লক্ষ্যহীন মানুষ জীবন নদীতে মাঝিহীন নৌকার মত
প্রকাশ : ২৭ মে ২০২৩, ১০:২৮

কথায় বলে মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়। কথাটি প্রতীকী অর্থে বলা হলেও- বাস্তবতা অনেকটা এরকমই। কেননা মানুষ যা আশা করে তা যদি সে বিশ্বাসে রূপান্তরিত করতে পারে তখনই স্বপ্ন পূরণ করা সম্ভব হয়। তাই স্বপ্ন বড় করে দেখতে হয়। বিশ্বাসের সাথে তা ধারণ করতে হয়। তারপর সেই স্বপ্ন পূরণের পথ তৈরি করতে হয়। স্বপ্ন মানে বাস্তবতার সিঁড়িপথ। স্বপ্ন মানে একটি গন্তব্য- যেখানে আপনি যেতে চান। বাস্তবিক স্বপ্ন ও চেষ্টা কখনোই ব্যর্থ হয় না। মার্কনি স্বপ্ন দেখতেন, স্রষ্টার শক্তিকে জয় করে কাজে লাগাবেন। তিনি যে ভুল স্বপ্ন দেখেননি তার প্রমাণ বেতার ও টেলিভিশন আবিস্কার। মার্কনি যখন দাবি করলেন তিনি তারের সাহায্য ছাড়াই বাতাসের মধ্য দিয়ে সংবাদ প্রেরণের পদ্ধতি আবিস্কার করেছেন, তখন তার বন্ধুরা তাকে মনস্তাত্বিক হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিল। তাই তার স্বপ্ন আর বিশ্বাসের ফলশ্রুতিতেই অসাধ্যকে সাধন সম্ভব হয়েছে।
তবে স্বপ্ন পূরণে, সফলতা অর্জনে সততা ও পরিশ্রমের কোন বিকল্প নেই। এর সাথে মেধা ও স্বপ্নের যোগ হলে সফলতা আসবেই। মনে রাখতে হবে কখনো অন্যকে ঠকিয়ে বড় হওয়া যায় না। এ প্রসঙ্গে একটি গল্প শুনুন। বাংলাদেশের অন্যতম সেরা কেয়া কসমেটিকস-এর স্বত্বাধিকারী আব্দুল খালিক পাঠান ছোট বেলায় স্বপ্ন দেখতেন ব্যবসা করে অনেক টাকার মালিক হবেন। তিনি যখন তৃতীয় শ্রেণী বা চতুর্থ শ্রেণীতে পড়েন তখন স্কুলে যাওয়ার সময় বাবা টিফিন বাবদ আট আনা বা বার আনা দিতেন।
তিনি সেই টাকা জমিয়ে চকলেট কিনতেন। বিস্কুট আর চকলেট রাস্তার পাশে বসে বিক্রি করলে কিছু লাভ হতো। এভাবেই লাভের লোভে পড়ে গেলেন তিনি। বন্ধুর সাথে শুরু করলেন মুরগির ব্যবসা। স্থানীয় বাজার থেকে কিনে দূরের বাজারে বিক্রি করতেন। লাভের টাকা খরচ করতেন না বলে মূলধন বাড়তে লাগল। কিন্তু সমস্যা বাঁধল অন্য জায়গায়। মুরগি ব্যবসায়ী হওয়াটা তার পরিবারে কেউই পছন্দ করতেন না। তাই তিনি মুরগি কিনে রাখতেন এক বন্ধুর বাসায়। একদিন বন্ধু এসে বললো মুরগিগুলো শেয়ালে নিয়ে গেছে। মুরগির কিছু পাখনা আর মায়াকান্না দিয়ে ভুলানোর চেষ্টা করলো বন্ধুটি। সব পুঁজি শেষ। কিছুদিন পর তিনি নানা বাড়ী গেলেন। বহু কষ্টে অল্প কিছু টাকা যোগার করলেন। নতুনভাবে ব্যবসা শুরু করলোন। ঠিক করলেন এবার আর কোন অংশীদার নয়। পাইকারী কিনে রাস্তার পাশে বসে খুচরা বিক্রি করতে লাগলেন। পরে স্বাধীনতার যুদ্ধের অটো-প্রমোশনটা বাঁধ সাধলো ব্যবসায়। এক লাফে ক্লাস ফোর থেকে সিক্স-এ উঠলেন।
বাবার কড়া হুকুম- ‘অনেক হয়েছে আর নয়, পান-বিড়ি বিক্রি বাদ দিয়ে মন দিয়ে লেখাপড়া কর।’ সুতরাং ব্যবসার অদম্য ইচ্ছাটাকে মনের খাঁচায় পুরে রেখে পড়ালেখায় মনোনিবেশ করলেন। ১৯৭৮সালে মেট্রিক পাস করলেন। তারপর প্রেম এবং প্রেম থেকে বিয়ে।
কোনো পক্ষই মানল না। স্ত্রীর জমানো ৬০০ টাকা হাতে তুলে দিল। এই টাকাই তাকে নতুন করে স্বপ্ন দেখালো। শুরু করলেন লাকড়ির ব্যবসা। স্ত্রী তার পরিবার থেকে পাওয়া গয়নাটি বিক্রি করে হাজার পাঁচেক টাকা হলো। পুকুর লিজ নিয়ে রুই মাছের পোনা ছাড়লেন।এই পোনা বড় হতে লাগবে তিন বছর। অতদিন ধৈর্য ধরার মত সময় বা সামর্থ কোনটাই তার ছিলো না।
এক বছরের মাথায় সব বিক্রি করে আবার শুরু করলেন লাকড়ির ব্যবসা। অতপর শ্বশুর মহাশয়ের মন নরম হলে তিনি তার ইটের খোলায় চাকরি দিলেন। বেতন ৬০০টাকা। কিন্তু সেখানেও বেশিদিন কাজ করা হলো না। মাথায় ছিলো ব্যবসার ভাবনা। অনেক টাকার মালিক হওয়ার স্বপ্ন। চাকরি ছেড়ে কিস্তিতে প্রগতি থেকে একটা ট্রাক কিনলেন। ৪০ হাজার নগদ, বাকিটা সুদে পরিশোধ করতে হবে।
দিনে ড্রাইভার আর রাতে নিজে চালিয়ে দ্বিগুণ আয় করতে লাগলেন। ৬ মাসে বেশ কিছু পুজি তৈরি হলো। শ্বশুর সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিলেন। ২ লাখ টাকা ঋণ দিলেন পরের বছর সোনালী ব্যাংক থেকে আরো ৩ লাখ টাকা নিয়ে দাঁড়িয়ে গেল পাঁচটা ইট ভাঁটা।
তারপরের স্বপ্ন নিটিং এন্ড ডাইং গার্মেন্টেস করার। ভারত থেকে ১৮টি নিটিং মেশিন কিনে নিয়ে কাজ শুরু হলো। এক পর্যায়ে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ সবকিছু দেখে গিয়ে ঋণ বরাদ্দ করলেন ১ কোটি ৫ লাখ টাকা। এভাবেই স্বপ্নের জাল ছড়িয়ে দিলেন তিনি।
এখন এই শিল্প প্রতিষ্ঠান থেকে প্রতি বছর কাপড় রপ্তানি হয়। প্রায় ৫ হাজার লোকের কর্মসংস্থান হয়েছে। সবশেষে হাত দিয়েছেন কসমেটিক ব্যবসায়। কেয়া নারকেল তেল, পাউডার আর সাবান দিয়ে। এখন কেয়া কসমেটিকস দেশের একটি স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠান। এই গল্পের মাধ্যমে প্রমাণিত হয়- মানুষ তার আশার সমান সুন্দর ও বিশ্বাসের সমান বড় হতে পারে।
লক্ষ্যহীন মানুষ জীবন নদীতে সে মাঝিহীন নৌকার মত। নদীতে নৌকা যেমন এদিক সেদিক ঘুরাঘুরি করে কিন্তু তীরে ভিড়তে পারে না তেমনি মানুষও হোঁচট খেতে খেতে এগোয় বটে তবে যেহেতু তার কোন গন্তব্য জানা নেই তাই কোথাও পৌঁছাতে পারে না।
জীবনের জন্য যেমন বায়ুর প্রয়োজন, তেমনি জীবনে বড় হওয়ার জন্য প্রয়োজন স্বপ্নের। স্বপ্ন ছাড়া কেউই হঠাৎ সফল হয় না। বাস্তব স্বপ্ন ও চেষ্টা কখনোই ব্যর্থ হয় না। যদি স্বপ্নকে বিশ্বাসে রূপান্তরিত করতে পারা যায় তাহলে তা অর্জনও করা যায়। এই জীবনের চলার পথে মানুষ মাত্রই স্বপ্ন দেখে। লক্ষ্য করুন আমরা সবাই সাফল্য চাই।
সকলে জীবনে সেরা জিনিসটি চাই। কেউই সাদামাটা জীবন চাই না। একবার ভাবুন তো- বিশাল এই পৃথিবীতে দূর মহাকাশের নক্ষত্র থেকে আলো এসে পড়ে। আমরা সবাই এই পৃথিবীর প্রদর্শনীতে অংশ নিচ্ছি মাত্র কিছু সময়ের জন্য যে সময়টা খুব বেশীও নয় আবার খুব কমও নয়।
এই সময়কে নিজের ইচ্ছে মতো সাজিয়ে নিতে দরকার সুপরিকল্পিত স্বপ্নের। যা আপনাকে সফল হতে সাহায্য করবে। আসল কথা হচ্ছে যে মানুষ প্রতিকুলতা এড়িয়ে একাকী চলতে শুরু করে সে-ই পথ পেয়ে যায়, সে-ই এগিয়ে যায়। আসলে স্বপ্ন ছাড়া মানুষ বাঁচতে পারে না।
স্বপ্নই মানুষকে জীবন যুদ্ধে লড়াই করার ক্ষমতা প্রদান করে। স্বপ্ন না থাকলে আজ পৃথিবীতে কোন আবিষ্কার হত না।
ঘুমের মধ্যে সবাই স্বপ্ন দেখে কিন্তু আমি খালি চোখে স্বপ্ন দেখার কথা বলছি, এ স্বপ্ন ঘুমের স্বপ্ন নয়-তা হলো আপনি কি পেতে চান, কোথায় যেতে চান, প্রত্যাশা এবং প্রাপ্তির স্বপ্ন। বলা হয়, স্বপ্ন সাধারণত দুই রকমের হয়। যার একটি হলো স্বাভাবিক স্বপ্ন, যা আমরা ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে দেখি। আরেক ধরনের স্বপ্ন আছে, যা স্বপ্ন বা মনছবি অথবা আমরা বলতে পারি ‘জীবন ছবি’। আর এটা হলো বড় হওয়ার স্বপ্ন, জীবনে একটা কিছু করার স্বপ্ন। এই স্বপ্নই আমাদের জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করে।
স্বপ্নের আরেক মানে হলো লক্ষ্য বা মানুষের জীবনের অভীষ্ট উদ্দেশ্য। লক্ষ্য শুধুই অলীক স্বপ্ন নয়। লক্ষ্য স্থির না পর্যন্ত কিছুই করা সম্ভব নয়, প্রথম পদক্ষেপটি পর্যন্ত নেয়া অসম্ভব। হাওয়া যেমন বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজন তেমনি আপনি বা আমি কোথায় পৌঁছতে চাই সে সম্বন্ধে সুস্পষ্ট ধারণা থাকা চাই। শুরু করার আগে কোথায় যাব তা স্থির দরকার। আপনার ভবিষ্যৎ ক্যারিয়ার গড়ার চিন্তার আগে ভালোভাবে নিশ্চিত হয়ে নিন যে এটাই আপনার স্বপ্নের কাজ- স্বপ্নের জগত। আপনার স্বপ্নের কাজে সবকিছু আনন্দের সঙ্গে করতে ইচ্ছে হবে আর এর ব্যত্যয় হলে আপনি আনন্দ খুঁজে পাবেন না।
লেখক : বিশ্লেষক ও কলামিস্ট