জীবনযুদ্ধে জয়ী ৫ নারী এখন সবার প্রেরণা

প্রকাশ : ২৩ জুন ২০১৯, ১৩:৩৩

সাহস ডেস্ক

সভ্যতা বিনির্মাণে যুগে যুগে পুরুষের পাশাপাশি নারীও সমানভাবে তাদের অবদান রেখে এসেছে। তবুও আজকের আধুনিক বিশ্বেও একজন নারীকে তার অস্তিত্ব প্রমাণে নানা সংগ্রাম করে এগিয়ে যেতে হচ্ছে।

দৃঢ় মনোবল, সাহস, বুদ্ধি ও পরিশ্রমের সমন্বয়ে জীবন সংগ্রামে জয়লাভ করে এগিয়ে যাচ্ছেন বিয়ানীবাজারের পাঁচ নারী। তাদের মধ্যে অর্থনৈতিক সাফল্য অর্জন করেছেন মেওয়ার পারুল বেগম, শিক্ষা ও চাকরিক্ষেত্রে সাফল্য অর্জন করেছেন শিল্পী রাণী দত্ত, সফল জননী শাহজাদী সুলতানা বেগম, নির্যাতনের বিভীষিকা মুছে ফেলে নতুন উদ্যমে জীবন শুরু করা মোছা. রুবিনা আক্তার রুবি ও সমাজ উন্নয়নে অসামান্য অবদান রাখা নারী তাজিরুন বেগম। এখন তারা অন্য নারীদের অনুপ্রেরণার উৎস।

পাঁচ জয়িতার জীবনযুদ্ধে হার না মানার গল্প ..। 

পারুল বেগম: মেওয়া গ্রামের মো. আব্দুল হান্নানের স্ত্রী পারুল বেগম। ছোটবেলা থেকে জীবনের সাথে যুদ্ধ করে বড় হওয়ার শিক্ষা পেয়েছেন তিনি। বিভিন্ন প্রতিকূলতা এবং সংসারের অনটনের কথা চিন্তা করে অনেকটা কিশোর বয়সেই মামা তার বিয়ে দিয়ে দেন।

স্বামীর ক্ষুদ্র ব্যবসায় তার সংসারের চাকা ধীরলয়ে ঘুরতে থাকে। তবে কিছুদিন পর ব্যবসায় ক্ষতি হওয়ায় তাও বন্ধ হয়ে যায়। পরে স্বামীর পরামর্শে কিছু ছাত্র ছাত্রীকে প্রাইভেট পড়ানো শুরু করেন পারুল বেগম। স্বামীও যোগ দেন রাজমিস্ত্রীর কাজে।

এ সময় স্থানীয় একটি এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে পুরাতন সেলাই মেশিন ক্রয় করেন। এভাবে তার আয় বাড়তে থাকে। কিছুদিন পর স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান পাঁচ হাজার টাকা মাসিক বেতনে তাকে এলাকার অন্যান্য মেয়েদের দিয়ে সেলাই কাজ শুরু করার দায়িত্ব দেন।

এভাবে দুই বছর পেরিয়ে গেলে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে সংরক্ষিত ওয়ার্ডের নারী সদস্য পদে নির্বাচন করে জয়লাভ করেন তিনি। বর্তমানে তার নিজ খামারে ২৫টি মুরগি, ২৩টি ছাগল ও ৮টি গরু রয়েছে। এছাড়াও তার একটি মোবাইল সার্ভেসিং এর দোকান রয়েছে।

শিল্পী রাণী দত্ত: শিল্পী রাণী দত্ত উপজেলার চারখাই ইউনিয়নের বিলুয়া গ্রামের অমরেশ চন্দ্র দেবের স্ত্রী।

১৯৮৩ সালে ৫ম শ্রেণি পাস করার পর যোগাযোগ সুবিধা না থাকা এবং দারিদ্রতার কারণে তার লেখাপড়া বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়। তখন নিজের ইচ্ছা আর মায়ের চেষ্টায় মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হন রাণী দত্ত। বাবা ছিলেন সংসারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি।

চরম প্রতিকূলতার মাঝেও ১৯৯০ সালে এসএসসি পাস করেন। কলেজে পড়াকালীন সময়ে একটি কিন্ডারগার্টেন স্কুলে খণ্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে এক বছর চাকরি করেন। এ সময় রাণী দত্ত পরিবার কল্যাণ সহকারী পদে চাকরি পান। একই কলেজ থেকে তিনি বিএ পাস করেন। বর্তমানে তিনি একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারি শিক্ষিকা হিসেবে চাকরি করছেন।

শাহজাদী সুলতানা বেগম: আলীনগর ইউনিয়নের করগ্রামের হাজী আব্দুর নূরের মেয়ে শাহজাদী সুলতানা বেগম। খুব কষ্টে এসএসসি পাস করে পরিবার-পরিকল্পনা বিভাগে চাকরি নেন। কিন্তু পারিবারিক চাপের কারণে পরে তা ছেড়ে দিতেও বাধ্য হন তিনি

চাকরি ছেড়ে দেয়ার পর এক বেকার যুবকের সাথে তার বিয়ে হয়। পরে তার স্বামী কুয়েতে পাড়ি জমালেও সেখানে খাপ খাওয়াতে না পেরে শূন্য হাতে দেশে ফেরেন। জীবনের কঠিন এ সময়ে সংসারের হাল ধরেন শাহজাদী। একসময় দিন বদলাতে শুরু করে তার।

বড় মেয়ে উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ করে প্রবাসে পাড়ি জমালে সেখানে তার বিয়ে হয়। বড় ছেলে এইচএসসি পাস করে কুয়েতে পাড়ি জমায়। ছোট মেয়েও সিলেট এমসি কলেজ থেকে অনার্স পাস করে যুক্তরাজ্যে পাড়ি জমালে সেখানে তার বিয়ে হয়। ছোট ছেলে বিবিএ-এমবিএ পাস করে চাকরির জন্য ছুটছেন।

রুবিনা আক্তার রুবি: আর্থিক অনটনের সংসারে ১০ম শ্রেণিতে পড়াবস্থায় বিয়ে হয় তার। বিয়ের পর নতুন সংসার ভালো চলছিল। হঠাৎ তার স্বামী মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন। এ কারণে তার সৌদি আরব যাওয়া হয়নি।

আর এটা মেনে নিতে না পেরে শ্বশুর বাড়ির লোকজন তার ওপর শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন শুরু করেন। পরে রুবি বাপের বাড়ি চলে আসেন।

পরবর্তীতে বৈরাগীবাজারের একটি মহিলা সংস্থায় প্রশিক্ষক হিসেবে কাজ করেন তিনি। তখন তাকে সম্মানী হিসেবে মাসিক ৪ হাজার টাকা দেয়া হত। তিনি এই কাজের পাশাপাশি এলাকায় স্বর্ণকারের দোকানে কাজ নেন।

পুঁজি কম ও আয় বেশি হওয়ায় পূর্বের জুয়েলারি দোকানের কর্মচারীর অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে তিনি নিজেও এরকম একটি দোকান দেন। তার দোকানে এখন ৬ জন কর্মচারী কাজ করছেন। রুবি কুড়ারবাজার ইউনিয়নের খশিরবন্দ গ্রামের মো. নুর উদ্দিনের মেয়ে।   

তাজিরুন বেগম: মাত্র ১৫ বছর বয়সে বাবা মারা যাওয়ার পর সাত ভাই ও এক বোনকে নিয়ে শুরু হয় তাজিরুন বেগমের সংগ্রাম। দুইবার তার লেখাপড়া বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়।

স্কুলের শিক্ষক ও ইউপি চেয়ারম্যানের সহায়তায় এইচএসসি পাস করেন তিনি। এ সময় বাড়িতে সেলাই কাজের পাশাপাশি স্থানীয় ইউনিয়ন অফিসে সহকারী হিসেবে মাস্টার রোলে যোগ দেন। প্রতি শনিবার সূর্যের হাসি ক্লিনিকের প্রতিনিধি হিসেবে দরিদ্র অসহায় মা ও বোনদের চিকিৎসা সেবা প্রদান করেন।

বর্তমানে তিনি একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্পের সভাপতি, বৈরাগীবাজার মহিলা সমিতির সভাপতি, কমিউনিটি স্যাটেলাইট ক্লিনিক পরিচালনা কমিটির সভাপতি হিসেবে মানুষের কল্যাণ করে যাচ্ছেন।

তাজিরুন নিজস্ব অর্থায়নে দুইকক্ষ বিশিষ্ট পাকাঘর, ১০ শতক জমি ক্রয় করেছেন। তিনি সমাজ উন্নয়নে কাজ করে জয়িতা মনোনয়ন পেয়েছেন। তাজিরুন লাউতা ইউনিয়নের পাড়িয়াবহর গ্রামের মৃত কালা মিয়ার মেয়ে। 

ইউএনবি

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত