ভারত: মাসিকের সময় নারীদের ঘর থেকে বের করে দেয়া হয়

প্রকাশ : ০৫ জুন ২০২১, ০৫:১১

বিবিসি বাংলা

ভারতের মহারাষ্ট্র রাজ্যে এখনও হাজার হাজার নারী ও কিশোরীকে তাদের মাসিকের সময় বাসা থেকে বের করে দেয়া হয়। মাসিকের দিনগুলোতে তাদের বসবাসের অযোগ্য কুঁড়েঘরে থাকতে বাধ্য করা হয়।

মুম্বাইয়ের একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন এই নারীদের সাহায্য করতে ভেঙে পড়া কুঁড়েঘরের জায়গায় আধুনিক পাকা ঘর তোলার একটি প্রকল্প শুরু করেছে। এই মাসিক কুঁড়েঘরগুলোকে স্থানীয়ভাবে বলা হয় "কুর্ম ঘর বা গাওকর।"

কিন্তু তাদের এই কাজ নিয়ে জোর সমালোচনা শুরু হয়েছে যে তারা এই অমানবিক প্রথা বিলোপের বদলে তাকে টিকিয়ে রাখারই উদ্যোগ নিয়েছে।

সমালোচকরা বলছেন, বরং মাসিকের সময় মেয়েদের আলাদা করে রাখার জন্য তৈরি এই কুঁড়েঘরগুলো একেবারে ভেঙে ফেলাটাই সময়োপযোগী পদক্ষেপ হতো।

যদিও খেরওয়াদি সোসাল ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন নামের সংগঠনটি বলছে, এই নারীদের জন্য পাকা ঘর, টয়লেট, ঘুমানোর বিছানা, পানি ও বিদ্যুতের ব্যবস্থা করে দিয়ে তারা নারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে চাইছে। বলছে তারাও এই প্রথা বিলোপের পক্ষে।

ভারতীয় সমাজে দীর্ঘদিন ধরেই পিরিয়ডের সময় মেয়েদের সামাজিকভাবে একটা নিষেধের আবহে কাটাতে হয়। মাসিকের সময় নারীদের অশুচি বলে বিবেচনা করা হয় এবং তাদের কঠোর বিধিনিষেধ মেনে চলতে হয়।

তাদের এসময় সামাজিক ও ধর্মীয় সব অনুষ্ঠানে যোগদান নিষিদ্ধ করা হয় এবং মন্দির বা কোন ধর্মীয় সৌধে, এমনকি রান্নাঘরেও ঢুকতে দেয়া হয় না।

তবে মহারাষ্ট্রের অন্যতম দরিদ্র ও অনুন্নত একটি জেলা গাডচিরোলির মাদিয়া সম্প্রদায়ের নারীদের মাসিকের সময় সমাজে চরম বিধিনিষেধের মুখে থাকতে হয়, যা সামাজিক বিধিনিষেধের অন্য সব ঘেরাটোপকেও ছাড়িয়ে যায়।

প্রতি মাসের ওই পাঁচদিন প্রথাগত নিয়ম মেনে তাদের থাকতে হয় একটা কুঁড়েঘরে। শুধু তাই নয়, এই কুঁড়েঘরগুলো হয় মূলত গ্রামের একেবারে বাইরে, জঙ্গলের কিনার ঘেঁষে। অর্থাৎ এই সময়টা তাদের 'একঘরে' হয়ে থাকতে হয়।

তাদের রান্না করতে দেয়া হয় না। গ্রামের কুয়া থেকে পানি তুলতে দেয়া হয় না। বাসার নারী আত্মীয়দের দেয়া খাবার ও পানি খেয়ে তাদের দিন কাটাতে হয়। যদি কোন পুরুষ তাদের ছুঁয়ে ফেলে, তাহলে ওই পুরুষকে সাথে সাথে গোসল করতে হয়, কারণ ওই "অপবিত্র" নারীকে "ছুঁয়ে ফেলার কারণে সেও অপবিত্র হয়ে গেছে" বলে মনে করা হয়।

মুম্বাইয়ের স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার তৈরি প্রথম আধুনিক পাকা ঘরকে স্বাগত জানিয়েছেন টুকুম গ্রামের নারীরা।

তারা বলছেন, এর আগে পিরিয়ডের সময় এগিয়ে আসলেই তারা ভয়ে কুঁকড়ে থাকতেন গ্রামের শেষ মাথায় ভাঙাচোরা কুঁড়েঘরে থাকতে হবে সে কথা ভেবে। কারণ মাটি আর বাঁশের তৈরি খড়ের চালের ওই ঘরে কোন জানালা বা দরোজা নেই। আশেপাশে জীবনযাপনের জন্য প্রয়োজনীয় কিছুই পাওয়া যায় না। গোসল করতে বা কাপড় কাচতে তাদের হেঁটে যেতে হয় এক কিলোমিটার দূরের নদীতে।

গ্রামের বাসিন্দা ৩৫ বছরের সুরেখা হালামি বলছেন, গ্রীষ্মকালে ওই কুঁড়েতে অসহনীয় গরম থাকে, আর থাকে মশার উৎপাত। শীতকালে প্রচণ্ড ঠাণ্ডা আর বর্ষায় ঘরের চাল দিয়ে অনবরত পানি পড়ে ঘরের মাঝখানে পুকুর হয়ে যায়। কখনও কখনও কুকুর আর শূকরও ভেতরে ঢুকে আসে।

২১ বছরের আরেক নারী শীতল নারোতে বলছেন, কুঁড়েঘরে একা থাকলে সারা রাত ঘুম আসে না ভয়ে। ভেতরে আর বাইরে ঘুটঘুটে অন্ধকার। আমি বাড়ি যেতে চাই সর্বক্ষণ, কিন্তু কোন উপায় তো নেই।

তার প্রতিবেশি ৪৫ বছরের দুরপাতা উসেন্দি বলছেন, দশ বছর আগে ২১ বছরের এক নারী ওই কুঁড়েতে থাকার সময় সাপের কামড়ে মারা যায়।

তিনি বলেন, মাঝরাতের পর আমাদের ঘুম ভেঙে গিয়েছিল। তখন কাঁদতে কাঁদতে আর চেঁচাতে চেঁচাতে সে কুঁড়ে থেকে ছুটে বাইরে যায়। তার নারী স্বজনরা তাকে সাহায্য করার চেষ্টা করেছিল, তাকে কিছু লতাপাতা আর স্থানীয় ওষুধ এনে দিয়েছিল।

তিনি আরো বলেন, পুরুষরা, এমনকি তার নিজের পরিবারের পুরুষরাও দূরে দাঁড়িয়ে দেখেছে। কিন্তু তার যেহেতু মাসিক চলছিল তারা ওকে ছুঁতে পারেনি, কারণ ঋতুর সময়ে মেয়েরা যে অশুচি। সাপের বিষ তার সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়লে সে যন্ত্রণায় মাটিতে পড়ে কাতরাতে থাকে, কয়েক ঘণ্টার মধ্যে মারা যায়।

টুকুম গ্রামে সংস্থাটি প্রথম যে পাকা ঘর তৈরি করেছে ভিডিও কলে আমাকে সেটা দেখিয়ে নারীরা বললেন, "সবচেয় বড় কথা ঘরের ভেতর টয়লেট আছে আর দরোজা লক করার ব্যবস্থা আছে।"

সংস্থার নিকোলা মন্টেরিও বলছেন, সাড়ে ছয় লাখ রুপিতে তৈরি একটা ঘর বানাতে সময় লেগেছে আড়াই মাস। তারা আশপাশের গ্রামগুলোতে সব মিলিয়ে আরও দশটা এরকম ছোট বাড়ি জুনের মাঝামাঝি নাগাদ চালু করতে যাচ্ছে।

ওই এলাকায় কাজ করে স্পর্শ নামে স্থানীয় আরেকটি বেসরকারি সংস্থা, যার প্রেসিডেন্ট দিলীপ বারসাগাড়ে বলছেন, গত কয়েক বছরে এরকম ২২৩টি মাসিকের কুঁড়েঘর তারা ঘুরে দেখেছেন যার মধ্যে ৯৮% "অনিরাপদ এবং সেখানে কোন শৌচাগার নেই"।

গ্রামবাসীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা তথ্যের ভিত্তিতে তিনি একটি রিপোর্ট তৈরি করেছেন। তিনি জানালেন "কুর্ম ঘরে থাকার সময় অন্তত ২১জন নারী মারা গেছে, যাদের মৃত্যু ঠেকানো সম্ভব ছিল।"

তিনি বললেন, "যেমন একজন মারা গেছে সাপের কামড়ে, অরেকজনকে ভালুক টেনে নিয়ে গেছে, আরেকজন প্রচণ্ড জ্বরে চিকিৎসা না পেয়ে মারা গেছে।"

কয়েক বছর আগে দেয়া মি. বারসাগাড়ের ওই রিপোর্টের পর ভারতের জাতীয় মানবাধিকার কমিশন মহারাষ্ট্র রাজ্য সরকারকে "এই প্রথা উচ্ছেদের" নির্দেশ দিয়েছিল, কারণ তারা বলছিল "এই প্রথা নারীদের মানবাধিকার চরমভাবে লংঘন করছে, তাদের নিরাপত্তা, স্বাস্থ্য এবং সম্মান ব্যাপকভাবে বিপর্যস্ত হচ্ছে"। কিন্তু তার পর অনেকগুলো বছর গড়িয়ে গেলেও ওই প্রথা এখনও মাদিয়াদের সমাজে গভীরভাবে প্রোথিত রয়ে গেছে।

টুকুম এবং আশেপাশের গ্রামগুলোর যত নারীর সঙ্গে আমি কথা বলেছি প্রত্যেকে বলেছে তারা 'মাসিকের কুঁড়েতে' যেতে চায় না। সেখানে কোন কিছুর সুবন্দোবস্ত নেই, যেটা তদের ক্ষিপ্ত করে। কিন্তু কয়েক শতাব্দী প্রাচীন এই প্রথা বদলানোর কোন ক্ষমতা তাদের নেই।

সুরেখা হালামি বলেন তারা ভয় পান এই প্রথা ভাঙলে ঈশ্বর তাদের ওপর রুষ্ট হবেন এবং তাদের পরিবারের ওপর মৃত্যু ও অসুস্থতার অভিশাপ নেমে আসবে।

"আমার মা, আমার দাদী প্রত্যেকে প্রতি মাসে কুর্ম ঘরে গেছেন, আমিও যাচ্ছি প্রত্যেক মাসে। একদিন আমার মেয়েকে আমি সেখানে পাঠাব," তিনি বলেন।

গ্রামের প্রবীণ ব্যক্তি চেন্ডু উসেন্দি বলেছেন, এই প্রথা বদলানো যায় না কারণ "এটা ঈশ্বরের বিধান।"

তিনি বলেন, এই প্রথা না মানলে শাস্তি পেতে হয়। যে প্রথা ভাঙে তাকে সারা গ্রামের মানুষকে মাংস ও মদ খাওয়াতে হয়, সেই সাথে আর্থিক জরিমানাও দিতে হয়।

এধরনের বিধিনিষেধের পেছনে প্রায়ই ধর্মীয় ও প্রথাগত আচারের দোহাই দেয়া হয়, কিন্তু আজকের শহুরে শিক্ষিত নারীরা এসব পশ্চাদপদ প্রথাকে চ্যালেঞ্জ জানাতে শুরু করেছে।

পিরিয়ডের সময়ও নারীরা যাতে মন্দিরে বা দরগায় যেতে পারে সে দাবি জানিয়ে নারী সংগঠনগুলো আদালতের দ্বারস্থ হয়েছে। সোসাল মিডিয়াতেও মাসিকের সময় মেয়েদের 'অশুচি' বলার বিরুদ্ধে আন্দোলন চালানো হয়েছে।

"কিন্তু মহারাষ্ট্রের এই এলাকা খুবই পশ্চাদপদ এবং অভিজ্ঞতা থেকে দেখা গেছে এধরনের সমাজে পরিবর্তন সবসময়ই আসে খুবই ধীরে। প্রাচীন এসব সামাজিক বিধানের বিরুদ্ধে লড়াই করা সহজ নয়," বলছেন খেরওয়াদি সোসাল ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের মিজ মন্টেরিও।

তিনি বলছেন আপাতত নারীদের সুরক্ষার জন্য পাকা ঘর তারা তৈরি করে দিলেও এই প্রথা পুরোপুরি বিলোপের তারা পক্ষে এবং সে লক্ষ্যে তারা কাজ করছেন।

"পাকা ঘর তৈরি করাটা এর উত্তর নয়," বলছেন মি. বারসাগাড়ে। "পিরিয়ডের সময় নারীদের শারীরিক ও মানসিক সহায়তার দরকার থাকে অনেক সময়, যেটা ঘরে পাওয়া যায়- মেয়েদের নির্বাসনে ঠেলে দিয়ে নয়। কিন্তু পরিস্থিতি বদলানোর জন্য কোন যাদুর কাঠি আমাদের হাতে নেই।"

তিনি বলেন, সবচেয়ে বড় সমস্যা হল, এই নারীরা বোঝেনই না যে এখানে তাদের অধিকার লংঘিত হচ্ছে।

"তবে একটাই আশার কথা, এদের সমাজেও অল্পবয়সী শিক্ষিত মেয়েরা এই প্রথা নিয়ে এখন প্রশ্ন তুলতে শুরু করেছে। হয়ত এদের হাত ধরেই ভবিষ্যতে পরিবর্তন আসবে," বলছেন দিলীপ বারসাগাড়ে।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত