মানুষ কেন অন্য প্রাণীর দুধ পান করে?

প্রকাশ : ১৭ মে ২০২৩, ১৪:১২

সাহস ডেস্ক
-দুধ

শুরুর দিকে মানুষ অন্য প্রাণীর দুধ হজম করতে পারতো না। কিন্তু এখন অনেক মানুষই অন্য প্রাণীর দুধ হজম করতে পারে। মানুষের মধ্যে দুগ্ধ সহনশীলতার বিবর্তন কেন তৈরি হলো?

প্রাণিজ দুধের প্রতিযোগী রয়েছে। বিকল্প ‘দুধ’ সয়া বা আমন্ড উদ্ভিদ থেকে তৈরি, যার জনপ্রিয়তা দিন দিন বাড়ছে। প্রাণিজ দুধে যাদের অ্যালার্জি হয় এবং নিরামিষভোজীদের জন্য এই বিকল্প দুধ উপযোগী। ২০১৮ সালের যুক্তরাজ্যের দ্য অ্যাপ্রেনটিস সিরিজের দ্বিতীয় স্থান অধিকারী ব্যক্তি বিভিন্ন স্বাদ ও ফ্লেবারের বাদাম দুধের ব্যবসা করতেন।

তবে প্রাণিজ দুধের সাথে মানব সভ্যতার সম্পর্কের ইতিহাসের মধ্যে নতুন সংযোজন হচ্ছে এই বিকল্প দুধ। এই সম্পর্কের ইতিহাস হাজার বছরের পুরনো এবং এটি নানা চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে আজকের অবস্থানে এসেছে।

আপনি চিন্তা করলে দেখবেন, দুধ আসলে পান করার জন্য বেশ উদ্ভট একটা বস্তু। এটা হচ্ছে এমন একটি তরল পদার্থ যা গরু বা অন্য কোন প্রাণী তার বাচ্চাকে খাওয়ানোর জন্য উৎপন্ন করে। এটা সংগ্রহ করতে হলে গরুর স্তন থেকে দোহন করতে হয়।

 

অনেক সংস্কৃতিতে এটা খুব একটা পরিচিত নয়। ২০০০ সালে চীন দেশজুড়ে একটি প্রচারণা চালায়, যেটির উদ্দেশ্য ছিল সুস্বাস্থ্যের জন্য জনগণকে বেশি পরিমাণে দুধ এবং দুগ্ধজাত খাবার খেতে উৎসাহিত করা।

বিষয়টি নিয়ে চীনের অনেক প্রবীন নাগরিক সন্দিহান ছিলেন। তাদের সন্দেহ পাশ কাটিয়ে এই প্রচারণা চালানো হয়েছিল। গাঁজন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে দুধ থেকে পনির উৎপাদিত হয়। এটি খেলে অনেক চীনা নাগরিক অসুস্থ হয়ে যান।

তিন লাখ বছরের মানব ইতিহাসে দুধ পান করার অভ্যাস বেশ নতুন। দশ হাজার বছর আগেও বিরল উৎসব ছাড়া তেমন কেউ দুধ পান করতো না। প্রথম দিকে যারা দুধ পান করতে শুরু করে তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল পশ্চিম ইউরোপের শুরুর দিককার কৃষক এবং পশুপালক-তারাই প্রথম মানব যারা গরুসহ গৃহপালিত পশুর দুধ পান করতো।

বর্তমানে উত্তর ইউরোপ, উত্তর আমেরিকা এবং বিশ্বের অন্যান্য জায়গায় দুধ পান করা খুবই সাধারণ একটি বিষয়।

শিশু খাদ্য

প্রাণিজ দুধ পান করা জৈবিকভাবেই একটি অস্বাভাবিক বিষয়। দুধে এক ধরণের চিনি থাকে, যাকে বলা হয় ল্যাক্টোজ। এটি ফলমূল এবং অন্যান্য মিস্টি খাদ্যে পাওয়া চিনির তুলনায় আলাদা।

আমরা যখন শিশু থাকি তখন আমাদের দেহে ল্যাক্টেজ নামে বিশেষ ধরণের এনজাইম তৈরি হয় যা আমাদের মায়ের দুধে থাকা ল্যাক্টোজ হজম করতে সহায়তা করে। কিন্তু আমরা যখন শিশুকাল অতিক্রম করি তখন অনেক মানুষের দেহেই এটির উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায়।

শরীরে ল্যাক্টেজ ছাড়া আমরা দুধে থাকা ল্যাক্টোজ ভালভাবে হজম করতে পারি না। যার কারণে প্রাপ্তবয়স্ক কেউ যদি বেশি পরিমাণে দুধ পান করে তাহলে পেট ফাঁপা, পেট ব্যথা এবং ডায়রিয়া পর্যন্ত হতে পারে।

এটা উল্লেখ করা যায় যে অন্য স্তন্যপায়ী প্রাপ্তবয়স্ক প্রাণীদের মধ্যে ল্যাক্টেজ সহিষ্ণুতা নেই- যেমন প্রাপ্তবয়স্ক গরুর সক্রিয় ল্যাক্টেজ নেই। একইভাবে বিড়াল বা কুকুরের মধ্যেও এটা নেই।

সুতরাং প্রথম যে ইউরোপিয়রা দুধ খাওয়া শুরু করেছিল তারা হয়তো অনেক বেশি পরিমাণ বায়ুত্যাগ করতো। কিন্তু এর পর বিবর্তন ঘটতে শুরু করে।

অনেক মানুষ প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পরও তাদের ল্যাক্টেজ এনজাইম ধরে রাখতে সক্ষম হতে থাকে। এই “ল্যাক্টেজ সহিষ্ণুতা” তাদের কোন ধরণের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ছাড়াই দুধ পান অব্যাহত রাখতে সাহায্য করেছে। এটা সম্ভব হয়েছে ডিএনএ-এর একটি অংশে পরিবর্তনের কারণে যা ল্যাক্টোজ জিনের কার্যক্রমকে নিয়ন্ত্রণ করে।

“ল্যাক্টেজ সহিষ্ণু জিনের অংশের উপস্থিতি আমরা ইউরোপে প্রথম দেখি আজ থেকে প্রায় ৫ হাজার বছর আগে দক্ষিণ ইউরোপে। আর এর পরে মধ্য ইউরোপে ৩০০০ বছর আগে এটি ব্যাপকভাবে পাওয়া যায়,” বলেন প্যারিসের মিউজিয়াম অব হিউম্যানকাইন্ডের সহকারী অধ্যাপক ল সিগুরেল। তিনি ২০১৭ সালে ল্যাক্টেজ সহিষ্ণুতার বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যার রিভিউ যৌথভাবে লিখেছিলেন।

ল্যাক্টেজ সহিষ্ণুতার ধারা বির্বতনের মাধ্যমে ঘটেছে এবং আজ এটি অনেক মানুষের মধ্যে বেশ সাধারণ একটি ঘটনা। ইউরোপের উত্তরাঞ্চলে ৯০ শতাংশের বেশি মানুষ ল্যাক্টেজ সহিষ্ণু। আফ্রিকা এবং মধ্যপ্রাচ্যের ক্ষেত্রেই এটি প্রায় একই রকম।

কিন্তু এখনো অনেক মানুষ আছে যাদের মধ্যে ল্যাক্টেজ সহিষ্ণুতা নেই বললেই চলে। অনেক আফ্রিকানদের মধ্যে এই বৈশিষ্ট্য নেই এবং এশিয়া ও দক্ষিণ আমেরিকাও এটি বেশি নয়।

এই বৈশিষ্ট্যের কোন যুক্তিযুক্ত কারণ জানা যায় না। কারণ আমরা এখনো জানি না যে দুধ পান এবং ল্যাক্টেজ সহিষ্ণুতা কেন উপকারী, বলেন সিগুরেল: “এটা নিজে থেকেই কেন এতো বেশি উপকারী?”

এর ভাল উত্তর হচ্ছে, দুধ পান করলে তা মানুষের জন্য পুষ্টির একটি নতুন উৎস তৈরি করে এবং এর ফলে অনাহারের ঝুঁকি কমায়। কিন্তু একটু খতিয়ে দেখলে এই যুক্তি টেকে না।

“খাবারের অনেক ভিন্ন ভিন্ন উৎস রয়েছে, তাই এটা অবাক করা যে কোন একটি উৎস এতো বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে, যা অন্য খাদ্য উৎসের তুলনায় অনেক বেশি আলাদা,” বলেন সিগুরেল।

যেসব মানুষ ল্যাক্টেজ সহিষ্ণু নন তারা নির্দিষ্ট পরিমাণ ল্যাক্টোজ খেতে পারে। তার মানে হচ্ছে, কম পরিমাণ দুধ পান করলে কিছু হয় না। এছাড়া দুধকে অন্য খাদ্যবস্তু যেমন মাখন, দই, ক্রিম বা পনিরে পরিণত করার সুযোগ আছে- যার সবগুলোই ল্যাক্টোজের পরিমাণ কমিয়ে দেয়।

চেডার চিজের মত শক্ত পনিরে দুধের তুলনায় ১০ শতাংশেরও কম ল্যাক্টোজ থাকে। একই ঘটনা ঘটে মাখনের ক্ষেত্রেও। “হেভি ক্রিম আর মাখনেও কম পরিমাণে ল্যাক্টোজ থাকে,” বলেন সিগুরেল।

সেই অনুযায়ী, মানুষ বেশ দ্রুতই পনির আবিষ্কার করেছে। ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে প্রত্নতাত্ত্বিকরা ক্রোয়েশিয়ায় মাটির পাত্রের টুকরা খুঁজে পান। সেখানে ফ্যাটি অ্যাসিডের অস্তিত্ব পাওয়া যায় যার মানে হলো ওই পাত্রটিকে এক সময় ঘোল থেকে দই আলাদা করার কাজে ব্যবহার করা হতো। যা কিনা পনির উৎপাদনের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।

এটা যদি সঠিক হয় (যদিও এটা নিয়ে প্রশ্ন আছে) তাহলে ইউরোপের দক্ষিণাঞ্চলের মানুষ ৭২০০ বছর আগে থেকে পনির উৎপাদন করে আসছে। একই ধরণের আরো কিছু প্রমাণ ইউরোপের অন্যান্য অংশে পাওয়া যায় যা অবশ্য কিছুটা পরের সময় বা ৬০০০ বছর আগে থেকে পনির উৎপাদনের খবর মেলে। এগুলো ইউরোপে ল্যাক্টেজ সহিষ্ণুতা স্বাভাবিক হওয়ার অনেক আগের ঘটনা।

ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনের প্রজনন বিদ্যার অধ্যাপক ডালাস সোয়ালো বলেছেন যে, মানুষের মধ্যে যে ল্যাক্টেজ সহিষ্ণুতা গড়ে ওঠা ও না ওঠা নিয়ে সুস্পষ্ট বৈশষ্ট্য রয়েছে।

যাদের মধ্যে এই বৈশিষ্ট্য আছে তারা পশুপালক: যারা পশুপালন করে। যারা শিকারী বা খাবার সংগ্রহ করতো এবং পশুপালন করতো না তাদের মধ্যে এই জিনগত পরিবর্তন হয়নি। একইভাবে যারা বনমালি বা যারা পশু নয় বরং উদ্ভিদ ও গাছের চাষ করতেন তাদের মধ্যেও এই বৈশিষ্ট্য দেখা যায়নি।

এর থেকে বোঝা যায় যে, যাদের কাছে প্রাণিজ দুধ ছিল না তাদের মধ্যে দুধের সাথে খাপখাইয়ে নেয়ার মতো বির্বতনের চাপ ছিল না।

প্রশ্ন হচ্ছে কেন কিছু পশপালক মানুষের মধ্যে এই বৈশিষ্ট্য ছিল এবং বাকীদের মধ্যে ছিল না?

সিগুরেল এশিয়া অঞ্চলের পশুপালক গোষ্ঠীর উদাহরণ তুলে ধরেন। যেমন মঙ্গোলিয়া, এদের মধ্যে সর্বনিম্ন হারে ল্যাক্টেজ সহিষ্ণুতা পাওয়া যায়, যদিও তারা তাদের পশুর দুধের উপর খাদ্যের জন্য প্রচন্ডভাবে নির্ভরশীল।

এই জিনগত পরিবর্তন পার্শ্ববর্তী ইউরোপ এবং পশ্চিম এশিয়ার দেশগুলোতে অনেকটা স্বাভাবিক ছিল। তাই এই জিনগত পরিবর্তনগুলো এশিয়ার এই গোষ্ঠীদের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়ার কথা ছিল যা আসলে হয়নি। “এটাই হচ্ছে সবচেয়ে বড় ধাঁধা,” বলেন সিগুরেল।

দুগ্ধজাত খাবারের সুবিধা

তিনি ধারণা করেন যে, পুষ্টিগুণ ছাড়াও দুধ পান করার আরো উপকারিতা রয়েছে। যারা পশুপালন করে তারা তাদের রোগেরও সান্নিধ্যে আসে, যার মধ্যে রয়েছে অ্যানথ্রাক্স এবং ক্রিপ্টোস্পোরিডিওসিস। গরুর দুধ পান করলে এসব সংক্রমণের বিরুদ্ধে অ্যান্টিবডি তৈরি হতে পারে। আসলেই দুধের সুরক্ষাগুণ বুকের দুধ পান করা শিশুদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ উপকারিতা বলে ধরা হয়।

কিন্তু ল্যাক্টেজ সহিষ্ণুতার রহস্যময় অনুপস্থিতির কারণে একটি পশুপালক গোষ্ঠীর মধ্যে কোন একজন সঠিক জিনগত পরিবর্তন হবে কিনা তার সম্ভাবনা কিছুটা কমিয়ে দিতে পারে। মোটামুটিভাবে বলা যায় যে তখন পৃথিবীতে কম মানুষ ছিলো এবং স্থানীয় বাসিন্দাদের সংখ্যাও কম ছিল, যার কারণে যারা বাদ পড়েছে সেটা তাদের মন্দভাগ্য ছাড়া আর কিছু নয়।

আমার মনে হয়, এই চিত্রের সবচেয়ে সামঞ্জস্যপূর্ণ অংশ হচ্ছে পশুপালনের সাথে জীবনযাত্রার একটি আন্তঃসম্পর্ক ছিলো বলেন সোয়ালো। তিনি বলেন, কিন্তু এর জন্য আপনার আগে জিনগত পরিবর্তন হওয়াটা জরুরী। এরপরই শুধু প্রাকৃতিক নির্বাচন পদ্ধতি কাজ করবে।

মঙ্গোলিয়ার পশুপালকদের ক্ষেত্রে, সোয়ালো বলেন যে, তারা শুধু গাঁজানো দুধ পান করতো, যাতে ল্যাক্টেজের পরিমাণ কম। তর্কাতীতভাবেই, দুধকে সহজেই আরো বেশি খাদ্যোপযোগী করতে পারাটা ল্যাক্টেজ সহিষ্ণুতা বাড়ার বিষয়টিকে আরো বেশি জটিল করে তুলেছে।

কারণ সাংস্কৃতিকভাবে আমরা দুধকে প্রক্রিয়াজাত করতে এবং গাঁজন জাত করতে এতো বেশি পারদর্শী ছিলাম যে, কেন আমাদেরকে এটি জিনগতভাবে পরিবর্তন ঘটাতে হলো তা বোঝাটা কঠিন হয়ে পড়েছে, বলেন সয়ালোর পিএইচডি শিক্ষার্থী ক্যাথেরিন ওয়াকার।

ল্যাক্টেজ সহিষ্ণুতা বাড়াতে একটি নয়, একাধিক বিষয় কাজ করে। সোয়ালো ধারণা করেন যে, এর একটি বিষয় হতে পারে দুধের পুষ্টিগুণ যেমন এতে প্রচুর পরিমাণে ফ্যাট, প্রোটিন, চিনি এবং ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন ডি এর মতো মাইক্রোনিউট্রিয়েন্টস রয়েছে।

এটা পরিষ্কার পানিরও একটি উৎস। আপনার গোষ্ঠী কোন অঞ্চলে বাস করে তার উপর ভিত্তি করে আপনি অভিযোজন করে থাকেন একাধিক কারণে।

তবে বিবর্তনের কারণে ল্যাক্টেজ সহিষ্ণুতা তৈরি হয়েছে কিনা তা এখনো পরিষ্কার নয় এবং এ কারণেই এটি আরো বেশি বিস্তার লাভ করবে কিনা তাও বলা যাচ্ছে না, বলেন সোয়ালো। ২০১৮ সালে চিলির কোকুইবো এলাকায় একদল পশুপালকের উপর পরিচালিত একটি গবেষণায় অংশ নিয়েছিলেন তিনি যারা ল্যাক্টেজ সহিষ্ণুতা পেয়েছিল তাদের পূর্বপুরুষরা ৫০০ বছর আগে ইউরোপ থেকে আসা বাসিন্দাদের সাথে প্রজনন করার পর। এই বৈশিষ্ট্য এখন পুরো জনসংখ্যার মধ্যে ছড়িয়ে পড়ছে: এটা বিবর্তনবাদের জন্য হয়েছে কারণ ৫০০০ বছর আগে উত্তর ইউরোপিয়দের মধ্যে এটা ছিল।

তবে এটি একটি বিশেষ পরিস্থিতি কারণ কোকুইমবো এলাকার বাসিন্দারা দুধের উপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল। বিশ্ব জুড়ে এই চিত্র ভিন্ন।

আমার মনে হয়ে যেসব দেশে দুধ ছাড়া অন্য খাবারের ঘাটতি থাকায় দুধের উপর নির্ভরতা রয়েছে সেসব দেশ ছাড়া অন্যান্য এলাকায় এটি একটি স্থিতাবস্থায় পৌঁছেছে, বলেন সোয়ালো। “পশ্চিমে, যেখানে এতো ভাল খাবার রয়েছে, সেখানে এ ধরণের কোন চাপ থাকার কথা নয়।”

দুগ্ধজাত পণ্য কমছে?

তবে গত কয়েক বছরে প্রচারিত নানা খবর অবশ্য এর উল্টো চিত্র তুলে ধরে: এত বলা হচ্ছে যে মানুষ দুধ খাওয়া ছেড়ে দিচ্ছে। ২০১৮ সালের নভেম্বরে গার্ডিয়ান তাদের এক খবরের শিরোনামে বলে, “কিভাবে দুধের প্রতি আমাদের ভালবাসা কমলো”, যেখানে তারা এমন কিছু প্রতিষ্ঠানের উত্থানের গল্প বলে যারা ওটমিল্ক ও বাদামের দুধ বিক্রি করে। এতে আরো উল্লেখ করা হয় যে, ঐতিহ্যগতভাবে প্রাণিজ দুধ বাজার হারাচ্ছে।

কিন্তু পরিসংখ্যান ভিন্ন গল্প বলে। আইএফসিএন ডেইরি রিসার্চ নেটওয়ার্কের ২০১৮ সালের পরিসংখ্যান বলছে, ১৯৯৮ সালের পর থেকে বাড়তি চাহিদার কারণে প্রতি বছরই দুধ উৎপাদন বেড়েছে। ২০১৭ সালে বিশ্বব্যাপী ৮৬৪ মিলিয়ন টন দুধ উৎপাদিত হয়েছিল। এরপর থেকে এটি কমতির কোন লক্ষণ দেখা যায়নি: আইএফসিএন বলছে যে, ২০৩০ সাল নাগাদ দুধের চাহিদা ৩৫শতাংশ বেড়ে ১১৬৮ মিলয়ন টনে দাঁড়াবে।

এরপরও এটি স্থানীয় আরো কিছু ট্রেন্ড তৈরি করে। খাবার খাওয়া নিয়ে ২০১২ সালে করা একটি গবেষণা অনুযায়ী, গত কয়েক দশকে যুক্তরাষ্ট্রে দুধ পানের পরমাণ কমেছে- এই পানের অভ্যাস অ্যামন্ড বাদাম দুধের পরিবর্তে অন্য পানীয় দ্বারা স্থানান্তরিত হয়েছে। এই ভারসাম্য রক্ষিত হয়েছিল উন্নয়নশীল দেশে বিশেষ করে এশিয়া চাহিদা বাড়ার মাধ্যমে- যা আইএফসিএন-ও উল্লেখ করেছে। এরমধ্যে ১৮৭ দেশের মানুষের পানের অভ্যাসের উপর পরিচালিত ২০১৫ সালের এক গবেষণা অনুযায়ী, বয়স্ক মানুষেরা বেশি দুধ পান করেন। যদিও এটি তরুণ জনগণের দইয়ের মতো দুগ্ধজাত পণ্যের ভোগ সম্পর্কে কোন ধারণা দেয় না।

তারপরও এটা মনে হয় না যে বিকল্প দুধ বিশ্বের ক্রমবর্ধমান দুধের চাহিদা মেটাতে ভূমিকা রাখতে পারবে, অন্তত পরবর্তী আরো কয়েক দশক ধরে পারবে না বলে মনে হচ্ছে।

ওয়াকার বলেন, প্রাণিজ দুধের জায়গা বিকল্প দুধ দখল করে নিতে পারবে না। বিশেষ করে এগুলোর মধ্যে অনেকগুলোর পুষ্টিগুণ তত ভাল নয়। তিনি বলেন, এগুলো বেশিরভাগ ক্ষেত্রে শাকাহহারী এবং দুধের প্রতি অ্যালার্জি রয়েছে এমন মানুষদের জন্য প্রয়োজনীয়। অ্যালার্জি হচ্ছে দুধের প্রোটিনের প্রতি বিরূপ প্রতিক্রিয়া এবং এর সাথে ল্যাক্টোজের কোন সম্পর্ক নেই।

এটা সবচেয়ে বেশি লক্ষণীয় যে, দুধের চাহিদা বাড়ছে এশিয়া অঞ্চলে যেখানে বেশিরভাগ মানুষই ল্যাক্টেজ অসহিষ্ণু। যাইহোক সেখানকার মানুষ দুধের উপকারীতার কারণে তা হজমের সমস্যা ইস্যুকে পাত্তা দেয় না বা প্রক্রিয়াজাত করার প্রয়োজন মনে করে না।

বাস্তবিকপক্ষে জাতিসংঘের খাদ্য এবং কৃষি বিষয়ক সংস্থা উন্নয়নশীল দেশের বাসিন্দাদের অপ্রচলিত দুগ্ধজাত প্রাণী যেমন লামা প্রতিপালনের পরামর্শ দেয়। যাতে করে গরুর দুধ অনেক বেশি দামী হয়ে গেলে বা পাওয়া না গেলেও যাতে দুধের সরবরাহ থাকে।

২০১৯ সালের জানুয়ারিতে প্রকাশিত একটি বড় গবেষণায় ‘প্ল্যানেটারি হেলথ ডায়েট’ বিষয়ে ব্যাখ্যা করা হয় যা একই সাথে আমাদের স্বাস্থ্যের জন্যও উপকারী এবং পরিবেশের জন্যও ভাল। সেখানে মাংস এবং অন্যান্য প্রাণিজ দ্রব্য খাওয়ার বিষয়টি ব্যাপক হারে কমানোর কথা বলা হয় এবং এটি প্রতিদিন এক গ্লাস দুধ খাওয়ার মতোই উপকারী বলে উল্লেখ করা হয়।

দুধের চাহিদা শেষ হয়ে যাচ্ছে না। বরং আমাদের শরীরে বির্বতন ঘটুক আর নাই ঘটুক দুধের চাহিদা এখনো বেড়েই চলেছে।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত