বিক্ষুব্ধ সময়, অতীন্দ্রিয়বাদ আর কিছু ভাবনা

প্রকাশ : ০৭ ডিসেম্বর ২০১৯, ১৩:৩৪

অতীন্দ্রিয়বাদের চর্চাতো অনেক প্রাচীন। সেটা সুমেরান বলুন আর হিট্টাটাইট হয়ে ক্যানানাইট বলুন, শুরুর দিকের সভ্যতাগুলোতে এর চর্চা ছিল। 'সি গড' তথা উর্বরতার ঈশ্বর থেকে 'গড' রূপান্তরের পরেও 'শেকিনাহ'র চর্চা কিন্তু এই নতুন গড়ে ওঠা সভ্যতাগুলোতে ছিল।

জিন্দাআভেস্তা মতে আদি একেশ্বরবাদী জারথ্রুস্ট্রিয়ানরাতো পুরোপুরিই আলো-আঁধারের অতীন্দ্রিয়বাদী গোষ্ঠী। যদিও তাদের চর্চাকে আমাদের সেমেটিক গোষ্ঠী একেশ্বরবাদী চর্চা না বলে 'দ্বিত্তবাদ' বলতেই সাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। এই পথের হাতধরে এব্রাহামিক একেশ্বরবাদের শুরুটা বললে হিব্রুভাষী ইহুদীবাদই প্রথমে আসে। তাদের মধ্যেও অতীন্দ্রিবাদের চর্চা ছিল। এই ইহুদীবাদের ধারা ঘুরে কৃশ্চিয়ানিটির মধ্যেও এর প্রভাব ব্যাপক।

এবার আসি সেমেটিকদের আরেক প্রভাবশালী গোষ্ঠী ইসলামে। নবী মুহাম্মদ(সাঃ) জন্মের কিছু বছর আগে ম্যানিবাদের একটি প্রচার ছিল আরবের আশেপাশে। তাদের মধ্যেও এই পরম সাধনার একটি প্রবনতা ছিল। আবার নবীর দাদা ছিলেন হানিফ গোত্রের ধর্ম সাধনার ভক্ত। এই ধারাতে অভুক্ত থেকে ঈশ্বর আরাধনার প্রবনতা ছিল, ছিল পাহাড়ে গিয়া গুহায় বসে ধ্যান করার প্রবনতা যা ইসলামের নবী মুহাম্মদকে(সাঃ) প্রভাবিত করেছিল বলে ধরে নেয়া হয়।

ইসলাম শুরুতেই হেজাজের বাইরে আসেনি। দেশত্যাগ করে ইয়াসরিব তথা মদিনাতে আসার পর ইসলাম ধীরে ধীরে আরবের কালচার থেকে সরে বৈশ্বিক কালচার গ্রহণ করা শুরু করে। এই সংস্কৃতির গ্রহণে ভারতীয় বুদ্ধবাদ অথবা জৈনবাদ কিংবা গৃহত্যাগী কৃচ্ছতাবাদী অতীন্দ্রিয়বাদের লক্ষনও দেখা যায় যার উদাহরন হাসান আল বাসরী।

প্রশ্ন হলো নবী মুহাম্মদ(সাঃ) প্রাচীন সকল ধ্যান ধারনাকে আপাত সরিয়ে দিয়ে নতুন ধ্যান ধারনার ইসলামকে এস্টাবলিস্ট করলেন তাহলে তার মৃত্যুর মাত্র একশত বছরের মাথায় এই অতীন্দ্রিয়বাদের হঠাৎ প্রয়োজনই বা হলো কেন?

নবীর পরে ক্ষমতায় এলেন আবু বকর, উমর, ওসমান, আলী এবং পরে উমাইয়ারা। এরা সবাই মোটামুটি  নবীর সান্নিধ্যে এসেছিলেন এবং তাঁর জীবদ্দশায় এরা ব্যাপক প্রভাবশালীও ছিলেন। সুতরাং তাদের শাসনকাঠামোতে নবীর অনুসৃত নিয়ম-নীতির ব্যাবহার ছিল বলেই আমাদের ধরে নেয়া উচিৎ, যদিও আমরা জানিনা তার অনুসৃত নিয়ম-নীতিগুলো আসলে কি ছিল। কারন হাদিস বা ফিকহ শাস্ত্র সম্পর্কিত প্রায় সকল দলিলই তাঁর মৃত্যুর প্রায় দুশো বছর পরে রচিত।

এখান থেকে বোঝা যায় তখনকার জনগোষ্ঠীর একটি অংশ অবশ্যই এই শাসনব্যবস্থার প্রতি খানিক বীতশ্রদ্ধ ছিলেন। আবার উমাইয়াদের এই সময়েই বা তাদের শাসনের শেষের দিকে যুক্তিবাদীরাও বেশ প্রভাবশালী হয়ে উঠছিলেন। এই গোষ্ঠী দর্শন-বিজ্ঞান চর্চায় নিজেদের মনোনিবেশ করেছিলেন। এরা বিশ্ব ইতিহাসে মুতাজিলা সম্প্রদায় নামে পরিচিত। আল কিন্দী, ইবনে সিনা, আল ফারাবী, খাওয়ারিজমি প্রমুখ বিজ্ঞানী-দার্শনিকেরা এই ধারার অর্থাৎ যুক্তিবাদী ধারায় বিশ্বাসী। আরা ব্যাপক ভাবে গ্রীক দর্শনের অনুবাদ করেছেন এবং ইসলামী দর্শন বলতে মূলত এই গোষ্ঠীর প্রতিষ্ঠিত দর্শনকেই বোঝায়। এদের যুক্তিভিত্তিক চর্চায় জাজমেন্ট ডে, স্বর্গ-নরক, এনজেলস সহ বিভন্ন ধর্মীয় মাইথোলজী ব্যাপক প্রশ্নের মুখোমুখি চলে যাচ্ছিল।

আবার আরেক গোষ্ঠীর উত্থান ছিল যারা প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মকে আঁকড়ে ধরতে আগ্রহী ছিল। এরা ছিল ব্যক্তিগতভাবে ন্যায়পরায়ন কিন্তু ভিন্নমতকে ধূলিস্মাত করে দেয়ার পক্ষের লোক যাদেরকে আমরা বলে থাকি অর্থোডক্সি। ইমাম হাম্বল বা ইমাম আশয়ারিরা এই পন্থার।

তিনটি পন্থা যথাঃ

১.শাসক গোষ্ঠীর ধর্মের চেয়ে রাজ্য জয়ে মনোযোগ।

২. যুক্তিবাদী গোষ্ঠীর যুক্তির নিরিখে ধর্ম বিশ্বাস বা যুক্তি ভার্সেস ধর্ম।

৩. অর্থোডক্সি গ্রুপের শাসকগোষ্ঠীর আনুকুল্যে ভিন্নমতকে ধুলিস্মাত করে দেয়ার প্রবনতা।

আমি বিশ্বাস করি এই তিনপন্থার কারনেই তাসাউফ বা অতিন্দ্রিয়বাদ তদানীন্তন সময়ে বেশ ভালোই প্রভাব বিস্তার করে। এই অতীন্দ্রিয়বাদ কখনও ব্যাপক মানবতাবাদের দিকে গিয়েছে যেমন ইমাম কুরাইশিয়া অথবা ইবনুল আরাবী, স্পেসিফক ইবনুল আরাবীরা সর্বেশ্ববাদী। যেখানে তিনি ঈশ্বরকে সর্বোত্রই খুজেছেন সেখানে মসজিদ, মন্দির, গীর্যার কোন আলাদা ভ্যালু ছিল না।

আবার প্রায় সমাজচ্যুত হয়ে চরমপন্থার দিকেও ধাবিত হয়েছে যেমনঃ মনসুর হাল্লাজ। কিন্তু আরো অনেক পরে এই অতীন্দ্রিয়বাদকে তথা সুফীবাদকে একটি ক্ল্যাসিক্যাল পর্যায়ে নিয়ে গেছেন মাওলানা রূমীরা, শামস তাবরিজরা।

আনুষ্ঠানিকতায় মধ্যপ্রাচ্যের সুফীবাদ গ্রীকদের এলিটিজম আর ভারতীয়দের কৃচ্ছতাসাধনের মিশ্রন বলা যায়। মূলত ইসলামকে টিকিয়ে রাখতে আরেকটু স্পেসিফিক ভাবে ইসলামের আলোকিত দিকগুলোকে টিকিয়ে রাখতে সেই বিবর সময়ে হাসান আল বাসরিদের উত্থান সেটা সভ্যতার জন্য ভালো কিছু এনেছে কিনা বলতে পারিনা তবে অন্য অনেক ইসলাম ধর্মীয় কাল্টের মত এরা বিশ্ববাসীর ক্ষতির কোন কারন হয়নি এটুকু সত্য।

এখন মধ্যযুগ নয়, সেই সময়ের চেয়ে এই সময় অনেক গতিশীল, অনেক আধুনিক। এই আধুনিক যুগে এসে মানবতাবাদ আরো প্রভাবশালী হওয়ার কথা ছিল কিন্তু বাস্তব চিত্র বলছে ভিন্নকথা।

এই গতিশীলতার যুগে গালিবের প্রিয়ার চোখের জোড়া ভুরু, লালনের মানুষ ভজা, রুমীর প্রেমভরা জগৎ সংসার, ইবনুল আরাবীর সর্বত্রে পরম খোজা হয়তো খানিক গতিশীলতা কমাবে কিন্তু মানুষ ভজা'র চর্চাকে বাড়াবে এটুকু হলফ করে বলতে পারি।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

লেখকদের নামঃ