মওলানা আজাদ: পাকিস্তান সৃষ্টির পূর্বেই যিনি দেখেছিলেন পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ!

প্রকাশ | ০৮ আগস্ট ২০১৯, ১৪:২১ | আপডেট: ০৮ আগস্ট ২০১৯, ১৪:২৭

অনুবাদকের কথা: কংগ্রেসের সভাপতি এবং স্বাধীন ভারতের প্রথম শিক্ষামন্ত্রী মওলানা আবুল কালাম আজাদের জন্ম ১৮৮৮ সালের ১১ নভেম্বর। কংগ্রেসের সর্বকনিষ্ঠ সভাপতি হিসেবে তিনি ১৯২৩ সালে নির্বাচিত হন এবং পরবর্তীতে ১৯৪০ সালে আবারো কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত হন। মওলানা আজাদ শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত দেশভাগের বিরোধিতা করে গিয়েছেন এবং বিভিন্ন বক্তৃতা বিবৃতিতে দ্বিজাতি তত্ত্বের তীব্র সমালোচনাও করেছেন, বলেছেন, এর ভিত্তিতে দেশভাগ হলে ভারতীয় মুসলমানরা আরো সমস্যায় পড়বে।

 

১৯৪৬ সালের এপ্রিল মাসে উর্দু সাময়িকপত্র চাতানকে তিনি একটা সাক্ষাৎকার দেন; সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছিলেন পত্রিকাটির সম্পাদক শরিস কাশ্মীরি। পরবর্তীতে এর ইংরেজি অনুবাদ ‘কভার্ট’ এ প্রকাশিত হয়েছিল।
 
সাক্ষাৎকারে মওলানা আজাদ দ্বিজাতি তত্ত্ব, দেশভাগ, পাকিস্তান সৃষ্টি এবং বর্তমান মুসলমান সমাজের বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। তিনি এখানে যেমন কথা বলেছেন মুসলমান সংখ্যালঘু প্রদেশের মুসলমানদের ভবিষ্যৎ নিয়ে, তেমনি কথা বলেছেন পাকিস্তান সম্পর্কে বাঙালিদের দৃষ্টিভঙ্গি কেমন হবে সেটা নিয়েও। পাকিস্তানে কিছুদিনের মধ্যেই স্বৈরশাসন আসবে এবং বাঙালিরা একসময় বিদ্রোহ করবে – এমন ভবিষ্যদ্বাণীও করেছিলেন মাওলানা। পরবর্তী ইতিহাস প্রমাণ করেছে, তাঁর ভবিষ্যৎদৃষ্টি ছিল যেমন স্বচ্ছ, তেমনি অভ্রান্ত।

মূল আলোচনা 

প্রশ্ন: হিন্দু-মুসলমান দ্বন্দ্ব এতই তীব্র আকার ধারণ করেছে যে এটা সমস্যা সমাধানের সকল রাস্তাই বন্ধ করে দিয়েছে। আপনার কি মনে হয় না এই পরিস্থিতিতে পাকিস্তান সৃষ্টি অপরিহার্য হয়ে পড়েছে?
 
উত্তর: যদি পাকিস্তান হিন্দু-মুসলমান সমস্যার সমাধান হতো, তাহলে আমি অবশ্যই তা সমর্থন করতাম। এখনতো হিন্দুদের একটা অংশের মতও পাকিস্তানের পক্ষে চলে যাচ্ছে। উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ, সিন্ধু, বেলুচিস্তান ও এক পার্শ্বে পাঞ্জাবের অর্ধেক এবং অন্যপাশে বাংলার অর্ধেক ছেড়ে দিয়ে,হিন্দুদের মতে, ভারতের বাকি অংশগুলো তারাই পাচ্ছে – একটা বিশালকায় দেশ যা কিনা সকল সাম্প্রদায়িক দাবি দাওয়া থেকে মুক্ত থাকবে। যদি আমরা মুসলিম লীগের পরিভাষায় বলি, এই নতুন ভারত কার্যত এবং প্রকৃতিগতভাবে একটা হিন্দু রাষ্ট্রই হবে।
কোন সচেতন সিদ্ধান্তের কারণে এটা ঘটবে না, বরং এটা হবে তার সামাজিক বাস্তবতার যৌক্তিক পরিণাম। আপনি কিভাবে আশা করেন, যে সমাজে ৯০% হিন্দু, যারা প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকেই নিজেদের তত্ত্ব ও নীতির সাথে এখানে বসবাস করে আসছে, তারা ভিন্নভাবে বেড়ে উঠবে? যে উপাদানগুলো ভারতীয় সমাজে ইসলাম ধর্মের ভিত্তিস্থাপন করেছিল এবং বিশাল অনুসারী সৃষ্টি করেছিল তা বর্তমানে এই দেশভাগের রাজনীতির শিকার। সাম্প্রদায়িক ঘৃণা ধ্বংস করে দিচ্ছে এখানে ইসলামের প্রচার ও প্রসারের সকল সম্ভাবনা। এই সাম্প্রদায়িক রাজনীতি ধর্মের সীমাহীন ক্ষতি করছে। মুসলমানরা কোরআন থেকে সরে গিয়েছে। তারা যদি কোরআন এবং নবী’র জীবন থেকে শিক্ষা নিত এবং ধর্মের নামে সাম্প্রদায়িক রাজনীতিতে না জড়াত তাহলে ইসলামের গতি রুদ্ধ করা যেত না। মোগল শাসনামলের শেষের দিকে ভারতে মুসলমানের সংখ্যা ছিল ২২.৫ মিলিয়ন, যা বর্তমান সংখ্যায় প্রায় ৬৫%।
এরপর থেকে সংখ্যাটা বাড়ছেই। যদি মুসলমান রাজনীতিবিদরা আক্রমণাত্মক ভাষা ব্যবহার করে সাম্প্রদায়িক সম্পর্ককে তিক্ত করে না তুলতেন এবং অন্য অংশ ব্রিটিশদের পক্ষ নিয়ে হিন্দু-মুসলমান বিরোধকে আরও ব্যাপক করে না দিতেন, তাহলে ভারতে মুসলমানদের সংখ্যা আরও বৃদ্ধি পেত। ধর্মের নামে আমরা যে রাজনৈতিক বৈরিতা তৈরি করেছি সেটা ইসলামকে রাজনীতিতে ক্ষমতার অস্ত্র হিসেবে চিহ্নিত করেছে; অথচ এটা (ইসলাম) হচ্ছে মানব আত্মা পরিবর্তনের পদ্ধতি। ব্রিটিশের প্রভাবে আমরা ইসলামকে এক অবরুদ্ধ সিস্টেমে পরিণত করেছিলাম এবং অন্যান্য সম্প্রদায় যেমন, ইহুদি, পার্সি ও হিন্দুদের মতো নিজেদেরকে পুরুষানুক্রমিক সম্প্রদায় হিসেবে চিহ্নিত করতাম।
ভারতের মুসলমানরা ইসলাম ও তার বার্তাকে বদ্ধ করে রেখে নিজেদেরকে অনেকগুলো শাখাতে বিভক্ত করে ফেলে। স্পষ্টতই উপনিবেশ শক্তি কিছু কিছু শাখার সৃষ্টি করেছে। ফলস্বরূপ, এই শাখাগুলোর গতিশীলতা ও সক্রিয়তা ব্যাহত হয় এবং তারা ইসলামিক মূল্যবোধে বিশ্বাস হারিয়ে ফেলে। মুসলমান অস্তিত্বের মূলমন্ত্র যেখানে ক্রমাগত সংগ্রাম করে যাওয়া, সেখানে এ বিষয়টাই তাদের কাছে এখন অপরিচিত। তারা অবশ্য মুসলমান, কিন্তু তারা নিজেদের‘খেয়াল খুশি’কেই অনুসরণ করে। কার্যত তারা রাজনৈতিক শক্তির কাছে মাথা নত করেছে, ইসলামিক মূল্যবোধের কাছে নয়। তারা রাজনীতির ধর্মকে পছন্দ করে, কোরআনের ধর্মকে পছন্দ করে না। ‘পাকিস্তান’ হচ্ছে এক রাজনৈতিক মত।
আসলে এটা ভারতীয় মুসলমানদের সমস্যা সমাধানের সঠিক উপায় কি না সেটা বিবেচনা না করে এটাকে ইসলামের নামে দাবি করা হচ্ছে। প্রশ্ন হচ্ছে,কখন এবং কোথায় জনসংখ্যা নিষ্পত্তির জন্য ইসলাম বিশ্বাস ও অবিশ্বাসের ভিত্তিতে অঞ্চল বিভাজনের অনুমতি দেয়। এটা কি কোরআন কিংবা নবী’র ঐতিহ্যের কোন অংশে আছে? ইসলামের কোন পণ্ডিত কি স্রষ্টার এই আধিপত্যকে উপরোক্ত ভিত্তিতে ভাগ করেছেন? আমরা যদি এই ‘বিভাজন’কেই নীতি হিসেবে মেনে নেই, তাহলে ইসলাম সার্বজনীন – এ দাবির সাথে একাত্মতা করব কিভাবে? ভারতসহ বিভিন্ন অমুসলমান দেশসমূহে মুসলমানদের ক্রমবর্ধমান উপস্থিতি কিভাবে ব্যাখ্যা করব? তারা কি এটা বুঝে না যে, ইসলাম যদি এই নীতিকে (বিভাজনকে) অনুমতি দিত তাহলে তার অনুসারীদেরকে কোন অমুসলিম দেশে প্রবেশের অনুমতিও সে দিত না এবং এতে অনেক পাকিস্তানি সমর্থকদের পূর্বপুরুষরা ইসলাম ধর্ম গ্রহণই করতে পারতেন না?
ধর্মের ভিত্তিতে অঞ্চল বিভাজন হচ্ছে মুসলিম লীগের এক অদ্ভুত চিন্তা। তারা এটাকে রাজনৈতিক এজেন্ডা হিসেবে অনুসরণ করতে পারে কিন্তু ইসলাম ও কোরআনে এর কোন বিধান নেই। একজন ধার্মিক মুসলমানের মূল লক্ষ্য কী? ইসলামের আদর্শ প্রচার করা নাকি রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের জন্যে ধর্মকে ব্যবহার করে অঞ্চল ভাগ করা? পাকিস্তান দাবি - কোনভাবেই মুসলমানদের উপকারে আসছে না। পাকিস্তান কিভাবে ইসলামের উপকার করবে সেটাও তর্ক-সাপেক্ষ প্রশ্ন এবং এটা মূলত নির্ভর করবে সেখানকার নেতৃত্বের উপর।
পাশ্চাত্য চিন্তা ও দর্শনের প্রভাব এই পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলছে। মুসলিম লীগের নেতৃত্ব যেভাবে চলছে তা পাকিস্তান ও ভারতের মুসলমানদের কাছে ইসলামকে দুষ্প্রাপ্য বস্তু বানিয়ে ছাড়বে। এটা অনুমান মাত্র এবং একমাত্র আল্লাহই জানেন কি আছে ভবিষ্যতে? পাকিস্তান, সৃষ্টির পরপরই, ধর্মীয় সংঘাতের মুখোমুখি হবে।
আপাতদৃষ্টিতে যা দেখতে পাচ্ছি, যে সকল লোকের হাতে ক্ষমতা থাকবে তারা ইসলামে বড় ক্ষতি করবে। তাদের ব্যবহারের কারণে পাকিস্তানি যুবকরা তাদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে এবং তারা যে কোন ধর্ম নিরপেক্ষ আন্দোলনের (non-religious movements) অংশ হয়ে যাবে। আজকাল মুসলমান সংখ্যালঘু রাষ্ট্রের মুসলমান যুবকরা সংখ্যাগুরু রাষ্ট্রের যুবকদের তুলনায় অধিকতর ধর্মভাবাপন্ন। আপনি দেখবেন, পাকিস্তানে উলামাদের প্রভাব বৃদ্ধি সত্ত্বেও ধর্ম তার উজ্জ্বলতা সেখানে হারিয়ে ফেলবে।
 
প্রশ্ন: কিন্তু কায়েদ-এ-আজম [জিন্নাহ] এর সাথে তো অনেক উলামাই আছেন?
 
উত্তর: সম্রাট আকবরের সাথেও তো অনেক উলামা ছিলেন; তারা তো তাঁর জন্য নতুন ধর্মই আবিষ্কার করেছিল। কারো ব্যক্তিগত সম্পর্কে আমরা আলোচনা না করি। আমাদের ইতিহাস তো এমন উলামাদের কর্মকাণ্ডে ভরপুর যারা যুগে যুগে ইসলামের জন্যে অপমান এবং লাঞ্ছনা এনেছে। সত্যের পতাকাবাহীরা ব্যতিক্রম। গত ১৩০০ বছরের মুসলিম ইতিহাসে কতজন উল্লেখযোগ্য উলামার নাম পাওয়া যাচ্ছে? একজন ছিলেন ইমাম হাম্বল, অন্যজন ইবনে তাইমিয়া। ভারতে তো শাহ ওয়ালিউল্লাহ ও তাঁর পরিবার ছাড়া আর কারো নাম মনে পড়ে না। আলফে সানির সৎসাহস সম্পর্কে কোন সন্দেহ নেই,কিন্তু যারা রাজদরবারে তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছিল এবং তাঁকে কারারুদ্ধ করেছিল, তারাও তো উলামাই ছিল। তারা কোথায় এখন? কেউ কি তাদের প্রতি কোন সম্মান প্রদর্শন করে?
 
প্রশ্ন: মাওলানা, যদি পাকিস্তান সৃষ্টিই হয়ে যায় তাতে দোষের কী? পরিশেষে, ইসলামকে তো সম্প্রদায়ের ঐক্য রক্ষার কাজেই ব্যবহার করা হচ্ছে?
 
উত্তর: আপনি এমন একটা কারণে ইসলামের নাম ব্যবহার করছেন যা ইসলামিক মূল্যবোধ অনুযায়ী ঠিক নয়। মুসলিম ইতিহাসে এমন অনেক নৃশংস কাজের উদাহরণ আছে। জামালের যুদ্ধে (ইমাম আলি ও নবীর বিধবা স্ত্রী হযরত আয়েশার যুদ্ধ) তলোয়ারের সম্মুখে কোরআন ঝুলানো হয়েছিল।* এটা কি ঠিক ছিল? কারবালায় যাদের হাতে মহানবীর পরিবারবর্গ শহিদ হয়েছিল, তারাও তো নিজেদেরকে নবীর সাহাবী দাবি করে। এটা কি ঠিক ছিল? হাজ্জাজ একজন মুসলমান সেনাপতি ছিল এবং সে মক্কার পবিত্র মসজিদে নৃশংস হামলা চালিয়েছিল। এটা কি ঠিক ছিল? কোন পবিত্র শব্দই একটা অসৎ উদ্দেশ্যকে (ভ্রান্ত অভিপ্রায়কে) ন্যায্যতা ও পবিত্রতা দান করতে পারে না।
পাকিস্তান যদি মুসলমানদের জন্য সঠিক হতো তাহলে আমি অবশ্যই সেটা সমর্থন করতাম। কিন্তু আমি পরিষ্কারভাবে এই দাবিতে অন্তর্নিহিত বিপদ দেখতে পাচ্ছি। আমি আশা করি না যে, মানুষ আমাকে অনুসরণ করবে, কিন্তু নিজের বিবেকের বিরুদ্ধে কাজ করাও আমার দ্বারা সম্ভব না। মানুষ সাধারণত বলপ্রয়োগ কিংবা অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞানের কাছে আত্মসমর্পণ করে। মুসলমানরা এখন পাকিস্তানের বিরুদ্ধে কিছুই শুনবে না যতক্ষণ পর্যন্ত না তারা এর অভিজ্ঞতা নিবে। আজকে তারা সাদাকে কালো বলতে পারে, কিন্তু পাকিস্তান প্রশ্নে কোন ছাড় দিবে না। এটা বন্ধ করার একমাত্র উপায় হচ্ছে, হয় সরকার এ প্রস্তাব গ্রহণ করবে না, অথবা জিন্নাহ নিজে – যদি তিনি নতুন কোন প্রস্তাবে রাজি হন।
ওয়ার্কিং কমিটির আমার সহকর্মীদের মনোভাব থেকে বুঝলাম, ভারত বিভাজন মোটামুটি নিশ্চিত। কিন্তু, আমি সতর্ক করে দিচ্ছি, দেশভাগের অশুভ পরিণতি শুধু ভারতকেই প্রভাবিত করবে না, পাকিস্তানও সমানভাবে এর শিকার হবে। ভাগটা হবে জনসংখ্যার ধর্মের ভিত্তিতে, কোন প্রাকৃতিক সীমারেখা– যেমন, পাহাড়, মরুভূমি অথবা নদী – এর ভিত্তিতে নয়। একটা লাইন টানা হবে; সেটা কতটা টেকসই হবে বলা মুশকিল।
আমাদের মনে রাখতে হবে, ঘৃণা হতে সৃষ্ট যে কোন কিছু ততদিনই টিকে থাকবে যতদিন ঘৃণা বেঁচে থাকবে। এই ঘৃণা ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ককে গ্রাস করে ফেলবে। এই পরিস্থিতিতে ভারত ও পাকিস্তান দুই দেশের মধ্যেই বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখা এবং শান্তিপূর্ণ অবস্থায় বেঁচে থাকা সম্ভব হবে না, যদি না আকস্মিক বিপত্তিমূলক কোন ঘটনার সম্মুখীন হতে হয়। দেশভাগের রাজনীতি নিজেই তাদের মধ্যে বাধাস্বরূপ হয়ে দাঁড়াবে। ভূমি স্বল্পতার কারণে পাকিস্তান ভারতের সকল মুসলমানকে জায়গা দিতে পারবে না। অন্যদিকে, হিন্দুদেরও সেখানে থাকা সম্ভব হবে না, বিশেষ করে পশ্চিম পাকিস্তানে। হয় তাদেরকে বের করে দেয়া হবে, অথবা তারা নিজেরাই চলে আসবে। এর প্রতিক্রিয়া ভারতেও দেখা যাবে এবং ভারতীয় মুসলমানদের সামনে তিনটি পথ খোলা থাকবে -
১) তারা লুণ্ঠন ও নৃশংসতার শিকার হবে এবং পাকিস্তানে চলে যাবে; কিন্তু সেখানেও কতজন মাথা গোঁজার ঠাই পাবে?
২) তারা হত্যা ও অন্যান্য অত্যাচারের কবলে পড়বে। এই প্রজন্মের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত এবং দেশভাগের দুঃসহ স্মৃতি বিস্মৃত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মুসলমানদের এই অগ্নিপরীক্ষার মধ্য দিয়ে যেতে হবে।
৩) একটা বিরাট সংখ্যক মুসলমান দারিদ্র্য, রাজনৈতিক প্রতিহিংসা ও আঞ্চলিকতার উৎপাতে ইসলাম ত্যাগ করতে বাধ্য হবে।
মুসলিম লীগের বিশিষ্ট মুসলমানরা পাকিস্তান চলে যাবে এবং ধনী মুসলমানরা সকল শিল্প-প্রতিষ্ঠান ও ব্যবসার দখল করে পাকিস্তানের অর্থনীতিকে কুক্ষিগত করে ফেলবে। কিন্তু ৩০ মিলিয়নের অধিক মুসলমানরা ভারতে পড়ে থাকবে। পাকিস্তান তাদের জন্যে কি রেখেছে? পাকিস্তান থেকে হিন্দু ও শিখদের বিতাড়ন তাদের পরিস্থিতিকে আরও বিপজ্জনক করে তুলবে। পাকিস্তান নিজেই অনেক সমস্যার সম্মুখীন হবে। সবচেয়ে বড় বিপদটা আসবে আন্তর্জাতিক শক্তির কাছ থেকে যারা এই নতুন দেশটাকে নিয়ন্ত্রণ করতে চাইবে, এবং সময়ের সাথে সাথে এই নিয়ন্ত্রণ আরও কঠিন হবে। বহির্শক্তির চাপ সংক্রান্ত এই সমস্যা ভারতের থাকবে না; তার ভয় পাকিস্তানের শত্রুতা।
আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যা মি. জিন্নাহর দৃষ্টি এড়িয়ে গিয়েছে, সেটা হচ্ছে বাংলা। তিনি জানেন না যে, বাঙালিরা বাইরের নেতৃত্ব পছন্দ করে না এবং আজ না হয় কাল তারা সেটা প্রত্যাখ্যান করবেই। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়, মি ফজলুল হক জিন্নাহর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করলেন এবং মুসলিম লীগ থেকে তাঁকে বহিষ্কার করা হলো। মি সোহরাওয়ার্দীও জিন্নাহ সম্পর্কে খুব উচ্চ ধারনা পোষণ করতেন না। শুধু মুসলিম লীগে কেন, কংগ্রেসের ইতিহাসের দিকে তাকান। সুভাষ চন্দ্র বোসের বিদ্রোহের কথা সবাই জানে। বোস সভাপতি হওয়াতে গান্ধীজী খুশি হতে পারেন নি এবং রাজকোটে আমরণ অনশন করার মাধ্যমে গান্ধীজী জনস্রোতকে বোসের বিরুদ্ধে নিয়ে যান। সুভাষ বোস গান্ধীজীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করলেন এবং নিজেকে কংগ্রেস থেকে সরিয়ে নিলেন। বাংলার পরিবেশটাই এমন যে, এরা বাইরের নেতৃত্ব অপছন্দ করে এবং যখনই নিজেদের অধিকার ও স্বার্থ ক্ষুণ্ণ হওয়ার আশংকা দেখা দেয় তখনি তারা বিদ্রোহ করে।
জিন্নাহ ও লিয়াকত আলী যতদিন জীবিত আছেন ততদিন পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তান আস্থা হারাবে না। কিন্তু তাঁদের পরে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ঘটনাও তাদের মধ্যে অসন্তোষ ও শত্রুতা তৈরি করবে। আমার মনে হয়, পূর্ব পাকিস্তান বেশিদিন পশ্চিম পাকিস্তানের সাথে থাকতে পারবে না। নিজেদেরকে মুসলমান বলে দাবি করে –এটা ছাড়া তাদের মধ্যে আর কোন সাদৃশ্য নেই। কিন্তু, পৃথিবীর কোথাও - আমরা মুসলমান – এই ভিত্তিতে স্থায়ী কোন রাজনৈতিক ঐক্য গড়ে ওঠে নি। উদাহরণস্বরূপ আমাদের সামনে আরব বিশ্ব আছে; তাদের ধর্ম এক, সভ্যতা এক, সংস্কৃতি এক এবং একই ভাষায় তারা কথা বলে। বস্তুত: তারা স্থানিক ঐক্যের কথাও স্বীকার করে। তবু তাদের সরকার ব্যবস্থা আলাদা এবং প্রায়ই নিজেদের মধ্যে উক্তি-প্রত্যুক্তি ও বিবাদে জড়িয়ে পড়ে। পক্ষান্তরে, পূর্ব পাকিস্তানের ভাষা, সংস্কৃতি ও জীবন প্রবাহ সবই পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পুরোপুরি ভিন্ন। যে মুহূর্তে পাকিস্তান সৃষ্টির এই উষ্ণতা শীতল হবে, তখন থেকেই অসঙ্গতিগুলো স্পষ্ট হতে থাকবে এবং বিরোধ বাড়তে থাকবে। আন্তর্জাতিক শক্তিগুলোর ক্ষমতার দ্বন্দ্ব এতে আরও ইন্ধন যোগাবে এবং পরিশেষে দুই অংশ আলাদা হয়ে যাবে।
পূর্ব পাকিস্তান আলাদা হয়ে যাওয়ার পর, সেটা যখনই ঘটুক, পশ্চিম পাকিস্তান বিভিন্ন আঞ্চলিক দ্বন্দ্ব-সংঘাতের কুরুক্ষেত্র হয়ে উঠবে। পাঞ্জাব, সিন্ধু,সীমান্ত এবং বেলুচিস্তান – নিজেদের আলাদা আলাদা জাতি হিসেবে ঘোষণা করবে এবং এটা বহির্শক্তির হস্তক্ষেপ বাধ্য করবে। আন্তর্জাতিক শক্তি পাকিস্তানি রাজনৈতিক নেতৃত্বের বৈচিত্র্যময় উপাদানগুলো ব্যবহার করে আরব এবং বলকানের মতো পাকিস্তানকেও খণ্ড খণ্ড করে ফেলবে। হয়তোবা এ অবস্থাতেই আমরা নিজেদের প্রশ্ন করব – কী পেলাম আর কী হারালাম?
মূল বিষয়টা হচ্ছে অর্থনৈতিক উন্নতি এবং অগ্রগতি, সেটা মোটেও ধর্ম নয়। মুসলমান ব্যবসায়ী নেতাদের নিজেদের সক্ষমতা ও যোগ্যতা সম্পর্কে নিজেরাই সন্দিহান। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা ও আনুকূল্য গ্রহণে তারা এতটা অভ্যস্ত যে মুক্তি ও স্বাধীনতা প্রাপ্তিকে ভয় পাচ্ছে। নিজেদের সেই ভয় গোপন রাখার জন্যে দ্বি-জাতি তত্ত্ব প্রচার করে যাচ্ছে এবং উপযুক্ত প্রতিদ্বন্দ্বীর প্রতিযোগিতা ছাড়াই পুরো অর্থনীতিকে একচেটিয়াভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে একটা মুসলিম রাষ্ট্র তারা চায়। দেখা যাক, কতদিন তারা এই প্রতারণা চালিয়ে যাতে পারে।
আমি মনে করি শুরু থেকেই পাকিস্তান কিছু মারাত্মক সমস্যার সম্মুখীন হবে:
১) অযোগ্য রাজনৈতিক নেতৃত্ব সামরিক স্বৈরশাসনের পথ প্রশস্ত করবে, যা বিভিন্ন আরব দেশেই ঘটেছে।
২) প্রচুর বৈদেশিক ঋণের বোঝা বইতে হবে।
৩) প্রতিবেশীদের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক অনুপস্থিত থাকবে এবং সামরিক সংঘাতের সম্ভাবনা থাকবে।
৪) অভ্যন্তরীণ অসন্তোষ ও আঞ্চলিক অন্তর্কোন্দল চলতে থাকবে।
৫) নব্য ধনী ও শিল্পপতিরা পাকিস্তানের জাতীয় সম্পদ লুট করবে।
৬) নব্য ধনীদের শোষণে শ্রেণী সংগ্রাম শুরু হতে পারে।
৭) যুবকদের মধ্যে অসন্তোষ দেখা দিবে এবং ধর্ম থেকে তাদের বিচ্যুতি ঘটবে যা ‘পাকিস্তান তত্ত্ব’কেই ধ্বংস করে দিবে।
৮) পাকিস্তানকে নিয়ন্ত্রণ করতে আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র চলবে।
এই পরিস্থিতিতে, পাকিস্তানের স্থায়িত্ব হুমকির মুখে পড়ে যাবে এবং মুসলিম দেশগুলোও কোন কার্যকরী সাহায্য দেয়ার মতো অবস্থায় থাকবে না। অন্যান্য জায়গাও থেকে শর্ত ছাড়া কোন সাহায্য আসবে না, এবং এটা পাকিস্তানকে আদর্শিক ও স্থানিক মূল্য দিতেও বাধ্য করবে।
 
প্রশ্ন: কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, মুসলমানরা কিভাবে তাদের সম্প্রদায়ের পরিচয় (community identity) বজায় রাখতে পারে এবং কিভাবে একটা মুসলমান রাষ্ট্রের নাগরিকের গুণাবলি অর্জন করতে পারে?
 
উত্তর: ফাঁকা বুলি দিয়ে যেমন মূল বাস্তবতাকে অস্বীকার করা যায় না, তেমনি বাঁকা প্রশ্নও উত্তরকে দুর্বল করে দেয় না। এটা শুধু আলোচনাকে বিকৃত পর্যায়ে নিতে পারে। সম্প্রদায়ের পরিচয় বলতে কি বুঝায়? যদি এই সম্প্রদায় ব্রিটিশ দাসত্বেও তাদের পরিচয় বজায় রাখতে পারে, তাহলে মুক্ত ভারতে কিভাবে এটা হুমকির মুখে পড়তে পারে, যেখানে রাষ্ট্রীয় ব্যাপারে মুসলমানরা সমভাবেই অংশগ্রহণ করতে পারবে। মুসলমান রাষ্ট্রের কী কী গুণাবলি আপনি ধারণ করতে চান?
মূল বিষয়টা হচ্ছে, বিশ্বাস এবং ধর্মচর্চায় স্বাধীনতা এবং এই স্বাধীনতায় কে বাধা দিতে আসবে। স্বাধীনতা কি ৯০ মিলিয়ন মুসলমানকে এমন অসহায় পরিস্থিতিতে ফেলবে যেখানে তারা ধর্মীয় স্বাধীনতা উপভোগ করতে পারবে না? যেখানে বিশ্বশক্তি হিসেবে ব্রিটিশই এই স্বাধীনতা কেড়ে নিতে পারেনি,সেখানে হিন্দুদের হাতে কি এমন ক্ষমতা বা জাদু থাকতে পারে যে তারা ধর্মীয় স্বাধীনতাকে অস্বীকার করতে পারে? এই প্রশ্নগুলো তারাই তুলছে, যারা পাশ্চাত্য সংস্কৃতির প্রভাবে নিজেদের ঐতিহ্যকে ভুলে গিয়েছে এবং এখন রাজনৈতিক ফন্দিফিকিরের মাধ্যমে এসব কাঁদা ছুড়ছে।
মুসলিম ইতিহাস ভারতীয় ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। আপনার কি মনে হয়, মুসলমানরা রাজারা ইসলামের খুব সেবা করেছিলেন? ইসলামের সাথে তাদের নামমাত্র সম্পর্ক ছিল; তারা ইসলাম প্রচারক ছিলেন না। ভারতের মুসলমানরা সুফিদের কাছে ঋণী এবং অনেক সুফিকেই ঐ রাজাদের নৃশংসতার শিকার হতে হয়েছিল।
অধিকাংশ রাজারাই উলামাদের একটা বড় গোষ্ঠী তৈরি করতেন যারা ইসলামিক মূল্যবোধ প্রচারের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াত। ইসলাম, তার প্রাথমিক যুগে অসাধারণ আবেদন তৈরি করেছিল এবং প্রথম শতাব্দীতে হেজাজের আশেপাশের মানুষের মন ও হৃদয় কেড়েছিল। কিন্তু, যে ইসলাম ভারতে প্রবেশ করেছিল সেটা ভিন্ন ছিল, এর প্রচারকরা অনারব ছিল এবং এর মূল চেতনাটা অনুপস্থিত ছিল। তবু, ভারতের সংস্কৃতি, গান, শিল্প, স্থাপত্য ও ভাষাতে এখনো মুসলমান যুগের ছাপ স্পষ্ট। ভারতের সাংস্কৃতিক কেন্দ্র, যেমন দিল্লি এবং লক্ষ্নৌ কি প্রকাশ করছে? এর অন্তর্নিহিত মুসলিম চেতনাটা স্পষ্ট।
যদি মুসলমানরা এখনো আশংকা করে এবং বিশ্বাস করে যে, স্বাধীন ভারতেও দাসত্ব করতে হবে তাহলে আমি শুধু তাদের বিশ্বাস ও হৃদয়ের জন্যে প্রার্থনাই করতে পারি। একজন মানুষ যদি নিজের জীবন নিয়ে হতাশাগ্রস্ত হয় তাহলে তাকে উদ্ধারে সাহায্য করা যেতে পারে, কিন্তু কেউ যদি ভীরু হয় এবং সাহসের অভাবে ভুগে তাহলে তাহলে তাকে তো আর নির্ভীক ও সাহসী করে তোলা সম্ভব নয়। মুসলমানরা সম্প্রদায়গতভাবেই কাপুরুষ হয়ে গিয়েছে। তারা আল্লাহকে ভয় না করে মানুষকে ভয় করে। এটাই ব্যাখ্যা করে, কেন তারা নিজেদের অস্তিত্বের হুমকি নিয়ে এতটা আচ্ছন্ন! সবই তাদের বানানো কল্পনামাত্র!
ব্রিটিশদের ক্ষমতা দখলের পর মুসলমানদের ওপর যতটা অত্যাচার করা সম্ভব, সবই করা হয়েছিল। কিন্তু, মুসলমানরা তো বিলুপ্ত হয়ে যায়নি। বিপরীতে,তাদের বৃদ্ধি ছিল গড়ের কিছুটা বেশি। মুসলিম সংস্কৃতির মূল্যবোধে একটা আবেদন আছে। তারপর ভারতের তিনদিকেই মুসলমান প্রতিবেশী আছে। ভারতের সংখ্যাগরিষ্ঠরা কেনই বা মুসলমানদেরকে নিশ্চিহ্ন করে দিবে? এটার সাথে কিভাবে তাদের স্বার্থ জড়িত? ৯০ মিলিয়ন মুসলমানদের শেষ করে দেয়া কি খুব সহজ? বস্তুত, মুসলিম সংস্কৃতির আকর্ষণে ভারতে যদি সংখ্যাগরিষ্ঠ লোক এর অনুসারী হয়ে ওঠে তাহলেও আমি অবাক হব না।
স্থায়ী শান্তি ও জীবন দর্শন – পৃথিবীর দুটোই প্রয়োজন। যদি হিন্দুরা মার্ক্সের অনুসারী হতে পারে এবং পাশ্চাত্য জ্ঞান ও দর্শন অনুশীলন করতে পারে,তাহলে তারা ইসলামকেও অস্বীকার করবে না এবং এর নীতি থেকে উপকার পেয়ে খুশিই হবে। বস্তুত, তারা ইসলামের সাথে অনেক পরিচিত এবং স্বীকার করে যে, ইসলাম মানে কৌলিক গোষ্ঠীগত সংকীর্ণতা নয় কিংবা নিপীড়ক শাসন ব্যবস্থাও নয়। ইসলাম হচ্ছে মানুষের সাম্যের ভিত্তিতে শান্তি প্রতিষ্ঠার সার্বজনীন আহ্বান। তারা জানে যে ইসলাম হচ্ছে একজন নবীর ঘোষণা যিনি স্রষ্টাকে উপাসনা করতে বলেন, নিজেকে নয়। ইসলাম মানে সবধরনের সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্য হতে মুক্তি এবং স্রষ্টা, ন্যায়নিষ্ঠ কর্ম ও জ্ঞান – এই তিনের ভিত্তিতে সমাজের পুনর্গঠন।
বস্তুত আমাদের মুসলমানদের চরমপন্থি আচরণের কাড়নেই অমুসলিমরা ইসলামের প্রতি বিরাগভাজন হচ্ছে। আমরা যদি আমাদের স্বার্থপর উচ্চাকাঙ্ক্ষাগুলোকে বাস্তবায়ন করতে গিয়ে ইসলামকে অপবিত্র না করতাম তাহলে অনেক সত্যান্বেষী মানুষই ইসলামের মধ্যে সান্ত্বনা খুঁজে পেত। পাকিস্তানের সাথে ইসলামের কোন সম্পর্ক নেই; পাকিস্তান হচ্ছে ভারতীয় মুসলমানদের জাতীয় স্বার্থে মুসলিম লীগ কর্তৃক উত্থাপিত একটি রাজনৈতিক দাবি। আমি মনে করি এটা মুসলমানদের সমস্যার কোন সমাধান নয়; আসলে এটা মুসলমানদের জন্যে আরও সমস্যা বয়ে আনবে।
মহানবী বলেছেন, ‘আল্লাহ পুরো পৃথিবীটাই আমার জন্যে মসজিদ বানিয়ে দিয়েছেন’। এখন আমাকে বলবেন না যে এই মসজিদ ভাগ করার পরিকল্পনাকে সমর্থন করতে হবে। যদি নয় কোটি মুসলমানরা পুরো ভারত জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকতো এবং এক-দুই অঞ্চলে তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিশ্চিত করে প্রদেশগুলোকে পুনঃসংগঠনের দাবি জানানো হতো, তাহলে হয়তোবা সেটা বোধগম্য হতো।
আবার এই ধরনের দাবিও ইসলামিক দৃষ্টিতে সঠিক নয়, কিন্তু প্রশাসনিক কারণে সমর্থনযোগ্য। কিন্তু বর্তমান অবস্থা বহুলাংশেই ভিন্ন। ভারতের সীমান্তবর্তী সবগুলো প্রদেশই মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ এবং তাদের সীমানা অন্য মুসলিম দেশের সাথে সংযুক্ত।
আমাকে বলেন, এই জনগোষ্ঠীকে কি কেউ উচ্ছেদ করতে পারে? পাকিস্তান দাবি করে মূলত আমরা গত ১০০০ বছরের ইতিহাস থেকে নিজেদের দৃষ্টি সরিয়ে নিচ্ছি এবং, যদি আমি মুসলিম লীগের পরিভাষায় বলি, ৩০ মিলিয়নের অধিক মুসলমানকে ‘হিন্দু রাজ’ এর কোলে ছুড়ে ফেলে দিচ্ছি। হিন্দু-মুসলমান সমস্যা কংগ্রেস এবং লীগের মধ্যে যে রাজনৈতিক অস্থিরতার সৃষ্টি করেছে সেটা দুই রাষ্ট্রের মধ্যে বিবাদের উৎস হয়ে থাকবে এবং বহির্শক্তির ইন্ধনে ভবিষ্যতে যে কোন সময় এটা ভয়াবহ যুদ্ধের আকার ধারণ করবে।
একটা প্রশ্ন প্রায়ই উঠছে যে, পাকিস্তান ধারনা যদি মুসলমানদের জন্যে এতই বিপদের কারণ হয়, তাহলে হিন্দুরা এর বিরোধিতা করছে কেন? আমি মনে করি, এই বিরোধিতা দুটি পক্ষ থেকে আসছে। একপক্ষ সাম্রাজ্যবাদী চক্রান্ত সম্পর্কে সচেতন এবং দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে যে, স্বাধীন, অখণ্ড ভারত নিজেকে রক্ষা করতে সুবিধে পাবে। বিপরীতে, আরেকপক্ষ পাকিস্তানের বিরোধিতা করছে মুসলমানদেরকে তাদের দাবির প্রতি উস্কে দেয়ার জন্যে যেন মুসলমানদের থেকে তারা রেহাই পায়। মুসলমানদের সাংবিধানিক সুরক্ষা দাবি করার অধিকার অবশ্যই আছে, কিন্তু ভারত ভাগ তাদের স্বার্থ সিদ্ধ করবে না। এই দাবি সাম্প্রদায়িক সমস্যার ভ্রান্ত রাজনৈতিক সমাধান।
ভবিষ্যতে ভারত সাম্প্রদায়িক সমস্যার সম্মুখীন না হয়ে শ্রেণী সমস্যার সম্মুখীন হবে; মূল দ্বন্দ্ব হবে পুঁজি ও শ্রমের। কমিউনিস্ট ও সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন বেড়েই চলছে এবং এটা উপেক্ষা করাও সম্ভব হবে না। শোষিত শ্রেণীর স্বার্থ রক্ষায় এই আন্দোলনগুলো ক্রমশই সংগ্রাম করে যাবে। মুসলমান পুঁজিপতি শ্রেণী এবং সামন্তশ্রেণী আসন্ন এই হুমকিতে ভীত। তাই, তারা পুরো বিষয়কে একটা সাম্প্রদায়িক রূপ দিয়েছেন এবং অর্থনৈতিক ইস্যুকে ধর্মীয় বিবাদে পরিণত করেছেন। কিন্তু এটার জন্যে শুধুমাত্র মুসলমানরা দায়ী না। প্রথমত এই কৌশল ব্রিটিশ দ্বারাই গৃহীত হয় এবং পরবর্তীতে, আলীগড়ের রাজনৈতিক ব্যক্তিরা এটাকে সমর্থন করেন। সেই সাথে হিন্দুদের অদূরদর্শিতা বিষয়টাকে আরও অবনতির দিকে নিয়ে যায় এবং এখন স্বাধীনতা এই ভারত ভাগের উপর নির্ভরশীল হয়ে গিয়েছে।
জিন্নাহ নিজেও এককালে হিন্দু-মুসলমান ঐক্যের দূত ছিলেন; কংগ্রেসের এই সভাতেই সরোজিনী নাইডু তাঁকে এই উপাধি দিয়েছিলেন। তিনি দাদাভাই নওরোজীর শিষ্য ছিলেন। ১৯০৬ সালে মুসলমানদের এক প্রতিনিধি দলে – যারা ভারতে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির শুরু করে – তিনি যোগ দিতে অস্বীকার করেন। ১৯১৯ সালে একজন জাতীয়তাবাদী নেতা হিসেবেই তিনি যৌথ নির্বাচন কমিটিতে মুসলমানদের দাবির তীব্র বিরোধিতা করেন।
১৯২৫ সালের ৩ অক্টোবরে, টাইমস অব ইন্ডিয়া পত্রিকায় লেখা এক চিঠিতে - ‘কংগ্রেস হিন্দুদের সংগঠন’ - এই দাবি তিনি উড়িয়ে দেন। ১৯২৫ এবং ১৯২৮ সালের সর্বদলীয় অধিবেশনে তিনি যুক্তভোটের (joint electorate) পক্ষে দৃঢ় সমর্থন দেন। ১৯২৫ সালের জাতীয় পরিষদের ভাষণে বলেন, ‘প্রথমত এবং শেষত আমি একজন জাতীয়তাবাদীই’ এবং সেই সাথে হিন্দু-মুসলমান সহকর্মীদের ‘সভার মধ্যে সাম্প্রদায়িক ইস্যু না তুলতে এবং এই পরিষদকে সত্যিকার অর্থে একটা জাতীয় প্রতিষ্ঠানে পরিণত করতে’ উপদেশ দেন।
১৯২৮ সালে, সাইমন কমিশন বয়কট করার জন্যে কংগ্রেসের আহ্বানকে জিন্নাহ সমর্থন করেন। ১৯৩৭ সাল পর্যন্ত তিনি ভারত ভাগের পক্ষে ছিলেন না। বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনের কাছে তিনি হিন্দু মুসলমান ঐক্যের প্রয়োজনীয়তা বিষয়ে জোর দিতেন। কিন্তু, যখন মুসলিম লীগকে বাদ দিয়ে কংগ্রেস সাত প্রদেশে মন্ত্রীসভা গঠন করল তিনি তখন ক্ষুব্ধ হন। ১৯৪০ সালে মুসলমানদের রাজনৈতিক অবক্ষয় ঠেকাতে তিনি দেশ ভাগের পক্ষে থাকার সিদ্ধান্ত নেন। সংক্ষেপে বলতে গেলে, পাকিস্তান দাবি হচ্ছে তাঁর ব্যক্তিগত রাজনৈতিক অভিজ্ঞতারই ফসল। আমার সম্পর্কে যে কোন মতামত দেয়ার সম্পূর্ণ অধিকার মি জিন্নাহর আছে, কিন্তু তাঁর বুদ্ধিমত্তা সম্পর্কে আমার কোন সন্দেহ নেই। একজন রাজনীতিবিদ হিসেবে মুসলিম সাম্প্রদায়িকতা ও পাকিস্তান দাবিকে শক্তিশালী করে তুলতে তিনি প্রচণ্ড পরিশ্রম করেছেন। এখন এটা তাঁর কাছে সম্মানের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে এবং কোন কিছুর মূল্যেই তিনি এই দাবি ছাড়বেন না।
 
প্রশ্ন: এটা পরিষ্কার যে, মুসলমানরা পাকিস্তান দাবি থেকে পিছু হটবে না। কিন্তু সবধরনের যুক্তি-তর্ক-বিচারবোধ তাদের কাছে অভেদ্য ঠেকছে কেন?
 
উত্তর: কোন উচ্ছৃঙ্খল জনতার অসঙ্গত উদ্দীপনার বিপক্ষে লড়াই করা কঠিন, অসম্ভবও বটে। কিন্তু, কারো বিবেককে দমন করা মৃত্যুর চেয়েও খারাপ। আজকে মুসলমানরা হাঁটছে না, তারা ভাসছে। সমস্যাটা হচ্ছে যে, মুসলমানরা স্থিরগতিতে হাঁটা শেখে নি; হয় তারা দৌড়ায়, নাহয় স্রোতের সাথে ভেসে বেড়ায়। যখন কোন গোষ্ঠীর আত্মবিশ্বাস ও আত্মমর্যাদা হারিয়ে যায়, তখন তারা বিভিন্ন কাল্পনিক সন্দেহ ও বিপদ দ্বারা পরিবেষ্টিত হয়ে পড়ে এবং সঠিক ও ভুলের মধ্যে পার্থক্য নিরূপণেও অক্ষম হয়ে পড়ে।
সংখ্যাগত শক্তি দিয়ে জীবনের মূল অর্থ অনুভব করা যায় না, বরং দৃঢ় বিশ্বাস এবং ন্যায়নিষ্ঠ কাজের দ্বারাই তা করা যায়। ব্রিটিশের রাজনীতি মুসলমানদের মানসজগতে ভয় ও অবিশ্বাসের চারা রোপণ করেছে। এখন তারা ত্রাসজনক অবস্থায় আছে, ব্রিটিশদের প্রস্থানে তারা বিলাপ করছে এবং বিদেশি প্রভুর বিদায়ের পূর্বেই দেশ ভাগের দাবি তুলছে। তারা কি বিশ্বাস করে যে, দেশভাগ তাদের জীবনের সকল বিপদকে প্রতিহত করবে? যদি এই বিপদগুলো বাস্তবিক হয়ে থাকে, তাহলে এগুলো তাদের সীমানায় হানা দিবে এবং যে কোন সশস্ত্র সংঘর্ষ জীবন ও ধনসম্পত্তির আরও ক্ষতি বয়ে আনবে।
 
প্রশ্ন: কিন্তু, হিন্দু মুসলমান তো ভিন্ন মতবাদের দুটি ভিন্ন জাতি যাদের মধ্যে বৈসাদৃশ্যও বিদ্যমান। তাদের মধ্যে কিভাবে ঐক্য স্থাপন করা যাবে?
 
উত্তর: এটা খুব সেকেলে বিতর্ক। এই বিষয়ের উপর আল্লামা ইকবাল ও মাওলানা হুসাইম আহমাদ মাদানির মধ্যে পত্রবিনিময়গুলো আমি দেখেছি। কোরআনে ‘কওম’ শব্দটি শুধুমাত্র বিশ্বাসী সম্প্রদায়ের জন্যে ব্যবহৃত হয় নি বরং এটা সাধারণ মানুষের স্বতন্ত্র গোষ্ঠী বুঝাতে ব্যবহার করা হয়েছে। মিল্লাত(সম্প্রদায়), কওম (জাতি) ও উম্মত(গোষ্ঠী) – এই শব্দগুলোর ব্যুৎপত্তিগত অর্থের বিতর্ক তুলে আসলে আমরা কি আদায় করতে চাচ্ছি? ধর্মীয় দিক থেকে দেখলে ভারত হচ্ছে বিভিন্ন মানুষদের বাসস্থান – হিন্দু, মুসলমান, খ্রিষ্টান, পার্সি, শিখ ইত্যাদি।
হিন্দু ধর্ম ও ইসলামের মধ্যে পার্থক্য ব্যাপক, কিন্তু এই ভিন্নতা যেমন ভারতের স্বাধীনতার পথে বাধা সৃষ্টি করতে পারে না, তেমনি দুটো স্বতন্ত্র ও ভিন্ন ধর্মবিশ্বাস ভারতের ঐক্যের ধারনাকে নাকচ করে দেয় না। এখানে ইস্যুটা হচ্ছে আমাদের জাতীয় স্বাধীনতার এবং কিভাবে আমরা সেটা নিশ্চিত করতে পারি। স্বাধীনতা (Freedom) হচ্ছে একটা আশীর্বাদ এবং প্রতিটা মানুষের অধিকার। এটা ধর্মের ভিত্তিতে ভাগ করা যাবে না।
মুসলমানদেরকে উপলব্ধি করতে হবে যে, তারা এক সার্বজনীন বার্তার বাহক। তারা কোন জাতিগত কিংবা আঞ্চলিক গোষ্ঠী নয় যেখানে অন্যান্যরা প্রবেশ করতে পারবে না। নির্মম সত্য হচ্ছে, ভারতের মুসলমানরা এক সম্প্রদায় নয়; তারা বিভিন্ন সুপ্রতিষ্ঠিত উপদলে বিভক্ত। তাদেরকে আপনি হিন্দু-বিদ্বেষে উত্তেজিত করে ঐক্যবদ্ধ করতে পারবেন কিন্তু ইসলামের নামে তাদেরকে ঐক্যবদ্ধ করতে পারবেন না। তাদের কাছে ইসলাম মানে তাদের উপদলের প্রতি নিছক আনুগত্য।
ওয়াহাবি, সুন্নি এবং শিয়া ছাড়াও আরও অনেক গোষ্ঠী আছে যারা বিভিন্ন সাধু ও সন্ন্যাসীদের কাছে আনুগত্য প্রকাশ করে থাকে। নামাজে হাত তোলা এবং জোরে আমিন বলার মতো ছোট ছোট ইস্যুগুলো প্রচুর বাদানুবাদ সৃষ্টি করেছে যার সমাধান করা সম্ভব হয় নি। উলেমারা তাকফির উপাদানটাকে (কাউকে অবিশ্বাসী আখ্যা দেয়ার ফতোয়া) যথেচ্ছভাবে ব্যবহার করে থাকেন। পূর্বে তারা ইসলামকে অবিশ্বাসীদের কাছে নিয়ে যেতেন; এখন তারা ইসলামকে বিশ্বাসীদের কাছ থেকেই দূরে নিয়ে যান। ইসলামের ইতিহাস ভালো ও ধার্মিক মুসলমানদেরকে কাফির আখ্যায়িত করার ঘটনায় পরিপূর্ণ। এমন ভয়াবহ পরিস্থিতি মোকাবেলা করার সামর্থ্য একমাত্র নবীদেরই ছিল। কিন্তু তাদেরকেও তো অনেক কষ্ট ও পরীক্ষার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। বস্তুত: যখন যুক্তি ও বুদ্ধিমত্তা লোপ পায় এবং আচরণগুলো জীবাশ্মে পরিণত হয় তখন যে কোন সংস্কারকের কাজটিই খুব কঠিন হয়ে যায়।
তবে বর্তমানে পূর্বের যে কোন সময়ের তুলনায় আমাদের অবস্থা খারাপ। মুসলমানরা সাম্প্রদায়িকতাকেই আঁকড়ে ধরেছে; তারা ধর্মের চেয়ে রাজনীতিকেই বেশি পছন্দ করছে এবং ধর্মের আদর্শের মতো করে তাদের পার্থিব আকাঙ্ক্ষাকে অনুসরণ করছে।
ইতিহাসে দেখা যায়, প্রত্যেক যুগে আমরা এমন কিছু মানুষকে নিয়ে উপহাস করেছি যারা আমাদের ভালো করতে এসেছিল; তাদের আত্মত্যাগ ও নিঃস্বার্থ কাজকে অবজ্ঞায় ছুড়ে ফেলে দিয়েছি। আমরা তো সাধারণ মানুষ; এমনকি নবীরাও এইসব রীতিনীতি আঁকড়ে ধরা মানুষদের হাত থেকে রেহাই পান নি।
 
প্রশ্ন: আপনিতো বহুদিন আগেই ‘আল-হিলাল’ পত্রিকার প্রকাশনা বন্ধ করে দিয়েছেন। এটা কি মুসলমানদের বুদ্ধিবৃত্তিক ক্ষয়ের প্রতি আপনার হতাশা থেকে নাকি এটা আপনার কাছে অরণ্যে রোদন বলে মনে হচ্ছিল?
 
উত্তর: ‘আল হিলাল’ পত্রিকা বন্ধ করে দিয়েছি, এর অর্থ এই না যে, এর সত্যতার প্রতি আমি বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছিলাম। এই পত্রিকা মুসলমানদের একটা বড় অংশের মধ্যে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। তারা ইসলাম, মানব মুক্তি এবং ন্যায়নিষ্ঠ লক্ষ্যের প্রতি তাদের বিশ্বাসকে আরও জোরদার করেছিল। বস্তুত: এই অভিজ্ঞতা আমার ব্যক্তিগত জীবনকেও অনেক সমৃদ্ধ করেছিল এবং আমি নিজেকে ঐ মানুষগুলোর মতো অনুভব করতাম যারা সরাসরি নবীর কাছ থেকে শিক্ষাগ্রহণের সুযোগ পেয়েছিল।
আমার নিজের কণ্ঠই আমাকে মোহিত করে এবং এর প্রভাবে আমি ফিনিক্স এর মতো পুড়ে গিয়ে নতুন জীবন পেলাম। আল-হিলাল তার উদ্দেশ্য সাধন করেছে এবং এক নতুন যুগ শুরু হচ্ছিল। আমার অভিজ্ঞতার আলোকেই আমি পরিস্থিতিকে পুনর্মূল্যায়ন করি এবং নিজেকে জাতীয় মুক্তির স্বার্থে পুরোপুরি নিয়োজিত করার সিদ্ধান্ত নেই। আমার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে, এশিয়া এবং আফ্রিকার স্বাধীনতা বহুলাংশে নির্ভর করবে ভারতের স্বাধীনতার উপর এবং ভারতের স্বাধীনতার চাবিকাঠি হচ্ছে হিন্দু-মুসলমান ঐক্য।
এমনকি প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পূর্বেই আমি উপলব্ধি করেছিলাম যে, ভারত স্বাধীন হবেই, এবং পৃথিবীর কোন শক্তিই এটা রোধ করতে পারবে না। মুসলমানদের ভূমিকা নিয়েও আমি পরিষ্কার চিন্তাভাবনা করেছিলাম। আমি তীব্রভাবেই চাচ্ছিলাম যে, মুসলমানরা যেন নিজের দেশের মানুষের সাথে হাঁটতে শিখে এবং ইতিহাস যেন কখনো বলার সুযোগ না পায় যে, ভারতীয়রা যখন স্বাধীনতার জন্য লড়াই করছিল, মুসলমানরা দর্শকের ভূমিকা পালন করেছিল। কেউ যেন বলতে না পারে যে, ঢেউয়ের সাথে লড়াইয়ের পরিবর্তে মুসলমানরা তীরে দাঁড়িয়ে ছিল এবং মুক্তিযোদ্ধাদের নৌকা ডুবতে দেখার হর্ষধ্বনি উপভোগ করছিল।
 
* অস্ত্রের সম্মুখে কোরআনের আয়াত ঝুলানো হয়েছিল সিফফিনের যুদ্ধে; এই যুদ্ধ হযরত আলী ও মুয়াবিয়ার মধ্যে সংঘটিত হয়। সূত্র: দ্যা স্পিরিট অব ইসলাম – স্যার সৈয়দ আমীর আলী।