প্রাইভেট পড়তেও ভয় পাচ্ছেন সেই অধ্যক্ষের তিন সন্তান

প্রকাশ : ২৯ জুন ২০২২, ২২:৪০

‘এই শাহীনুর ভাই ওই মালাডা কোহানে?’ কলেজ ভবনের সামনে দাঁড়িয়ে একব্যক্তি একথা বলার পর কিছুক্ষণ কেটে যায়। এ সময় কলেজ ভবনের সামনে অনেক পুলিশ সদস্যসহ বিক্ষুদ্ধ জনতা দাঁড়িয়েছে ছিলেন। এছাড়া ভবনের কলাপসিবল গেটের সামনেও পুলিশের এক সদস্যকে দেখা গেছে। এ সময়ও চারিদিকে শোরগোল চলছিল। হঠাৎ করেই ভবনের ভেতর থেকে নড়াইল সদরের মির্জাপুর ইউনাইটেড ডিগ্রি কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাস এবং অভিযুক্ত ছাত্র রাহুল দেব রায় ও তার বাবাকে বের  করে আনা হয়। পুলিশ সদস্যসহ বিক্ষুদ্ধ জনতা তাদের বের করে আনেন। এ সময় কলেজের অধ্যক্ষসহ কারোর গলায়ই জুতার মালা ছিল না। ঢালু সিঁড়িতে (প্রতিবন্ধীদের জন্য ব্যবহৃত) আসার পরই বিক্ষুব্ধরা ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষসহ ওই শিক্ষার্থীর গলায় জুতারমালা পরান। ফেসবুকে ৪ মিনিট ৫৮ সেকেন্ডের একটি ভিডিওচিত্রে এমন দৃশ্যই দেখা গেছে।

এক পর্যায়ে তাদের মাঠের ভেতরে নিয়ে আসলে একব্যক্তি বলেন, ‘এই প্রিন্সিপ্যালের মালাটা খুলে দেও।’ ভিডিওচিত্রে দেখা যায়-লাল, কালো ও আকাশি রঙের গেঞ্জি পরিহিত তিন যুবক গলায় জুতার মালা পরনোর কাজটি করেন। অস্পষ্ট ভিডিওতে তাদের ঠিকমতো চেনা যাচ্ছে না। তবে, পুলিশের সামনে অধ্যক্ষের গলায় জুতার মালা দেয়ায় বিভিন্ন মহলে নিন্দা ও প্রতিবাদ চলছে। দোষীদের গ্রেপ্তারের দাবি জানানো হয়েছে।

এদিকে, বুধবার (২৯ জুন) দুপুরে নড়াইল সদরের বড়কুলা গ্রামে অধ্যক্ষের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, পুলিশ প্রহারা রয়েছে। বাড়িতে অধ্যক্ষের স্ত্রী ও তিন মেয়েসহ পরিবারের অন্যরা আছেন। এর মধ্যে অধ্যক্ষের অনার্স পড়ুয়া বড় মেয়ের সঙ্গে কথা হলে তিনি বলেন, আমরা অপমান ও লজ্জায় ক্লাসে যেতে পারছি না। মেঝো বোনের সামনে এসএসসি পরীক্ষা। সে প্রাইভেট পড়তে বাইরে যেতে পারছে না। ছোট বোনেরও একই অবস্থা। আর বাবা আপাতত আত্মীয় বাড়িতে থাকছেন।  

অন্যদিকে অধ্যক্ষকে লাঞ্ছিত, শিক্ষকদের তিনটি মোটরসাইকেল পোড়ানো এবং পুলিশের কাজে বাঁধা দেয়ার মামলায় গ্রেপ্তারকৃত তিন আসামির বিরুদ্ধে বুধবার (২৯ জুন) দুপুরে আদালতে পাঁচদিনের রিমান্ড আবেদন করেন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা সদর থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মাহমুদুর রহমান। তিনি বলেন, আগামি ৩ জুলাই রিমান্ড শুনানি অনুষ্ঠিত হবে।  

এর আগে মির্জাপুর পুলিশ ক্যাম্পের ইনচার্জ এসআই মুরসালিন বাদি হয়ে গত সোমবার মামলা দায়ের করেন। এ মামলায় ১৭০ জনকে আসামি করা হয়েছে। এর মধ্যে আড়পাড়া গ্রামের মালেক মুন্সীর ছেলে মির্জাপুর বাজারের মোবাইল ফোন মেকার শাওন (২৮), মির্জাপুর গ্রামের সৈয়দ মিলনের ছেলে অটোচালক রিমন (২২) এবং একই গ্রামের মাদরাসা শিক্ষক মনিরুল ইসলামকে (২৭) মঙ্গলবার দুপুরে বিভিন্ন এলাকা থেকে গ্রেফতার করে পুলিশ। তাদেরকে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। এরপর থেকে এলাকায় লোকসমাগম কমে গেছে। ঘটনাস্থলের পাশে মির্জাপুর বাজারেও কিছুটা নিরব পরিবেশ বিরাজ করছে।

এদিকে, কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাসের গলায় জুতারমালা পরিয়ে অফিস থেকে বের করার নেপথ্যে দু’টি বিষয় উঠে এসেছে। এর মধ্যে একটি-ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের পদ দখল, অপরটি শিক্ষকদের মধ্যে দ্বন্দ্বের জের ! এমনটি বলেছেন, নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই কলেজের কয়েক শিক্ষকসহ বিভিন্ন পেশার মানুষ। এ ব্যাপারে জেলা বা পুলিশ প্রশাসনের পক্ষ থেকে কোনো মন্তব্য পাওয়া যায়নি।  

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কলেজের কয়েকজন শিক্ষকসহ বিভিন্ন পেশার মানুষ বলেন, গত ১৮ জুন মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) কে নিয়ে ‘বিতর্কিত মন্তব্যকারী’ ভারতের রাজনীতিবিদ নূপুর শর্মার ছবি ব্যবহার করে আমাদের কলেজের একাদশ শ্রেণির ছাত্র রাহুল দেব রায় তার ফেসবুক আইডিতে যে পোস্ট দিয়েছে, সেজন্য ওই ছাত্রই দায়ী। এ ঘটনায় ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ দায়ী নন। কলেজ শিক্ষকদের মধ্যে দ্বন্দ্ব এবং অধ্যক্ষের পদ দখলের অভিপ্রায় থেকেই তার (স্বপন কুমার) গলায় জুতার মালা দেয়া হয়েছে। জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে গত সোমবার (২৭ জুন) অনুষ্ঠিত আলোচনা সভায়ও বিষয়টি উঠে আসে।

সভায় অনেকেই অভিযোগের তীর ছুঁড়েছেন মির্জাপুর ইউনাইটেড ডিগ্রি কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ও স্থানীয় বিছালী ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি আকতার হোসেন টিংকুর দিকে। তিনি (টিংকু) এর আগে ওই কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ ছিলেন। এরপর স্বপন কুমার বিশ্বাসকে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ করা হয়।

তবে এসব অভিযোগ অস্বীকার করে আকতার হোসেন টিংকু বলেন, ঘটনা শুরুর আগে সকাল ১০টার দিকে আমি ক্লাসে যাই। পরবর্তীতে আরেকটি ক্লাস নেয়ার সময় সৃষ্ট ঘটনা জানতে পারি। ক্লাস থেকে বের হয়ে অধ্যক্ষের সাথে কথা বলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করি। অধ্যক্ষের দায়িত্ব নেয়ার কোনো ইচ্ছা আমার নেই। উদ্দেশ্যমূলক অভিযোগের তীর আমার দিকে ছোঁড়া হয়েছে। যারা এসব কথা ছড়াচ্ছেন, তারা বিএনপি ও জামায়াতের লোক।

এ ব্যাপারে মির্জাপুর ইউনাইটেড কলেজ পরিচালনা পরিষদের সভাপতি ও সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি অচিন চক্রবর্তী বলেন, ঘটনার দিন আমি ঢাকায় ছিলাম। শুনেছি অধ্যক্ষকে জুতার মালা দেয়া হয়েছে। এ ঘটনায় কে, কারা জড়িত তা তদন্তে বেরিয়ে আসবে। তিনি আরও বলেন, শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখতে ঈদুল আজহার পর কলেজ খুলবে।

জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান এবং পুলিশ সুপার প্রবীর কুমার রায় (পিপিএম বার) জানান, ঘটনার দিন তাদের প্রধান লক্ষ্য ছিল-সহিংসতা এড়িয়ে সবাইকে নিরাপদ রাখা। ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের গলায় জুতার মালা দেয়ার বিষয়টি তারা দেখেননি। এ সময় কলেজ গেটের কাছে ছিলেন তারা। ঘটনাটি তদন্তের জন্য অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট জুবায়ের হোসেন চৌধুরীর নেৃতৃত্বে জেলা প্রশাসনের একটি টিম এবং অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রিয়াজুল ইসলামের নেতৃত্বে পুলিশের অপর তদন্ত টিম কাজ করছে। ৩০ জুন তদন্ত প্রতিবেদন দেয়া হবে।  

পুলিশ ও কলেজ সূত্রে জানা গেছে, মির্জাপুর ইউনাইটেড ডিগ্রি কলেজের একাদশ শ্রেণির ছাত্র রাহুল দেব রায় নিজের ফেসবুক আইডিতে নূপুর শর্মার ছবি ব্যবহার করে লেখেন-প্রণাম নিও বস 'নূপুর শর্মা' জয় শ্রীরাম। এ পোস্ট দেয়ার পর গত ১৮ জুন সকালে কলেজে আসেন রাহুল। এরপর তার বন্ধুরা পোস্টটি মুছে ফেলতে বললেও সে পোস্ট মুছেননি রাহুল।

শিক্ষার্থীরা বিষয়টি কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাসকে জানান। এক পর্যায়ে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ কলেজের সব শিক্ষকদের পরামর্শে রাহুলকে পুলিশের হাতে তুলে দেয়ার চেষ্টা করেন। এরই মধ্যে শিক্ষার্থীসহ স্থানীয়রা বিক্ষুদ্ধ হয়ে ওঠেন। এক পর্যায়ে কলেজ চত্বরে থাকা শিক্ষকদের তিনটি মোটরসাইকেল পুড়িয়ে দেয় তারা। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুলিশ লাঠিচার্জসহ কয়েক রাউন্ড টিয়ারশেল ছোঁড়ে। ঘটনার সময় অন্তত ১০ জন ছাত্র-জনতা আহত হন।

এদিকে, অভিযুক্ত ছাত্রের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা না নেয়ার অভিযোগ এনে বিক্ষুদ্ধ জনতা ঘটনার দিন ১৮ জুন বিকেলে কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাস এবং শিক্ষার্থী রাহুল দেব রায়কে গলায় জুতারমালা পরিয়ে প্রতিবাদ জানান।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত