গভীর রাতে সাংবাদিককে তুলে নিয়ে এক বছরের জেল

প্রকাশ : ১৪ মার্চ ২০২০, ১৮:৩৪

সাহস ডেস্ক

কুড়িগ্রামের নিজ বাড়ি থেকে ঢাকা ট্রিবিউন সাংবাদিক আরিফুল ইসলামকে তুলে নিয়ে একবছরের জেল দিয়েছে জেলা প্রশাসনের মোবাইল কোর্ট। দুই থেকে তিনজন ম্যাজিস্ট্রেটসহ ১৫-১৬ জন আনসার সদস্য দরজা ভেঙে আরিফুলের বাড়িতে ঢুকে তাকে তুলে নিয়ে যায়।

শুক্রবার (১৩ মার্চ) তাকে নিজ বাসা থেকে গ্রেপ্তার করার পরে জেলা প্রশাসনের কার্যালয়ে নিয়ে চোখ বেঁধে বিবস্ত্র করে মারধর করা হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন তার স্ত্রী মোস্তারিমা নিতু।

পরিবারের সদস্য জানান, শুক্রবার রাতে দুই থেকে তিনজন ম্যাজিস্ট্রেটসহ ১৫-১৬ জন আনসার সদস্য দরজা ভেঙে তার বাড়ির ভেতর ঢুকে আরিফুলকে মারতে থাকে এবং একপর্যায়ে তাকে তুলে নিয়ে যায়।

ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে আরিফুলের স্ত্রী জানান, শুক্রবার রাত সাড়ে ১২টার দিকে হঠাৎ করে বাড়ির গেটে ধাক্কাধাক্কির শব্দ পান তারা। এসময় দরজা না খুললে তা ভেঙ্গে ফেলা হবে বলেও তাদেরকে হুমকি দেওয়া হয়। সেসময় কুড়িগ্রাম সদর থানার ওসি মাহফুজার রহমানকে ফোন করা হলে ওসি জানান, থানা থেকে কোনও পুলিশ সেখানে যায়নি, কারা গেছে বিষয়টি দেখছেন তিনি। একপর্যায়ে দরজা ভেঙ্গে ৭ থেকে ৮ জন সাদা পোশাকধারী তাদের বাসায় প্রবেশ করে দরজা ভেঙ্গে ঘরে ঢুকে আরিফুলকে মারতে মারতে ঘরের বাইরে নিয়ে যায়। এরপর আরিফুল তাদের কাছে কারণ জানতে চাইলে তারা আবারও তাকে মারধর করে। এরপর তাকে সরাসরি জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে নিয়ে যাওয়া হয়।

আরিফুল ইসলামকে রাতে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে নেওয়া হয় অভিযোগ করে তার স্ত্রী বলেন, জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে আরিফুলের পোশাক খুলে দুই চোখ বেঁধে নির্যাতন করা হয়েছে। পুরো দৃশ্য ভিডিও করা হয়েছে। আর এসব ঘটনার নেতৃত্ব দিয়েছেন কুড়িগ্রাম জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের আরডিসি (সিনিয়র সহকারী কমিশনার-রাজস্ব) নাজিম উদ্দিন।

আরিফুল ইসলাম তার স্ত্রীকে জানান, মধ্যরাতে তাকে বাসা থেকে জোর করে তুলে আনার পথে জেলা প্রশাসক কার্যালয় পর্যন্ত লাথি-থাপ্পড়, ঘুষি মারতে মারতে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে একটি কক্ষে নিয়ে গিয়ে প্রথমে তার দুই চোখ কাপড় দিয়ে বেঁধে ফেলা হয়। এরপর প্যান্ট ও গেঞ্জি খুলে তাকে উলঙ্গ করে অমানুষিক নির্যাতন করা হয়। এসব দৃশ্য ভিডিও করা হয়।

তিনি আরও জানান, যারা তাকে নির্যাতন করেছে, তারা জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের কর্মকর্তা। তাদের দেখতে না পারলেও তাদের সবার গলার স্বর তার মনে আছে।

এদিকে মাদক বিরোধী অভিযানের সময় মাদকসহ আরিফুল ইসলাম রিগানকে আটক করা হয় বলে দাবি করেছেন অভিযান পরিচালনাকারী নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট রিন্টু বিকাশ চাকমা।

আরিফুল ইসলামের স্ত্রী মোস্তারিমা সরদার বলছেন, আরিফুল সিগারেট, এমনকি পানও খান না। আর তারা বাড়িতে আসলেও ঘরের ভেতরে সার্চ করেননি, তারপরেও কেমন করে তার কাছে মাদক পাওয়া গেছে বলে একবছরের কারাদণ্ড দেওয়া হলো তাকে?

অন্যদিকে, ‘মাদক বিরোধী অভিযানের’ উদ্যোগ জেলা প্রশাসন না মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কুড়িগ্রাম জেলা কার্যালয় নিয়েছিল, তা নিয়ে কুড়িগ্রামের জেলা প্রশাসক ও জেলা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ কার্যালয়ের সহকারী পরিচালকের পরস্পরবিরোধী বক্তব্য পাওয়া গেছে।

অভিযান পরিচালনাকারী নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট রিন্টু বিকাশ চাকমা বলেন, সুনির্দিষ্ট অভিযোগের প্রেক্ষিতে পুলিশ, আনসার ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের সমন্বয়ে টাস্কফোর্সের অভিযান পরিচালনা করা হয়। এ অভিযানের সময় মাদকসহ আরিফুল ইসলাম রিগানকে আটক করা হয়। ভ্রাম্যমাণ আদালতের সামনে সে দোষ স্বীকার করায় এক বছরের বিনাশ্রম কারাদন্ড ও ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়।

জেলা প্রশাসক পারভীন সুলতানা বলেন, অ্যাজ ইউজুয়াল টাস্ক ফোর্স অভিযানে গেছে। মাদকদ্রব নিয়ন্ত্রণ অফিসের চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে আমার একজন ম্যাজিস্ট্রেট, পুলিশের কয়েকজন ফোর্স, ব্যাটালিয়ান আনসারের পাঁচজন আর মাদকদ্রবের তিনজন ছিলেন। তাদের কাছে লিখিত অভিযোগ ছিল। সেই পরিপ্রেক্ষিতেই অভিযান হয়। মাদক দ্রব্যই আমাদের কাছে ম্যাজিস্ট্রেট চেয়েছিল।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কুড়িগ্রাম জেলা কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক আবু জাফর বলেন, তিনি এলাকায় ছিলেন না। শনিবার দুপুরে কার্যালয়ের পরিদর্শক জাহিদ সাহেব তাকে জানিয়েছেন, রাতে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে তাদের অভিযানের কথা বলে নিয়ে যাওয়া হয়।

আবু জাফরের এই বক্তব্য জেলা প্রশাসককে জানালো হলে তিনি বলেন, মাদকদ্রব্য কার্যালয়ের পক্ষ থেকেই চাওয়া হয়েছিল। তারপর এরা (ম্যাজিস্ট্রেট ও জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তা) বলেছে যে, যাওয়া যাবে। অবশ্য আমি তো কাল ছিলামও না, আমি রৌমারিতে ছিলাম।

প্রসঙ্গত, কুড়িগ্রামের জেলা প্রশাসকের (ডিসি) সুলতানা পারভীনের বিরুদ্ধে নিজ নামে পুকুর খননের অভিযোগ ওঠায় সেবিষয়ে একটি প্রতিবেদন লেখেন আরিফুল। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ওই ঘটনার পর থেকেই তার বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ ছিলেন ডিসি। সম্প্রতি জেলা প্রশাসনের নিয়োগ অনিয়ম নিয়েও প্রতিবেদন করছিলেন সাংবাদিক আরিফুল।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত