বঙ্গবন্ধুর ভাষণ: বাঙালি জাতির মুক্তির সনদ

প্রকাশ : ০৭ মার্চ ২০২১, ১৪:৪৩

এস. এম. খালিদ হোসেন

স্বাধীনতা বাঙালি জাতির শ্রেষ্ঠ অর্জন। বাঙালি জাতিকে স্বাধীনতার রঙে রাঙিয়েছেন যে মহামানব তিনি আর কেউ নন, এ দেশের সব মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতীক, বাংলার গণমানুষের মুক্তির উপলক্ষ, মহান স্বাধীনতার রূপকার, হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, বাংলার অবিসংবাদিত নেতা, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ স্বাধীনতার মহান স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর  রহমান তৎকালীন পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠীর রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে অসীম সাহসিকতার সাথে ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে বিকাল ৩.২০ মিনিটে লাখো জনতার উদ্দেশ্যে বজ্রকণ্ঠে ১৮ মিনিটব্যাপী যে ঐতিহাসিক ভাষণ প্রদান করেন তা ছিল মূলত বাঙালি জাতির মুক্তির সনদ। আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসের পরতে পরতে মিশে আছে জাতির পিতার অসামান্য অবদান। তার অনন্য বাগ্মিতা ও রাজনৈতিক প্রজ্ঞায় ভাস্বর ওই ভাষণে তিনি তৎকালীন রাজনৈতিক পরিস্থিতি, বাঙালির আবেগ, স্বপ্ন ও আকাক্ষাকে একসূত্রে গেঁথে বজ্রকণ্ঠে ঘোষণা করেন ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’, যা ছিল মূলত স্বাধীনতার ডাক। এ অমোঘ উচ্চারণের মধ্য দিয়ে সেদিন তিনি যে অমর মহাকাব্য রচনা করেন রেসকোর্স ময়দানে, বাঙালি জাতির মুক্তির সনদ হিসেবে আজ তা বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত। গোটা বিশ্বের নিপীড়িত, অধিকার বঞ্চিত মানুষের মুক্তির দিশা আজ তালাশ করা হয় বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ থেকে।

কবি নির্মলেন্দু গুণ বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণকে দেখেছেন অমর কবিতা হিসেবে৷ আর বঙ্গবন্ধুকে অভিহিত করেছেন কবি হিসেবে৷ তিনি বলেন, ‘একটি অমর কবিতার সব গুণ আছে বঙ্গবন্ধুর ভাষণে৷ এরমধ্যে রয়েছে কাব্য এবং কাব্যিক ঢং৷ পশ্চিমা বিশ্ব তাকে বলেছে ‘পয়েট অফ পলিটিক্স’৷ তার ভাষণ শুনে নিউজ উইক তাঁকে পয়েট অব পলিটিক্স বলেছে, কারণ, তার ভাষণে শব্দয়ন মানুষকে সম্মোহিত করতো, ধরে রাখতো৷’

বিশ্বজনীনতা এবং মানবিক গুণের কারণেই বঙ্গবন্ধুর ভাষণ ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ হয়েছে৷ তিনি যে আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকারে কথা বলেছিলেন এটা সারাবিশ্বের সব মানুষের অধিকার৷ তাই সারবিশ্বের নিপীড়িত  মানুষের কথা, স্বাধীনতা-বঞ্চিত মানুষের কথা বলেছেন৷ আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার মানুষের সার্বজনীন অধিকার৷ বঙ্গবন্ধু তার ভাষণে বলেছেন, ‘আমরা সংখ্যায় মেজরিটি, কিন্ত একজন মানুষও যদি ন্যায্য কথা বলে আমরা তা মেনে নেবো৷’- এরচেয়ে আর বড় কোনো গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ হতে পারে না৷ তিনি বলেছেন, ‘এই বাংলায় হিন্দু বা মুসলমান, বাঙালি বা অবাঙালি সকলেই এ দেশের সন্তান, তাদের জানমালের নিরাপত্তার দায়িত্ব হলো জনগণের৷ তিনি পার্টির নেতা-কর্মীদের বলেছেন আমাদের যেন বদনাম না হয়৷’

বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণটি ছিল অত্যন্ত প্রজ্ঞাপূর্ণ ও কৌশলী। পৃথিবীর বহু সমাজবিজ্ঞানী, রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও গবেষক ৭ই মার্চের ভাষণ নিয়ে বহুমাত্রিক বিশ্লেষণ করেছেন। এ ভাষণ বিশ্বসম্প্রদায় গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেছিল। লন্ডনের অবজারভার পত্রিকার তখনকার বিখ্যাত কলামিস্ট ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক সিরিল ডান বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে বলেন, ‘বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাসে এই প্রথম একজন নেতা এলেন, যিনি, চারিত্রিক, নৃতাত্ত্বিক, ভাষা, পোশাক-আশাক, গায়ের রং, আচার আচরণে একজন নিখুঁত বাঙালি। তার বজ্রকন্ঠের ঘোষণা দেশের মানুষ মন্ত্রমুগ্ধের মতো শোনে এবং মান্য করে।’

১৯৭৪ সালে শান্তিতে নোবেল বিজয়ী শন ভ্যাকব্রাইড বলেছেন, ‘শেখ মুজিবুর রহমান বুঝতে পেরেছিলেন, কেবল ভৌগোলিক স্বাধীনতাই যথেষ্ঠ নয়, প্রয়োজন মানুষের মুক্তি, বেঁচে থাকার স্বাধীনতা। সাম্য ও সম্পদের বৈষম্য দূর করাই স্বাধীনতার মূল লক্ষ্য। আর এ সত্যের প্রকাশ ঘটে ৭ মার্চের ভাষণে।’

ভারতীয় নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য  সেন বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু ছিলেন বাঙালি জাতির পথ প্রদর্শক। তার সাবলীল চিন্তাধারার সঠিক মূল্য শুধু বাংলাদেশ নয়, সমস্ত পৃথিবী স্বীকার করবে।’

পশ্চিমবঙ্গের প্রয়াত মূখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু বলেন, ‘৭ মার্চের ভাষণ একটি অনন্য দলিল। এতে একদিকে আছে মুক্তির প্রেরণা। অন্যদিকে আছে স্বাধীনতার পরবর্তী কর্ম পরিকল্পনা।’ কিউবার অবিসংবাদিত নেতা ফিদেল ক্যাস্ট্রো বলেছেন, ‘৭ই মার্চের শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণ শুধুমাত্র ভাষণ নয়, এটি একটি অনন্য রণকৌশলের দলিল।’ গ্রেট ব্রিটেনের সাবেক প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হীথ বলেছেন, ‘পৃথিবীর ইতিহাসে যতদিন পরাধীনতা থেকে মুক্তির জন্য সংগ্রাম থাকবে, ততদিন শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ই মার্চের ভাষণটি মুক্তিকামী মানুষের মনে চির জাগরুক থাকবে। এ ভাষণ শুধু বাংলাদেশের মানুষের জন্য নয়, সারা বিশ্বের মুক্তিকামী মানুষের অনুপ্রেরণার উৎস।’

পরিশেষে বলতে চাই, ৭ই মার্চ বাঙালি জাতির স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। আজো এই ভাষণ উজ্জীবিত করে গোটা বাঙালি জাতি ও বিশ্ববাসীকে । সমকালীন বিশ্ব ইতিহাসে শ্রেষ্ঠ ভাষণগুলোর মধ্যে বঙ্গবন্ধুর এ ভাষণ অন্যতম। এ ভাষণ পাল্টে দিয়েছে একটি দেশের মানচিত্র, জাতীয় পতাকা ও জাতীয় সঙ্গীত। আজ মহান মুক্তিযুদ্ধের  অর্ধশত বছর পেরিয়ে গেছে। ৭১’র সেই ভগ্নদশা থেকে ঘুরে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশ আজ জাতির জনকের কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার হাত ধরে উন্নতি সমৃদ্ধির পথে অগ্রসর হচ্ছে। বাস্তবায়িত হচ্ছে  বঙ্গবন্ধুর সেই স্বপ্ন।

লেখকঃ শিক্ষক ও গবেষক, আর্মি আইবিএ সাভার (বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অফ প্রফেশনালস) 
smkhossain.armyiba@gmail.com

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

লেখকদের নামঃ