আজও শুকায়নি সিডরের ক্ষত

প্রকাশ | ১৫ নভেম্বর ২০২১, ১৩:২৬

অনলাইন ডেস্ক

আজ সেই ভয়াল ১৫ নভেম্বর। ২০০৭ সালের আজকের এই দিনে ঘটে যাওয়া সুপার সাইক্লোন সিডরের ভয়াবহতার কথা স্মরণ করে আজও আঁতকে ওঠেন ইন্দুরকানী মানুষ। প্রকৃতি যে মানুষের উপর এতটা নিষ্ঠুর আচরণ করতে পারে ২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বরের প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় ‘সিডর’ তার ভয়াবহ উদাহরণ। 

আজকের এই দিনে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের ১২ টি জেলার উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া প্রলয়ংকরী এ ঝড়ে শুধু মানবকুলের অস্তিত্বই নয়, ধ্বংসযজ্ঞে পরিনত হয় গোটা উপকুলীয় এলাকার বিস্তীর্ণ জনপথ। প্রকৃতির নিষ্ঠুর আঘাতে সেদিন অসংখ্য প্রাণহানী সহ বহু স্থাপনা, রাস্তাঘাট, বেড়িবাঁধ, আবাসস্থল, পশুপাখি, জীবজন্তু, গাছপালা সবকিছুই মাটির সাথে মিশে যায়। ওই একটি রাত তছনছ করে দেয় অনেকের সাজানো সংসার। 

সিডরের মরণ ছোবলে ভেঙ্গে যায় খাদিজা, চেহারাভানু, জয়নব বিবি, লালভানুর মত অনেকের লালিত স্বপ্ন। 

ওই দিন সন্ধ্যা ৬ টার দিকে ঝড়ের আলামত শুরু হলেও রাত ১১ টার দিকে প্রচণ্ড বেগে ইন্দুরকানী এলাকায় আঘাত হানে সিডরের প্রলয় থাবা। এ সময় ৮ থেকে ১০ ফুট জলোচ্ছাসে প্লাবিত হয়ে যায় বিস্তীর্ণ এলাকা। হাজার হাজার গাছপালা এবং সহস্রাধিক ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হওয়ায় গৃহহীন হয়ে পড়ে অসংখ্য পরিবার। চারিদিকে নদী বেষ্টিত সমুদ্র উপকুলবর্তী এলাকা ইন্দুরকানী সেদিন সিডরের হিংস্র থাবায় নারী, পুরুষ, শিশু সহ ৬৫ জনের প্রাণহানী ঘটে। আহত হন শতশত নারী পুরুষ। 

উপজেলার তিনটি ইউনিয়নের মধ্যে সবচাইতে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয় ৩নং বালিপাড়া ইউনিয়ন। শুধু ওই এলাকায়ই নিহত হয় ৫৭ জন। 

সিডরের ১৪টি বছর পার হয়ে গেলেও এখনো ক্ষতচিহ্ন শুকায়নি অনেক পরিবারের। সেদিনের দুঃসহ স্মৃতি মনে করে গুমরে কেঁদে ওঠেন নদীর কিনারে বাসবাসরত পূর্ব চন্ডিপুর গ্রামের জেলে ইব্রাহীম সেখ। বলেন, তার তিন সন্তান হারানোর সেই বেদনা বিধুর কথা। কোন কিছু বুঝে ওঠার আগেই ঝড় যখন প্রচণ্ড বেগে শুরু হল তখন নদী থেকে বিদ্যুৎ বেগে পানি আসতে দেখে স্ত্রী জয়নব বিবি, এক বছরের ছেলে রাকিব, সাকিব (৪), নাইমকে (১১) নিয়ে দ্রুত নিরাপদ আশ্রয় যাবার জন্য ঘর থেকে বের হন। কিন্তু ভাগ্যক্রমে তিনি এবং তার স্ত্রী বেঁচে গেলেও দু’দিন পর ১কিঃ মিঃ দুরে মালবাড়ি ব্রীজের কাছে ধানক্ষেতে তার ৩ সন্তানের লাশ পাওয়া যায়। 

৪ বছরের শিশু কন্যর চাঁদনিকে হারিয়ে এখনো মূর্ছা যান মা খাদিজা বেগম। সেদিন প্রিয় সন্তানকে হরানোর কথা বর্ননা করতে গিয়ে মেয়ের ছবি বুকে জড়িয়ে অঝর কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন তিনি। প্রচণ্ড বাতাস আর জলোচ্ছাসে যখন তার ঘর দুমড়ে মুচড়ে পড়ে তখন মেয়ে চাঁদনিকে নিয়ে নেমে পড়েন বাইরে। কিন্তু রাস্তায় উঠতেই তাদের দুজনকে ভাসিয়ে নিয়ে যায় সর্বনাশা পানি। 

খাদিজা বেগমকে একটি গরুর লেজ ধরা অবস্থায় ভোর রাতে বাড়ি থেকে ১ কিঃ মিঃ দুরে পানের বরজ থেকে জীবিত উদ্ধার করা হলেও ধানক্ষেত থেকে ৬ দিন পর একমাত্র মেয়ে চাঁদনির লাশের সন্ধান মেলে। এতো গেল শিশু চাঁদনির কথা। 

অপরদিকে, পূর্ব চরবলেশ্বর গ্রামের দিনমজুর মতিউরের স্ত্রী লালভানু (৩০) তখন ৩ সন্তান নিয়ে বাড়িতেই ছিলেন। প্রচণ্ড জলোচ্ছাসে যখন ঘরে থাকার উপায় নেই তখন বাঁচার তাগিদে সন্তানদের নিয়ে পাশের একটি এনজিও অফিসে আশ্রায় নেওয়ার জন্য রাস্তায় বের হতেই পানির তোড়ে ভাসিয়ে নিয়ে যায় তাদের সবাইকে। ৩ দিন পর লালভানুকে ৪ বছরের মেয়ে কুলছুম এবং তার দু’ বছরের শিশু পুত্র সাকিবকে বুকে জড়ানো অবস্থায় বাড়ি থেকে আধা কিঃ মিঃ দুরে ধানক্ষেতে তাদের লাশ উদ্ধার করে এলাকাবাসী।

বাড়িতে অবস্থান না করায় ভাগ্যক্রমে সেদিন বেঁচে গেলেও স্ত্রী এবং দু’সন্তানকে হারিয়ে আজও নির্বাক মতিউর। সিডরের ভয়ালও থাবা কেড়ে নেয় খোলপটুয়ার হানিফ জোমাদ্ধারের স্ত্রী ও এক সন্তানকে। এভাবেই মাঝের চরের গৃহবধু ময়না, কুলছুম, পূর্ব চন্ডিপুর গ্রামের ফয়সাল (৭), ১৪ দিন বয়সের হৃদয়ের মতো আরো অনেককে ওই দিন চলে যেতে হয়েছে না ফেরার দেশে। 

পূর্ব চন্ডিপুর গ্রামের জেলে মনির গাজী সেদিনের দুঃসহ স্মৃতি মনে করে বলেন, সেদিন বড় ড্যাগের (পাতিল) মধ্যে করে ভাসিয়ে নিয়ে আমার দুই শিশুর প্রাণ রক্ষা করি। একই গ্রামের ১২ বছরের শিশু সোহাগ বলেন, সিডরের সময় আমার বয়স তখন ৫ বছর। বাঁচার জন্য সেদিন আমি সহ আরো ৮ জন শিশু তিন ঘন্টা পানির সাথে যুদ্ধ করে একটি আম গাছের ডাল ধরে জীবন বাঁচাই।

সাহস২৪.কম/এমআর