স্যারনামা

প্রকাশ | ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ১৪:৪৬

দুদকের চেয়ারম্যান বলেছেন দুদক চায়, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা সেবাপ্রার্থী নাগরিকদের 'স্যার' বলে সম্বোধন করুক।

এটা খুবই প্রত্যাশিত এবং স্বাভাবিক একটি ব্যাপার ছিল। কিন্তু 'কলোনিয়াল লিগ্যাসির' ধারবাহিকতায় আমরা একে অস্বাভাবিক একটা ব্যাপার করে তুলেছি। ঔপনিবেশিক কায়দায় এ বঙ্গে উল্টো সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের 'স্যার' বলে সেবাপ্রার্থীর জান জেরবার হয়ে যায়। যাই হোক, আমি একবার ভর্তি সংক্রান্ত কাজে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রেজিস্টার বিল্ডিংয়ে গেলাম। দেখি এক কর্মকর্তার টেবিলের উপর নেমপ্লেটে লেখা "ভাই, মামা বা আঙ্কেল" ডাকবেন না। স্যার বলে সম্বোধন করুন। মি. হাসমত আলী(ছদ্মনাম) বিএ, এমএ।

হাসমত আলী বিএর নেমপ্লেট দেখে আমি হাসতে হাসতে শেষ। কোনোমতে মুখ চেপে রুম থেকে বের হয়ে বারান্দায় পৌঁছে প্রাণখুলে এক চোট হাসলাম। এটা এক ধরণের হীনমন্যতাবোধ। ইনফেরিওর কমপ্লেক্সিটি। হীনমন্যতাবোধ থেকে এই সংকটের জন্ম। কৃষিসমাজ থেকে উঠে আসা বাঙালি হিন্দু-মুসলমানের মন! আপনাকে যদি অসম্মান না করে কেউ নাম ধরে ডাকে তাতে আপনার সমস্যা কী? আপনি তো প্রভু না। সেবাপ্রার্থী জনগণ আপনার দাস না। নানাসময় বিদেশীদের সঙ্গে কাজ করার সুযোগ হয়েছে। তাদের অনেকেই আন্তর্জাতিক মানের বিশেষজ্ঞ। পিএইচডি ডিগ্রিধারী। তারা আমাকে নাম ধরে ডাকত। আমিও তাদের নাম ধরে ডাকতাম।

এমনকি এ মুহুর্তেও একজন ইটালিয়ান ও ব্রিটিশ নাগরিকের সঙ্গে একটা গবেষণা কাজে সহযোগিতা করছি। দুজনেই বিশেষজ্ঞ। দুই নাম্বার বা ভুয়া পিএইচডি না, বিলেতে এবং ইতালির নামকরা প্রতিষ্ঠানের পিএইচডি। মজার ব্যাপার হলো তারা যখন কাউকে নিজের পরিচয় দেয় বলে না যে আমি ড. এক্স, ওয়াই, জেড। সাদামাটাভাবে শুধু নিজের নামটুকু বলে। তাদেরও ড. যোগ করে সম্বোধন করতে হয় না। অথচ আমাদের কোনো পিএইচডিকে যদি ড. না বলে সম্বোধন করেন, স্যার না বলেন— উনি রীতিমতো ঘোরতর মাইন্ড করে বসবেন। দেশে পিএইচডি নাই এমন একজন রাজনীতিবিদও আছেন যিনি চান সবাই তাঁকে 'স্যার' বলে ডাকুক। অথচ উনার অনেক সিনিয়র নেতাকে সবাই অনায়াসে তোফায়েল ভাই বলে ডাকে। বঙ্গবন্ধুকে ছাত্রনেতারা মুজিব ভাই বলেই ডাকত। রাষ্ট্রের নির্বাহী বিভাগের প্রধানকেও সবাই আপা বলে ডাকে। এসব আমাদের বড় বড় কর্তারা যে জানেন না এমন ভাবার কোনও কারণ নেই। তারা পড়াশোনা করেন। হরহামেশা সুযোগ পেলেই বিদেশ যান। এমনকি পুকুর খনন দেখতেও। শাহী কায়দায় পুকুর খনন দেখে বউ-শ্যালিকার জন্য জমিয়ে শপিং করেও নিয়ে আসেন। শুধু নিয়ে আসেন না বা শিখে আসেন না তাদের ভালো কালচারটুকু। আন্তরিক সেবার মানসিকতাটুকু।

অধ্যাপক আনিসুজ্জামান, আবদুল্লাহ আবু সায়ীদকে সবাই স্বতঃস্ফূর্ত 'স্যার' বলেই সম্বোধন করে। প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমানকে অফিসের সবাই মতি ভাই বলে ডাকে। উনি চাইলে একজন জ্যেষ্ঠ সাংবাদিককে সবাই সানন্দে 'স্যার' বলেই ডাকত। মানবজমিনের মতিউর রহমান চৌধুরীকেও আমরা মতি ভাই বলে ডাকতাম। দেশের সিনিয়র সাংবাদিক পীর হাবিবুর রহমানকেও অনায়াসে আমরা পীর ভাই বলেই ডাকি। কিন্তু আমলাতন্ত্রে সিনিয়র কাউকে ভাই, বোন বা আপা ডাকলে তারা দেখি খুব গোস্বা করে বসেন। কষ্ট পান। নাম ধরে ডাকার তো প্রশ্নই ওঠে না(বলবেন এটা আমাদের সংস্কৃতিতে নেই। 'স্যার' ডাক কী এই অঞ্চলের মানুষের সংস্কৃতিতে ছিল?)।