ধুকেই নয়, বাঙালির হাজার বছরের প্রত্যাশার অর্জন স্বাধীনতার আদর্শগুলোকেও হত্যা করতে চেয়েছিল।
শোকের মাস আগস্ট। ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারের নির্মমভাবে হত্যার করা হয়। একটু খতিয়ে দেখলেই বোঝা যায়, এই হত্যাকান্ডের ‘ব্লুপ্রিন্ট’ এবং ‘অ্যাকশন প্ল্যান’ ছিল অত্যন্ত সুপরিকল্পিত। অতিশয় কুটকৌশল ও ঘটনার আগে-পরে সবকিছু নিখুঁতভাবে পর্যালোচনা ও বিচার-বিশ্লেষণের মাধ্যমে তৈরি করা হয় এই ব্লুপ্রিন্ট। এটা যে শুধু খন্দকার মোশতাক, মেজর ফারুক, রশীদ, ডালিমদের মতো কতিপয়ের মস্তিষ্কপ্রসূত চিন্তার ফল নয়, সেটা সহজেই অনুমান করা যায়। আর এটাও বোঝা যায় যে, এর পেছনে ছিল অনুরূপ রাজনৈতিক হত্যার অভিজ্ঞ পেশাদার আন্তর্জাতিক চক্রান্তকারী গোষ্ঠী, যারা কিনা ইতিপূর্বে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এ ধরনের বহু পৈশাচিক হত্যাকান্ডের নীলনকশা তৈরি করে হাত পাকিয়েছে এবং ইতিপূর্বে এরা স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি বিচার-বিশ্লেষণের মাধ্যমে এ ধরনের অনেক ‘নীলনকশা’ সফলভাবে বাস্তবায়ন করেছে। 
 
বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের ক্ষেত্রেও তারা বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ও আঞ্চলিক রাজনীতির কৌশলগত দিকসমূহ বিশেষভাবে মাথায় রেখে দিনক্ষণ নির্দিষ্ট করে ব্লুপ্রিন্ট তৈরি ও প্ল্যানিং সেল গঠন করে।
 
এখন এ বিষয়টি অনেকেই জানেন যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জারের বিদেশি শশ্রুর তালিকায় ছিল তিনটি নাম। তাদের অন্যতম হলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। অন্য দুজন হলেন চিলির প্রেসিডেন্ট সালভাদর আলেন্দে ও ভিয়েতনামের প্রেসিডেন্ট উয়েন ভান থিউ। যে কোনো উপায়ে এই তিনজনকে উৎখাত করাই ছিল কিসিঞ্জারের লক্ষ্য। এই তিনজন বরাবরই কিসিঞ্জারের পরিকল্পনা বানচাল করে দিচ্ছিলেন। তাদের মধ্যে বঙ্গবন্ধুর ওপর কিসিঞ্জারের রাগটা ছিল একটু বেশি। এই রাগের অনেকগুলো কারণের একটি হলো- বঙ্গবন্ধু মুক্তি-সংগ্রামের মাধ্যমে চীন-মার্কিন সুসম্পর্কের সম্ভাবনাকে প্রায় অনিশ্চিত করে তুলেছিলেন। ওই সময় চীনের সঙ্গে মার্কিনদের সম্পর্কেও দ্যূতিয়ালির ভূমিকায় ছিল পাকিস্তান। সেই পাকিস্তানে যুদ্ধ শুরু হওয়ায় এই দ্যূতিয়ালির কাজে ভাটা পড়ে। এতে প্রতিশোধপরায়ণ কিসিঞ্জার বঙ্গবন্ধুকে উৎখাতের সিদ্ধান্ত নেয়। ওই সময় বঙ্গবন্ধুকে বাঁচিয়ে রেখে তাঁর সরকারকে উৎখাত করা সম্ভব নয়, এ বিষয়ে হেনরি কিসিঞ্জার তথা সংশ্লিষ্ট ষড়যন্ত্রকারীদের মনে কোনো রকম সন্দেহ ছিল না। তাই তারা বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মাধ্যমে উৎখাতের বিষয়টি মাথায় রেখে ‘অ্যাকশন প্ল্যান’ তৈরি করে।
 
১৯৭৪ সালের ২৭ জুন ভুট্টো ঢাকায় আসেন। ভুট্টোকে স্বাগত জানাতে সেদিন ঢাকার তেজগাঁও আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে প্রচন্ড ভিড়। ফলে জনতাকে ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশকে লাঠিচার্জ করতে হয়। ভুট্টো এতে বুঝেছিলেন, পাকিস্তানের এজেন্টরা স্বাধীন বাংলাদেশে বেশ ভালোভাবেই কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। তা না হলে যে পাকিস্তান সেনাবাহিনী মাত্র বছর তিনেক আগে তিরিশ লাখ বাঙালিকে হত্যা, তিন লাখ মা-বোনের সম্ভ্রম হরণ করেছিল, তাদের প্রধানমন্ত্রীকে স্বাগত জানাতে এত লোক হতো না। ভুট্টোর ঢাকা সফরের সময় তার সঙ্গে এসেছিলেন পাকিস্তানি গোয়েন্দা দফতরের কয়েকজন দক্ষ অফিসার।
 
ঢাকায় এসে তারা বাংলাদেশে তাদের এজেন্টদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। এমনকি ওই সফরে একজন প্রভাবশালী ব্যক্তির মাধ্যমে খন্দকার মোশতাক আহমদের সঙ্গেও নাকি ভুট্টোর মতবিনিময় হয়। ওই সময় ভুট্টো খন্দকার মোশতাককে সবুজ সংকেত দিয়ে যান।
 
জুলফিকার আলি ভুট্টোর বাংলাদেশ সফরের পর বঙ্গবন্ধু হত্যা চক্রান্তের অংশ হিসেবে ওই বছরেরই ৩০ অক্টোবর ঢাকা সফরে আসেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার। ঢাকায় তিনি ছিলেন সর্বসাকল্যে মাত্র আট ঘণ্টা। সাংবাদিকরা কিসিঞ্জারের জন্য অপেক্ষা করছিলেন বঙ্গভবনের বাইরে। তিনি সাংবাদিকদের সঙ্গে মাত্র কয়েক মিনিট কথা বলেন। তারপর তিনি সরাসরি নিজের গাড়িতে গিয়ে ওঠেন। অন্যদিকে ঢাকায় বঙ্গবন্ধুবিরোধী চক্র তখন অত্যন্ত তৎপর। বঙ্গবন্ধু তাঁর সরকারে স্থান দিয়েছেন খন্দকার মোশতাক ও তাহের উদ্দিন ঠাকুরকে। মোশতাক ছিলেন বাণিজ্যমন্ত্রী আর তাহের তথ্য প্রতিমন্ত্রী। মন্ত্রিপরিষদে তাদের মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন ছিল বাইরের পোশাকের মতো। লোক দেখানোর জন্য। ভেতরে ভেতরে তারা তৎপর ছিলেন সরকার উৎখাতের চক্রান্তে।
 
কিসিঞ্জার ওই সময় ঢাকায় এসে লক্ষ্য করেন, তাদের পরিকল্পনা অনুযায়ী অ্যাকশনের পটভূমি পুরোপুরি তৈরি। বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা অবনতি হয়েছে, উগ্র সাম্প্রদায়িক শক্তিগুলো মাথা তুলেছে। দুর্ভিক্ষ ও বন্যা ছড়িয়ে দিয়েছে। মানুষ মরছে অনাহারে, অর্ধাহারে রোগব্যাধিতে। সারা দেশে বঙ্গবন্ধুবিরোধী ক্ষোভকে কাজে লাগানোর অপচেষ্টা আংশিক সফলও হচ্ছে। কাজেই এ সময়টাকে তারা বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মাধ্যমে উৎখাতের উপযুক্ত বলে মনে করেন। 
 
তাই কিসিঞ্জার ওই সময়ই জুলফিকার আলি ভুট্টোর মতোই বঙ্গবন্ধুকে হত্যার সবুজ সংকেত দিয়ে যান। ফলে কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়নে পাকিস্তান-মার্কিন চক্রান্তকারী শিবিরে শুরু হয় আরো জোর কর্মতৎপরতা। বঙ্গবন্ধু হত্যা চক্রান্তের একটি বিশেষ দিক এই যে, এই চক্রান্তের সামনে রাখা হয় আওয়ামী লীগের একটি স্বার্থান্বেষী মহল এবং কয়েক মুক্তিযোদ্ধাকে। 
 
এই বীভৎস ষড়যন্ত্রের পেছনে আমেরিকা, পাকিস্তান বা বাংলাদেশের স্বাধীনতাবিরোধী অন্য কোনো বিদেশি রাষ্ট্রের সংশ্লিষ্টতার বিষয়টি সম্পূর্ণ আড়াল করতেই এই কৌশল অবলম্বন করা হয়। এ জন্য এই হত্যা চক্রান্তের সঙ্গে পাকিস্তান থেকে প্রত্যাগত সৈন্য বা অফিসারকে যুক্ত করা হয়নি। আরো একটি দুরভিসন্ধি থেকে এই চক্রান্তের সঙ্গে কতিপয় আওয়ামী লীগ নেতা ও মুক্তিযোদ্ধাদের যুক্ত করা হয়।
 
এটা হলো, বঙ্গবন্ধুকে খুনের দায় খোদ তাঁরই দল আওয়ামী লীগ এবং মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর চাপিয়ে সব মুক্তিযোদ্ধার ভাবমূর্তি নষ্ট করা এবং মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী দল আওয়ামী লীগকে কলঙ্কিত করা। 
 
বঙ্গবন্ধু হত্যা পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে ভুট্টো-কিসিঞ্জার চক্র অভ্যন্তরীণ ও আঞ্চলিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণের মাধ্যমে পঁচাত্তরের পহেলা সেপ্টেম্বরের আগে যে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। কারণ পহেলা সেপ্টেম্বর থেকে কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগের (বাকশাল) প্রশাসন চালু হওয়ার কথা ছিল। 
 
বাকশাল চালু হলে সেনাবাহিনীকে ব্যারাক থেকে বের করে ৬৪ জেলায় ছড়িয়ে দেয়া হবে। ওই ৬৪ জেলায় সেনা ইউনিটের ওপর থাকবেন ৬৪ জন গভর্নর। তখন বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে কোনো ধরনের মিলিটারি অ্যাকশন নেয়া সম্ভব হবে না। ফলে তারা যে কোনো প্রকারেই হোক পহেলা সেপ্টেম্বরের আগেই বঙ্গবন্ধু হত্যা পরিকল্পনা বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত নেয়। 
 
এক্ষেত্রে একাধিক কারণে আগস্ট মাস এবং তারিখ নির্ধারণ করা হয় ১৫ আগস্ট। এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সিআইএ এবং খন্দকার মোশতাক চক্রের একটি বড় মাথাব্যথা ছিল রক্ষীবাহিনী। 
 
এই বাহিনী ছিল বঙ্গবন্ধুর অত্যন্ত বিশ^স্ত। তাই বঙ্গবন্ধু হত্যার ব্লুপ্রিন্ট  তৈরিতে তারা রক্ষীবাহিনীর ওপর বিশেষভাবে নজর দেয়। সেই সঙ্গে ১৫ আগস্টের আগে রক্ষীবাহিনীকে নেতৃত্বশূন্য করার সিদ্ধান্ত নেয়, যাতে পরিকল্পনা বাস্তবায়নের চূড়ান্ত পর্বে এই বাহিনী কোনো প্রকার পদক্ষেপ নিতে না পারে। এই লক্ষ্যে ১৫ আগস্টের আগে রক্ষীবাহিনীর প্রধান ব্রিগেডিয়ার নুরুজ্জামানকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত একটি কোর্সের প্রশিক্ষণের জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়।
 
ব্রিগেডিয়ার জেনারেল নুরুজ্জামান সেই আমন্ত্রণ গ্রহণ করেন এবং ১২ আগস্ট যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশে রওনা হন। তৎক্ষণাৎ গুজব রটানো হয় রক্ষীবাহিনীর জন্য ট্যাংক জোগাড় করতে ব্রিগেডিয়ার নুরুজ্জামান বিদেশ যাচ্ছেন। 
 
এ সময় রক্ষীবাহিনীর ভারপ্রাপ্ত পরিচালক ছিলেন আবুল হাসান খান। তবে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল নূরুজ্জামানের অনুপস্থিতিতে রক্ষীবাহিনীর অবস্থা তখন অনেকটা কান্ডারিহীন নৌকার মতো। এ অবস্থায় ওই বাহিনী যে ঘাতকদের ট্যাংকবাহিনীর সামনে বুক চিতিয়ে দাঁড়াতে পারবে না, এ বিষয়ে চক্রান্তকারীরা ছিল নিশ্চিত। না থাকুক সেই ট্যাংকে কোনো গোলা, সেটা তো অত্যন্ত গোপনীয় ব্যাপার, রক্ষীদের সেটা জানার কথা নয়। তাই চক্রান্তকারীরা ধরেই নিয়েছিল, রক্ষীবাহিনীর শিবিরে ট্যাংকের উপস্থিতিতে রক্ষীদের হাতের রাইফেল খসে পড়বে। ব্রিগেডিয়ার নুরুজ্জামান যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার পথে লন্ডনে জানলেন বঙ্গবন্ধু নিহত। তখন তার কিছুই করার ছিল না।
 
বঙ্গবন্ধু হত্যার দিনটি ছিল শুক্রবার। এই শুক্রবার নিয়ে মেজর ফারুক বেশ একটা গল্প ফেঁদেছিল। এক সাক্ষাৎকারে সে বলেছিল, ‘শুক্রবার ভোরের আজানের সময় তার জন্ম। আবার এই শুক্রবার তার শাদির দিন। এমনই একটি শুক্রবারেই সে পাকিস্তানি সৈন্যবাহিনী ছেড়ে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেয়। অন্যদিকে এই শুক্রবার মুসলমানদের কাছে পরম পবিত্র দিন। তাই এই হত্যার কাজটি করার জন্য তারা শুক্রবারকেই বেছে নেয়!’ কিন্তু আসল ব্যাপার কি তাই? নিশ্চয়ই তা নয়। এর অন্য কারণ আছে। পঁচাত্তরে ১৫ আগস্ট পড়েছিল শুক্রবার। আর এই ১৫ আগস্ট হলো ভারতের স্বাধীনতা দিবস। চক্রান্তকারীদের আশঙ্কা ছিল, বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হলে, পঁচিশ বছরের ভারত-বাংলাদেশ শান্তি, মৈত্রী ও সহযোগিতা চুক্তি অনুযায়ী ভারত এ ব্যাপারে সামরিক অভিযান চালাতে পারে।
 
ভারত সামরিক অভিযান চালালে তা সামাল দেয়া তাদের পক্ষে কোনোভাবেই সম্ভব হবে না। কিন্তু ১৫ আগস্ট স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে ভারতের সরকার, ভারতের রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও সামরিক বাহিনী ব্যস্ত থাকবে। এমন একটি দিনে তারা প্রতিবেশী একটি দেশে সামরিক অভিযান চালাবে না। তাই এই দিনটিকেই চক্রান্তকারীরা বঙ্গবন্ধু হত্যার দিন হিসেবে বেছে নেয়। 
 
এ ছাড়া আরো দুটি কারণে চক্রান্তকারীরা ১৫ আগস্টকে বেছে নিয়েছিল। এর একটি হলো- পঁচাত্তরের আগস্ট মাসে নবগঠিত বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগের (বাকশাল) জেলাওয়ারি কর্মকর্তা নিয়োগের প্রাক্কালে ঢাকায় ৬৪ জেলার ৬৪ জন নবনিযুক্ত গভর্নরের ট্রেনিং চলছিল।
 
এই ট্রেনিং উপলক্ষে সারা দেশের প্রতিটি জেলার শীর্ষস্থানীয় নেতারা ঢাকায় অবস্থান করছিলেন। তাই চক্রান্তকারীরা ধরেই নিয়েছিল বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর ঢাকায় কারফিউ জারি করে তাদের আটক করতে পারলে সারা বাংলায় কোথাও কোনো কার্যকর প্রতিরোধ গড়ে উঠবে না। কেননা, নেতৃবৃন্দের অনুপস্থিতিতে বিভিন্ন জেলার বাকশাল তখন ছিল কান্ডারিহীন নৌকার মতো।
 
১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট জাতীয় শোকের দিন। বাংলার আকাশ-বাতাস আর প্রকৃতিও অশ্রুসিক্ত হওয়ার দিন। কেননা পঁচাত্তরের এই দিনে আগস্ট আর শ্রাবণ মিলেমিশে একাকার হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর রক্ত আর আকাশের মর্মছেঁড়া অশ্রুর প্লাবনে। পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট রাতে যখন ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে নিজ বাসভবনে সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে বুলেটের বৃষ্টিতে ঘাতকরা ঝাঁজরা করে দিয়েছিল, তখন যে বৃষ্টি ঝরছিল, তা যেন ছিল প্রকৃতিরই অশ্রুপাত। ভেজা বাতাস কেঁদেছে সমগ্র বাংলায়। ঘাতকদের উদ্যত অস্ত্রের সামনে ভীতসন্ত্রস্ত বাংলাদেশ বিহ্বল হয়ে পড়েছিল শোকে আর অভাবিত ঘটনার আকস্মিকতায়। 
 
কাল থেকে কালান্তরে জ্বলবে এ শোকের আগুন। ১৫ আগস্ট শোকার্ত বাণী পাঠের দিন, স্বাধীনতার স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৪৮তম শাহাদতবার্ষিকী। 
 
সেই কালরাতে শহিদ হয়েছিলেন যাঁরা ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের কালরাতে ঘাতকের হাতে নিহত হন বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, বঙ্গবন্ধুর স্ত্রী শেখ ফজিলাতুন্নেছা, পুত্র শেখ কামাল, শেখ জামাল, শেখ রাসেল, শেখ কামালের স্ত্রী সুলতানা কামাল, জামালের স্ত্রী রোজী জামাল, বঙ্গবন্ধুর ভাই শেখ নাসের, এসবি অফিসার সিদ্দিকুর রহমান, কর্নেল জামিল, সেনা সদস্য সৈয়দ মাহবুবুল হক, প্রায় একই সময়ে ঘাতকরা বঙ্গবন্ধুর ভাগ্নে যুবলীগ নেতা শেখ ফজলুল হক মণির বাসায় হামলা চালিয়ে শেখ ফজলুল হক মণি, তাঁর অন্তঃসত্ত্ব স্ত্রী আরজু মণি, বঙ্গবন্ধুর ভগ্নিপতি আবদুর রব সেরনিয়াতের বাসায় হামলা করে সেরনিয়াবাত ও তার কন্যা বেবী, পুত্র আরিফ সেরনিয়াবাত, নাতি সুকান্ত বাবু, আবদুর রব সেরনিয়াবাতের বড় ভাইয়ের ছেলে সজীব সেরনিয়াবাত এবং এক আত্মীয় বেন্টু খান।
 
জাতি গভীর শোক ও শ্রদ্ধায় স্মরণ করছে সব শহিদকে। মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত অপশক্তির ষড়যন্ত্র থেমে থাকেনি। পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতে তারা একের পর এক চক্রান্তের ফাঁদ পেতেছে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সেনাবাহিনীর বিপথগামী উচ্চাভিলাষী কয়েক সদস্যকে ষড়যন্ত্রকারীরা ব্যবহার করেছে ওই চক্রান্তেরই বাস্তব রূপ দিতে। এরাই স্বাধীনতার সূতিকাগার বলে পরিচিত ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের বাড়িটিতে হামলা চালায় গভীর রাতে। হত্যা করে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তার পরিবারকে।
 
বিশ্ব ও মানবসভ্যতার ইতিহাসে ঘৃণ্য ও নৃশংসতম এই হত্যাকান্ডের মাধ্যমে সেদিন তারা কেবল বঙ্গবন্ধুকেই নয়, তার সঙ্গে বাঙালির হাজার বছরের প্রত্যাশার অর্জন স্বাধীনতার আদর্শগুলোকেও হত্যা করতে চেয়েছিল। মুছে ফেলতে অপপ্রয়াস চালিয়েছিল বাঙালির বীরত্বগাথার ইতিহাসও।
 
বঙ্গবন্ধুর নৃশংসতম হত্যাকান্ড বাঙালি জাতির জন্য করুণ বিয়োগগাথা হলেও ভয়ংকর ওই হত্যাকান্ডে খুনিদের শাস্তি নিশ্চিত না করে বরং দীর্ঘ সময় ধরে তাদের আড়াল করার অপচেষ্টা হয়েছে। এমনকি খুনিরা পুরস্কৃতও হয়েছে নানাভাবে।
 
 
লেখক : প্রাবন্ধিক ও রিসার্চ ফেলো
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

লেখকদের নামঃ