সামন্ত-প্রভু’র বিশ্ববিদ্যালয়

প্রকাশ : ২৩ সেপ্টেম্বর ২০১৯, ১২:২৭

‘আমার বাপ-দাদা জমিদার ছিল’– এই বাক্যটা উচ্চারণ করে বাঙালি যে এখনো তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলে, তার মধ্যেই লুকিয়ে আছে আমাদের সামন্ত-প্রীতির নমুনা। সামন্তপ্রথা ভেঙেছে সেই পাকিস্তানে আমলে; কিন্তু সেই শেকলটাকে ভেঙে আলোর মুখোমুখি দাঁড়াবার মতো সাহস আমাদের মন এখনো অর্জন করতে পারেনি। পশ্চিমারা বুর্জোয়া সমাজে প্রবেশের পর সামন্তবাদের যে শৃঙ্খল, যে কুসংস্কার, যে ধর্মান্ধতা, যে অশিক্ষাকে পরাজিত করেছিল, যে মুক্তির গান গাইতে পেরেছিল, সেটা আমরা পারিনি। আমাদের বুর্জোয়ারা পশ্চিমাদের অনুসরণ করেছে ঠিকই কিন্তু তাদের মানসিকতাকে অনুসরণ করতে পারেনি। অর্থাৎ, যে বুর্জোয়া সমাজব্যবস্থা ইউরোপে প্রগতিশীল ভুমিকা পালন করেছিল, উপনিবেশয়ানের কল্যাণে সেই বুর্জোয়া ব্যবস্থাই ভারতবর্ষে প্রতিক্রিয়াশীল ভূমিকা পালন করেছে। তাই বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদকে বলতে শোনা যায়, 'সামন্ত প্রভু আজ নেই সত্য– কিন্তু সামন্ত মনোবৃত্তি এখনও রয়েছে'। 



‘নিওলিবারিজম’ কিংবা মুক্তবাজার অর্থনীতিতে প্রবেশের পর থেকেই ‘Life is a race’ মন্ত্রটা আমাদের মস্তিষ্কের গভীরে ঢুকিয়ে দেয়া হয়, যার মাধ্যমে প্রত্যেকটা শিক্ষার্থীকে স্কুল পর্যায় হতেই একটা অসুস্থ প্রতিযোগিতার মধ্যে হাবুডুবু খেতে হয়। একদিকে যেমন এটা তাদের মধ্যে তৈরি করে ভয়ংকর মানসিক চাপ যা কিনা তাদের স্বাভাবিক বেড়ে ওঠাকে করে তুলে বিপর্যস্ত, অন্যদিকে সেটাই তাকে করে ফেলে বিচ্ছিন্ন। কেননা, প্রতিটা প্রতিযোগিতায়ই মূলত একে অপরকে প্রতিপক্ষ হিসেবেই বিবেচনা করা হয়। এই ‘বিচ্ছিন্নতা’টাকে যে কোন সমাজের শাসক শ্রেণির খুব প্রয়োজন, কেননা মানুষে মানুষে বন্ধন যত শিথিল হবে অন্যায়ের বিরুদ্ধে আন্দোলনও দমে আসবে। উচ্চস্বরে আওয়াজ তোলার মানুষও কমে যাবে।


আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর দিকে নজর দিলে উপরোক্ত দুটো জিনিসের উপস্থিতি লক্ষ্য করার মতো। ‘মুক্তবাজার অর্থনীতি’ ব্যক্তি মানুষে বিচ্ছিন্নতা তৈরির পাশাপাশি রাষ্ট্রের সেবা খাতগুলোতেও আঘাত হানে যার অন্যতম শিকার হচ্ছে আমাদের ‘শিক্ষা খাত’। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে লেখাপড়ার খরচ বেড়েই চলছে, যেমন ভর্তির জন্যে ফরমের মূল্যের দাম বাড়ছে,  তেমনি বাড়ছে সেমিস্টার ফি, ক্রেডিট ফি। ধীরে ধীরে পুরো উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থাটাই চলে যাচ্ছে নিম্নবিত্ত কিংবা নিম্ন মধ্যবিত্তের সাধ্যের বাইরে। আবার একজন ছাত্র কোন বিষয়ে পড়বে সেটারও নির্ধারক এখন আর সে নিজে না; বরং পারিপার্শ্বিক সমাজ ও পরিবার সর্বোপরি বাজার অর্থনীতিই সেটা ঠিক করে দিচ্ছে। এটা থেকেই ভালো সাবজেক্ট, খারাপ সাবজেক্ট এর ধারণার সূত্রপাত। এই বোধ থেকে ছাত্র কিংবা শিক্ষক, কেউই মুক্ত নন। এবং এ কারণেই শিক্ষার্থীদের মধ্যে ‘সুপিরিয়রিটি-ইনফেরিয়রিটি’ বোধের উৎপত্তি হচ্ছে এবং কিছু কিছু সাবজেক্টের ছাত্ররা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে বেশ বড় একটা সময় কাটান সেই হতাশাকে ঘিরে।


অনেকগুলো ধাপ পেরিয়ে যখন একজন ছাত্র অবশেষে ভর্তি হয় বিশ্ববিদ্যালয়ে, বিদ্যালয়টাকে ‘বিশ্ব’ বলেই অনুমান করে আসে। মুক্তচিন্তা চর্চার এক আধার  হিসেবেই বিশ্ববিদ্যালয়কে গণ্য করতে ভালোবাসে; যেখানে তৈরি হবে নতুন নতুন চিন্তা, শিখবে বিজ্ঞানভিত্তিক চিন্তা চেতনা, উপড়ে ফেলবে মান্ধাতার আমলের সকল কুসংস্কার; চর্চা হবে সুস্থ রাজনীতির। অধিকাংশই প্রথমবারের মতো ঘর ছেড়ে বাইরে পড়াশোনা করতে আসে এবং নতুন পরিবেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের কাছে তাদের থাকে আকাশছোঁয়া প্রত্যাশা। কিন্তু, এখানে এসেও সে হাজির হয় সেই পুরনো ক্ষমতা-কাঠামোর মধ্যে, যেখানে নির্দিষ্ট করে দেয়া আছে শিক্ষক-ছাত্রের কর্মকাণ্ডের সীমানা। ‘রাজা যাই বলেন তাই ঠিক ‘– সামন্ত মনের সেই চিন্তাটা এখনো খেলা করে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষমতা-কাঠামোর মধ্যে। শিক্ষক-ছাত্রের সম্পর্ক যেখানে জ্ঞানের পূর্ব সাধক ও উত্তর সাধক হওয়া উচিৎ সেখানে সেটা হয়ে গিয়েছে ‘ক্ষমতা’র সম্পর্ক। তাই দেখা যায়, যে কোন আন্দোলনে যেখানে ছাত্র-শিক্ষক হাত ধরাধরি করে শরিক হওয়ার কথা সেখানে শিক্ষকেরা উল্টো পরীক্ষায় ফেল করানোর হুমকি দেন; এমনকি সার্টিফিকেট আটকে রাখারও ভয় প্রদর্শন করেন। কখনো প্রচলিত সিস্টেমের কোন বিষয় সম্পর্কে প্রশ্ন উত্থাপন করলেও একই অবস্থায় পড়তে হয়। তাই একজন ছাত্র শিক্ষককে তখন ‘জ্ঞান-গুরু’ না ভেবে ভয়ের কারণ হিসেবেই ভাবতে শুরু করে। এর  ফলশ্রুতিতে ছাত্র-শিক্ষকের মনোঃজগতে এক বিশাল দূরত্ব তৈরি যায় যা কাটিয়ে ওঠা আর কারো দ্বারা সম্ভব হয় না। পাশাপাশি ‘ক্ষমতা’ কাঠামোর এই সীমানাপ্রাচীর টপকানোও অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায় এবং যেখানে ছাত্র থাকাকালীন অবস্থায় সে দাবি করে ভবিষ্যতে শিক্ষক হতে পারলে এই প্রভূত্ব প্রদর্শন করবে না, কিন্তু শিক্ষক হওয়া মাত্রই সেও এই নিষ্ঠুর ক্ষমতা কাঠামোর সাথে একাত্ব হয়ে যায়। এই সামন্তবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন থেকে শুরু করে প্রতিটা স্তরেই বিদ্যমান; ক্ষমতা-কাঠামোর সিঁড়ির একেবারে উপরে বসে আছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি এবং সকলেই নিজের ক্ষমতা প্রদর্শনে ভীষণ আগ্রহী।


বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা সাংবিধানিক নিয়মেই জাতীয় নির্বাচনে ভোট দেয়ার যোগ্যতাসম্পন্ন; তার মানে সে দেশের রাষ্ট্র ক্ষমতায় কে বসবেন আর কে বসবেন না সে সিদ্ধান্তে তার গুরুত্বপূর্ণ অবদান আছে। অথচ, বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরে সেই গণতান্ত্রিক পরিবেশ অনুপস্থিত। প্রশাসনের কোন সিদ্ধান্তে ছাত্রদের কোন প্রতিনিধি থাকে না; যেমন ছাত্র সংসদ নেই, তেমনি বিভাগগুলোর সমিতিতেও ছাত্র প্রতিনিধি অনুপস্থিত। উচ্চশিক্ষার স্থানেই যদি গণতন্ত্র চর্চা না হয়, তাহলে সামন্ত চিন্তা আমাদের ছেড়ে যাবে কিভাবে? আবারো স্মরণ করতে হয় তাজউদ্দীন আহমদের উক্তি; তিনি বলেছিলেন, ‘আমরা সামন্তবাদী অবস্থা ও পরিবেশ থেকে এখনও পূর্ণ গণতান্ত্রিক অবস্থায় পৌছাতে পারিনি’। এই পূর্ণ গণতান্ত্রিক অবস্থায় পৌঁছানোর সবচেয়ে বড় দায়িত্ব আমাদেরই, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-ছাত্র সমাজের।


পুরো শরীরে যখন পচন ধরে তখন দু একটি নির্দিষ্ট অঙ্গ পচনের হাত থেকে রক্ষা পাবে তা হয় না; প্রত্যেকটা অঙ্গই পচে। বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরো ব্যবস্থাতেই যখন সামন্ত চিন্তার গাঢ় উপস্থিতি বিদ্যমান, সেখানে ছাত্ররাও কেন বাদ যাবে? সিনিয়ররা জুনিয়রদের মানুষ বানানোর জন্যে ও আদব-কায়দা শেখানোর জন্যে ‘র‍্যাগিং’ নামক যে উদ্ভট প্রথা চালু করেছে সেটাও সেই পচনের আরেক রূপ। এখানেও সেই ক্ষমতা-কাঠামো! অবস্থাটা এমন যে, নতুন যে আসবে তাকে নিয়ে উদ্ভট হাসি তামাশা করা যেন সিনিয়রদের অধিকারের মধ্যেই পড়ে। যদি কোন জুনিয়র প্রতিবাদ করে তবে সে আখ্যা পায় ‘বেয়াদব’ হিসেবে। নতুন কারো সাথে যখন পরিচিত হই তখন সে যে অস্বাভাবিক ভঙ্গিতে হড়বড় করে তার নামধাম, ঠিকানা সব বলতে যায় এবং তার চোখে মুখে যে আতংক থাকে সেটা যে মোটেও শ্রদ্ধার নয় তা বলার অপেক্ষা রাখে না। শ্রদ্ধা আর ভয় যে এক না সেটা বুঝার ক্ষমতাও আমাদের উধাও হয়ে গিয়েছে আজকাল। এই ‘ক্ষমতা-কাঠামো’টাকে ভাঙতে পারছে না কেউ; বরং আষ্টেপৃষ্ঠে  জড়িয়ে পড়ছে এর সাথে। একজন ছাত্র যখন নবীন তখন সে যে অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে গিয়েছে সেটা উপলব্ধি না করে সিনিয়র হওয়া মাত্রই একই কাজ (র‍্যাগিং) সে-ও করছে। কেননা, তার মস্তিষ্কে ততদিনে আসর গড়েছে ‘ক্ষমতা-কাঠামো’।


আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় সংকটের দিক অনেক; পাশাপাশি সম্ভাবনার দিকও অনেক যদি সেগুলো কাটিয়ে ওঠা যায়। আমাদেরই ঠিক করা উচিৎ কেমন হওয়া উচিৎ আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা? কি হওয়া উচিৎ আমাদের শিক্ষার দর্শন? এছাড়া, সর্বোপরি সকলের জন্যে বৈষম্যহীন শিক্ষাব্যবস্থা চালু করতে না পারলে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের কোন স্বপ্ন এবং লক্ষ্য অর্জন করা আদৌ সম্ভব হবে না। কেননা,  বৈষম্যহীন সমাজ গড়ার প্রথম এবং প্রধান হাতিয়ার হচ্ছে বৈষম্যহীন শিক্ষাব্যবস্থা তৈরি করা। এখানেই মূল দায়িত্ব এসে বর্তায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও ছাত্রদের উপর। নোয়াম চমস্কি  এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, “দায় দায়িত্ব সুযোগ সুবিধা ভোগের সাথে সম্পর্কিত। আপনি যতই বেশি সুবিধাভোগী হবেন তত বেশি দায়িত্ব আপনার”। তাই আমাদের সংকটগুলোকে সম্ভাবনাতে পরিণত করতে এবং সকল ধর্মান্ধতা-কুসংস্কার-শৃঙ্খল ভেঙে ফেলার প্রাথমিক শর্ত হচ্ছে, আমাদের মনে জেঁকে বসে থাকা সামন্ত-প্রভুকে বিদায় করা।

[লেখাটি শাবিপ্রবি’র পরিসংখ্যান বিভাগের প্রথম পূনর্মিলনী-২০১৭ এর স্মারকগ্রন্থ ‘অনুরণন’ এ প্রকাশিত]

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

লেখকদের নামঃ