পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা)-এর উদ্যোগে ওয়েবিনার

ওয়ান হেলথ : মানুষ ও পরিবেশ সুরক্ষার নতুন দিগন্ত।

প্রকাশ | ২৬ নভেম্বর ২০২০, ১৭:৩৬ | আপডেট: ২৬ নভেম্বর ২০২০, ১৭:৪৬

অনলাইন ডেস্ক

বৈশ্বিক ওয়ান হেলথ (সর্বপ্রাণের জন্য অভিন্ন স্বাস্থ্য) এর অন্যতম নেতৃত্বে বাংলাদেশ। এতে বাংলাদেশের মর্যাদা বৃদ্ধি পেয়েছে, বেড়েছে দায়িত্বও। এ প্রেক্ষিতে পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা)-এর উদ্যোগে ২৬ নভেম্বর ২০২০, বৃহস্পতিবার, সকাল ১১.০০ টায় অনলাইনে (জুমে) লাইভ আলোচনা সভা (ওয়েবিনার) অনুষ্ঠিত হয়েছে। 

সভার আলোচনার বিষয়:

ওয়ান হেলথ বিষয়ক বৈশ্বিক কার্যক্রমের নেতৃত্বে বাংলাদেশ। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ইতিবাচক ভূমিকা। 

ওয়ান হেলথ বাস্তবায়নে বাংলাদেশের সম্ভাবনা এবং সমস্যা। 

ওয়ান হেলথ বাস্তবায়নে অগ্রবর্তীতার ক্ষেত্র নির্ধারণ ( Priority fixation)। 

পবা-র সুপারিশসমূহ।


গ্রিন ফোর্স সমন্বয়ক ও পবা’র সম্পাদক মেসবাহ সুমন-এর সঞ্চালনায় সভায় ধারণাপত্র উপস্থাপন করেন পবা’র যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী। সভায় প্রধান অতিথি হিসাবে উপস্থিত ছিলেন অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক, চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা ও সাবেক উপাচার্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। 

সম্মানিত আলোচক হিসাবে উপস্থিত ছিলেন:

অধ্যাপক ডা. রশিদ-ই-মাহবুব,  সাবেক সভাপতি, বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ)।

অধ্যাপক ডা. শুভাগত চৌধুরী, প্রথিতযশা লেখক (চিকিৎসা বিজ্ঞান) ও চিন্তক।

প্রকৌশলী মোঃ আব্দুস সোবহান, সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক, পরিবেশ অধিদপ্তর ও সাধারণ সম্পাদক, পবা। 

ডা. মুশতাক হোসেন, সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা (আইইডিসিআর)

সৈয়দ মাহবুব আলম তাহিন, ও সম্পাদক পবা।

আবু নাসের খান, চেয়ারম্যান, পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন, পবা। 

অনুষ্ঠানের শুরুতেই আগামী ৩ বছরের জন্য ‘ওয়ান হেলথ গ্লোবাল লিডার্স’ গ্রুপের কো-চেয়ার নির্বাচিত হওয়ায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কে অভিনন্দন জানানো হয়। ধারণপত্রের সাথে একাত্বতা করে আলোচকবৃন্দ বলেন — 

একটি নীরোগ সুস্থ জীবন হলো মানুষের চুড়ান্ত কামনা। কিন্তু এটা এখন পরিষ্কার যে মানুষ একা ভালো ও সুস্থ থাকতে পারেনা। তাকে সকল প্রাণী, উদ্ভিদ  ও পরিবেশের সর্ব উপাদানকে সুস্থ  রোগমুক্ত ও দূষণমুক্ত রাখার মধ্য দিয়েই ভালো থাকতে হবে। তাই আগামীদিনের স্বাস্থ্যব্যবস্থার নাম হবে 'ওয়ান হেলথ বা অভিন্ন স্বাস্থ্য ব্যবস্থা'। আমাদেরকে সেই পথে যাত্রার শুভ সূচনা করার সময় এখনই। আগামীদিনের পৃথিবীতে মানুষের ভালো থাকা এবং সুস্থতা নির্ভর করবে অভিন্ন স্বাস্থ্য ধারণার সঠিক প্রয়োগের মধ্য দিয়ে। এটি করতে হবে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতার কার্যকর সমন্বয়ের দ্বারা। 

আলোচনা সভায় উপস্থাপিত ধারণাপত্র

মানুষ, প্রাণী, উদ্ভিদ এবং পরিবেশ একে অপরের সাথে গভীরভাবে সংযুক্ত। পরিবেশের উপাদান দুই অংশে বিভক্ত। একটি জীব অংশ এবং অপরটি জড় অংশ। মানুষের সুস্থতা এবং ভালো থাকা সার্বিকভাবে সমস্ত কিছুর সাথে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। তাই মানুষকে ভালো থাকতে হলে ভালো রাখতে হবে পৃথিবীর সকল প্রাণী, উদ্ভিদ, পানি,বায়ু, পাহাড়, নদী,সমুদ্র ইত্যাদিসহ সবকিছুকে। একটির মন্দ থাকা অনিবার্যভাবে অন্য সবাইকে, সবকিছুকে মন্দে নিয়ে যাবে। মূলতঃ এটাই হচ্ছে 'ওয়ান হেলথ বা অভিন্ন স্বাস্থ্য' এই ধারণার মৌলিক ভিত্তি। ওয়ান হেলথ বা অভিন্ন স্বাস্থ্য'-কে সুনির্দিষ্ট করার জন্য একটি টাস্ক ফোর্স গঠিত হয়। নাম ছিলো --One health initiative task force। ওরা একটা সংজ্ঞা নির্ধারণ করে। সেটা হলো--" মানুষ, প্রাণী এবং আমাদের পরিবেশের সর্বোচ্চ সুস্বাস্থ্য অর্জন করার জন্য স্থানীয়, জাতীয় এবং আন্তর্জাতিকভাবে কর্মরত বহুবিধ ক্ষেত্রসমুহের মধ্যে একটি সহযোগিতামূলক প্রয়াস গড়ে তুলতে হবে।" এখানে লক্ষ্যনীয়, প্রায়োগিক দৃষ্টিভঙ্গী থেকে পুরো সংজ্ঞাটি নির্মিত হয়েছে। স্বাস্থ্যের সংজ্ঞা নির্ধারণ করতে গিয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা যেমন অনেক বেশি দার্শনিকতা ও তাত্ত্বিকতা প্রভাবিত ছিলো। মানুষ, প্রাণী, উদ্ভিদ ও পরিবেশের সমন্বয়ে গড়ে উঠা পরিপূর্ণ বাস্তুতন্ত্র বা ইকোসিস্টেমের ভারসাম্য রক্ষার বিষয়টি পূর্বালোচনা ব্যতিরেকে গৃহীত হয়েছে। তাই বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে ওয়ান হেলথকে দার্শনিক দৃষ্টিকোণ থেকে না দেখে কর্মভাবনার ভিত্তিতে থেকে দেখা হয়।

অভিন্ন স্বাস্থ্য বা ওয়ান হেলথের ধারণাকে বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজন-

১. একটি লাগসই কর্মসূচি। এটি আঞ্চলিক বা স্থানীয় প্রয়োজন বা চাহিদাকে ভিত্তি  করে প্রস্তুত হবে। এটিকে সামাজিক ও সাংস্কৃতিকভাবে মানুষের মধ্যে গ্রহণযোগ্য হতে হবে।

২. বাস্তবায়নের জন্য নীতিমালা তৈরি করা।

৩. এ সংক্রান্ত আইন ও বিধিমালা প্রস্তুত করা।

৪. ওয়ান হেলথ কনসেপ্ট নিয়ে নিরন্তর গবেষণা করা।

অভিন্ন স্বাস্থ্য বা ওয়ান হেলথ মূলত ব্যাপকভাবে বিস্তৃত একটি ক্ষেত্র। বিজ্ঞানের অধিকাংশ বিষয় এখানে যুক্ত হয়ে যায়। কিন্তু এই মহাবিস্তৃত কর্মক্ষেত্রে কাজের অগ্রবর্তীতা নির্ধারণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। 

তাই অগ্রবর্তীতা বিবেচনায় বাস্তবায়নের ক্ষেত্রগুলো হলো: 

১.খাদ্যের সামগ্রিক নিরাপদ সংক্রান্ত বিষয়সমুহ নিশ্চিত করা।

২. প্রাণী থেকে মানুষে সংক্রমিত হয় এমন সব সংক্রামক রোগবালাইর প্রতিরোধ করা।

৩. রোগজীবাণুর বিরুদ্ধে অ্যান্টিবায়োটিকগুলো ক্রমবর্ধমানভাবে কার্যকারিতা হারাচ্ছে। ঔষধ প্রতিরোধী রোগজীবাণুর আবির্ভাব ঘটছে। ঔষধ প্রতিরোধী "সুপারবাগ"-এর পদধ্বনি শোনা যাচ্ছে। এই প্রক্রিয়াকে রোধ করা।

এজন্য প্রধান করণীয় হচ্ছে-

১. খাদ্যকে অনিরাপদ ও ক্ষতিকর করে এমন কোন দ্রব্য বা রাসায়নিক যেমন রাসায়নিক সার, কীটনাশক ঔষধ, সংরক্ষণ/রং করা/পাকানো/স্বাদ বৃদ্ধি/আকার বৃদ্ধি ইত্যাদির জন্য রাসায়নিক বব্যহার বন্ধ করা

২. প্রাণীর স্বাস্থ্যরক্ষার জন্য প্রাণীবিদ ও প্রাণী চিকিৎসকের কর্মপরিধি বিস্তৃত করা। 

৩. উদ্ভিদবিদ ও রোগতত্ত্ববিদের সেবা নিশ্চিত করা।

৪. বন ও জংলাভূমির অস্তিত্ব ও পরিধি অটুট রাখা। বনজঙ্গল ধ্বংস হওয়ার কারণে জঙ্গলবাসী রোগজীবাণু ক্রমবর্ধমানভাবে মানুষের শরীরে বাসা বাঁধছে।

৫. আন্তর্জাতিকভাবে গৃহীত গাইডলাইন অনুযায়ী মানুষ, প্রাণী ও কৃষিখাতে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করতে হবে। 

আমরা জানি --বিশ্বে ব্যবহৃত অ্যন্টিবায়েটিকের ৭৩% কৃষি, মুরগি ও অন্যান্য প্রাণীর শরীরে প্রয়োগ করা হয়। ২০১৪ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ব্যবহৃত অ্যান্টিবায়োটিকের ৮০% প্রয়োগ করা হয়েছিল পশুপালন খাতে। বিশ্বে এককেজি মুরগির মাংস উৎপাদনে বছরে ১৪৮ মিলিগ্রাম অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করা হয়। গরুতে এই পরিমাণ বছরে ৪৮ মিলিগ্রাম। এই অ্যান্টিআায়োটিক ফুড চেইনের মাধ্যমে মানুষের শরীরে প্রবেশ করে। মানুষের চিকিৎসায়,কৃষি,পোলট্রি ও লাইভ স্টকে প্রয়োগকৃত অ্যান্টিবায়োটিকের কারণে বিশ্বব্যাপী  Antibiotic Resistantance বাড়ছে। সম্প্রতি এক গবেষণায় দেখা গিয়েছে বিশ্বে প্রতিবছর ৭ লাখ মানুষ অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী জীবাণুর সংক্রমণে মারা যায়। এই দুঃখজনক মৃত্যুর রেখাচিত্রের অভিমুখ উর্ধ্বমুখি। পৃথিবী একটি মহাবিপর্যয়ের দিক ধাবিত হচ্ছে।
 
বাংলাদেশে ওয়ান হেলথ বা অভিন্ন স্বাস্থ্যের ধারণাকে গ্রহণ ও প্রয়োগের জন্য আইনী কাঠামো নেই। আমাদেরকে নতুন ভাবে শুরু করতে হবে। 

এই ক্ষেত্রে পবা’র সুপারিশগুলো হলো---

১. আমাদের দেশে ওয়ান হেলথ বা অভিন্ন স্বাস্থ্যের একটি প্রায়োগিক ধারণা প্রস্তুত করা দরকার। এজন্যে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ, প্রাণীবিদ,প্রাণী চিকিৎসক, উদ্ভিদ রোগতত্ত্ববিদ, উদ্ভিদবিদ,কৃষিবিদ, পরিবেশ বিজ্ঞানী,ঔষধ বিশেষজ্ঞ, সংশ্লিষ্ট বিষয়ে গবেষকসহ প্রয়োজনীয় লোকবল নিয়ে একটি জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটি গঠন করা। এই কমিটি একটি নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে তাদের প্রস্তাব তৈরি  করবে।

২. স্বাস্থ্য, কৃষি, প্রাণী সম্পদ,বন ও পরিবেশ, খাদ্যসহ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি সমন্বয়ে একটি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন  কাউন্সিল গঠন করা। এই কাউন্সিল ওয়ান হেলথের কার্যক্রম বাস্তবায়ন করবে। 

৩. মানুষ, প্রাণী,কৃষিখাতসহ অন্যান্য ক্ষেত্রে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের আন্তর্জাতিক গাইডলাইন কঠোরভাবে মেনে চলা নিশ্চিত করা।

৪. ওয়ান হেলথ ধারণার সাথে সাংঘর্ষিক দপ্তর, অফিস বা আইনের অবলুপ্তি ঘটানো।