‘পদোন্নতির জন্য শিক্ষকরা গবেষণার চেয়ে রাজনীতিতে বেশি মনোযোগী’

প্রকাশ : ১৬ অক্টোবর ২০২০, ২০:৫২

সাহস ডেস্ক
ফাইল ছবি

শিক্ষার মানের জন্য একদা ‘প্রাচ্যের অক্সফোর্ড’ হিসেবে অভিহিত করা হলেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে (ঢাবি) বিদেশি শিক্ষার্থী ভর্তির সংখ্যা দিন দিন কমছে।

বিদেশি শিক্ষার্থীদের ভর্তির দীর্ঘায়িত প্রক্রিয়া, বিদেশি বান্ধব ক্যাম্পাস, আবাসন সুবিধার অভাব এবং ঢাকার শিক্ষা খাতে অন্যান্য বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়াকে দায়ী করছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। এ ছাড়া, ঢাবিতে ভর্তি নিয়ে বিদেশি শিক্ষার্থীদের উদ্বেগ সমাধানে কর্তৃপক্ষের উদাসীনতাকেও দায়ী করছেন তারা।

বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সহায়তা ডেস্ক থেকে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিদেশি শিক্ষার্থী ভর্তির কোনো তথ্য পাওয়া না গেলেও, বর্তমানে ঢাবির বিভিন্ন বিভাগ ও অধিভুক্ত প্রতিষ্ঠানে প্রায় ৫,১৬০ বিদেশি শিক্ষার্থী এবং পে-রোল আওতায় ১৯ জন শিক্ষক নিযুক্ত আছেন বলে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে।

স্যার পি জে হার্টজ আন্তর্জাতিক হলের সংযুক্তিতে ঢাবিতে বিদেশি শিক্ষার্থীরা ভর্তি হন।

হলের প্রভোস্ট ড. মো. মহিউদ্দিনের দেওয়া তথ্য মতে, বর্তমানে হলটিতে ১১৭ জন বিদেশি শিক্ষার্থী রয়েছেন। তার মধ্যে ৩৮ জন বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগে অধ্যয়নরত আর বাকিরা অধিভুক্ত মেডিকেল ইনস্টিটিউটে ভর্তি রয়েছেন।

বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) বার্ষিক প্রতিবেদন অনুসারে, বাংলাদেশের ৫০টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ২৩টিতে প্রায় ৮০৪ জন বিদেশি শিক্ষার্থী ভর্তি রয়েছেন। অন্যদিকে, দেশে ১০৩টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩৭টিতে ১,৩৮৬ জন বিদেশি শিক্ষার্থী পড়াশুনা করছেন।

বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বলছে, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো চিরাচরিত এবং অনলাইন প্ল্যাটফর্মে বিজ্ঞাপনের প্রচারের মাধ্যমে বিদেশি শিক্ষার্থী ভর্তির সংখ্যা বাড়াচ্ছে।

ঢাবির আন্তর্জাতিক সম্পর্কিত কার্যালয়ের পরিচালক অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, বিশ্বব্যাপী বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যেভাবে বিজ্ঞাপন দেয়, সেভাবে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দেওয়া হয় না। ফলে, আমরা যে বিষয়গুলো পড়াই ও আমাদের যেসব ডিগ্রি কোর্স আছে, সে সম্পর্কে বিদেশি শিক্ষার্থীরা জানে না। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় বলে আমরা বিদেশি শিক্ষার্থীদের নজরে আসার জন্য মার্কেটিংয়ে লাখ লাখ টাকা ব্যয়ে বিশ্বাসী না।

বিদেশি শিক্ষার্থীদের আকৃষ্ট করতে না পারার জন্য গণমাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে নেতিবাচক মিডিয়া কভারেজকে’ দায়ী করেন এ অধ্যাপক। তিনি বলেন, অনেকের মধ্যে এ ভুল ধারণা আছে যে, ঢাবিতে পড়াশোনা করার জন্য বাংলা জানতে হবে। অনেক বিভাগই শেখানোর মাধ্যম হিসেবে ইংরেজি ব্যবহার রয়েছে, তা তারা জানেন না। আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের জন্য আলাদা খাবার সরবরাহ করার বিষয়েও তারা জানেন না।

বিদেশি শিক্ষার্থীদের আকর্ষণে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কৌশলগত বিষয়গুলো পুনর্বিবেচনা করা দরকার বলে একমত হয়েছেন অধ্যাপক ইমতিয়াজ। তিনি বলেন, একজন বিদেশি শিক্ষার্থী ভর্তির জন্য প্রথমে আমাদের ওয়েবসাইটে ঢুকে অনলাইন প্রসপেক্টাস ও আমাদের সম্পর্কে তথ্যানুসন্ধান করবেন। দুর্ভাগ্যক্রমে, আমরা এখনো আন্তর্জাতিক মানের একটি অত্যাধুনিক পোর্টাল এবং প্রসপেক্টাস ডিজাইন করতে পারিনি।

তিনি বলেন, আমাদের গৌরব অর্জন এবং আরও বিদেশি শিক্ষার্থীদের আকর্ষণ করার জন্য বিখ্যাত গবেষণা কাজগুলো তুলে ধরার উদ্যোগ নিয়েছি। তবে, পদোন্নতির জন্য শিক্ষকরা গবেষণা বা একাডেমিক কাজের চেয়ে রাজনীতির প্রতি বেশি মনোযোগী। এ প্রবণতা আমাদের নতুন গবেষণা করার ক্ষেত্রে একটি বড় বাধা হিসেবে কাজ করে চলেছে। তবে কোভিড সঙ্কট পরবর্তী বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বিদেশি শিক্ষার্থীদের ঢাবিমুখী করতে যথাসাধ্য চেষ্টা করবেন বলেও জানান তিনি।

র‌্যাঙ্কিংয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পিছিয়ে পড়াও বিদেশি শিক্ষার্থী আকৃষ্ট করতে না পারার পেছনে দায়ী। শিক্ষা বিষয়ক যুক্তরাজ্যভিত্তিক প্রতিষ্ঠান কুয়াকুয়ারেলি সাইমন্ডস (কিউএস) ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি ২০২১ সালের র‌্যাঙ্কিংয়ে প্রথম ১ হাজারের মধ্যে আছে কেবল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও বুয়েট। তবে, ২০০২ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে র‌্যাঙ্কিংয়ে প্রায় দুইশ পিছিয়ে ৮০০-১০০০ কোটায় পৌঁছে গেছে ঢাবি।

অধ্যাপক ইমতিয়াজ বলেছেন, বিশ্বব্যাপী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে শীর্ষে না থাকার কারণ হলো আমরা এ বিষয়ে সচেতন নই। ভালো উন্নত র‌্যাঙ্কিংয়ের জন্য যেসব প্রয়োজনীয় তথ্য সরবরাহ দরকার, তা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ থেকে সরবরাহ করা হয় না।

দীর্ঘ ও কঠিন ভর্তি প্রক্রিয়ার কারণেও বিদেশি শিক্ষার্থীরা ঢাবিতে আবেদন করতে নিরুৎসাহিত বোধ করার আরও একটি বড় কারণ।

বর্তমান পদ্ধতিতে, একজন বিদেশিকে প্রথমে বাংলাদেশ দূতাবাসের মাধ্যমে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে এবং তারপরে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আবেদন করতে হয়। অনুমোদন পাওয়ার পর, শিক্ষার্থীকে ভর্তির জন্য ঢাবিতে যোগাযোগ করতে হয়। অনলাইনে এসব প্রাথমিক প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে কমপক্ষে দুই থেকে তিন মাস সময় লাগে।

ভর্তি প্রক্রিয়া ও অন্যান্য বাধা সহজ করতে বিদেশি শিক্ষার্থী ভর্তির পৃথক ডিন স্থাপনের প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দিয়ে অধ্যাপক ইমতিয়াজ বলেন, ‘বিদেশি শিক্ষার্থী ভর্তির প্রক্রিয়া অনেক দীর্ঘ। এ ব্যবস্থার পরিবর্তন করা উচিত। দেশে পড়াশোনা করার জন্য একজন শিক্ষার্থীর আবেদনের পরে ভিসাই যথেষ্ট হওয়া উচিত।’

অধ্যাপক ইমতিয়াজের কথার সঙ্গে সুর মিলিয়ে ঢাবির ডেপুটি রেজিস্ট্রার শিউলি আফসারও দীর্ঘ ভর্তি প্রক্রিয়াকে বিদেশি শিক্ষার্থী ভর্তির মূল প্রতিবন্ধকতা হিসেবে মনে করছেন।

তিনি বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য বিদেশি শিক্ষার্থীর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে ছাড়পত্র নিতে হয়। পুলিশ তদন্তের পর শিক্ষা মন্ত্রণালয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাড়পত্র পাঠায়। এরপর কোনো বিদেশি শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারেন। একজন শিক্ষার্থীকে প্রতি বছর আবার তাদের ভিসা নবায়ন করতে হয়। সেজন্য তাদেরকে পাসপোর্ট অফিসে যেতে হবে। এসব নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতি বিদেশি শিক্ষার্থীদের ভোগান্তি বাড়ায়।

বিদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য আন্তর্জাতিক মানের আধুনিক ছাত্রাবাসের অভাব রয়েছে স্বীকার করে তিনি বলেন, বিদেশি শিক্ষার্থীরা শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষ চায়। যা আমরা দিতে পারি না। তাদের অনেকে স্কলারশিপ খোঁজেন, যা আমাদের দেওয়ার সুযোগ নেই। তারপরেও আমরা শিক্ষার্থীদের ভর্তি হতে রাজি করানোর জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করি।

তবে শিক্ষার্থীরা বলছেন, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ যদি তাদের উদ্বেগ নিরসনে এগিয়ে আসে এবং নিয়মিত কাউন্সেলিং করে, তবে এসব সমস্যা কাটিয়ে উঠতে পারে। ঢাবিতে ইংরেজিতে (আইএমএল) পড়তে আসা তুরস্কের শিক্ষার্থী উমুত দালার বলছিলেন, ভর্তি হয়ে যাওয়ার পরেও পর্যাপ্ত তথ্যের অভাবে বিদেশি শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন সমস্যার পড়তে হয়। বিদেশি শিক্ষার্থীদের নিয়মিত কাউন্সেলিং করলে তারা তাদের সমস্যা নিয়ে কথা বলতে পারে এবং যা সমাধানে কর্তৃপক্ষ তাদের সহায়তা করতে পারে।

ঢাবি উপাচার্য মো. আখতারুজ্জামানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনিও সীমাবদ্ধতা কথা স্বীকার করেন। তিনি বলেন, আমরা এসব সমস্যা সমাধানে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবকাঠামো, সংস্কার ও সম্প্রসারণের কাজ করছি। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়কে আন্তর্জাতিকমানে উন্নীত করার জন্য তথ্য, সামর্থ্য এবং সম্ভাবনা প্রচারে আন্তর্জাতিক বিষয়ক একটি কার্যালয়ও গঠন করেছি। যা আগে একটি ডেস্ক ছিল।

এদিকে, সমস্যা সমাধানে ইতোমধ্যে ঢাবি কর্তৃপক্ষ সরকারের কাছে আর্থিক অনুদান চেয়েছে বলেও জানিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয় সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত