বিষখালি ও সুগন্ধা নদীর পানির লবণাক্ততা কমতে শুরু করেছে

প্রকাশ : ১৫ এপ্রিল ২০২১, ১৯:১৮

মোঃ আঃ রহিম রেজা

হঠাৎ করে লবণাক্ত হয়ে যাওয়া ঝালকাঠির সুগন্ধা ও বিষখালী নদীর পানির লবণাক্ততা কমতে শুরু করেছে। বৃষ্টি না হলেও আগামী পুর্ণিমার জোয়ারে স্বাভাবিক হবে বলে বিশেষজ্ঞদের বরাত দিয়ে জানিয়েছেন জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. ফজলুল হক মিয়া।

তিনি জানান, ঝালকাঠির সুগন্ধা ও বিষখালী নদীতে পানির চাপ কম থাকায় গত পুর্ণিমার জোয়ারে সাগরের লবণ পানি প্রবেশ করে। এতে সুগন্ধা ও বিষখালী নদীর পানি লবণাক্ত হয়ে যায়। ইতিপুর্বে পানিতে কিছুটা লবণাক্ততা থাকলেও তা ছিলো ক্ষতিসীমার নীচে। নদীর পানি লবণাক্ত হলেও পার্শ্ববর্তী পুকুর, খাল ও ডোবার পানি স্বাভাবিক রয়েছে।

সুগন্ধা ও বিষখালী নদীর পানির লবণাক্ততা কমে স্বাভাবিক না হলে তা দিয়ে সেচ কাজ না করার অনুরোধ জানান জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক। পুকুর, খাল ও ডোবার স্বাভাবিক পানি দ্বারা সেচসহ অন্যান্য কাজ করার পরামর্শ দেন তিনি।

তবে তিনি আশ্বস্ত করে বলেন, এতে আতঙ্কিত হবার কিছুই নেই। ক্রমান্বয়ে লবণাক্ততা কমতে শুরু করেছে। বৃষ্টি না হলেও আগামী পুর্ণিমার জোয়ারের পানিতে পুরোপুরি স্বাভাবিক মিষ্টি স্বাদের পানিতে রূপ নেবে সুগন্ধা ও বিষখালী নদীর পানি।

অনুসন্ধানে জানাগেছে, এপ্রিল মাসের শুরু থেকে হঠাৎ করেই সুগন্ধা ও বিষখালী নদীর ওপর নির্ভরশীল মানুষরা পানি লবণাক্ততা অনুভব করতে শুরু করেন। নদী তীরবর্তী মানুষ দৈনন্দিন কাজে এ নদীর পানি ব্যবহার করলেও এখন তা স্বাভাবিকভাবে সম্ভব হচ্ছে না। আর মিঠাপানির এ দুটো নদীতে বর্তমানে যে কিছুটা লবণাক্ততা রয়েছে তা নিশ্চিত করেছেন পরিবেশবিদরাও। বিশেষ করে ২০২০ সাল থেকে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত এ নদীর পানিতে তড়িৎপরিবাহিতা (Electrical Conductivity-EC) অনেক কম থাকলেও মার্চ মাসে বেড়ে গেছে কয়েকগুণ। এমনকি গত ফেব্রুয়ারি থেকে মার্চে পানির তামপাত্রাও বেড়েছে। আর এসব হিসেবে গেলো বছর করোনাকালে বেশ ভালো ছিলো নদীর পানি।

বিশেষজ্ঞদের মতে শুষ্ক মৌসুমে উজানের পানি কম প্রবাহিত হওয়া এবং বৃষ্টিপাত না হওয়া, দূষণসহ জলবায়ু পরিবর্তনের কারণেই সুগন্ধা ও বিষখালী মতো মিঠা নদীর পানিও এখন লবণাক্ত হয়ে উঠেছে। এতে করে জীব বৈচিত্র্যের উপরও বিরূপ প্রভাব পড়বে, ফলে পরিবেশ বিপর্যয়ের শঙ্কাও রয়েছে।

বিষখালী ও সুগন্ধা নদীর পানির ওপর নির্ভরশীলদের মতে, চলতি এপ্রিল মাসের শুরুতে পূর্ণিমার জোয়ারে আসা সাগরের পানি থেকেই  নদীর পানিতে লবণের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। পৌর মিনি পার্ক ও ডিসি পার্ক সংলগ্ন সুগন্ধা নদীতে গোসল করতে গিয়ে অনেকেই পানি মুখে দিয়ে লবণের উপস্থিতি লক্ষ্য করেন। প্রথমে বিষয়টি নিয়ে ভ্রুক্ষেপ না করলেও, পুরাতন কলেজ খেয়াঘাট থেকে স্থানীয় দোকানিরা চায়ের পানি সংগ্রহ করতে গেলে তাতেও লবণের উপস্থিতি লক্ষ্য করেন। এরপর থেকেই নদীর পানি হঠাৎ করেই লবণাক্ত হওয়ার বিষয়টি লোকমুখে ছড়িয়ে পরে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে স্থানীয়দের মধ্যে বেশ শোরগোল শুরু হয়ে যায়।

চায়ের দোকানি সোহেল রানা জানান, প্রথমে নদীর পানি লবণাক্ত হয়ে ওঠার কথা ছোট ছোট ছেলে মেয়েদের কাছ থেকে শুনেছেন। পরে তিনি নিজেও মুখে নিয়ে বিষয়টি নিশ্চিত হন।

স্থানীয় বাসিন্দা জসিম জানান, প্রথমে ধারণা করা হচ্ছিলো শহরের ভেতর থেকে বয়ে আসা বাসন্ডা খালের কাঠপট্টি খালের মুখের পাশের জায়গাতে নদীর পানি লবণাক্ত। তাই এটা স্বাভাবিক ধরে নিয়েছিলো অনেকে। পরে বিভিন্নস্থান থেকে নদীর পানি লবণাক্ত হওয়ার খবর ছড়িয়ে পরে।

স্থানীয় যুবকরা বলছেন, শুধু পানি লবণই নয়, গোসল করার পর চুলগুলো কেমন যেন হয়ে যাচ্ছে, যা আগে হয়নি।

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন ও বাংলাদেশ নদী বাঁচাও আন্দোলন বরিশাল বিভাগীয় সমন্বয়কারী রফিকুল আলম জানান, ২০১০ সাল থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত তারা একটি সার্ভে করেছিলেন, যেখানে দেখতে পান শুষ্ক মৌসুমে সাগরের পানি তেঁতুলিয়া নদী পর্যন্ত চলে আসছে। তখন পরিবেশ অধিদপ্তরসহ দায়িত্বশীল সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোকে বিষয়টি নিয়ে ভাবার জন্য বলা হয়েছিলো।

তিনি বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে আমরা বেশ কিছু মাধ্যমে শুনতে পারছি বরিশালের কীর্তনখোলা, ঝালকাঠির সুগন্ধা ও বিষখালী নদীর পানিতে লবণাক্ততা আসছে। এজন্য পরিবেশ অধিদপ্তরকে কীর্তনখোলা নদীর পানি পরীক্ষা করতে হবে এবং কার্যকর পদক্ষেপ যেটুকু নেওয়া প্রয়োজন তা নিতে হবে। তা না হলে আমাদের জলজ সম্পদের ক্ষতি হবে, পাশাপাশি মানুষের জীবন-জীবিকার ওপর বিরূপ প্রভাব পড়বে এবং জীব-বৈচিত্র্যর ওপর বিরূপ প্রভাব পরবে।

তিনি আরো বলেন, এখন থেকে ১০ বছর আগে উজান থেকে যে পানি আসতো নদীগুলোতে এখন তা কমে আসছে। আর আমাদের এখানে যখন পানির পরিমাণটা কমবে তখন সাগর থেকে ওই পানির চাপটা ঠিকই আসবে। এটা কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের একটি বিরূপ প্রভাব। ফলে উজানের পানির প্রবাহ বাড়াতে হবে। পাশাপাশি জলবায়ু অভিযোজনের জন্য যা যা করা দরকার সেটা করতে হবে। সেইসঙ্গে আমাদের মানুষদেরও সচেতন হতে হবে। তবে সবকিছুর আগে লবণ পানির যে বিষয়টি শোনা যাচ্ছে সেটিকে যথাযথ প্রক্রিয়ায় পরীক্ষা করতে হবে। আর এটা নিয়মিত পরিবেশ অধিদপ্তর করে থাকে। তারা পরীক্ষা করে পানির মানের বিষয়টি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে অবহিত করবে।

প্রতিমাসেই নদীর পানি পরীক্ষা করা হয়ে থাকে বলে জানিয়েছেন পরিবেশ অধিদপ্তরের বরিশাল বিভাগীয় কার্যালয়ের সহকারি বায়োকেমিস্ট মো. মুনতাসির রহমান।

তিনি বলেন, পরীক্ষার হিসেব অনুযায়ী ফেব্রুয়ারি মাস থেকে মার্চ মাসে কীর্তনখোলা, সুগন্ধা ও বিষখালী নদীর পানির অনেকটাই পরিবর্তন এসেছে। এটা অবশ্যই চিন্তার বিষয়, তাই নিয়মিত মনিটরিং রাখা হচ্ছে। বিষয়টি নিয়ে অধিকতর বিশ্লেষণ করে পরবর্তীতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাও নেওয়া হবে।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত