বিলুপ্তির পথে পরিবেশের বন্ধু গুইসাপ

প্রকাশ : ৩০ মে ২০২৩, ০৯:১১

এস এম মুকুল
গুই সাপ বিষধর সাপ ও ক্ষতিকর পোকামাকড় খেয়ে প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষা করে

নিরীহ সরীসৃপ প্রাণী গুইসাপ। গুইসাপের দেহ শুষ্ক এবং অপেক্ষাকৃত বড়ো আকৃতির। এর বহিরআকৃতির বিশেষ বৈশিষ্ট হচ্ছে গুটিকা দ্বারা আবৃত সমস্ত দেহ, উন্নত নখরযুক্ত পাঁচ আঙ্গুল বিশিষ্ট পদ। অন্যান্য সরীসৃপের তুলনায় নমনীয় দীর্ঘ গ্রিবা, অভঙ্গুর লেজ। গুই সাপের দৈর্ঘ্য প্রায় দেড় থেকে তিন ফুট পর্যন্ত হয়ে থাকে। 

গ্রামাঞ্চলে একসময় হামেশাই চোখে পড়া গুইসাপ এখন কদাচিৎ দেখা যায়। গুইসাপ খুব ভাল সাঁতারু। তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, দেশের তৃতীয় বৃহত্তম শালবনের একাংশ রসুলপুর ,সন্তোষপুর  মধুপুর অংশের জঙ্গলের ঝোপ - ঝাড়, বন  - জঙ্গল  বিনস্ট, খাল- বিল, নদীনালা, পুকুর -ডোবা ভরাট, পরিবেশ দূষণ ও মানুষের আক্রমণে পরিবেশের বন্ধু গুই হারিয়ে যাচ্ছে। 

গুইসাপ নামে সাপ হলেও এরা আসলে সাপ নয়। তবে তাদের লালায় ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া থাকায় তা বিষাক্ত। বর্তমানে গুইসাপের তিনটি প্রজাতি কোনোরকমে টিকে আছে৷ এগুলো হল কালো গুইসাপ, সোনা গুইসাপ ও রামগদি গুইসাপ৷ কালো গুইসাপ লোকালয়ে বসতবাড়ির  আশেপাশে বেশি দেখা যায়।

উদ্ভিদ ও প্রাণী বিষেশজ্ঞদের মতে, গুইসাপ প্রকৃতিবান্ধব প্রানী। এদের সংখ্যা হ্রাস পেতে থাকলে পোকামাকড়, সাপ ও ইঁদুরের উৎপাত বেড়ে যাবে। কারণ গুইসাপ জীবিত বা মৃত প্রাণী খায়। বিষধর সাপ, ক্ষতিকর পোকামাকড়, ছোটসাপ, ব্যাঙ, ইদুর, মাছ, কেঁচো, শামুক, কাঁকড়া, হাঁস-মুরগির ছানা ও ডিম তাদের পছন্দের খাবার। বাংলাদেশে বিলুপ্ত প্রাণীদের মধ্যে গুই সাপও একটি। 

বাংলাদেশে শুধুমাত্র চট্টগ্রাম ও সিলেটে গুইসাপের বিচরণ রয়েছে। চট্টগ্রামের মিরসরাই উপজেলার উপকূলীয় অঞ্চলজুড়ে রামগাদি বা বড়ো গুই (ঠধৎধহঁং ভষধাবংপবহং) প্রজাতির গুইসাপ রয়েছে। ২০০০ সালে ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন অব কনজারভেশন অব ন্যাচার (আইইউসিএন) এই প্রজাতির গুইসাপকে বিলুপ্তি ঝুঁকিপূর্ণ প্রাণী হিসেবে তালিকাভূক্ত করে।


পরিবেশবিদদের মতে, বাংলাদেশে গুই সাপ ঝুঁকির অন্যতম কারণ চামড়া আহরণ এবং প্রজনন ক্ষেত্র এবং আবাসস্থল ধ্বংস। গুই সাপের চামড়া রপ্তানির ফলে পরিবেশের ওপর ক্ষতিকর প্রভাবের বিবেচনায় ১৯৯০ সালে সরকার এর ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। ২০১২ সালের বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইনে এ প্রাণীটি সংরক্ষিত হলেও, অতিমূল্যবান চামড়ার জন্যেই নিধন করা হচ্ছে এদের।

সরকারি নিষেধাজ্ঞার পরেও থামছেনা গুইসাপের চামড়া পাচার। অসাধু ব্যবসায়ীদের কারণেই এই উপকারী প্রাণীটি আজ বিলুপ্তির পথে। তথ্য-উপাত্ত্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, সারা পৃথিবীতে ৭৩ প্রজাপতি গুই সাপ রয়েছে। যার মধ্যে বাংলাদেশে রয়েছে মাত্র তিন প্রজাতির। অনেক প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে গুইসাপের তিনটি প্রজাতি- কালো গুইসাপ  (ঠধৎধহঁং ঝধষাধঃড়ৎ), সোনা গুইসাপ (ঠধৎধহঁং ঋষাবংপবহং), ও রামগদি গুইসাপ (ঠধৎধহঁং ইবহমধষবহংরং) কোনোরকমে টিকে আছে। 

বাংলাদেশে তিন প্রজাতির গুইসাপেরই বিচরণ রয়েছে, চট্টগ্রামের বিভিন্ন অঞ্চলে। কিন্তু বন উজাড়, জমি, খাল-বিল পুকুর-ডোবা, ভরাট আর কুসংস্কারের কারণে গ্রামাঞ্চলে  ভয়  পেয়ে মেরে ফেলা হয় গুই সাপকে। বাংলাদেশ ছাড়াও ভারত, নেপাল ও পাকিস্তানসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে গুই সাপ দেখা পাওয়া যায়। বিষধর সাপ ও ক্ষতিকর পোকামাকড়  খেয়ে এরা প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষা করে, মানবজাতির উপকার করে। কিন্তু অত্যন্ত মূল্যবান এদের চামড়ার লোভে গুইসাপকে নির্মমভাবে হত্যা করা হচ্ছে যার পরিণতি মানবজাতিকেই ভোগ করতে হবে। 

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত