কোভিডের নতুন ধরনটি কম উগ্র, চিন্তার কিছু নেই: বিশেষজ্ঞদের মতামত

প্রকাশ : ২৭ ডিসেম্বর ২০২০, ০১:৪৮

সাহস ডেস্ক
ছবি: সংগৃহীত

দেশে কোভিড-১৯-এর যে নতুন ধরন শনাক্ত হয়েছে তার সাথে যুক্তরাজ্যে ধরা পড়া ভাইরাসের কিছুটা মিল রয়েছে বলে খবর প্রকাশের পর জনগণের মাঝে দেখা দিয়েছে আতঙ্ক। তবে দেশের স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন যে এ ধরনটি কম উগ্র। কারণ এটি বিবর্তিত হয়েছে স্থানীয় বৈশিষ্ট্য নিয়ে।

তারা জনগণকে চিন্তিত না হওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন। কিন্তু সতর্ক থাকতে, কঠোরভাবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে ও বাচ্চাদের সাথে নিয়ে জনসমাগম এড়িয়ে চলতে বলছেন। কারণ ভাইরাসের নতুন ধরনটি শিশুদের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে দেখা যাচ্ছে।

যুক্তরাজ্যে কোভিডের নতুন যে ধরনটি চিহ্নিত হয়েছে তা আগের ভাইরাসের তুলনায় ৭০ শতাংশ বেশি সংক্রামক। তাই সেখান থেকে ভাইরাসটি যাতে দেশে আসতে না পারে সে জন্য যুক্তরাজ্যের সাথে বিমান চলাচল কয়েক সপ্তাহ বন্ধ রাখতে এবং বিমানবন্দরে যাত্রীদের পর্যবেক্ষণ ও স্বাস্থ্য পরীক্ষা জোরদার করতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদের (বিসিএসআইআর) বিজ্ঞানীরা বৃহস্পতিবার জানান যে দেশে নভেম্বরের শুরুর দিকে করোনাভাইরাসের নতুন একটি ধরন শনাক্ত হয় যার সাথে যুক্তরাজ্যে পাওয়া ভাইরাসের নতুন ধরনটির মিল রয়েছে।

বিসিএসআইআরের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মো. সেলিম খান জানান, তারা নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে করোনাভাইরাসের সর্বশেষ জিন বিশ্লেষণের মাধ্যমে নতুন ধরনটি শনাক্ত করেন। তারা দেখেছেন যে নতুন ধরনটি এবং যুক্তরাজ্যে শনাক্ত হওয়াটি প্রায় একই রকম। কিন্তু এটি শতভাগ এক নয়।

এখনও স্পষ্ট নয় নতুন ধরনটির বৈশিষ্ট্য

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও হেলথ অ্যান্ড হোপ হাসপাতালের চেয়ারম্যান ডা. এমএইচ চৌধুরী (লেলিন) জানান যে দেশে শনাক্ত হওয়া করোনাভাইরাসের নতুন ধরনটির বৈশিষ্ট্য এখনও স্পষ্ট নয়।

তিনি বলেন, বাংলাদেশে নতুন ধরনটি শনাক্ত হওয়ার পর কয়েক সপ্তাহ অতিবাহিত হয়ে গেছে কিন্তু ভাইরাস সংক্রমণ, মৃত্যু ও গুরুতর অসুস্থতার হারে বড় ধরনের পরিবর্তন আসেনি। তাই আমরা বলতে পারি যে এটি নিয়ে আতঙ্কিত হওয়ার কারণ নেই।

এ বিশেষজ্ঞ জানান, দেশের নতুন ধরনটি আর যুক্তরাজ্যেরটি পুরোপুরি এক নয়। যুক্তরাজ্যের ধরনটির উৎপত্তি হয়েছে আফ্রিকায় এবং এটি দ্রুত ছড়াতে পারে। বাংলাদেশের ধরনটি যদিও যুক্তরাজ্যরটির মতোই কিছুটা, তবে ভাইরাস সংক্রমণের দিক দিয়ে এর বৈশিষ্ট্য ভিন্ন। আমরা যদি বাংলাদেশে গত তিন সপ্তাহের করোনা সংক্রমণের হার পরীক্ষা করি তাহলে এটি বৃদ্ধি পাওয়ার কোনো ধারা দেখি না। তাই দেশে স্থির পরিস্থিতি বিরাজ করছে যেটি যুক্তরাজ্যে নেই।

অযথা আতঙ্ক ছড়ানো

ডা. লেলিন মনে করেন যে বিসিএসআইআরের উচিত নতুন ধরনটি নিয়ে আরও কাজ করা। এটি অপরিণত ঘোষণা যে বাংলাদেশের নতুন ধরনটি যুক্তরাজ্যটির মতো। এটি জনগণের মাঝে অযথা আতঙ্ক ছড়িয়েছে।

সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইন্সটিটিউটের (আইইডিসিআর) প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা এএসএম আলমগীর বলেন, দেশে পাওয়া নতুন ধরনটি নিয়ে মানুষজনের উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই। সারা বিশ্বে করোনাভাইরাস প্রোটিনে নানা রূপান্তর হয়েছে। বাংলাদেশেও পরিবর্তন এসেছে এবং নতুন পরিবর্তনটি যুক্তরাজ্যেরটির মতো বলে বলা হচ্ছে। এর মানে হলো এটি পুরোপুরি যুক্তরাজ্যেরটির মতো নয়।

এএসএম আলমগীর বলেন, কোভিডের মতো ভাইরাস টিকে থাকার জন্য রূপান্তরিত হয়। ‘পরিবর্তনের মাধ্যমে ভাইরাস এবং এর প্রখরতা হয় দুর্বল বা শক্তিশালী হয়ে উঠে। দেশে পাওয়া করোনাভাইরাসের নতুন ধরনটি প্রাণঘাতী নয়। অনেক বিশেষজ্ঞ নতুন ধরনটির দ্রুত ছড়ানো এবং সংক্রমণের সক্ষমতা নিয়ে কথা বললেও বাংলাদেশে গত এক মাসে তেমন কিছু দেখা যায়নি।

যা জনগণের মাঝে শুধু উদ্বেগ বাড়িয়ে দেবে তেমন কোনো অপ্রয়োজনীয় মন্তব্য এবং যাচাইবিহীন ও ভুল তথ্য মিডিয়ার মাধ্যমে না ছড়াতে বিশেষজ্ঞদের প্রতি আহ্বান জানান এএসএম আলমগীর।

শিশুদের মাঝে সংক্রমণ বাড়ছে

ডা. লেলিন জানান, গত কয়েক সপ্তাহে শিশুদের মাঝে ভাইরাস সংক্রমণের হার বেড়েছে। দেখে মনে হচ্ছে নতুন ধরনটি শিশুদের জন্য কিছুটা মারাত্মক। লোকজন শীতের মৌসুমে মাস্ক না পরে এবং যথাযথভাবে স্বাস্থ্য সুরক্ষা ও সামাজিক দূরত্বের নিয়ম না মেনে শিশুদের নিয়ে বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে অংশ নিচ্ছেন। এ কারণে প্রাপ্তবয়স্কদের পাশাপাশি শিশুরা করোনায় সংক্রমিত হচ্ছে।

এ স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞের মতে, শিশুদের জনসমাগম ও সামাজিক অনুষ্ঠানে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে অভিভাবকদের অবশ্যই সতর্ক থাকতে হবে। সেই সাথে তাদের কঠোরভাবে স্বাস্থ্যবিধি মানা এবং শিশুদের মাস্ক পরা ও কিছু স্পর্শ করার পর সাবান দিয়ে হাত ধোয়ার জন্য উৎসাহিত করতে হবে।

যুক্তরাজ্যের নতুন ধরন রোধে দরকার পদক্ষেপ

ডা. লেলিন বলেন, যুক্তরাজ্যে পাওয়া নতুন ধরনটি ইতোমধ্যে সিঙ্গাপুর ও কিছু ইউরোপীয় দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। এ ধরনটি ৭০ শতাংশের মতো অধিক সংক্রামক। যদিও একে খুব প্রাণঘাতী হিসেবে ভাবা হচ্ছে না। এ ধরনটি আমাদের দেশে ছড়িয়ে যেতে পারলে হাসপাতালগুলোর ওপর চাপ বেড়ে যাবে।

তিনি জানান, নতুন ধরনটির আমদানি রোধ করতে সরকারের উচিত হবে যুক্তরাজ্যের সাথে বিমান চলাচল স্থগিত করার বিষয়টি বিবেচনা করা। সরকার যদি যুক্তরাজ্যের সাথে বিমান চলাচল বন্ধে সমস্যা মনে করে তাহলে যারা ওই দেশটি থেকে আসবেন তাদের সরকারি ব্যবস্থাপনায় বাধ্যতামূলকভাবে কমপক্ষে ১০ দিন কোয়ারেন্টাইনে রাখা উচিত।

তার মতে, এমনকি যারা নেগেটিভ সনদ নিয়ে আসবেন তাদেরও কোয়ারেন্টাইনে পাঠাতে হবে। কারণ তারা সফরের সময় ভাইরাসে সংক্রমিত হতে পারেন। সুতরাং, যুক্তরাজ্যের যাত্রীদের বিষয়ে আমাদের নেগেটিভ সনদের ওপর নির্ভর করলে চলবে না। সরকারের সিঙ্গাপুরের যাত্রীদের বিষয়েও পর্যবেক্ষণ বাড়াতে হবে। যে কোনো মহামারি রোধে এক নম্বর ধাপ হলো রোগটি বা আক্রান্তদের প্রবেশ সীমিত করা।

ডা. লেলিন জানান, আরটি-পিসিআর পরীক্ষায় দুই ধরনের কিট-- এক-জিন কিট এবং তিন-জিন কিট ব্যবহার করা হয়। পরিবর্তিত ভাইরাস অনেকবারই এক-জিন কিটে ধরা পড়ে না। তাই আমরা আরটি-পিসিআর পরীক্ষায় তিন-জিন কিট ব্যবহারের পরামর্শ দেই। তা না হলে আমরা হয়ত অনেক মিথ্যা নেভেটিভ প্রতিবেদন পাব।

এএসএম আলমগীর বলেন, সরকার ইতোমধ্যে বিমানবন্দরগুলোতে নজরদারি জোরদার করেছে। বাংলাদেশে কাউকে কোভিড নেগেটিভ সনদ ছাড়া ঢুকতে দেয়া হবে না। পিসিআর পরীক্ষার প্রতিবেদন না থাকা যাত্রী বহনের দায়ে গত সপ্তাহে আমরা কিছু এয়ারলাইন্সের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছি। এখন কোনো যাত্রী পরীক্ষার প্রতিবেদন ছাড়া আসছেন না।

আইইডিসিআরের এ বিজ্ঞানী জানান, তারা ইতোমধ্যে বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষকে যুক্তরাজ্য থেকে আসা যাত্রীদের আলাদাভাবে পরীক্ষা করার নির্দেশ দিয়েছেন। যদি কোনো যাত্রী যুক্তরাজ্য থেকে কোভিড নেগেটিভ সনদ ছাড়া আসেন তাহলে তাকে আমরা কোয়ারেন্টাইনে পাঠিয়ে দেব।

তিনি বলেন, ভাইরাসের নতুন ধরনটি সরকারের টিকা কার্যক্রমকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে না। কোভিড টিকা সব পরিবর্তিত ধরনের বিরুদ্ধেই কার্যকর হবে।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত