বাংলাদেশ-ভারত বন্ধুতা: বিদ্যুৎ ও জ্বালানী খাত

প্রকাশ : ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ১৭:২৮

হাসান ইবনে হামিদ

২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। ক্ষমতায় আসার সাথে সাথেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে প্রত্যক্ষ করতে হয় পর্যদুস্থ অর্থনীতি ও স্থবির বাণিজ্যের এক বাংলাদেশকে। মূলত ২০০৯ সালের পূর্বে বিদ্যুতের অভাবে দেশের অর্থনীতি, শিল্প ও বাণিজ্য ভঙ্গুর হয়ে পরেছিলো এবং জনজীবন অতিষ্ঠ ছিলো লোডশেডিংয়ের ভয়াবহতায়। তাই ক্ষমতায় এসে প্রথমেই বিদ্যুৎ সমস্যা সমাধানে উদ্যোগী হয়ে উঠেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বঙ্গবন্ধু কন্যার দূরদর্শী পদক্ষেপে খুব দ্রুত সময়ের মধ্যেই বিদ্যুৎ সমস্যা সমাধানের পথে অগ্রসর হয় বাংলাদেশ। দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়ন ও বিদ্যুতের চাহিদা বৃদ্ধির বিষয়টি অনুধাবন করে বাংলাদেশ সরকার বিদ্যুৎ উৎপাদন বৃদ্ধির পাশাপাশি প্রতিবেশি দেশসমূহ হতে আন্তঃদেশীয় সহযোগিতার মাধ্যমে বিদ্যুৎ আমদানির কার্যক্রম গ্রহণ করে। আর তাই ২০২০ সালে এসে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ চাহিদা কাটিয়ে উঠে এক নতুন সম্ভাবনার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। আর এক্ষেত্রে প্রতিবেশী দেশ হিসেবে বাংলাদেশ পায় ভারতের সহযোগিতা। তেরঙ্গা-লাল সবুজ সম্পর্ক আবারো দৃশ্যমান হয়ে উঠে অতীতের মতোই!

২০১০ সালের জানুয়ারি মাসে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর আমন্ত্রণে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ভারত সফর করেন। এ সময় বিভিন্ন বিষয়ে সহযোগিতার ক্ষেত্র চিহ্নিত করে উভয় দেশের মধ্যে একটি যৌথ ইশতেহার স্বাক্ষরিত হয় এবং একই মাসে একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়। পরবর্তী সময়ে ২০১৭ সালের ৭-১০ এপ্রিল মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরকালীন সময়ে স্বাক্ষরিত ২২টি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরের মাধ্যমে সম্পর্কের এক নবযুগে পদার্পণ করে দু’দেশ। জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতে সম্পাদিত চুক্তি ও সমঝোতা স্মারকগুলো বিশেষভাবে লক্ষ্য করার বিষয়। তেল, গ্যাস, বিদ্যুৎ, পারমাণবিক শক্তির শান্তিপূর্ণ ব্যবহার, নবায়নযোগ্য জ্বালানির দক্ষ ব্যবহারের ব্যাপক ক্ষেত্র চুক্তি ও সমঝোতা স্মারকগুলোর অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। আজকের এই লেখাতে মূলত উপরোক্ত বিষয়ের প্রতি আলোকপাত ও ভারত-বাংলাদেশের বিদ্যুৎ ও জ্বালানী খাতের পারস্পরিক সহযোগিতার বিষয়গুলোও আলোচনা করবো। 

বাংলাদেশ-ভারত প্রথম বিদ্যুৎ সঞ্চালন কেন্দ্র, এইচভিডিসি প্রথম ব্লক
২০১০ সালের  সমঝোতা স্মারকের অধীনেই মূলত কুষ্টিয়ার ভেড়ামারায় বাংলাদেশ ভারত বিদ্যুৎ সঞ্চালন কেন্দ্র নির্মাণ করা হয়। ২০১৩ সালের ৫ অক্টোবর গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী ডঃ মনমোহন সিং ‘বাংলাদেশ-ভারত প্রথম বিদ্যুৎ সঞ্চালন কেন্দ্র’ উদ্বোধন করেন। ভেড়ামারায় স্থাপিত এইচভিডিসির প্রথম ব্লকের মাধ্যমে ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানি শুরু হয়। বর্তমানে ওই ৫০০ মেগাওয়াট ছাড়াও ত্রিপুরা থেকে ১৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানি হচ্ছে। ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর নাগাদ এই মোট ৬৬০ মেগাওয়াট আমদানী করছিলো বাংলাদেশ। 

এইচভিডিসি দ্বিতীয় ব্লক স্টেশন
বিদ্যমান বাংলাদেশ(ভেড়ামারা)-ভারত(বহরামপুর) গ্রীড আন্ত সংযোগের ক্ষমতা বৃদ্ধির মাধ্যমে ভারত থেকে আরো ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানি করার উদ্দেশ্যেই এই দ্বিতীয় ব্লক নির্মাণ করা হয়েছে। অর্থাৎ ভারত থেকে বর্তমানে মোট আমদানিকৃত বিদ্যুতের পরিমাণ ১,১৬০ মেগাওয়াট। এই বিদ্যুৎ আমদানির ফলে দেশের দক্ষিণ পশ্চিমাংশের শিল্প এলাকায় নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে পারবে সরকার, ফলশ্রুতিতে দ্রুত শিল্পায়ন ঘটবে এবং আর্থসামাজিক অবস্থার পরিবর্তন ঘটবে। তাছাড়া ক্রমবর্ধমান বিদ্যুৎ চাহিদা পূরণের পাশাপাশি রাজশাহী ও খুলনা বিভাগে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প স্থাপনের মাধ্যমে নারী ও বেকার জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা যাবে।

নেপাল ও ভুটানের জলবিদ্যুৎ আমদানীর ক্ষেত্রে ভারতের সহায়তা
নেপাল ও ভুটানের জলবিদ্যুৎ সম্ভাবনা কারো অজানা নয়, এই বিপুল সম্ভবনাকে কাজে লাগিয়ে তা বাংলাদেশে আমদানি করার স্বপ্ন বাংলাদেশ দেখছে বহু আগে থেকেই। কিন্তু বাস্তবতা ছিলো সম্পূর্ণ ভিন্ন। এ ক্ষেত্রে অন্যতম প্রধান বাধা ছিলো ভারতের কেন্দ্রীয় বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয়ের জারি করা ‘আন্তরাষ্ট্র বিদ্যুৎ বিপণন গাইডলাইন’। কিন্তু ২০১৭ সালে সকল বাধা অতিক্রম করেছে দু’দেশ। ২০১৭ সালের ৭-১০ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরের সময় সম্পাদিত ২২টি চুক্তির মধ্যে জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতে সম্পাদিত এই চুক্তিটি ছিলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ, দুই দেশের সম্পর্ক উচ্চতর মাত্রায় নিয়ে যাবার আরেকটি মাইলফলক। উল্লেখিত সফরের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অর্জন—ভারতের ভূমি ব্যবহার করে নেপাল ও ভুটানের বিদ্যুৎ বাংলাদেশে আমদানির প্রতিবন্ধকতা অপসারণ। এই চুক্তির ফলে নেপাল ও ভুটানের সঙ্গে বাণিজ্যিক চুক্তির অধীনে ভারতের ভূখণ্ড ব্যবহার করে বিদ্যুৎ আমদানি করার জন্য গ্রিডলাইন স্থাপন ও বিদ্যুৎ সঞ্চালনের উদ্যোগ কার্যকর করতে পারবে বাংলাদেশ। এমনকি দু’দেশ এই ঐক্যমতে পৌঁছেছে যে,বাংলাদেশের ভূখণ্ডের মধ্য দিয়ে ভারতের আসাম থেকে বিহার পর্যন্ত বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন নির্মাণ করা হবে এবং এর সাহায্যে ভারতের একাংশের বিদ্যুৎ অপর অংশে পরিবাহিত হবে। এই বিদ্যুৎ ট্রানজিট বা ট্রান্সমিশন লাইন থেকে বাংলাদেশ বাণিজ্যিক চুক্তির অধীনে ১ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ বাংলাদেশের পার্বতীপুরে সাবস্টেশন নির্মাণের মাধ্যমে কিনতে পারবে। 

মেঘনাঘাট বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ
ভারতের বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সাথে সমঝোতার অধীনে  বাংলাদেশ সরকার ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানি করতে পারবে যদিও ২০১৭ সালের পূর্বে তা সম্ভব ছিলো না। মূলত ২০১৭ সালের এপ্রিলে স্বাক্ষরিত চুক্তিই এই বিশাল দ্বার বাংলাদেশের জন্য উন্মুক্ত করে দিয়েছে। ইতোমধ্যে ভারতের বেসরকারি কোম্পানি রিলায়েন্স পাওয়ার ১০০ কোটি মার্কিন ডলার বিনিয়োগ করে ঢাকার অদূরে মেঘনাঘাটে ৭৫০ মেগাওয়াট প্রথম পর্ব বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করবে এবং এলএনজি বা তরলীকৃত গ্যাস পুড়িয়ে উৎপাদিত বিদ্যুৎ বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (বিপিডিবি) কাছে বিক্রি করবে। এই বিদ্যুৎকেন্দ্র ভবিষ্যতে ৩ হাজার মেগাওয়াট ক্ষমতার কেন্দ্রে উন্নীত হবে। 

ঝাড়খন্ড কয়লাবিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ রপ্তানী
ভারতীয় বেসরকারি কোম্পানি আদানি পাওয়ার লিমিটেড ভারতের কয়লাসমৃদ্ধ ঝাড়খন্ড রাজ্যে ১ হাজার ৬০০ মেগাওয়াট কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করে বাংলাদেশে বিদ্যুৎ রপ্তানি করবে। আদানি পাওয়ার এ প্রকল্পের জন্য ২০০ কোটি ডলার বিনিয়োগ করবে এবং উৎপাদিত প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ ৮ দশমিক ৭ মার্কিন সেন্ট মূল্যে বাংলাদেশে রপ্তানি করবে। ২০১৭ সালের চুক্তি অনুযায়ী, আদানি পাওয়ারের সঙ্গে সম্মত বিদ্যুতের মূল্য আগামী ২০ বছর অপরিবর্তিত থাকবে।

রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণে সহায়তা
এই বিদ্যুৎ কেন্দ্র বিভিন্ন কারণেই আলোচিত। একদল বলছে পরিবেশের ক্ষতি অন্যদিকে দুই দেশের সরকার ও তাদের বিশেষজ্ঞ টিম বলছে নির্দিষ্ট দূরত্বেই তা হচ্ছে তাই পরিবেশের কোন ক্ষতি হবেনা। যাই হউক, আজকের আলোচনা যেহেতু সেদিকে না তাই বিশদ বর্ণণাতে না গিয়ে মূল জায়গায় ফোকাস করছি, বাংলাদেশ-ভারতের বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে সহযোগিতার জায়গাকেই এখানে তুলে ধরছি। রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের বিনিয়োগ সম্পর্কিত প্রশ্নের সমাধান ২০১৭ সালের চুক্তির পর হয়েছে। এর আগে বিপিডিবি ও ভারতের এনটিপিসির সঙ্গে স্বাক্ষরিত চুক্তির অধীনে ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট ক্ষমতার রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের নির্মাণকাজের জন্য ভারতের এক্সিম ব্যাংক বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রী বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ কোম্পানিকে ১৬০ কোটি ডলার ঋণ দেওয়ার চুক্তি স্বাক্ষর করেছে।

এনএলজি খাতে সহায়তা
বাংলাদেশ ও ভারতের কোম্পানিগুলো এলএনজি খাতে সহায়তার তিনটি পৃথক চুক্তি করেছে। পেট্রোবাংলা ও ভারতের পেট্রোনেট এলএনজি কুতুবদিয়া দ্বীপে প্রতিদিন বাংলাদেশে ৫০০ ঘনফুট গ্যাস সরবরাহের জন্য ভারতের রিলায়েন্স পাওয়ার কোম্পানির নির্মিতব্য এলএনজি টার্মিনাল ব্যবহার করার লক্ষ্যে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করেছে। ২০১৭ সালে প্রধানমন্ত্রীর সফরকালে পশ্চিমবঙ্গের দত্তপুলিয়া থেকে বাংলাদেশের যশোর, খুলনা অঞ্চলে গ্যাস সরবরাহের জন্য পাইপলাইন নির্মাণে দুই দেশ সম্মত হয়েছে। এই পাইপলাইন দিয়ে পশ্চিমবঙ্গের উপকূল অঞ্চলে স্থাপিত এলএনজি টার্মিনালে রূপান্তরিত প্রাকৃতিক গ্যাস বাংলাদেশে সরবরাহ হবে। অপরদিকে ভারতের শিলিগুড়ি থেকে বাংলাদেশের পার্বতীপুর পর্যন্ত নির্মাণাধীন ১৩৫ কিমি দীর্ঘ পাইপলাইনের কাজ সম্পন্ন হলে আসামের নুমালিগড় রিফাইনারি থেকে পরিশোধিত ডিজেল শিলিগুড়ি হয়ে দিনাজপুরের পার্বতীপুরের বিপিসির তেল সরক্ষণাগারে সরবরাহ করা সম্ভব হবে। বর্তমানে রেলপথে ভারত থেকে বাংলাদেশ ডিজেল আমদানি করছে।

বাংলাদেশ-ভারত বন্ধুত্ব চিরস্থায়ী হোক, উভয় দেশ একসঙ্গে কাজ করে জনগণের উন্নতি সাধন করুক। আমরা আশা করছি, যেমন করে ছিটমহল সমস্যা সমাধান হয়েছে, সীমান্ত হত্যা কমে এসেছে, তেমন করেই দ্রুত সময়ের মধ্যে সকল অমীমাংসিত সমস্যার সমাধান হবে। ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক সখ্যে বাঁধা ‘গণভবন থেকে জনপথ রোড’ এর সম্পর্ক থাকবে অটুট। দু’দেশের জনগণের আকাঙ্খা পূরণে একসঙ্গে এগিয়ে চলার সুযোগুলো কাজে লাগিয়ে এগিয়ে চলুক এই বন্ধুতা।

লেখক: রাজনৈতিক ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

লেখকদের নামঃ