১৫ আগস্ট এবং এনায়েতুল্লাহ খান

প্রকাশ : ১৫ আগস্ট ২০১৯, ১৪:১৯

২৮ সেপ্টেম্বর, ১৯৭৩ সাল, সংসদ অধিবেশনে আব্দুল কুদ্দুস মাখন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর উদ্দেশ্যে প্রশ্ন করলেন- "পাকিস্তানী নাগরিক মোহাম্মদ আসলাম এখন কোথায়?"

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল মালেক উকিলের বয়ান থেকে এবং গোয়েন্দা রিপোর্টের ভিত্তিতে জানা যায়, ভুট্টো যখন তার পিপলস পার্টি গঠন করেন তখন এই আসলাম নামক উর্দুভাষী সাংবাদিকের আগমন ঘটে এদেশে। যুদ্ধকালে সে বাংলাদেশেই ছিল এবং যথারীতি পাকবাহিনীর সাথে যোগাযোগও ছিল। এই আসলাম ছিল পাকিস্তান তথা ভুট্টোর এজেন্ট।

স্বাধীনতার পর পাকিস্তানের সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ায় সে ঢাকায় গোপনে কাজ করছিল। তার কাজ ছিল বিচ্ছিন্ন পাকিস্তানী এজেন্টদের সাথে পাকিস্তানী গুপ্তচর বাহিনীর পুন:যোগাযোগ ঘটিয়ে দেয়া। আর এই কাজগুলো সে সুন্দর করে সমাধান করে এপ্রিলেই এদেশ ছেড়ে চলে যায়।

এবার আসি আসলাম খান কার শেল্টারে এদেশে ছিলেন? তিনি ছিলেন এদেশের প্রথিতযশা সাংবাদিক এনায়েতুল্লাহ খানের তত্ত্বাবধানে সাপ্তাহিক হলিডের নির্বাহী সম্পাদক হিসেবে।

সংসদে মাখন সাহেবের ঐ প্রশ্নোত্তর পর্বের ঘটনা এনায়েত সাহেবের কানে এসেছিল এবং তিনি প্রধানমন্ত্রী বরাবর পার্লামেন্টের এই 'ননসেন্স' থামানোর আবেদন করেন। এখানে উল্লেখ্য যে আসলাম একজন পাকিস্তানী ও আসলাম যে তার পত্রিকায় কর্মরত ছিলেন এনায়েতুল্লাহ সেটা অস্বীকার করেননি। [Holiday, 30th September,1973]

 

১। ১৯৭৪ সালের ২৪ শে জুন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ভুট্টো তিনদিনের সফরে বাংলাদেশে আসেন। তার সঙ্গে সর্বমোট ১০৭ জন সফর সঙ্গী ছিল। ভুট্টো ঢাকায় পৌছার পূর্বেই একটি অগ্রবর্তী দল ঢাকা আসে। তাদের মধ্যে সামরিক ও বেসামরিক গোয়েন্দাবাহিনীর লোক অন্তর্ভুক্ত ছিল। ঢাকা এসেই তাদের পুরানো বন্ধুদের সাথে যোগাযোগ করতে সক্ষম হয় কেননা হলিডে পত্রিকার নির্বাহী সম্পাদক মি. আসলাম ভুট্টো তথা পাকিস্তানী এজেন্ট হিসেবে স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে পাকিস্তানপন্থীদের ছিন্নভিন্ন ও হতোদ্যম শক্তি ও ব্যক্তিবর্গকে চাঙ্গা রাখতে পেরেছিলেন। [ হু কিলড মুজিব- এ এল খতিব]।

বাংলাদেশে তখনকার প্রচন্ড ভারত বিরোধীতার পাশাপাশি 'মুসলিম বাংলা'র স্বপক্ষে কার্যকর ব্যবস্থা ও আশাবাদ গড়ে তোলার কাজে এই ব্যক্তিটি হলিডে চক্রের সহায়তায় অত্যন্ত গোপনে কাজ করে যাচ্ছিল। এনায়েতুল্লাহর সহায়তায় ধরাপড়ার পূর্বেই পাকিস্তানী নাগরিক আসলাম সাহেব পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়।

 

২। স্বাধীনতার পর জনাব তাজউদ্দিন সহ মন্ত্রীপরিষদের সবাই যখন দালাল, রাজাকার, আলবদর, মুসলিম লীগ, জামাতীদের আইনগত ভাবে ব্যবস্থা নিতে যাচ্ছিলেন বা চেষ্টা করছিলেন তখন এনায়েতুল্লাহ পরিচালিত সাপ্তাহিক হলিডে লিখে দিল, "তাহলে কি আমরা ছয় কোটি লোক সকলেই দালাল?"

জাতীয় ঐক্যে ফাটল ধরিয়ে স্বাধীনতা বিরোধীদের রক্ষার্থে বিকল্প জনমত গঠনের পায়তারা শুরু করে এই হলিডে চক্র। শুরুহয় অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদের বিরুদ্ধাচরণ এবং বঙ্গবন্ধু- তাজউদ্দিনের মধ্যে ক্রমাগত বিরোধ তার প্রচেষ্টাকে আরও সফল করে। এরই মধ্যে বঙ্গভবনে শুরু হয় অবাধ যাতায়াত। তার গতিবিধি সন্দেহজনক হওয়ায় নিরাপত্তা আইনে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এম মনসুর আলীর নির্দেশে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। "এনায়েতুল্লাহ খান বন্দী হবার পর তার স্ত্রী গিয়ে শেখ মুজিবের দুয়ারে ধর্ণা দেন এবং বঙ্গবন্ধু এনায়েতুল্লাহ কে ক্ষমা করেন" [কনফিডেনসিয়াল ডায়েরী- বিক্রমাদিত্য ]

শুধু তাইনা বঙ্গবন্ধু এই এনায়েতুল্লাহকে চিনতে ভুল করেন এবং তাকে প্রেসিডেন্টের তথ্য উপদেষ্টা পদে নিয়োগ করেন।

 

৩। তথ্য উপদেষ্টার পদ পেয়েই এনায়েতুল্লা শুরু করলেন আরেক খেলা। চলুন দেখে আসি এক সাক্ষাতকারে তিনি কি বলেছেন:

"বাকশাল সৃষ্টির আগে শেখ মুজিব আমাকে একদিন ডেকে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় মিডিয়া গঠন সম্পর্কিত একটি পেপার তৈরী করে দিতে বললেন। আমি, সাংবাদিক শহীদুল হক ও তোয়াব খান এই তিনজন অন্যান্য সমাজতান্ত্রিক দেশের আলোকে বাংলাদেশে মিডিয়া 'State Controlled Media'-র স্ট্রাকচার ও ভূমিকা কি হওয়া উচিৎ এ বিষয়ে একটি পেপার তৈরী করে দিলাম। পেপারটি ছিল ফুললি একাডেমিক। সেখানে আমরা কয়েকটি দেশের দৃষ্টান্ত দেখিয়ে State Controlled Media-র পরামর্শ দিয়েছিলাম। আমি বিদেশ থাকা কালেই এটি ইম্পলিমেন্ট করা হয়।" [ এনায়েতুল্লাহ খানের সাক্ষাতকার, তারকালোক ২৫ তম সংখ্যা]

এই উপদেষ্টার পরামর্শে তৈরী ১৯৭৫ সালের নিউজপেপার অর্ডিন্যান্স পাশ হয়। এই বাকশাল গঠনের দুই মাসের মধ্যে বঙ্গবন্ধু খুন হলে এই এনায়েতুল্লাহ লিখলেন, 'তিনি দেশের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন। জীবনদিয়ে তাকে সেই মূল্য শোধ করতে হয়েছে।'

বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর খন্দকার মোশতাক আহমদ ক্ষমতায় এসেই এনায়েতুল্লাহকে বাংলাদেশ টাইমসের সম্পাদক নিযুক্ত করেন। ৭ নভেম্বর প্রতিক্রিয়াশীল অংশ ক্ষমতা দখল করলে এনায়েত সাহেব লিখলেন: 'বাংলাদেশ উইনস ফ্রিডম ' অর্থাৎ এতদিনে বাংলাদেশ স্বাধীন হল।

 

৪। এনায়েতুল্লাহ খান ছিলেন সিআইএ'র আশির্বাদপুষ্ট সাংবাদিক। সে কিসিঞ্জারের নির্দেশিত পথেই চালিত করতে চেয়েছিল এদেশের সংবাদমাধ্যম। মিথ্যাচার করে করে বিবিসি'র কাছে পাঠিয়েছে নিউজ। আস্তে আস্তে বঙ্গবন্ধুর জনপ্রিয়তাকে প্রশ্নবিদ্ধ করার চেষ্টা চালিয়েছে এই এনায়েতুল্লাহ খান এবং সে সফল হয়েছে পুরোপুরি।

সে যে সিআইএ'র এজেন্ট ছিল তার প্রমান পাওয়া যায় ১৯৭৮, ডিসেম্বর, ভূপেন গুপ্ত কতৃক উত্থাপিত ভারতীয় লোকসভার শীতকালীন অধিবেশনের প্রসিডিংস-এ।

সেখানে বাংলাদেশের পাঁচজনের নামোল্লেখ আছে:
১. সাপ্তাহিক হলিডের প্রাক্তন সম্পাদক এনায়েতুল্লাহ খান
২. ব্যারিস্টার মঈনুল হোসেন, দৈনিক ইত্তেফাকের সম্পাদক মন্ডলীর সভাপতি।
৩. আনোয়ার হোসেন মঞ্জু, সম্পাদক, দৈনিক ইত্তেফাক।
৪. জনাব আমানউল্লাহ, বাসস এর প্রাক্তন জেনারেল ম্যানেজার।
৫. নুরুল ইসলাম পাটোয়ারী, প্রাক্তন সম্পাদক- দৈনিক বাংলা ও দৈনিক বার্তা।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

লেখকদের নামঃ