আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলাম: মানবকল্যাণে ১১৬ বছর

প্রকাশ : ০৫ সেপ্টেম্বর ২০২১, ১৭:৪৮

ইসলামী মানবতাবাদী ভাবধারায় প্রতিষ্ঠিত জনকল্যাণমূখী সংস্থা আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলাম। মুসলমানের বেওয়রিশ লাশ দাফনের উদ্দেশ্যে সংস্থাটির গঠন করা হলেও আটকে থাকেনি ধর্মীয় ধরাবাঁধায়। ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সকলের পাশেই থাকতে চায় আঞ্জুমান। শুধু একটা ফোন কলেই লাশের পাশে পৌছে যায় আঞ্জুমানের লাশবাহী গাড়ী। অসহায় ও দুস্থ রোগীদের বিপদে এগিয়ে যেতে ৪০টিরও বেশি অ্যাম্বুলেন্স রয়েছে তাদের। যার ফলে আঞ্জুমানের নিষ্ঠা ও সততার কর্মবৈচিত্র ছড়িয়ে যাচ্ছে দেশ থেকে দেশান্তরে।

লাশ দাফন ছাড়াও লাশ বহনে ফ্রি-অ্যাম্বুলেন্স ও ফ্রিজিংভ্যান সেবা, এতিমখানা, অবৈতনিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, মুক্তিযোদ্ধাদের ভাতা প্রদান, নারীদের আত্মনির্ভর করে তুলতে নিজস্ব উদ্যোগে সেলাই প্রশিক্ষণ এবং সেলাইমেশিন প্রদানসহ অগণিত কার্যক্রম পরিচালনা করে চলেছে এ সংস্থাটি।

লাশ দাফন করছেন আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামের কর্মীরা। ছবি: আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলাম

জাতীয় দূর্যোগে ভূক্তভোগী মানুষের জন্য ত্রাণ কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকে আঞ্জুমান। এছাড়া করোনাকালীন মূহুর্তে করোনাক্রান্ত লাশ পরিবহন, গোসল করানো, দাফন করানোকে দায়িত্ব হিসেবে নিয়ে নিষ্ঠার সাথে পালন করেছে আঞ্জুমান। এছাড়া করোনায় ত্রাণ ও বিভিন্ন সেবা প্রদানের মাধ্যমে থেকেছে আয়-রোজগারহীন ও দুঃস্থ মানুষের পাশে।

আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলাম
১৯০৫ সালে যাত্রা শুরু করে আঞ্জুমান। তৎকালীন ভারতের নেতৃস্থানীয় মুসলিম চিন্তাবিদদের সহায়তায় সুরাটবাসী মুসলমান সমাজ কর্মী ইব্রাহিম মোহাম্মদ ডুপ্লের উদ্যোগে ভারতের কলকাতায় আঞ্জুমানের কার্যক্রম শুরু হয়। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক প্রভূত্ব স্থাপনের প্রথম দিকে মুসলমানদের প্রতি ব্রিটিশদের ঘৃণা ও বৈরী মনোভাবের কারণে সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং শিক্ষা-দীক্ষার ব্যাপারে ক্রমবর্ধমান ধ্বংসের মুখে এসে দাঁড়ায় মুসলিম জাতি। সে সময় ভারতীয় মুসলমানদের মাঝে একটি উন্নয়নমুখী বিপ্লবের প্রয়োজন অনুভূত হয় তীব্র ভাবে।

বীর মুক্তিযোদ্ধা আলহাজ্ব এম এ খালেক ও পরিবারবর্গের আঞ্জুমানের কাকরাইল কার্যালয়ে দানকৃত শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত অ্যাম্বুলেন্স। আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামের যেকোনও সেবাকেন্দ্রে কল করলেই পৌছে যাবে অ্যাম্বুলেন্স সার্ভিস | ছবি: আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলাম

বলা যায়, কলকাতায় এ বিপ্লবের শিক্ষা ও সমাজ-সংস্কৃতি ভিত্তিক সূচনা হয় আঞ্জুমান মফিদুল ইসলামের প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। শেঠ ইব্রাহিম মোহাম্মদ ডুপ্লে ছাড়াও সংস্থাটির পেছনে অক্লান্ত পরিশ্রম ছিল মৌলভী মোহাম্মদ ইসা খান, মৌলভী মোহাম্মদ হেদায়েত হোসেন, মুনসী চৌধুরী আমানুল্লাহ, মুনসী হাফিজ নাজির আহমদ সাহেব, মুনসী বদরুজ্জামান বদর, মুনসীন ওয়াজীশ আলী, মুনসী আব্দুল মোকারেম ফজলুল ওহাব, মুনসী কোরবান আলী, মৌলভী আব্দুল কাভী, মৌলভী সৈয়দ মকবুল আহমেদ প্রমুখ স্বনামধন্য ব্যক্তিদের।

১৯৪৭ সালের দেশভাগের পরপরই প্রথম আহবায়ক এ এফ এম আবদুল হক ফরিদীর (এডিপি, ইস্টবেঙ্গল) হাত ধরে ১৯৫০ সালের ১ জানুয়ারি গঠিত হয় ঢাকায় প্রথম পূর্ণাঙ্গ কমিটি। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের স্বাস্থ্যমন্ত্রী হবিবুল্লাহ বাহার সংস্থাটির ঢাকা কার্যালয়ের প্রথম সভাপতি নির্বাচিত হন।

'৭১ এ দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালে বিচারপতি সৈয়দ এ বি মাহমুদ হোসেনের সভাপতিত্বে নতুন উদ্যমে কার্যক্রম শুরু করে আঞ্জুমান। সর্বশেষ ২০১৯ সালের জুন মাসে সভাপতি নির্বাচিত হয়ে এখন পর্যন্ত দায়িত্বরত আছেন প্রাক্তন পররাষ্ট্র সচিব, রাষ্ট্রদূত (অব.) মুফলেহ আর ওসমানী।

কার্যক্রম
১৯০৫ সালের বেওয়ারিশ লাশ দাফন থেকে কার্যক্রম শুরু করলেও ধীরে ধীরে নিজেদের পরিসর বাড়াতে থাকে আঞ্জুমান। লাশ বহনে ফ্রি-অ্যাম্বুলেন্স ও ফ্রিজিংভ্যান সেবা, এতিমখানা, অবৈতনিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, মুক্তিযোদ্ধাদের ভাতা প্রদান, নারীদের আত্মনির্ভর করে তুলতে নিজস্ব উদ্যোগে সেলাই প্রশিক্ষণ- সেলাই মেশিন প্রদানসহ নানাবিধ কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে জনকল্যানে নিয়োজিত এ সংস্থাটি।

লাশ গোসল করানো হচ্ছে আঞ্জুমানের নিজস্ব সেবাকেন্দ্রে | ছবি: আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলাম

লাশ পরিবহন ও দাফন সেবা
একশ বছরের বেশি সময় ধরে হাসপাতালের মর্গে স্বজনহারা বেওয়ারিশ লাশ বিনামূল্যে দাফনের মানবিক দায়িত্ব পালন করে আসছে আঞ্জুমান।

সংস্থাটির তথ্যমতে, ২০১০ সাল থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত ১১ বছরে ৫০৫৬টি লাশ পরিবহন করেছে তারা। এই সময়ে দাফন করা হয়েছে ১২ হাজার ৯ শত আটটি বেওয়ারিশ লাশ। এর সঙ্গে ৫১২০টি ওয়ারিশ লাশ ও দাফন করেছে আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলাম।

করোনাকালীন এ মহাসংকটের সময়েও দমে থাকেনি আঞ্জুমান। ভাইরাস সংক্রমণের ভয়ে আত্মীয় স্বজনেরা যখন লাশ দাফনে ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে, এইসব লাশেদের মহাজাগতিক ঠিকানায় হস্তান্তর করে আঞ্জুমান। করোনাক্রান্ত রোগীদের লাশ দাফনের গুরুদায়িত্বপালন করে তারা।

আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলাম এর মুগদাপাড়া সেবাকেন্দ্রে নিজস্ব লাশবাহী ফ্রিজিং ভ্যান | ছবি: আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলাম

চিকিৎসা সেবা, ভাতা ও ফ্রি অ্যাম্বুলেন্স
লাশ পরিবহন, দাফন, দুস্থ ও অসহায় মানুষদের চিকিৎসা প্রদানের পাশাপাশি বিশ্ব ইজতেমায় আগত মুসল্লিদের মধ্যে চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করতে প্রতিবছর গঠন করা হয় অস্থায়ী মেডিক্যাল ক্যাম্প। অসহায় ও বিধবা মহিলাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা ও সাহায্যেও কাজ করছে তারা। গরীব ও বয়স্কদের ভাতা প্রদানের পাশাপাশি অসচ্ছল মুক্তিযোদ্ধাদের মাসিক ভাতার ব্যবস্থাও করে থাকে সংস্থাটি। এছাড়াও সহায়-সম্বলহীন পরিবারের সদস্যদের মধ্যে শীতবস্ত্র বিতরণ, দুর্যোগাক্রান্ত এলাকায় চিকিৎসা সেবা ও ত্রাণ সহায়তাও প্রদান করে মানবতাবাদী এ সংস্থাটি।

এছাড়া ঢাকা মহানগরীতে গরীব রোগীদের জন্য বিনামূল্যে প্রদান করে অ্যাম্বুলেন্স সার্ভিস। ৪০টি অ্যাম্বুলেন্স ও ফ্রিজিংভ্যানের মাধ্যমে লাশ ও রোগী পরিবহন করা হয় বিনামূল্যে।

শিক্ষাসেবা ও এতিমখানা
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে শিক্ষা সেবায় এগিয়ে যাচ্ছে আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলাম। বিশেষ করে অসহায়, এতিম ও দরিদ্রদের শিক্ষায় হাত বাড়িয়েছে তারা। ঢাকায় ও ঢাকার বাইরে এ সংস্থাটির রয়েছে ৯টি এতিমখানা। আঞ্জুমান জামিলুর রহমান ইসলামিয়া জুনিয়র হাইস্কুল এবং আঞ্জুমান রায়হানা মাহবুব নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয় নামে দুটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিচালনা করছে সংস্থাটি।

রাজধানীর গেন্ডারিয়ার এস কে দাস রোডে অবস্থিত আঞ্জুমান এ বি এম জি কিবরিয়া বালিকা হোম। সেবাকেন্দ্রটি ২৯ জন বালিকা নিয়ে ১৯৬০ সালে স্থাপিত হয় | ছবি: ইমদাদুল ইসলাম লিমন

অসচ্ছল শিক্ষার্থীদের কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষিত করতে আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলাম টেকনিক্যাল ইন্সিটিটিউট ও আঞ্জুমান রায়হানা মাহবুব টেকনিক্যাল ইন্সিটিটিউট নামে দুটি কারিগরি প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করছেন তারা। এছাড়া নিজস্ব অর্থায়নে রাজধানীর শ্যামলীতে একটি পলিটেকনিক ইন্সটিটিউট স্থাপন করেছে জনকল্যানমূখী এ সংস্থাটি।

মানবসম্পদ উন্নয়ন
মানবসম্পদ উন্নয়নে অক্লান্তভাবে কাজ করে যাচ্ছে আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলাম। শিক্ষার্থীদের কারিগরি শিক্ষায় গড়ে তুলতে টেকনিক্যাল ইন্সটিটিউটের আওতায় বিভিন্ন এলাকায় প্রশিক্ষণ কর্মসুচি গ্রহণ করা হচ্ছে। নারীদের আত্মনির্র্ভশীল করে তুলতে সেলাই প্রশিক্ষণ ও নারী উদ্যোক্তা তৈরীতে প্রদান করা হচ্ছে সেলাই মেশিনসহ নানাবিধ সহায়তা।

আঞ্জুমান রিদওয়ান রহমান টেকনিক্যাল ইনস্টিটিউটে বেসিক ট্রেড কোর্সের ড্রেস মেকিংয়ে প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন একজন প্রশিক্ষক। ছবি: ইমদাদুল ইসলাম লিমন

রাজধানীতে আঞ্জুমানের কিছু প্রতিষ্ঠান

আঞ্জুমান রিদওয়ান রহমান টেকনিক্যাল ইন্সটিটিউট
শতভাগ পাশের সাফল্য নিয়ে কারিগরি শিক্ষার প্রসারে বিনামূল্যে সেবা দিয়ে যাচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি। ২০০৪ সালে গেন্ডারিয়া থেকে এর যাত্রা শুরু হলেও বর্তমানে রাজধানীর গোপীবাগে কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে। স্কুল ভবন নির্মাণের জন্য জমিটি দান করেছেন মরহুম রিদওয়ান রহমানের মা ও আঞ্জুমানের বর্তমান কমিটির সদস্য ডা. লুৎফুন নাহার। প্রতিষ্ঠানটিতে অধ্যক্ষের দায়িত্বে আছেন মির্জা আবদুল হাই।

আঞ্জুমান রিদওয়ান রহমান টেকনিক্যাল ইনস্টিটিউটে এসএসসির (ভোকেশনাল) আরএসি ট্রেডের ক্লাস নিচ্ছেন একজন শিক্ষক। ছবি: ইমদাদুল ইসলাম লিমন

প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোতে এ প্রতিষ্ঠানটির মূল কোর্স এসএসসি (ভোকেশনাল)। যাতে কম্পিউটার ও তথ্যপ্রযুক্তি, ড্রেস মেকিং, জেনারেল ইলেক্ট্রিক্যাল ওয়ার্কস ও রেফ্রিজারেশন অ্যান্ড এয়ার কন্ডিশনিং; এ চারটি ট্রেডে হাতে কলমে শিক্ষাদান করা হয়। বর্তমানে ৩৪০ জন শিক্ষার্থীর জন্য ১৩ জন অভিজ্ঞ শিক্ষক রয়েছেন। 

একই সাথে প্রতিষ্ঠানটিতে ড্রেস মেকিং অ্যান্ড টেইলারিং, জেনারেল ইলেক্ট্রিশিয়ান ও রেফ্রিজারেশন অ্যান্ড এয়ার কন্ডিশনিং এ তিন বিষয়ে বেসিক ট্রেড সার্টিফিকেট কোর্স রয়েছে। যেখানে বিনামূল্যে সাধারণ যে কেউ প্রশিক্ষণ নিতে পারেন। এ তিনটি ট্রেডে মোট শতাধিক শিক্ষার্থী একই সময়ে প্রশিক্ষণ নিতে পারেন। প্রশিক্ষণ শেষে তাদের হাতে শিক্ষা সনদ তুলে দেওয়া হয়। 

আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলাম মোটর ড্রাইভিং স্কুল
২০১৮ সাল থেকেই আঞ্জুমানের গোপীবাগস্থ আঞ্জুমান রিদওয়ান রহমান টেকনিক্যাল ইন্সটিটিউটেই বিআরটিএ’র অনুমোদিত এই কার্যক্রম পরিচালিত হয়ে আসছে। ছয় মাসের এ কোর্সটিতে ৯টি ব্যাচে এতিম, দুঃস্থ, অসহায় ও নিম্নবিত্ত পরিবারের মোট ৭৭ জনকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। তাত্তি¡ক ও ইঞ্জিনের উপর ব্যবহারিক প্রশিক্ষণ প্রদানের পর প্রশিক্ষণার্থীদেরকে রাস্তায় গাড়ি চালানোর প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়।

আঞ্জুমান জামিলুর রহমান ইসলামিয়া জুনিয়র হাইস্কুল
গেন্ডারিয়ায় অবস্থিত এই জুনিয়র স্কুলটি প্রতিষ্ঠা করা হয় ১৯৭৭ সালে। সম্পূর্ণ বিনামূল্যে এ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির দায়িত্বে আছেন প্রধান শিক্ষিকা তাহমিনা খাতুন। প্রথম শ্রেণি থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত ১৯৭ জন বালক ও ২৭০ জন বালিকা নিয়ে মোট ৪৬৭ জন শিক্ষার্থী রয়েছে এ প্রতিষ্ঠানে। শিক্ষার্থীদের সুষ্ঠ শিক্ষা নিশ্চিতের লক্ষ্যে বেতনভূক্ত শিক্ষক আছেন ১৪ জন।

গেন্ডারিয়ায় অবস্থিত আঞ্জুমান জামিলুর রহমান ইসলামিয়া জুনিয়র হাই স্কুলের শিক্ষকবৃন্দ। বালক ও বালিকা হোমের শিশুরা এখানে অষ্টমশ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করতে পারে | ছবি: ইমদাদুল ইসলাম লিমন

জানা যায়, প্রতিষ্ঠানটিতে আঞ্জুমান থেকেই বেড়ে ওঠা এক শিক্ষার্থী সোনিয়া জাফরিন কাজ করছেন অফিস সহকারী হিসেবে। আবেগাপ্লুত হয়ে জানান তার জীবনের কথা।

সোনিয়া বলেন, আমি দশ বছর বয়স থেকেই আঞ্জুমান বালিকা হোমে (এতিমখানা) আছি। ১০১০ সালে আমি এসএসসি পাস করে আঞ্জুমানের পলিটেকনিক্যাল ইন্সটিটিউটে কম্পিউটারে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিং এ ভর্তি হই। সম্পূর্ণ খরচ আঞ্জুমানই বহন করেছে।

আঞ্জুমানের সাবেক এ শিক্ষার্থী বলেন, পড়াশোনা শেষ করার পর ২০১৫ সালে আঞ্জুমানই আমাকে এ প্রতিষ্ঠানে চাকরী দেয়। এখন আমি এ প্রতিষ্ঠানের অফিস সহকারী হিসেবে চাকরীরত আছি। 

আঞ্জুমান রোকসানা হুদা বালিকা হোম (এতিমখানা)
রাজধানীর ফার্মগেটের ৩/বি, তেজতুরী বাজার রোডে অবস্থিত প্রতিষ্ঠানটি ২০ জন বালিকা নিয়ে ২০১৮ সালে স্থাপিত হয়। অর্ধশতাধিক আসন বিশিষ্ট এ হোমে বর্তমানে আছে ৭ থেকে ১৬ বছর বয়সী ১৭ জন বালিকা। এখানে পড়াশোনা করানোর জন্য রয়েছেন ২ জন অভিজ্ঞ খন্ডকালীন হোম টিউটর। আর সার্বিক তত্ত্বাবধানের জন্য দায়িত্বরত আছেন হোম সুপার ফাহমিদা রশিদ ইভা।

ছবির বামদিক থেকে সায়মা আক্তার (প্রথম শ্রেণি), মরিয়ম আক্তার (শিশু শ্রেণি) ও সুরাইয়া আক্তার (শিশু শ্রেণি) । ওদের প্রত্যেকের চোখেই দারুণ স্বপ্ন। শিশুকাল থেকেই ওরা একসাথে হোমে বড় হচ্ছে | ছবি: ইমদাদুল ইসলাম লিমন

হোমের সরকারি ‘ফুড পিরামিড’ মাফিক তিন বেলা খাবার, নাস্তা ও পর্যাপ্ত বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা রয়েছে। খাদ্য়, বস্ত্র, চিকিৎসা, বিনোদনের জন্য রয়েছে পর্যাপ্ত ব্যবস্থা। বিশেষ উৎসবে রয়েছে পছন্দমত পোষাক, প্রসাধনী আর বিশেষ খাবারের আয়োজন।

রাজধানীর গেন্ডারিয়ার রজনী চৌধুরী রোডে আঞ্জুমান শেঠ ইব্রাহিম মোহাম্মদ ডুপ্লে বালক হোম। সেবাকেন্দ্রটি ২০ জন বালক নিয়ে ১৯৬০ সালে স্থাপিত হয় | ছবি: ইমদাদুল ইসলাম লিমন

আঞ্জুমান শেঠ ইব্রাহিম মোহাম্মদ ডুপ্লে বালক হোম (এতিমখানা)
গেন্ডারিয়ার ৪৪, রজনী চৌধুরী রোডে অবস্থিত প্রতিষ্ঠানটি ২০ জন বালক নিয়ে ১৯৬০ সালে স্থাপিত হয়। একশর অধিক আসনসংখ্যা বিশিষ্ট হোমে বর্তমানে আছে ৭-১৯ বছর বয়সী ৬৫ জন বালক। হোমে পড়াশোনা করানোর জন্য রয়েছেন ৯ জন অভিজ্ঞ খণ্ডকালীন হোম টিউটর। আর সার্বিক তত্ত্বাবধানের জন্য হোম সুপার রইসুল ইসলামের নেতৃত্বে রয়েছে ৯ জন কর্মচারী। হোমে সরকারি ‘ফুড পিরামিড’ মাফিক তিন বেলা খাবার, নাস্তা ও পর্যাপ্ত বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা রয়েছে। স্বাস্থ সুরক্ষা নিশ্চিতের লক্ষ্যে আছে খেলাধুলার জন্য মাঠ, ইনডোর গেইমে কেরাম, টেবিল টেনিস, দাবা, লুডো ইত্যাদি। এছাড়াও বাচ্চাদের চিকিৎসা, প্রয়োজনীয় শিক্ষা উপকরণ, উৎসবে নতুন পোষাক, বিশেষ খাবার প্রদানসহ সাংস্কৃতিক ও ক্রীড়ানুষ্ঠানের মত নানান সৃজনশীল অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।

বিশ্রাম নিচ্ছে আঞ্জুমান শেঠ ইব্রাহিম মোহাম্মদ ডুপ্লে বালক হোমের বাচ্চারা | ছবি: ইমদাদুল ইসলাম লিমন

এই হোম থেকে পড়াশোনা করে অনেকে এখন ভালো ভালো অবস্থানে আছেন। নাজমুল হাসান নামের এই হোমের একজন শিক্ষার্থী বর্তমানে মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিং-এ অধ্য়য়নরত।  

আঞ্জুমান এ বি এম জি কিবরিয়া বালিকা হোম (এতিমখানা)
গেন্ডারিয়ার ৫, এস কে দাস রোডে অবস্থিত প্রতিষ্ঠানটি ২৯ জন বালিকা নিয়ে ১৯৬০ সালে স্থাপিত হয়। শতাধিক আসন বিশিষ্ট এ হোমে বর্তমানে আছে ৭ থেকে ১৯ বছর বয়সী ১৩০ জন বালিকা। এখানে পড়াশোনা করানোর জন্য রয়েছেন ১০ জন অভিজ্ঞ খন্ডকালীন হোম টিউটর। আর সার্বিক তত্ত্বাবধানের জন্য হোম সুপার নুসরাত জাহানের নেতৃত্বে রয়েছে ৯ জন কর্মচারী।

বিকেলে এক সাথে বসে টেলিভিশন দেখছে আঞ্জুমান এ বি এম জি কিবরিয়া বালিকা হোমের বাচ্চারা | ছবি: ইমদাদুল ইসলাম লিমন

বালক হোমের মতই সরকারি ‘ফুড পিরামিড’ মাফিক তিন বেলা খাবার, নাস্তা ও পর্যাপ্ত বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা রয়েছে বালিকা হোমেও। এখানেও খাদ্য়, বস্ত্র, চিকিৎসা, বিনোদনের জন্য রয়েছে পর্যাপ্ত ব্যবস্থা। রয়েছে বিশেষ উৎসবে পছন্দমত পোষাক, প্রসাধনী আর বিশেষ খাবারের ব্যবস্থা।

এই হোম থেকে পড়াশোনা করে অনেক এতিম বালিকারা এখন ভালো ভালো জায়গায় আছেন। সুমি আক্তার নামের এক প্রাক্তন শিক্ষার্থী আঞ্জুমানের অর্থায়নে মিডওয়েফারি ও নার্সিং ডিপ্লোমা শেষ করে রাজধানীর ইব্রাহীম কার্ডিয়াক হাসপাতালে ফাস্ট জুনিয়র এইড নার্স হিসেবে কর্মরত আছেন।

নদী আক্তার। আঞ্জুমান রিদওয়ান রহমান টেকনিক্যাল ইন্সটিটিউটের ষষ্ঠ শ্রেণির শিক্ষার্থী। শিশুকালেই হারিয়েছে তার বাবাকে। অর্থনৈতিক সংকটে পড়ে নদীকে আঞ্জুমানে দিয়ে যান তার মা। নদীদের সমস্ত চাহিদা পূরণ করার চেষ্টা করে আঞ্জুমান | ছবি: ইমদাদুল ইসলাম লিমন

এই প্রতিষ্ঠানে বেড়ে ওঠা আরেকজন সোনিয়া আক্তার। তখন সোনিয়ার শিশুকাল। সড়ক দূর্ঘটনার শিকার হন তার গাড়ি চালক বাবা। ধনুষ্টংকার হয়ে গৃহবন্দি হয়ে পড়েন তিনি। সংসারের হাল ধরতে রানা প্লাজায় গার্মেন্টসে চাকরি নেন ছোট্ট সোনিয়ার মা। বছর যেতে না যেতেই ধ্বসে পরে রানা প্লাজা। রানা প্লাজার শত শত ভুক্তভোগী পরিবারের তালিকাতেই হারিয়ে যায় সোনিয়াদের নাম –যার করুন পরিণতিতে সোনিয়াদের আজ বাবা – মা থাকতেও বড় হতে হচ্ছে এতিমখানায়।

সোনিয়া আক্তার জানালেন তার জীবনের গল্প | ভিডিও: ইমদাদুল ইসলাম লিমন

“রানা প্লাজায় আহত নিহতদের অনেকের সন্তানই এখানে আছে।” সোনিয়া বলেন, “আমার আম্মুকে তিনদিন পর পাওয়া যায়। তারপরেই আমার আঞ্জুমানে আসা।”

৮ বছর বয়স থেকেই আঞ্জুমানের তত্ত্বাবধানে আছেন সোনিয়া। প্রথমে ছিলেন সাভারের নবীনগর হোমে। সেখানেই ‘ক্লাস এইট’ (অষ্টম শ্রেণি) পর্যন্ত পড়াশোনা করেছেন।

সোনিয়ার স্বপ্ন, ইঞ্জিনিয়ার হবে একদিন। এসএসসির পরে আঞ্জুমান রিদওয়ান রহমান টেকনিক্যাল ইন্সটিটিউট থেকে ডিপ্লোমা করে ভালো জায়গায় চাকুরীতে স্থায়ী হতে চায়। তিনি বলেন, পড়াশোনা করে ভালো রেজাল্ট করতে পারলে হোমের সুপার আপা বিএসসি’র জন্য তাদের সাহায্য করবেন।

‘হোম এ কেমন আছেন?’ জানতে চাইলে তিনি বলেন, “আমার বাবা আমার পড়াশোনা নিয়ে অনেক সহানুভূতিশীল ছিলেন। কষ্ট করে হলেও আমার পড়াশোনা চালানোর চেষ্টা করে যেতেন। কিন্তু একটা সময় গিয়ে অভাবের কারণে হয়তো ক্লান্ত হয়ে যেতেন। আর আমিও একটা মেয়ে। বাবার কষ্ট দেখে হয়তো আমি নিজ থেকে পড়াশোনাটা অফ (ছেড়ে) করে দিতাম।”

সোনিয়া আরও বলেন, “এখানে আমি অনেক ভালো আছি। চাইলেই সবকিছু পেয়ে যাই। আমি সবচেয়ে বেশি হ্যাপি (খুশি) যে, আমার পড়াশোনাটা চলছে।”

বিকেলে মাঠে খেলাধুলা করছে আঞ্জুমানের বাচ্চারা | ছবি: ইমদাদুল ইসলাম লিমন

আঞ্জুমানের তহবিল ও টাকার উৎস
মুসলমান ধর্মাবলম্বীদের যাকাত, ফেতরা, সাদকা নিয়েই চলা শুরু মানবকল্যানমূখী এ সংস্থাটির। পাশাপাশি নিজস্ব ট্রাস্টের ফান্ড, দান ইত্যাদির মাধ্যমেও আসে অর্থ। এছাড়াও আঞ্জুমানের নিজস্ব ভবন, বাড়ি, ব্যবসায়ীক প্রতিষ্ঠানসহ রয়েছে প্রচুর সম্পত্তি, যেগুলো মানবকল্যাণের স্বার্থে কারও না কারও দানকৃত সম্পদ।

গণভবনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত থেকে চেক গ্রহণ করছেন আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামের বর্তমান সভাপতি প্রাক্তন পররাষ্ট্র সচিব, রাষ্ট্রদূত (অব.) মুফলেহ আর ওসমানী। ছবি: আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলাম

আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামের একমাত্র নারী সহ-সভাপতি ও সাহস২৪.কম-এর ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মিতালী হোসেন বলেন, হিন্দু মুসলমান দাঙ্গার সময় মুসলমানদের পরে থাকা লাশগুলোর দাফনের উদ্যেশ্যে শুরু হলেও পরবর্তীতে সমাজ ও মানব উন্নয়নের অন্যান্য দিকেও কাজ করে আঞ্জুমান। 

তিনি বলেন, “শিক্ষা, আত্মকর্মসংস্থান, অসুস্থ ব্যক্তিকে অ্যাম্বুলেন্স সেবা দেওয়া, জাতীয় দূর্যোগে রিলিফ ওয়ার্কের জন্য বিশেষ কমিটির দ্বারা সহায়তামূলক কাজ করে থাকি আমরা। এই করোনাকালীন সময়েই পাঁচবারের মত বিভিন্ন জায়গায় খাদ্য সহায়তা দিয়েছে আঞ্জুমান।”

তিনি বলেন যে প্রতিটি এলাকার জন্য আঞ্জুমানের আলাদা আলাদা সার্ভিস সেন্টার (হেল্প ডেস্ক) করার চিন্তা আছে। যার যখন অ্যাম্বুলেন্স প্রয়োজন হয় কল দিলেই আঞ্জুমানের অ্যাম্বুলেন্স রোগী বা লাশের কাছে পৌছে যায়। এছাড়া আঞ্জুমান নিজস্ব একটা কবর স্থান করতে চায়।

আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামের এক আয়োজনে শিশুদের সাথে সংস্থাটির সহ-সভাপতি ও সাহস২৪.কমের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মিতালী হোসেন। (ছবির ডান দিকের প্রথম) ছবি: আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলাম

মিতালী হোসেন আরও বলেন, “আঞ্জুমানের আধুনিকায়ন হচ্ছে। আঞ্জুমানতো ইসলামি আইন অনুযায়ী চলে। তবে এখন কিছু কিছু বিষয় আমরা যোগ করেছি। একটা সময় শুধু মুসলিম কেন্দ্রিক ছিলো। এখন আমরা সব ধর্মকে নিয়ে –সব ধর্মের জন্যই কাজ করি। আমি নারী হয়ে এখানে আছি। এখানে এখন নারীরাও কাজ করতে পারে।”

সংস্থাটির তহবিল সম্পর্কে তিনি বলেন, “আঞ্জুমান যে টাকাটা খরচ করে সেটা সম্পূর্ণ দেশীয়। আমাদের এমনও ডোনার আছে যে দশ টাকা দেয়। একজন দাতাকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিলো, আপনিতো নিজেই ভিক্ষা করেন। আপনি দশ টাকা কেন দিয়ে গেলেন? উনি বলেছিলেন, আমি মরে গেলে আপনারাইতো আমাকে কবর দেওয়ার ব্যবস্থা করবেন। অতএব আমার এখানে কিছু দেওয়া উচিৎ।”

আঞ্জুমান জেআর টাওয়ারের নির্মাণ কাজ প্রক্রিয়াধীন। স্থাপনাটির কাজ সম্পন্ন হলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কার্যালয়গুলোকে একত্রে আনা হবে। এছাড়া টাওয়ারে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানকে ভাড়া দেওয়া হবে। যার সম্পূর্ণ অর্থ আঞ্জুমানের জনকল্যাণমুখী কাজেই ব্যয় করা হবে।

‘আঞ্জুমান টাওয়ার’ তৈরি সম্পন্ন হলে অনেক কাজ হাতে আছে তাঁদের। টাওয়ারটা হয়ে গেলে সবকিছুকে একত্রে নিয়ে আসা যাবে। কাজের আরও অগ্রগতি হবে।

পুরষ্কার
নিজস্ব কাজের গতি ও মানবাধিকার রক্ষায় নিয়োজিত থেকে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সুখ্যাতি অর্জন করেছে আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলাম। ১৯৯৪ সালে ইসলামিক ফাউন্ডেশন পুরষ্কার, ১৯৯৬ সালে স্বাধীনতা দিবস জাতীয় পুরষ্কারসহ সংস্থাটি অর্জন করেছে একাধিক পুরষ্কার। এছাড়া আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিস্বরুপ ১৯৯৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রের হিলটন হিউম্যানিটেরিয়ান প্রাইজ এর জন্য প্রাথমিকভাবে মনোনয়ন পায় আঞ্জুমান।

তথ্যসূত্র
১.
আঞ্জুমান মফিদুল ইসলাম | উইকিপিডিয়া বাংলা | সংগ্রহের তারিখ: ০৫ সেপ্টেম্বর ২০২১
২. ‘জীবনেও সাথী, মরণেও সাথী’ | আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলাম কর্তৃক প্রকাশিত সংকলন | প্রকাশকাল আগস্ট ২০২১

সাহস২৪.কম/এসটি/এসএ.

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত