বাংলদেশের প্রথম ব্যাটেল রয়েল গেমের ইতিবৃত্ত

প্রকাশ : ২০ মে ২০২১, ১৯:২০

সাহস ডেস্ক

আপনি যদি একজন গেম প্রিয় হয়ে থাকেন তাহলে অবশ্যই এতদিনে জেনে গেছেন বাংলাদেশের তৈরী প্রথম ব্যাটেল রয়েল গেম অ্যানিহিলেশন এর কথা। গত ৫ জানুয়ারি গেমটির একটি টিজার প্রকাশের পর থেকে অনলাইন সামাজিক মাধ্যমগুলোতে ব্যাপক সাড়া ফেলে দেয় গেমটি। রাজধানী ঢাকা সহ বাংলাদেশের প্রধান অঞ্চলগুলো মূল লোকেশন হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে গেমটিতে।

তবে সবচেয়ে দারুণ ব্যাপার হলো, গেমটির একটি প্রধান চরিত্র হিসেবে ফিচার করা হয়েছে বাংলাদেশের সিনেমা জগতের কিংবদন্তি নায়ক সালমান শাহকে। ফার্স্ট পার্সন শ্যুটার গেমটির প্রধান ডেভেলপার তরুণ গেমার ও প্রোগ্রামার সিয়াম হাসান উদয়।

চলুন, বাংলাদেশের গেম শিল্পে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করা এই গেমটির ব্যাপারে আরো কিছু জেনে নিই।

প্রথম ব্যাটেল রয়েল গেমটির শেষ খবর
গেম নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ক্রাইসিস এন্টারটেইনমেন্ট লিমিটেডের ব্যানারে গেমটি মুক্তি পাওয়ার কথা ছিল গত ৩০ এপ্রিল। অ্যানিহিলেশন কমিউনিটি ৩ দিন আগে গুগল প্লে স্টোরে গেমটি সাবমিটও করেছে। কিন্তু কোভিড-১৯ মহামারির কারণে গুগল থেকে জানানো হয়, গেমটি প্রকাশে আরো দেরি হবে। সুতরাং মাল্টিপ্লেয়ার ভিডিও গেম প্রিয়দের গেমটি খেলার জন্য বেশ কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে।

অ্যানিহিলেশন গেমের পটভূমি
গেমটির গল্প মূলত বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী নির্ভর। সময় ২০৩০ সাল। বাংলাদেশের সাহসী সৈনিকরা একত্রে আন্দোলন গড়ে তুলছে ‘কাউন্সিল’ নামের একটি গুপ্ত সংগঠনের বিরুদ্ধে। বহিঃবিশ্ব সংক্রান্ত কিছু অদ্ভূত ঘটনাকে কেন্দ্র করে রহস্য দানা বাঁধতে শুরু করে। ধীরে ধীরে সবাই বুঝতে পারে ঘটনা শুধু কাউন্সিলের মাঝেই সীমাবদ্ধ নয়। এর ভেতরে রয়েছে ভয়ঙ্কর এক বহুজাগতিক ধ্বংসের বীজ।

অতঃপর চূড়ান্তভাবে ঢাকা শহরে এলিয়েনদের অনুপ্রবেশকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হতে থাকে কাহিনী। মানুষের মস্তিষ্ক নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা সম্পন্ন এই এলিয়েনরা পারস্পরিক সংঘর্ষের দিকে ঠেলে দিতে থাকে শহরবাসীকে। মানুষ ক্রমশ এগিয়ে যায় গৃহযুদ্ধের দিকে। এ অবস্থায় বাংলাদেশের সাহসী সৈনিকরা এলিয়েনদের সাথে সম্মুখ যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়। নেপথ্যে থাকা এলিয়েনদের পরিচালনাকারী অদৃশ্য চরিত্র, একজন গেম ভক্ত হিসেবে আপনার রোমাঞ্চের খোরাক যোগাবে।

সব মিলিয়ে গেমটি করোনা পরবর্তী পৃথিবীর সম্ভাব্য সব রকম ভয়াবহতা তুলে ধরবে গেমারদের সামনে।

গেমপ্লের ফিচারসমূহ
ফার্স্ট পার্সন শ্যুটার এই গেমটিতে মোট ৮টি চরিত্র থেকে আপনার পছন্দ মত একজন ফাইটার বাছাই করতে পারবেন সরাসরি এলিয়েনদের সাথে লড়াই করার জন্য। প্রত্যেক হিরোকে ক্রমান্বয়ে লড়তে হবে ৬০ জন প্রতিদ্বন্দ্বীর সাথে। এই ৮টি চরিত্রের মাঝেই প্রধান হিসেবে থাকছে সালমান শাহ চরিত্রটি। ইতিমধ্যে অবশ্যই আপনি গেম ট্রেইলার দেখে একটি বায়োনিক মানুষ বা রোবট চরিত্রের সাথে প্রিয় নায়কের সাদৃশ্যতা ধরতে পেরেছেন। রোবটটির চেহারা, গলার লকেট, পরণের পোশাক, চোখের গ্লাস, চুলের এবং হাটার স্টাইল প্রভৃতির সাথে অকপটেই সালমান শাহের ভক্তরা মিল খুঁজে পেয়েছেন।

প্রাথমিকভাবে ঢাকা শহর সহ কিছু গ্রাম্য এলাকা ও আন্ডারগ্রাউন্ড দেখতে পাবেন। প্রতিটি ইভেন্টের জন্য দেখানো কাহিনীগুলোর মাধ্যমে পরবর্তীতে আপনি গেম খেলায় উৎসাহিত হবেন।

গেমটির একাধিক সিজন প্রকাশ হবে। প্রথমটা সিজন জিরো নামে আপনার নিকট পুরো প্লটটা তুলে ধরবে। ৮টি চরিত্রের প্রত্যেকের-ই থাকবে কিছু না কিছু ভালো এবং দুর্বল দিক। উন্নত প্রযুক্তির অস্ত্রশস্ত্র, হিরোদের সাথে গল্পের সম্পর্ক সব কিছু বিস্তারিত জানতে পারবেন প্রাথমিক গেমিং মুডগুলোর সাথে পরিচিত হওয়ার মাধ্যমে। ফার্স্ট পার্সন শ্যুটার হিসেবে যেহেতু আপনি একজন হিরোকে বাছাই করবেন, তাই আপনার প্রতিটি সিন্ধান্তের ওপর নির্ভর করে এগোতে থাকবে গেমের কাহিনীসূত্র।

সিজন ওয়ান এ আপনাকে সম্মুখীন হতে হবে এলিয়েনদের সাথে সংঘর্ষের। সিজন জিরোতে দেয়া নির্দেশনা অনুযায়ী আপনি এখানে ব্যবহার করতে পারবেন মারণাত্মক অস্ত্র, লোকেশন ম্যাপ, প্রয়োজনীয় স্কিল।

যাই হোক, গেমটি বাংলাদেশের এলাকা নির্ভর হলেও আপনি গেমটিকে বাংলা ভাষায় পাচ্ছেন না। এর মূল কারণ হলো, নির্মাতারা গেমটিকে বিশ্বব্যাপী বাজারজাত করার উদ্দেশ্য নিয়েই বানিয়েছে। আপনি বাংলা ভাষায় গেমটির ডিজিটাল ব্যানার, পোস্টার পেতে পারেন। কিন্তু গেমের চরিত্রগুলো এবং ব্যাকগ্রাউন্ড কণ্ঠগুলো সব গতানুগতিকভাবে ইংরেজিতেই কথা বলবে।

গেমটির খেলোয়ার এবং ডেভেলপারদের পারস্পরিক আলোচনার মাধ্যমে পুরো গেমপ্লে এখনো উন্নত করা হচ্ছে, সংযোজিত হচ্ছে নতুন ফিচার। প্রতিযোগিতামূলক এই গেমটির নির্মাণ শুরু হয় ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে। গেমটিকে পরিপূর্ণ ভাবে সব রকম টেকনিক্যাল সমস্যা মুক্ত করে বাজারে ছাড়ার চিন্তা ডেভেলপার প্রতিষ্ঠানের।

ইন্টারনেট কানেকশনের সাথে লাইভ গেমটি খেলায় আপনার আনন্দ আরো দ্বিগুণ বাড়িয়ে দিবে।

ডেক্সটপ কম্পিউটার ছাড়াও আপনি অ্যানিহিলেশন গেমটি খেলতে পারবেন স্টিম, প্লেস্টেশন কন্সোল্স, এক্সবক্স, অ্যান্ড্রয়েড এবং আইওএস ডিভাইসগুলোতে। অবশ্য প্লেস্টেশন, এবং এক্সবক্সে গেমটির সহজলভ্যতা নির্ভর করছে গেমারদের চাহিদার ওপর। চাহিদা বাড়লে ক্রাইসিস এন্টারটেইনমেন্ট অবশ্য দু’টি প্ল্যাটফর্মের জন্যই গেমটি প্রকাশ করবে।

গেমটির নেপথ্যে যারা রয়েছেন
গেমটির প্রধান ডেভেলপার সিয়াম হাসান উদয়। তিনি বর্তমানে আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি  বাংলাদেশ-এ সফ্টওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ব্যাচেলর ডিগ্রিতে পড়ছেন। এর আগে তিনি রাইজআপ ল্যাব্স নামক একটি প্রতিষ্ঠানের গেম ডেভেলপার ছিলেন।

গেমটির ফাইন্যান্স এবং মার্কেটিং ডিরেক্টর শাদমান সিয়ান। গেম ম্যানেজমেন্টে আছেন ফারুক ইমরান। অ্যানিহিলেশনের থ্রিডি ও লেয়ার ডিজাইনার হিসেবে কাজ করেছেন নাহিদ উল কবির। আর প্রোগ্রামার হিসেবে আছেন মিসবাহ হাবিব।

গেমটি বাংলাদেশের গেমারদের নিকট চূড়ান্তভাবে উন্মুক্ত হবে সহকারী প্রতিষ্ঠান ক্রাইসিস এন্টারটেইনমেন্ট লিমিটেডের ব্যানারে।

গেম শিল্পে অ্যানিহিলেশনের সম্ভাবনা
টিজার এবং ট্রেইলার বের হবার পর পরই গেমটি অনেক সমালোচনার সম্মুখীন হয়েছে। অনেকেই দাবী করেছেন যে, গেমটি দুর্বোধ্য, গেমপ্লে নিম্নমানের। গেমপ্লে থেকে ব্যাকগ্রাউন্ড পরিবেশটাকেই বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়েছে ট্রেইলারে। চরিত্র ও স্কিলগুলোর আধিক্য নিয়েও অনেকে প্রশ্ন তুলেছেন।

কিন্তু সবকিছুর ওপরে বাংলাদেশ এখনো এই শিল্পে হামাগুড়ি দিয়ে এগোচ্ছে। সে দিক থেকে ভাবলে, এরকম উচ্চ গ্রাফিক্স কোয়ালিটি সম্পন্ন গেম দেশের জন্য এক যুগান্তকারী সৃষ্টি। ২০০২ সালে ঢাকা রেসিং, ২০০৪ সালে অগ্নিশিখা, ২০১১ সালে রেড ক্লাউড-৭১, ২০১২ সালে লিবারেশন-৭১, এভাবে গেমিংয়ের জগতে বাংলাদেশের প্রাথমিক যাত্রা অব্যাহত থাকে। সে সময় থেকে এখন অ্যানিহিলেশনের আবির্ভাবে নিমেষেই স্বীকার করা যায় যে, বাংলাদেশে গেম ডেভেলপমেন্ট সঠিক দিকেই এগোচ্ছে। এখন এই গেমটিকে টেক্কা দিতে হচ্ছে কল অফ ডিউটি, ফ্রি ফায়ার-এর মত জনপ্রিয় গেমগুলোকে। এভাবে চলতে থাকলে একদিন বাংলাদেশের গেমগুলো বিশ্বমানের প্রথম সাড়িতে অবস্থান করবে বলে আশা করা যায়। সে সূত্রে অ্যানিহিলেশনকে বিশ্বমানের গেমের মাইলস্টোনের অগ্রদূত বলা যেতে পারে। নিঃসন্দেহে তা বাংলাদেশে গেম শিল্পে আরো নতুনত্ব আনার পথিকৃৎ হয়ে থাকবে।

শেষাংশ
বাংলাদেশের গেম ডেভেলপমেন্ট নিয়ে বৃহৎ পরিসরে কাজ না হলেও অ্যানিহিলেশন অগ্রদূত হিসেবে তাৎপর্যপূর্ণ অবদান রাখবে। ফলশ্রুতিতে দেশের সফ্টওয়্যার নিয়ে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীরা পাবে পেশাগতভাবে অনুশীলনের জন্য একটি প্ল্যাটফর্ম।

শুধু তাই নয়, গেম শিল্পে নিজের ক্যারিয়ার তৈরি করতে তাদের দেশের বাইরে যেতে হবে না। বরং গেমের সমৃদ্ধশালী গ্রাহকদের সেবা সুনিশ্চিত করতে নতুন প্রতিষ্ঠান সৃষ্টির মাধ্যমে সুযোগ বাড়বে নতুন কর্মসংস্থানের। এরই ধারাবাহিকতায় বিশ্ব মানচিত্রে গেম ডেভেলপার দেশ হিসেবে বাংলাদেশ নিজের জায়গা করে নিতে পারবে।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত