বিশ্বকাপে প্রথম জয় বাংলাদেশের

প্রকাশ : ২৪ অক্টোবর ২০২২, ১৮:৩২

শেষ দুই ওভারে নেদারল্যান্ডের দরকার ৩১ রান। মোস্তাফিজের করা ১৯তম ওভারে আসে ৭ রান। পরে শেষ ৬ বলে দরকার ২৪ রান, যেটি করতে আসেন সৌম্য সরকার। প্রথম ৩ বলে ওয়াইডসহ আসে ৪ রান। এরপর শেষ ৩ বলে দরকার ৩টি ছক্কা। চতুর্থ বলে ফুলটস পেয়েই ছক্কা মারেন ফন মিকেরেন। পঞ্চম বলেও তুলে মেরেছিলেন, তবে সেটি বাউন্ডারির বেশ ভেতরেই পড়েছে। শেষ বলেও উড়িয়ে মেরেছিলেন, তবে ক্যাচ দিয়েছেন মিকেরেন। এতে বাংলাদেশ পেল ৯ রানের প্রত্যাশিত জয়। এ জয়ে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের দ্বিতীয় পর্বে প্রথমবার জিতল বাংলাদেশ।

তবে জয়ের নায়ক তাসকিন আহমেদ। পুঁজি যখন খুব বেশি নয়, তাই ম্যাচ জিততে চাই শুরুতেই উইকেট। আর নতুন বলে উইকেট নেয়া ছিল বাংলাদেশের জয়ে একমাত্র উপায়। সেই দায়িত্বটাই পালন করলেন তাসকিন। বল হাতে ইনিংস শুরুর প্রথম দুই বলেই ২ উইকেট নিয়ে যেন গড়ে দিলেন ফল, ধরালেন ডাচ ব্যাটিং অর্ডারে ফাটল। শেষে এসে নেন আরও ২ উইকেট। শেষ পর্যন্ত ২৫ রানে ৪ উইকেট নিয়ে খেললেন ক্যারিয়ার সেরা ইনিংস। তার ক্যারিয়ার সেরা ইনিংসে ভর করেই প্রথমবার বিশ্বকাপের মূল আসরে জয় খরা ঘোচাল বাংলাদেশ। ক্যারিয়ার সেরা বোলিংয়ে ম্যাচ সেরার পুরস্কারও জিতেছেন এই পেসার।

সোমবার (২৪ অক্টোবর) হোবার্টের বেলরিভ ওভালে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের দ্বিতীয় পর্বে নিজেদের প্রথম ম্যাচে নেদারল্যান্ডের বিপক্ষে ৯ রানে জিতে বিশ্বকাপ শুরু করেছে বাংলাদেশ। এদিন টস হেরে আগে ব্যাট করতে নেমে নির্ধারিত ২০ ওভারে ৮ উইকেট হারিয়ে ১৪৪ রান করে সাকিব আল হাসানের দল। জবাবে নেমে নির্ধারিত ২০ ওভারে সব উইকেট হারিয়ে ১৩৫ রান তুলতে সক্ষম হয় নেদারল্যান্ড।

বাংলাদেশের করা ১৪৪ রানের জবাব দিতে গিয়ে নেদারল্যান্ড শুরুতেই হোঁচট খেল তাসকিনের বলে। ইনিংসের প্রথম ওভারের প্রথম দুই বলেই ২ উইকেট নেন তাসকিন। অফ স্টাম্পের বাইরের বলে খোঁচা দিয়েছেন বাঁহাতি বিক্রমজিত সিং। একমাত্র স্লিপে সামনে ঝুঁকে ভালো ক্যাচ নিয়েছেন ইয়াসির আলী। প্রথম বলেই উইকেট পান তাসকিন। আর তাতেই বাংলাদেশ শুরুটা পেয়েছে ‘পারফেক্ট’। এরপর দ্বিতীয় বলেও উইকেট। অফ স্টাম্পের বাইরের চ্যানেলে লাইন ধরে রাখা বলে খোঁচা দিয়েছেন ডানহাতি বাস ডি লিড। উইকেটের পেছনে নুরুল হাসান ক্যাচটি নিতে ভুল করেননি। তাসকিন পেয়ে গেলেন দুই বলে ২ উইকেট। প্রথম ওভারেই হ্যাটট্রিকের সামনে দাঁড়িয়ে তাসকিন! কিন্তু হ্যাটট্রিক পাননি তিনি, হ্যাটট্রিক বলে ৩ রান নিয়েছেন কলিন অ্যাকারম্যান, প্রথম ওভারে এসেছে ওই ৩ রানই। তবে হ্যাটট্রিক না পেলেও, তাসকিন বাংলাদেশকে এনে দিয়েছেন দুর্দান্ত শুরু।

এরপর ৩ বলে ২ রানআউটে আরও চাপে পরে নেদারল্যান্ড। চতুর্থ ওভারে সাকিব আল হাসানের করা প্রথম বলেই মিডউইকেট দিয়ে দারুণ টাইমিংয়ের শটে ছক্কা মারেন ও’ডাউড। পরের বলে মিডউইকেটে খেলেছিলেন, নিতে চেয়েছিলেন ডাবলস। তবে অ্যাকারম্যান তাতে সাড়া দেননি। স্কয়ার লেগ থেকে ছুটে আসা আফিফ হোসেনের থ্রো যতক্ষণে নন স্ট্রাইক প্রান্তে এসেছে, ও’ডাউড ক্রিজের বেশ বাইরে। এতে রানআউট হন ও’ডাউড। ছক্কা মারার পরের বলে ভুল বোঝাবুঝিতে রানআউট হওয়াটা ব্যাটারের জন্য হতাশাই। ম্যাক্স ও’ডাউডের হলো সেটিই। ঠিক ১ বল পরই হয়েছে আরেকটি রানআউট! এবারও দারুণ ফিল্ডিং। ডিপ পয়েন্টে খেলেছিলেন অ্যাকারম্যান। প্রথমে স্লাইড করে দারুণ ফিল্ডিং করেছেন নাজমুল, ওদিকে ৩ রান নিতে গিয়েছিলেন ব্যাটাররা। নাজমুলের থ্রোটাও ছিল দারুণ। তবে স্ট্রাইক প্রান্তে কুপার ফিরতে পারেননি সময়মতো, কোনো বল না খেলেই রানআউট হয়ে ফিরেছেন কুপার। এতে আরও চাপে পরে ডাচরা। সেটি থেকে আর বের হতে পারেনি তারা।

পাওয়ার প্লে-র ৬ ওভারে ৪ উইকেট হারিয়ে ৩২ রান করে নেদারল্যান্ড। তবে পাওয়ার প্লে-র শেষ বলে অ্যাকারম্যানকে ফেরাতে পারতেন হাসান মাহমুদ। তার বলে জায়গা বানিয়ে ড্রাইভ করেছিলেন অ্যাকারম্যান। কাভারে লাফিয়ে উঠে হাত লাগিয়েছিলেন ইয়াসির, তবে ক্যাচটা নিতে পারেননি তিনি। বল চলে যায় বাউন্ডারিতে, চার মেরে পাওয়ার প্লে শেষ করেন অ্যাকারম্যান। এরপর পুরো ম্যাচে বলতে গেলে একাই লড়েছেন কলিন অ্যাকারম্যান, তবে দলকে পার করাতে পারেননি। তাসকিন-হাসান মাহমুদদের বোলিং তোপে দাঁড়াতেই পারেনি ডাচদের ব্যাটাররা। যাওয়া আশার মিছিলেই ছিল তারা। এর মধ্যে ফিফটি তুলে নেন অ্যাকারম্যান। মোসাদ্দেকের করা চতুর্থ বলে ডাবলস নিয়ে আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টিতে প্রথম ফিফটি পূর্ণ করলেন কলিন অ্যাকারম্যান। ওই ওভারের শেষ বলে ছক্কা মারেন তিনি।

তবে তাসকিনের শিকার হন অ্যাকারম্যান। ইনিংসের ১৭তম ওভারে নিজের শেষ ওভারটি করতে আসেন তাসকিন। দ্বিতীয় বলেই ফেরান শারিজ আহমেদকে। হার্ডলেংথে বলে জোরের ওপর খেলতে গিয়ে থার্ডম্যানে ক্যাচ তুলেছেন শারিজ। এটি তাসকিনের তৃতীয় উইকেট। অ্যাকারম্যান হচ্ছেন তাসকিনের চতুর্থ উইকেট। ওই ওভারের পঞ্চম বলে শর্ট বল তুলে মারতে গিয়ে ডিপ মিডউইকেটে ধরা পড়েন অ্যাকারম্যান। এতে চতুর্থ উইকেট নিয়ে তাসকিন পেয়ে যান ক্যারিয়ার সেরা ইনিংস। আর ৪৮ বলে ৬ চার ২ ছক্কায় ৬২ রান করে ফেরেন অ্যাকারম্যান। ফেরার পথে অবশ্য অ্যাকারম্যান আম্পায়ারকে জিজ্ঞাসা করছিলেন, বলটি শর্ট হিসেবে ধরা হয়েছে কি না।

এরপর শেষ দুই ওভারে নেদারল্যান্ডের দরকার ৩১ রান। মোস্তাফিজের করা ১৯তম ওভারে আসে ৭ রান। পরে শেষ ৬ বলে দরকার ২৪ রান, যেটি করতে আসেন সৌম্য সরকার। প্রথম ৩ বলে ওয়াইডসহ আসে ৪ রান। এরপর শেষ ৩ বলে দরকার ৩টি ছক্কা। চতুর্থ বলে ফুলটস পেয়েই ছক্কা মারেন ফন মিকেরেন। পঞ্চম বলেও তুলে মেরেছিলেন, তবে সেটি বাউন্ডারির বেশ ভেতরেই পড়েছে। শেষ বলেও উড়িয়ে মেরেছিলেন, তবে ক্যাচ দিয়েছেন মিকেরেন। এতে বাংলাদেশ পেল ৯ রানের প্রত্যাশিত জয়।

বাংলাদেশের হয়ে সেরা বোলার তাসকিন আহমেদ। ৪ ওভার করে ২৫ রান দিয়ে নিয়েছেন ৪টি উইকেট। টি-টোয়েন্টিতে এই পেসারের এটিই ক্যারিয়ারসেরা বোলিং। দুর্দান্ত বল করেছেন হাসান মাহমুদও। ৪ ওভার বল করেছেন, দিয়েছেন মাত্র ১৫ রান। নিয়েছেন ১ মেডেনসহ ২টি উইকেট। সাকিব আল হাসান ও সৌম্য সরকার ১টি করে উইকেট নিয়েছেন।

এর আগে টস হেরে ব্যাট করতে নেমে শুরুটা ভালোই হয় বাংলাদেশের। ৩০ ম্যাচ পর উদ্বোধনী জুটি থেকে আসে চল্লিশোর্ধ রান। নাজমুল হোসেন শান্ত আর সৌম্য সরকার মিলে উদ্বোধনী জুটিতে দলকে এনে দেন ৪৩ রান। ভালো শুরু পর ইনিংসের ষষ্ঠ ওভারে প্রথম উইকেট হারায় বাংলাদেশ। ১৪ বলে ১৪ রান করা সৌম্য সরকারকে ফিরিয়ে ব্রেক থ্রু আনেন পল ফল মিকেরেন। পাওয়ার প্লে-র ৬ ওভার শেষে ১ উইকেট হারিয়ে বাংলাদেশের আসে ৪৭ রান। কিন্তু পাওয়ার প্লে-র ঠিক পরের বলেই বিদায় নেন উইকেটে সেট হয়ে যাওয়া শান্ত। টিম প্রিঙ্গলের বাঁহাতি স্পিনে স্লগ সুইপ করতে গিয়ে সহজ ক্যাচে ফেরেন তিনি। ফেরার আগে ২০ বলে ৪ চারে ২৫ রান করেন নাজমুল হাসান শান্ত।

এরপর ধস নামে বাংলাদেশের লাইনআপে। স্কোরবোর্ডে ৭৬ রান তুলতে নেই আরও ৪ উইকেট। তবে লড়াইয়ের ভিত গড়ে দেন আফিফ হোসেন, নাজমুল হোসেন শান্ত আর মোসাদ্দেক হোসেন। শুরুতে শান্তর ২০ বলে ২৫। মাঝে আফিফের ২৭ বলে ৩৮ রানের পর মোসাদ্দেক ১২ বলে ২০ রানের ইনিংস ভিত গড়তে অবদান রাখে। শেষ পর্যন্ত ৮ উইকেট হারিয়ে ১৪৪ রানের সংগ্রহ পায় বাংলাদেশ।

খেলার মাঝে শুরু হয় বৃষ্টি। কিছুক্ষণ বন্ধ থাকে খেলা। কিছুক্ষণের মধ্যে বৃষ্টি বন্ধ হলে আবারও শুরু হয় খেলা। পুরো ম্যাচে বৃষ্টির চোখরাঙানি থাকলেও শেষ পর্যন্ত ম্যাচের ফলে তা আর কোনো পার্থক্য গড়ে দেয়নি। বেশ কয়েকবার খেলা বন্ধ হলেও কিছুক্ষণ পরই তা আবার শুরু হয়েছে। ফলে, আম্পায়ারদের ওভার কমাতে হয়নি বা বৃষ্টি আইনের সহায়তা নিতে হয়নি। নেদারল্যান্ডের হয়ে ভ্যান মিকেরেন ও বাস ডি লিড ২টি করে উইকেট নেন। ফ্রেড ক্লাসেন, টিম প্রিঙ্গেল, শারীজ আহমেদ ও ভ্যান বিক ১টি করে উইকেট নেন। ম্যাচ সেরা হয়েছেন তাসকিন আহমেদ। আগামী ২৭ অক্টোবর সিডনিতে বাংলাদেশের প্রতিপক্ষ দক্ষিণ আফ্রিকা।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত