কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রয়াণ দিবস আজ

প্রকাশ : ০৬ আগস্ট ২০২৩, ০৯:৫২

এস এম মুকুল
ছবি: সংগৃহীত

এমন দিনে তারে বলা যায়/এমন ঘনঘোর বরিষায়-/ এমন মেঘস্বরে-বাদল ঝরঝরে/তপনহীন ঘন তমসায়..। বর্ষা ছিল কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রিয় ঋতু। বর্ষাতেই পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে পরলোকে যাত্রা করেছিলেন বাঙালি মনন সৃজনের এই অনন্য প্রতিভাধর। আজ ২২ শ্রাবণ বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ৮২তম প্রয়াণ দিবস। ১৩৪৮ বঙ্গাব্দের ২২ শ্রাবণ কলকাতার জোড়াসাঁকোর পৈতৃক বাড়িতেই তাঁর জীবনপ্রদীপ নির্বাপিত হয়েছিল।

কবিরা যতটা বর্ষাপ্রিয় হয় তারচেয়েও অধিক বর্ষাপ্রিয় ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ‘আষাঢ়’ কবিতায় বলেছেন, ‘নীল নবঘনে আষাঢ়গগনে তিল ঠাঁই আর নাহি রে/ ওগো, আজ তোরা যাস নে ঘরের বাহিরে। মেঘলা আকাশ, রিমঝিম বৃষ্টি কবি মনকে উথাল-পাতাল করে দিত। তাঁর কবিতা ও গানে তারই প্রমাণ পাওয়া যায়। কেবল আষাঢ় আর শ্রাবণ নিয়েই শতাধিক গান-কবিতা রচনা করেছেন কবি।

জমিদারির প্রথাগত দম্ভ, লালসা, অহমিকা, শাসন, শোষণ এসব কিছুকে ছাড়িয়ে তিনি ছিলেন মানুষ কবি মানুষের কবি। তিনি প্রজা দরদি এক জমিদার কবি, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। মানুষের অভাব, দুঃখ দূর করার জন্য মানুষের নিজস্ব সক্ষমতার কথা বার বার বলেছেন। তিনি বলেছেন, মানুষের মাঝেই আছে সম্পদ সৃজনের লুক্কায়িত ক্ষমতা। আছে অপার সম্ভাবনা।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন বাঙালির রুচি ও সংস্কৃতির নির্মাতা। লেখালেখি শুরু করেছিলেন মাত্র আট বছর বয়সেই। বিচিত্র তাঁর বিষয়, বিপুল তার পরিমাণ। লেখালেখি ও চিত্রকর্ম করার পাশাপাশি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শিক্ষাবিস্তার, সাংগঠনিক কর্ম এবং সমাজকল্যাণমূলক কাজেও অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন।

বাংলা সাহিত্যকে তিনি বিশ্ব অঙ্গনে বিশেষ মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করেছেন। ‘গীতাঞ্জলি’ কাব্যগ্রন্থের মাধ্যমে তিনি প্রথম এশীয় হিসেবে ১৯১৩ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক গভীর প্রেমময়। কুষ্টিয়ার শিলাইদহ, সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর, নওগাঁর পতিসর, খুলনার দক্ষিণডিহি ও পদ্মার সঙ্গে তার সম্পর্ক ছিল কর্ম ও সাধনার। বাংলাদেশের সবুজ ভূমিতে তার শ্রেষ্ঠ লেখাগুলো রচিত হয়। মুক্তিযুদ্ধে তার গান বাঙালিকে অনুপ্রাণিত করেছে। স্বাধীনতা অর্জনের পর তার লেখা গান ‘আমার সোনার বাংলা’ বাংলাদেশের জাতীয় সংগীতের মর্যাদা পায়। 

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অতুলনীয় সৃজনপ্রতিভা বাংলা কাব্য, উপন্যাস, ছোটগল্প, প্রবন্ধ, নাটক, ভ্রমণ, চিঠিপত্র, শিশুসাহিত্যসহ বাংলা সাহিত্যকে স্বর্ণময় উজ্জ্বলতা দান করেছে। গীত রচনা ও সুরস্রষ্টা হিসেবে তিনি নিজেই নিজের তুলনা। চিত্রকলা নতুন মাত্রা লাভ করেছে তাঁর প্রতিভায়।

এককথায় সাহিত্য-সংস্কৃতির এমন কোনো ক্ষেত্র নেই, যা তাঁর প্রতিভাস্পর্শে দীপ্তিমান হয়ে ওঠেনি। অপরদিকে তিনি কৃষক ও পল্লি উন্নয়নের কথা ভেবে চালু করেছিলেন কৃষিঋণ ব্যবস্থা। নতুন ধরনের শিক্ষার জন্য প্রতিষ্ঠা করেছেন বিশ্বভারতীর মতো প্রতিষ্ঠান। আবার অন্যায়, নিপীড়নের প্রতিবাদেও ছিলেন অকুতোভয়। জালিয়ানওয়ালাবাগে দেশবাসীর ওপর ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ সেনাদের হত্যাযজ্ঞের প্রতিবাদে তিনি ত্যাগ করেছিলেন নাইটহুড খেতাব।
দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও সারদা সুন্দরী দেবী দম্পতির ১৫ সন্তানের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন চতুর্দশ এবং পুত্রদের মধ্যে অষ্টম। কলকাতার বিখ্যাত ঠাকুর পরিবারের জোড়াসাঁকোর বাড়িতে তাঁর জন্ম ১৮৬১ সালের ৭ মে, বাংলা ২৫ বৈশাখ ১২৬৮ বঙ্গাব্দ। ঠাকুর পরিবার তখন ছিল মর্যাদা ও সংস্কৃতিচর্চায় বিশেষ খ্যাতির অধিকারী। আভিজাত্যের সঙ্গে উদারতা ছিল ঠাকুর পরিবারের ঐতিহ্য।

সেই পরিবেশ শৈশবেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মনকে মুক্ত করে দিয়েছিল। পরবর্তীকালে বিশেষত বাংলার পদ্মা, মেঘনা, যমুনায় নৌকায় ভ্রমণের মধ্য দিয়ে তিনি নিসর্গ ও সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার অভিজ্ঞতা প্রত্যক্ষ করেছিলেন, সেটি তাঁর ভেতরে প্রকৃতি ও মানুষের প্রতি গভীর ভালোবাসা সৃষ্টি করেছিল। তাঁর সাহিত্যে এর বিপুল প্রভাব পড়েছে।

১৯১৩ সালে গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থের জন্য রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নোবেল পুরস্কার বাংলা সাহিত্যকে বিশ্বসাহিত্যের দরবারে মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একই সঙ্গে কবি, কথাশিল্পী, প্রাবন্ধিক, নাট্যকার, ঔপন্যাসিক, ছোটগল্পকার, নাট্যাভিনেতা, সংগীত রচয়িতা, সুরকার, গায়ক ভাষাবিজ্ঞানী, দার্শনিক ও চিত্রশিল্পী। সাহিত্যের সমান্তরাল তিনি ধর্ম, দর্শন, রাজনীতি ও সমাজভাবনা সমানভাবে চালিয়ে গেছেন। একজন প্রজা দরদি জমিদার রবীন্দ্রনাথ কবি হিসেবেও জমিদার তিনি। মানুষের জন্য, দেশের জন্য, সমাজ ও শিল্প এবং সংস্কৃতির জন্য তার ভাবনা যুগে যুগে আমাদের আলোকিত পথের সন্ধান দেবে।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত