বাড়ির আঙিনায় চৌবাচ্চায় রঙিন মাছ চাষ করে সফল রাকিব

প্রকাশ : ০৪ অক্টোবর ২০২৩, ১৫:০৭

দিনাজপুর প্রতিনিধি
ছবি: সাহস

বাড়ির আঙিনায় সারি সারি সিমেন্টের তৈরী রিং পাশাপশি কয়েকটি পলিথিন ও বাঁশ দিয়ে তৈরি চৌবাচ্চায় রঙিন মাছ চাষ করে সফলতা পেয়েছেন দিনাজপুর সদরের যুবক ইয়াসিন আলী রাকিব (২৫)। ২০২০ সালে মাত্র  ৫০ টাকা দিয়ে শুরু করে এখন প্রতি মাসে ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকার মাছ বিক্রি করেন তিনি। পুঁজি দাঁড়িয়েছে এখন ছয় লাখ টাকা। প্রতিমাসে তার আয় হচ্ছে ৩০ থেকে ৩২ হাজার টাকা।

রঙ্গিন মাছ চাষী  ইয়াসিন আলী রাকিব দিনাজপুর সদরের ১ নম্বর চেহেলগাজী ইউনিয়নের হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পেছনে কর্ণাই হাজীপাড়া গ্রামের বাসিন্দা রফিকুল ইসলামের ছোট ছেলে। 

জানা গেছে, ৩ বছর আগে দিনাজপুর  শহরের একটি দোকান থেকে ৩০০ টাকায় চারটি গাপ্পি মাছ ও ৫০ টাকার খাবার ক্রয় করে রঙিন মাছ চাষ শুরু করেন। রঙ্গিন মাছ চাষ  লাভজনক হওয়ায় বেসরকারি চাকরি ছেড়ে এখন নিজ বাড়ীতে তৈরি প্রতিষ্ঠান ইয়াছিন আলী রাকিব অ্যাকোয়া ফার্মে সময় দিচ্ছেন। এখন পরিবারের সদস্যদের সহযোগিতা আর সমর্থন রঙ্গিন মাছ চাষে আগ্রহ বেড়ে গেছে । 

তার প্লাটিকের চৌবাচ্চা ও রিং মধ্যেই  চাষ হচ্ছে রঙ্গিন মাছ । রাকিবের চাষ করা মাছের মধ্যে গাপ্পি, মারবেল মলি, হোয়াইট মলি, ব্ল্যাক মলি, প্লাটি, সোর্ড টেইল, ফাইটার, কৈ কার্প, জেব্রা, কমেট, সরটেইল, গোল্ড ফিস, ক্ল্যাকমর, চিকলেট, টেট্রা অন্যতম।

রাকিব বলেন, ইউটিউব দেখের পর নিজ উদ্যোগে শহরের একটি দোকান থেকে ৩০০ টাকায় চারটি গাপ্পি মাছ ও ৫০ টাকার খাবার ক্রয় করে এই রঙ্গিন মাছ চাষের যাত্রা। বাড়িতে ছোট একটি চাড়িতে পানি দিয়ে চাষ শুরু হয়। এরপর মাছগুলো যখন পোনা দিতে শুরু করে তখন সিদ্ধান্ত নিই এই রঙিন মাছের চাষ আরও বাড়াবো।

তিনি বলেন, প্রথমে চারটি রঙিন মাছ কিনে পরিত্যক্ত একটি মাটির হাড়িতে শুরু করেন চাষ। পরে তিনি দেখলেন সেখান থেকে আটটি পোনা পাওয়া গেছে। এরপর তা বাড়তে থাকে। পরে তিনি সেই মাছগুলো সিমেন্ট-বালু দিয়ে তৈরি রিংয়ের মধ্যে ছেড়ে দেন। এভাবে একপর্যায়ে বাণিজ্যিকভাবে রঙিন মাছ চাষ করার সিদ্ধান্ত নেন রাকিব। কিন্তু অ্যাকুরিয়াম কেনা বা পাকা চৌবাচ্চা তৈরিতে অনেক খরচ, যা তার পক্ষে যোগাড় করা সম্ভব নয়। তাই বুদ্ধি খাঁটিয়ে বাড়ির আঙিনায় পলিথিন ও বাঁশ দিয়ে তৈরি করেন চৌবাচ্চা। সেই সঙ্গে রিং দিয়ে তৈরি হাউজে শুরু করেন রঙিন মাছ চাষ। আর এতেই দেখা মেলে সফলতার। এখন তার বাড়ির আঙিনায় সাতটি প্লাস্টিকের তৈরি চৌবাচ্চা, বেশ কয়েকটি রিং এ রয়েছে ১৫ প্রজাতির রঙিন মাছ। এই মাছ বিক্রি করে সংসারের খরচ চালিয়েও এখন তার পুঁজি দাঁড়িয়েছে ছয় লাখ টাকায়।

তিনি আরো বলেন, এখন আমার ৯ শতাংশ জমিতে বাঁশ ও পলিথিন দিয়ে সাতটি চৌবাচ্চা এবং বেশ কয়েকটি রিং, প্লাস্টিকের বালতি ও হাড়িতে মাছ আছে। এই চৌবাচ্চাগুলো পাকা তৈরি করতে গেলে কমপক্ষে পাঁচ লাখ টাকা খরচ হতো। অথচ আমার সব মিলিয়ে ৩০ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। বর্ষা মৌসুমে এই চৌবাচ্চাগুলো যেন ভরে না যায়, সেজন্য নিচে বিশেষ ব্যবস্থায় প্লাস্টিকের পাইপ লাগানো আছে। ট্যাংকের পানি যেমন ওভার ফ্লো হলে বেরিয়ে যায়, তেমনি আমার এই চৌবাচ্চাগুলো থেকেও পানি বেরিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে। ওপরে রয়েছে নেট। যাতে করে গাছের পাতা বা ময়লা আবর্জনা না পড়ে।

রাকিবের স্ত্রী বলেন, আমাদের দুই বছর আগে বিয়ে হয়েছে। সংসারের কাজের পাশাপাশি  আমি আমার স্বামীর সাথে রঙ্গিন মাছের চাষ দেখাশোনা করি । মাঝে মধ্যে মাছের খাবার দিতে হয় । পানি কম বেশি হলে তা দেখতে হয় । প্রতিদিন অনলাইন অনেকেই মাছের অডার দেয় । আমার স্বামী বাস যোগে কিংবা কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন জেলাতে রঙ্গিন মাছ বিশেষ ব্যবস্থাপনায় পাঠিয়ে দেয়। আবার কেই আমাদের বাড়ী থেকেও মাছ ক্রয় করে নিয়ে যায় । এই মাছ বিক্রির আয় দিয়ে এখন আমাদের সংসার ভালোভাবে চলছে।

রাকিবের মা বলেন, খুব কষ্ট করে আমার ছেলেটাকে লেখাপড়া শিখিয়েছি। রাকিব ডিগ্রী পাস করেছে কিন্তু বর্তমানে কোন চাকরি নেই। পাওয়ার সম্ভাবনাও নেই কারণ একটা চাকরি নিতে গেলে অনেক টাকা দিতে হয়। যেটি আমার পক্ষে সম্ভব নয়। রাকিবের বাবা গত এক বছর পূর্বেই মারা গিয়াছে। তাই আমার অভাব অনটনের মধ্যেই রাকিব নিজ বাড়ীতেই এই রঙ্গিন  মাছ বিক্রি করে সংসার চালাচ্ছে। রাকিবের একটা মেয়ে হয়েছে। তার খরচও বেড়ে গেছে। আমার বৌমা ও আমার ছেলে দুইজন মিলেই এই মাছের দেখাশুনা এবং খাবার দিয়ে থাকে। আমার ছেলের এই সাফল্যে আমি অবশ্যই গর্বিত।

স্থানীয় ইফাত আহমেদ বলেন, গত ৩ বছর আগে মাত্র ৩৫০ টাকা দিয়ে রাকিব চারটি রঙ্গিন মাছ ক্রয় করে এনে তার এই যাত্রা শুরু করেছিল।  বর্তমানে তার ৬ লক্ষাধিক টাকার অধিক মাছ রয়েছে।  অনেকেই বাড়ী  থেকে রঙ্গিন মাছ ক্রয় করে নিয়ে যায় ।  আবার অনেকেই অনলাইন  মাছ ক্রয়ের ওডার দেয়  রাকিব কুরিয়ার  সার্ভিসের মাধ্যমে রঙ্গিন মাছ প্রেরন  করছে।  রাকিব তার স্ত্রীর এই ব্যতিক্রমী উদ্যোগের কারণে আমাদের এলাকায় এখন প্রশংসা পাচ্ছে । 

গ্রামবাসী মুসতাক আহমেদ বলেন, রাকিব রঙ্গিন চাষ করে আমাদের গ্রামটিকে পরিচিতি লাভ করেছে। কারণ অনেকেই এখন আমাদের এই গ্রামে রঙ্গিন মাছ কেনার জন্য চলে আসেন। সেই সাথে আমাদের গ্রামের মানুষের সাথে পরিচয়   হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে। তাই আমরা মনে করি রাকিবের এই রঙ্গিন মাছ চাষ আমাদের গ্রামকে আরো পরিচিতি লাভ করিয়ে দিয়েছে।

হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিশারিজ বিভাগের শিক্ষার্থী শাহরিয়ার কবীর বলেন, রাকিব ভাইয়ের ফার্মের রঙ্গিন মাছ আমরা প্রায়ই দেখতে আসি । আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরাসহ আলোচনা করি। প্রয়োজনীয় অনেক মাছ তার কাছ থেকে ক্রয় করে নিয়ে আসি। রঙ্গিন মাছ দেখতে মাঝে মধ্যেই সুযোগ পেলে তার বাসায় চলে আসি।  রাকিব ভাইয়ের এই রঙ্গিন মাছ চাষ তাকে রঙ্গিন স্বপ্ন দেখাচ্ছে সেই সাথে তার কর্মজীবনের সফলতা  বেড়েছে।

দিনাজপুর সদর উপজেলা সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা আন্না রানী দাস বলেন, এই উপজেলায় আরও চার-পাঁচটি রঙ্গিন মাছ চাষ উদ্যোক্তার যাত্রা শুরু করেছে । তার মধ্যে রাকিবের এই রঙিন মাছ চাষের খামারটি অনেক বড় । এখানে প্রায় ১৫ থেকে ১৭ প্রকার রঙ্গিন মাছ চাষ হচ্ছে।  এই রঙিন মাছ এখানেই বংশ বিস্তার করছে।  আমাদের মৎস্য অফিস থেকে সকল ধরনের প্রশিক্ষণ ও সরকারি সহযোগিতা প্রদান করা হবে। 

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত