দক্ষিণা হাওয়া

প্রকাশ : ১৫ জুন ২০২৩, ১৫:১৪

শহীদুল হক বাদল

সিটিং বাসে অয়নের পাশের সিটটা তখনও খালিই ছিলো। সে ভাবছিলো, এইমাত্র বাসে ওঠা ভয়ঙ্কর এই সুন্দরী মেয়েটা হয়তোবা তার এখানে এসেই পাশে বসবে। কিন্তু না, সে বসলো গিয়ে পিছনের সিটে বুঁড়ো একটা লোকের কাছে। এইরকম বহু ঘটনাতেই তার মন খারাপ হয়ও প্রায়সময়। ইদানিং, সেই বাস্তবতাকে মেনে নিয়েই হয়তোবা মনের কষ্টটা সামলে নেওয়ার অভ্যাস হয়ে গেছে অয়নেরও অনেকটাই। 

সামনের বাস ষ্টপেজে এসেই ঐ বুঁড়ো লোকটা নেমে গেলো। ওখানে বসলো তখন আরেকটা হ্যান্ডসাম বখাটে যুবক ছেলে। সেই মেয়েটা তখন হঠাৎ করেই ওখান থেকে উঠে গিয়ে সে অয়নের পাশেই বসলো। আগের বুঁড়ো লোকটাকে হারিয়ে বোধহয় কিছুটা নিরাপদ ভেবেই সে এখন অয়নের পাশে এসে বসেছে। যদিওবা তার চূল সবই কলপ লাগিয়ে কালো করাই ছিলো ক'দিন আগে। 
তবুও, সব মেয়েরাই সম্ভবত কীভাবে যেন পুরুষদের বয়সটা ঠিকই টের পেয়ে যায় সহজে, তা আমিও বুঝিনা আজও। 

ভেতরের অভিমানটা অয়ন তার মনের ভেতর চেপে রেখেই সে দৈনিক একটি পত্রিকার পাতায় নিজের মনোসংযোগ রাখার কিছুটা ভান করলো। ভাবটা তার এমনই যে, মেয়েদের প্রতি তার তেমন কোনোই কৌতুহলবোধ নেইও। 

আবার বাসটা সামনের দিকে এগুচ্ছে তখন। অয়নের ডান হাতে বেশ ক’দিন ধরেই খুব ব্যথা। ঔষধপত্রেও কাজ হচ্ছেনা তেমন। তাই, সে মাঝেমাঝেই নিজের হাতটাকে ফিজিওথেরাপীর অনুকরণেই সাবধানে সামনে ও পিছনেও এদিক-ওদিক নাড়াছড়া করছিলো সে কিছুটা। এটা দেখেই বোধহয়, ঐ মেয়েটা মৃদু হেসেই তাকে বললো-

(২)
- এই যে, শোনেন ভাই! এভাবে হাতের ব্যথা কিন্তু জীবনেও সারবে না। আমিই দেখাচ্ছি আপনাকে, এই যে এভাবেই করুন- তবেইনা কাজ হবে। কোনো সন্দেহ হচ্ছে কী আপনার মনে? আমি এই লাইনেরই একজন অর্থোপিডিকস ডাক্তারও। এই নিন আমার ভিজিটিং কার্ড।

অয়ন তখন নিজের মাথা নেড়েই ধন্যবাদ জানানোর মতো সায় দিলো মেয়েটির কথায়। তখন মেয়েটিিও এক রহস্যময়তার ভাব নিয়েই মৃদু হাসলো কেবল । অতঃপর, বিনয়ের সঙ্গেই তাকে আবার বললো-

- ভাই, আপনার বোতল থেকে কী আমি একটু পানি খেতে পারি? ও হ্যাঁ, ওতে তো আবার মুখ লাগিয়ে পানি খাননি আপনি?
ইচ্ছে করেই অয়ন এবার তাকে মিথ্যে কথা বললো-
- হ্যাঁ, মুখ লাগিয়েই আমি খেয়েছি।
তবুও, ঐ বোতলটাই মেয়েটি হাতে বাড়িয়ে নিয়ে ঢক-ঢক করেই পানি খেতে খেতেই বললো-
- আমিও বোতলে মুখ লাগিয়েই সচরাচর পানি খাই। তাই বলছিলাম যে, আপনার এই অভ্যাসটাও ভালো না। আচ্ছা ভাই, আপনার সমুদ্র দেখতে কেমন লাগে বলুন তো?
- অনেকটাই মগডালে উঠে গাছপাকা আম খাওয়ার মতোই লাগে।
- একটু কাব্যিকভাবেই বলেন না, ভাই।
- আমি পুরোটাই একজন বাস্তববাদী মানুষ। হেলা-ফেলায় বড় হয়েছি এই জীবনে। এইসব নিয়ে ভাববারও কোনো সময় পাই নাই, বুঝলেন।
- আচ্ছা, চাকরী-বাকরী নিশ্চই কিছু একটা তো হয়তোবা করেন?
- তা করিও অবশ্য কিছু একটা। ওটাও হয়তোবা ছেড়ে দেবো ভাবছি। এক মাসের বেতন, তারপরের মাসেও দেওনের মালিক বেটাদের কোনোই খবর থাকে না।
- বিয়েশাদী নিশ্চই করেছেন, তাইনা...?
- বিয়েশাদী… ওটা কে করবে আমায় বলেন? আমার যেইরকম একটা এলোমেলো স্বভাবও না। শোনেন, সমুদ্র দু’একদিন দেখতে সবারই ভালো লাগে। ক’দিন পর যখন লোকেরা টের পায় যে- বাইরে আমার ফিটফাট আর ভিতরে হইলো গিয়া সদরঘাট। 

জানেন, কী সুন্দর সুন্দর মাইয়্যাগোর প্রায় সবারই বিয়া হইতে দেখি ঐ পয়সাঅলা রাঘব বোয়াল, কুমিরের বাচ্চা, বড় পদের চাকুরীজীবী কিংবা বিদেইশ্যা কোনো এবরা-ডেবরা পুলার লগেই। আর আমরা হইলাম গিয়া, পান্তা ভাতের সাথে কাঁচামরিচের মতোই অনেকটাই যোগালী।

(৩)
ওই মেয়েটির নাম হলো- মৃদুল। সে তখন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলেই অয়নকে বললো-
- সবই তো বুঝলাম ভাই। আপনি বোধহয় বিরাট একটা সমস্যার মধ্যেই আছেন এখন। তবে, আমার অবশ্য মুটামুটি টাকা-পয়সা, বাড়ি-গাড়ী সবই আছে। কিন্তু, আমি যা তা নিজের মতোই থাকার জন্য আপনাকেই আমার জীবনে খুব প্রয়োজনও বোধহয় এখন।

 আমাদের এই সমাজে, অনেকের আচার-আচরণেও কেমন যেন একটা কৃত্রিমতায় ভরা। রোজ আয়নায় যাকে আমরা দেখছি, সেই আমিই হয়তোবা ঠিক আমি নই। আমার আমিটাও যেন লুকিয়ে আছে... সে এক আজানা দূরে- অন্যকোথায়।

- আচ্ছা ম্যাডাম…! বুঝতেই যখন পারছেন সব, আমি এখন বড্ডই এক ঠেকার মধ্যেই আছি। তাই ভাবছি, আপনার এই প্রস্তাবটা ফিরিয়ে দিইবা কেমন করে। তবে, আপনি বরং আরও কিছুটা সময় নিয়েই সব বুঝেশুনে সিদ্ধান্ত নিন। কারন, আমার মতো গাছের আগায়-আগায় চড়ে বেড়ানো বান্দরকে পোষ মানাইতে গিয়া আপনিইনা আবার তাল সামলাতে হিমসিম খেয়ে এক্কেবারেই নাজেহাল হয়ে পড়েন।

- ওসব নিয়ে আপনাকে কখনো ভাবতেও হবেনা। আমি সব বুঝেই সিদ্ধান্ত নিই তবে। আপনার মনের চিকিৎসার জন্য এই আমাকেই হয়তোবা লাগবে সারাজীবনই... বুঝলেন কিছু কী মিষ্টার?

(৪)
দু’জনেই তখন তন্ময় হয়ে কিছুক্ষণ চোখে-চোখ রেখেই কী যেন ওরা খুঁজে ফিরছে হৃদয়ের অলিন্দ কোঠরে। অতঃপর, একে অপরের হাত ধরেই মৃদু হাসলো দু'জন। 

জানিনা, কী দেখতে পেয়েছিলো স্বপ্নীল দু’নয়নে তাদের সেই জোড়া চোখ দুটো। অবশেষে, হাতে হাত রেখেই ওরাও বোধহয় পরম এক আস্থার উপস্থিতি অনুভব করেছিলো মনের ভেতরে। 

যা আগামীদিনে দৃঢ় বিশ্বাসে আলোয় পথ চলার বাসনায়। সুখ তুমি কী? তা আমরা ক'জনাইবা ঠিক জানি। চলছে তো, নদীর অববাহিকায় এঁকে-বেঁকে। চলুক না, থেমে না গেলেই হয়- সাগরের খুব কাছে এসেও নীল জলতরঙ্গের তীরের মোহনায়...???

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত