নির্ভীক প্রহরীর মতো দাঁড়িয়ে আছে রাবির বধ্যভূমি

প্রকাশ : ০৬ সেপ্টেম্বর ২০২২, ১৩:৪৫

সাহস ডেস্ক

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল ক্যাম্পাসের উত্তর পাশে তিনতলা বিশিষ্ট একটি ঐতিহ্যবাহী হলের অবস্থান। হলটির নাম শহীদ শামসুজ্জোহা হল। এ হল থেকে প্রায় আধা কিলোমিটার পূর্বে হাজারো ফুল গাছ দ্বারা বেষ্টিত সাদামাটা একটি স্তম্ভ। স্তম্ভটি বহন করে চলেছে এই শিক্ষালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও কর্মচারীসহ নাম না জানা হাজারো নিরীহ মানুষের স্মৃতি। বলছি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বধ্যভূমির কথা। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে নির্যাতিত ও শহীদ হওয়া সকল বাঙালির স্মৃতি বহন করছে বধ্যভূমিটি। ১৯৭২ সালের ২৩ এপ্রিল আবিষ্কৃত হওয়া এখানকার গণকবরগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ স্মৃতি সংগ্রহশালার অন্তর্ভুক্ত।

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন রাবির শহীদ শামসুজ্জোহা হলকে পাক বাহিনী তাদের সেনা ক্যাম্প হিসাবে ব্যবহার করেছিল। রাজশাহীর পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন এলাকা থেকে নিরীহ বাঙালীদের ধরে আনা হতো এই হলে। তারপর তাদের উপর চালানো হতো অমানবিক নির্যাতন। রেহাই পেতো না নারী-শিশুরাও। সকালে হলের করিডোরে কেউ পড়ে থাকতো মৃতাবস্থায় আবার কেউ বা অর্ধমৃতাবস্থায়। তারপর তাদেরকে গাড়িতে করে গণকবর দেওয়া হতো এই স্থানটিতে। একটা লাশের উপরে আরেকটা লাশকে ফেলা হতো। মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হওয়া সকল বাঙালীর স্মৃতিকে অম্লান করে রাখার স্বার্থে নির্মিত হয় এই স্মৃতিস্তম্ভ।

বধ্যভূমি স্মৃতিস্তম্ভটি নির্মাণের জন্য তৎকালীন উপাচার্য অধ্যাপক ড. আব্দুল খালেক ১৯৯৮ সালে সরকারের কাছে দাবি জানান। পরে ২০০২ সালের ২১ ডিসেম্বর (৭ পৌষ ১৪০৯) এ স্মৃতিস্থম্ভের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন প্রতিমন্ত্রী রেদোয়ান আহমেদ এবং ১৯৯৯ সালের মহান বিজয় দিবসে স্মৃতিফলক উন্মোচন করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য অধ্যাপক সাইদুর রহমান খান। ২০০৪ সালের ৯ ডিসেম্বর (২৫ অগ্রহায়ণ,১৪১১) বধ্যভূমি স্মৃতিস্তম্ভের শুভ উদ্বোধন করেন মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সেই সময়কার প্রতিমন্ত্রী অধ্যাপক মো. রেজাউল করিম।

৬ স্তরবিশিষ্ট এ স্মৃতি স্তম্ভটি সমতল ভূমি হতে ৪২ ফুট উঁচুতে অবস্থিত। স্তম্ভটির চারপাশ ঘিরে আছে গোলাকার একটি কংক্রিটের বেদি এবং বেদির মাঝখানে আছে বড় একটি কূপ। কূপটিকে মৃত্যুকূপ এর সঙ্গে তুলনা করা হয়। স্তম্ভের গায়ের কালো কালো ছাপ যা দেশের স্বাধীনতায় অবদান রাখা শহীদদের রক্ত শুকানো দাগের প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। স্তম্ভের কিছু অংশ ভাঙাচোরা, ক্ষত-বিক্ষত যেনো ইটগুলো খসে পড়ছে। স্তম্ভের ভাঙা ইট দ্বারা মুক্তিযোদ্ধাদের গায়ের ক্ষত বোঝানো হয়েছে। খোলা আকাশের নিচে নির্ভীক প্রহরীর মতো দাঁড়িয়ে আছে স্তম্ভটি।

প্রায় আড়াই কোটি টাকা ব্যয়ে তৈরি করা জায়গাটি ছোট হলেও সেখানে ৮-১০টি গণকবর আবিষ্কৃত হয়েছে এবং ধারণা করা হয় এই গণকবরগুলোতে প্রায় ৩-৪ হাজার নিরীহ মানুষকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর এই মৃত্যুকুপ থেকে মানুষের অসংখ্য খুলি ও কঙ্কাল পাওয়া গেছে। সেগুলো বিশ্ববিদ্যালয় শহীদ স্মৃতি সংগ্রহশালায় সংরক্ষণ করা হয়েছে।

রাবির শহীদ স্মৃতি সংগ্রহশালার পরিচালক সূত্রে জানা যায়, স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে দেশের গণকবরগুলো চিহ্নিত করে সংরক্ষণ করে রাখে বাংলাদেশ সরকার। সারাদেশে জরীপ চালিয়ে বৃহৎ ৮টি গণকবর চিহ্নিত করা হয়। তন্মধ্যে রাবির এ গণকবরটিও স্থান পায়। স্মৃতিস্তম্ভ স্থাপন করার গুরু দায়িত্ব দেওয়া হয় গণপূর্ত অধিদপ্তরের উপর।

ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে মহান মুক্তিযুদ্ধে এদেশের আমজনতার ছিল স্বতঃস্ফূর্ত সংযোগ। তাদের সাথে একাকার হয়ে আন্দোলনে যোগ দেয় এই বিদ্যাপীঠের শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও কর্মচারীরাও। যাদের অবদান কখনো মলিন হবার নয়। ইতিহাসের প্রতিটি পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে তাদের নাম, অমলিন থেকে যাবে দেশপ্রেমী মানুষদের অন্তরে। বিশ্ববিদ্যালয়ের নথিপত্রে ৩ জন শিক্ষকসহ ২৭ জন শহীদের নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা রয়েছে। একটু দূর থেকে স্তম্ভটিতে দৃষ্টি দিলে অন্তরে ভেসে ওঠে আত্মত্যাগী বাঙালিদের স্মৃতি।

লোক প্রশাসন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক স্বপ্নীল রহমান বলেন, ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় পাক হানাদার বাহিনীর নারকীয় কার্যক্রমের এক জ্বলন্ত প্রমাণ হিসাবে দাঁড়িয়ে আছে রাবির বধ্যভূমি। প্রতিদিন রাবি ক্যাম্পাসে ঘুরতে আসা হাজারো দর্শনার্থী শহীদ শামসুজ্জোহা হলের পূর্ব দিকে অবস্থিত এই বধ্যভূমি স্মৃতিস্তম্ভটিতে এক বারের জন্য হলেও দেখতে যান। শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের অবিস্মরণীয় আত্মত্যাগের নিদর্শন এই স্মৃতিস্তম্ভটি দেখে সবার হৃদয় শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে ওঠে। একইসাথে তাদের অন্তরে নতুন করে দেশপ্রেম জাগ্রত হয় বলে আমি মনে করি।

বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. সুলতান-উল-ইসলাম বলেন, স্বাধীনতা যুদ্ধে রাজশাহী অঞ্চলের আশেপাশের অগণিত মানুষকে হত্যা করে এই জায়গাতে ফেলা হতো। প্রতি মুহূর্তে তাদের আত্মত্যাগ স্বরণ করার জন্য এ স্মৃতিফলক নির্মাণ করা হয়েছে। বাংলাদেশ যতদিন বেঁচে থাকবে শহীদদের স্মৃতি ততদিন বেঁচে থাকবে। তাদের জীবনের বিনিময়ে আজকের সুন্দর বাংলাদেশ। দেশের জন্য তাদের আত্মদানকে বর্তমান ও পরবর্তী প্রজন্ম কৃতজ্ঞতাচিত্তে স্বরণ করবে স্মৃতিফলকে এসে।

সাহস২৪.কম/এএম/এসকে.

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত