বঙ্গোপসাগর

ফিশিং ট্রলারে রহস্যময় বিস্ফোরণে লক্ষ্মীপুরের ৬ জেলের মৃত্যু

প্রকাশ : ১০ মার্চ ২০২১, ২০:১১

কক্সবাজার সংলগ্ন বঙ্গোপসাগরে মাছ ধরার ট্রলারে 'রহস্যময়' এক বিস্ফোরণে অগ্নিদগ্ধ হয়ে ৬ জন জেলের মৃত্যু হয়েছে। তারা সবাই চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন। এ ঘটনায় অগ্নিদগ্ধ ১২ জনসহ ২১ জেলে আহত হয়েছেন। গত ২৭ ফেব্রুয়ারি মধ্যরাতে এ 'রহস্যময়' বিস্ফোরণ ঘটে। জেলে ও তাদের পরিবারের সাথে কথা বলে এ তথ্য জানা গেছে।

বুধবার (১০ মার্চ) মিরাজ হোসেন (২৫) নামের এক জেলের মৃত্যুর পর এর সংখ্যা হয় ৬।

মৃত ও আহত জেলেদের বাড়ি লক্ষ্মীপুর জেলা শহর থেকে ৮৫ কিলোমিটার দূরে রামগতি উপজেলার চরগাজী ইউনিয়নের চর লক্ষ্মী ও চর রমিজ ইউনিয়নের চর গোসাই গ্রামে।

এ ঘটনায় পুরো গ্রাম স্তব্দ হয়ে গেছে। এরই মধ্যে চিকিৎসাধীন অবস্থায় বুধবার ১ জন, মঙ্গলবার ১ জন, সোমবার ১ জন, শনিবার ১ জন এবং শুক্রবার ২ জনের মৃত্যু হয়।

অগ্নিদগ্ধ আহত আরো ৫ জন ঢাকার শেখ হাসিনা বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে চিকিৎসাধীন রয়েছেন এবং ১ জন বাড়িতে রয়েছেন। মৃত জেলেদের মধ্যে রয়েছেন, চর গাজী ইউনিয়নের ৬নং ওয়ার্ড দক্ষিণ টুমচর গ্রামের মো: নুর উদ্দিনের ছেলে মো: বেলাল হোসেন (২৮), মো: সিরাজুল হকের ছেলে মো: মেহেরাজ (২৬), চর লক্ষ্মী গ্রামের মো: দেলোয়ার হোসেনের ছেলে মো: মিরাজ (২৫), মো: আবদুজ জাহেরের ছেলে মো: মিলন (৩০), চর রমিজ ইউনিয়নের চর গোসাই গ্রামের মন্তাজল হকের ছেলে আবুল কাশেম মিস্ত্রী (৫৫), আবু তাহেরের ছেলে মো. রিপন মাঝি (৩৮)।

অন্যদিকে অগ্নিদগ্ধ আহত চিকিৎসাধীন জেলেদের মধ্যে রয়েছে চর লক্ষ্মী গ্রামের খুশিদ আলমের ছেলে মো: আলাউদ্দিন, কামাল উদ্দিনের ছেলে মো: সাহাবউদ্দিন, আবু তাহেরের ছেলে মো: আবু জাহের, সিরাজুল হকের ছেলে মো: মেহেরাজ উদ্দিন, সিরাজ উদ্দিনের ছেলে মো: মিরাজ উদ্দিনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। এর মধ্যে চর লক্ষ্মী গ্রামের আবদুর জাহেরের দুই ছেলের মধ্যে মেহরাজকে (২৬) আহত অবস্থায় বাড়িতে দেখা গেছে এবং মো: মিলন মারা গেছেন।

এছাড়া এ ঘটনায় আরো ১০ জেলে সামান্য আহত হয়ে কক্সবাজারে চিকিৎসা নিয়ে বর্তমানে বাড়িতে ও আত্মীয় স্বজনদের বাড়িতে অবস্থান করছেন।

সামান্য আহত হয়ে বাড়িতে ফিরে আসা চর লক্ষ্মী গ্রামের জেলে মো: শরীফ (২৫) জানান, মেঘনা নদীতে মাছ ধরা নিষেধের কারণে ও পরিবারের অভাব মেটানোর জন্য গত কয়েক দিন আগে তারা একই গ্রামের মনির মাঝির নেতৃত্বের স্থানীয় ২১ জন জেলে মিলে কক্সবাজারে যায়। সেখানে গিয়ে কক্সবাজার জেলার স্থানীয় সোহেল কোম্পানী নামের এক ব্যক্তির মালিকানাধীন এফবি ওশিন নামের একটি ট্রলারে মাছ ধরতে সাগরে যায়। ঘন্টায় ৬০ কি.মি. বেগে ট্রলার চলানোর পর গত ২৭ ফেব্রুয়ারি তারিখে তারা সাগরে জাল ফেলে। মধ্যরাতে তাদের ট্রলারে হঠাৎ একটা শব্দ করে। পরপর আরো দুটি শব্দ হয়। এরপর তারা কিছু লোক সাগরে পড়ে যায়, কিছু লোক কেবিনে এলোপাতাড়ি পড়ে থাকে। ট্রলারে থাকা একজনমাত্র লোক রশি ফেলে সাগরে পড়ে যাওয়াদের উদ্ধার করে। এরপর তারা ওপরে উঠে দেখে তাদের সাথে কেবিনে থাকা সবাই বিভৎস্য হয়ে গেছে। হাউমাউ করে চিৎকার দিতে থাকেন তারা।

তিনি বলেন, এর একঘন্টা পর আরেকটি ফিশিং ট্রলার এসে ৩ ঘন্টা ট্রলার চালিয়ে তাদেরকে নেটওয়ার্ক এলাকায় নিয়ে আসে। তারপর তারা তাদের কোম্পানীকে ফোন করে বিষয়টি জানালে, কোম্পানী স্পীডবোট পাঠিয়ে তাদের ট্রলার কক্সবাজার নিয়ে আসে। আহতদেরকে প্রথমে কক্সবাজার সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। পরে চট্টগ্রাম হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়।

শরীফ আরো বলেন, আমরা প্রথমে ভেবেছিলাম ইঞ্জিনে বিস্ফোরণ হয়েছে, কিন্ত আমরা দেখলাম আমাদের ইঞ্জিনে কিছুই হয়নি। গ্যাসের সিলিন্ডারগুলো ঠিক ছিল। ট্রলারও ঠিক ছিল। কিন্ত বিষয়টি রহস্যজনক মনে হয়েছে। কিভাবে আমরা এত লোক আহত হলাম? ওই বিকট শব্দটি কিসের ছিল? আমরা জানি না।

শরীফ অভিযোগ করে জানান, তাদেরকে কক্সবাজার সদর হাসপাতালে ভর্তি করানোর পর কোম্পানী আজ পর্যন্ত আর কোন খোঁজ নেয়নি। এদিকে কক্সবাজার সদর হাসপাতালের চিকিৎসকরা তাদের ১২ জনকে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজের বার্ন ইউনিটে স্থানান্তর করেন। সেখানের চিকিৎসকরা তাদেরকে ঢাকায় নিয়ে যাওয়ার জন্য নির্দেশ দেয়।

এদিকে মারাত্মক আহত ও গরীব জেলেদের চিকিৎসা নিয়ে যখন সংকট দেখা দেয় সেসময় খবর পেয়ে তাদের চিকিৎসায় এগিয়ে আসে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন 'স্বপ্ন নিয়ে'। স্বপ্ন নিয়ে আহত ১২ জেলেকে গত ২ মার্চ তারিখে ঢাকার শেখ হাসিনা বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে ভর্তি করায়। পাশাপাশি রোগীদের সেবায় স্বেচ্ছাসেবক নিয়োজিত করে, চিকিৎসা ও খরচের অর্থ সংগ্রহের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে।

এদিকে ওই ফিশিং ট্রলার এফবি ওশানের মালিক ও কক্সবাজার যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক মো: শহীদুল হক সোহেল জানান, আমার ট্রলারটি ছিল নতুন। এ ঘটনায় ট্রলারের ইঞ্জিন, গ্যাস সিলিন্ডারের কোন ক্ষতি হয়নি। তিনি দাবি করেন, কোনো বাহিনীর গোলাবারুদ এসে ট্রলারে পড়ে তাতে জেলেরা জলসে যায়। এ ঘটনায় তিনি কক্সবাজার থানায় জিডি করবেন বলে জানিয়েছেন।

রামগতি উপজেলার চরগাজী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান তাওহীদুল ইসলাম সুমন জানান, অগ্নিদগ্ধ বেশিরভাগ জেলের বাড়িই তার এলাকায়। আর্থিক সঙ্কটের কারণে ওইসব জেলেদের পরিবার চিকিৎসার খরচ চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে রামগতি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আব্দুল মোমিন জানান, কী কারণে জেলেদের ট্রলারে বিস্ফোরণ হয়েছে তার খোঁজ খবর নিবেন তিনি।

অন্যদিকে খবর পেয়ে আহত ও মারা যাওয়া জেলেদের তালিকা জেলা প্রশাসকের কার্যারয়ে পাঠানো হয়েছে। দুই-এক দিনের মধ্যে তাদেরকে সহায়তা করা হবে।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত