স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়: ছাত্রদরদী এক শিক্ষক

প্রকাশ : ২৯ জুন ২০১৯, ১২:৪৫

সাহস ডেস্ক

'বাংলার বাঘ' খ্যাত শিক্ষাবিদ স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের ১৫৫তম জন্মবার্ষিকী আজ। ১৮৬৪ সালের ২৯ জুন কলকাতার ভবানীপুরে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। তিনি ছিলেন কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় এর ভাইস-চ্যান্সেলর। 

কলকাতার ভবানীপুরে সেসময়ের চিকিৎসক গঙ্গাপ্রসাদ মুখার্জী ও জগৎ্তারীনী দেবীর ঘরে জন্ম আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের। মেধাবী ছাত্র আশুতোষ মুখার্জী ১৮৭৯ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এন্ট্রান্স পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন এবং দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেন। তিনি ১৮৮৪ সালে প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে ডিগ্রি ও ১৮৮৫ সালে গণিতে এম.এ পাস করেন। এর পরের বছরে তিনি পদার্থবিদ্যায় এম.এ ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি ১৮৮৪ সালে ঈশান বৃত্তি লাভ করেন এবং ১৮৮৬ সালে প্রেমচাঁদ রায়চাঁদ বৃত্তি (পি.আর.এস.) অর্জন করেন। আন্তর্জাতিক কর্তৃপক্ষ জ্যামিতির ওপর তার কাজের স্বীকৃতি প্রদান করে।


আশুতোষ মুখার্জী ছিলেন একজন স্বাধীনচেতা। তার জীবনের প্রধান লক্ষ্যই ছিল কলকাতা হাই কোর্টের বিচারক হওয়া। ১৮৮৮ সালে তিনি বি.এল. ডিগ্রী লাভ করলে আইন ব্যবসার সাথে সম্পৃক্ত হন আশুতোষ। তবে এর পাশাপাশি তিনি তার একাডেমিক পড়াশুনাও চালিয়ে যান। ১৮৮০ থেকে ১৮৯০ সালের মধ্যে বেশ কিছু নামকরা জার্নালে তার গণিত বিষয়ক লেখা ছেপা হয়। 

আশুতোষ মুখার্জী ইন্ডিয়ান অ্যাসোশিয়েসন ফর দি কালটিভেশন অব সায়েন্স-এর সাথেও সক্রিয়ভাবে সম্পৃক্ত ছিলেন। সেখানে তিনি ১৮৮৭ থেকে ১৮৯১ সালের মধ্যে গণিতের ওপর লেকচার প্রদান করেন। তার দুটি অসাধারণ একাডেমিক অবদান হলো ১৮৯৩ সালে প্রকাশিত জিওমেট্টি অব কোণিক্স এবং ১৮৯৮ সালে প্রকাশিত ল অব পারপিচুইটিস। ১৯০৮ সালে তিনি কলকাতা ম্যাথেমেটিক্যাল সোসাইটি প্রতিষ্ঠা করেন। 

১৮৯৪ সালে তিনি ল' এর ওপর ডক্টরেট ডিগ্রী লাভ করেন এবং ১৮৯৮ সালে ট্যাগোর ল'এর প্রফেসর হন। এরপর ১৯০৪ সালে তিনি তার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে উত্তীর্ণ হন এবং কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি হিসেবে বিচারকাজ পরিচালনা শুরু করেন।

এর আগে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফেলো ও ১৮৮৯ সালে এর সিন্ডিকেটের সদস্যের পদ অলংকৃত করেন। তিনি ১৮৯৯ থেকে ১৯০৩ সাল পর্যন্ত কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিনিধি হিসেবে বাংলার লেফটেন্যান্ট গভর্নরের কাউন্সিলের সদস্য ছিলেন। ১৯০২ সালে লর্ড কার্জন তাকে বিশ্ববিদ্যালয় কমিশনের সদস্য হিসেবে নিযুক্ত করেন। ১৯০৬ সালে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস-চ্যান্সেলর পদে অধিষ্ঠিত হন এবং ১৯১৪ সাল পর্যন্ত তিনি এ দায়িত্ব পালন করেন।

তার ভাইস-চ্যান্সেলর হিসেবে থাকাকালীন সমগ্র সময়টি বাংলায় স্বদেশীদের বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন ছিল তুঙ্গে। জাতীয়বাদীরা সমালোচনা করে যে, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত ঔপনিবেশিক শিক্ষা ব্যবস্থায় জনসম্পদের উন্নয়ন ও জাতি গঠনের পারিপার্শ্বিক অবস্থা ছিল না। ১৮৯৫ সালে সতীশচন্দ্র মুখার্জীর প্রতিষ্ঠিত ভগবত চতুস্পতি-এর মাধ্যমে শুরু হয় জাতীয় শিক্ষা আন্দোলন। এটি মূলত ভারতীয় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য নিয়ে অগ্রসর হয়। ১৯০২ সালে এ প্রতিষ্ঠানটি ডন সোসাইটিতে রূপান্তরিত হয়। ১৯০২ থেকে ১৯০৬ সালের মধ্যে এটি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের মডেল হিসেবে কাজ করে।


কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক প্রদত্ত শিক্ষা জাতীয় উদ্দেশ্য লাভে ব্যর্থ হয়। ১৯০৪ সালের বিশ্ববিদ্যালয় আইন-এ জাতীয় শিক্ষার পরিধি আরও একটু সীমিত হয়ে যায়। কারণ এ আইনের বলে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট ও সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণ সরকার মনোনীত ইউরোপীয়দের হাতে চলে যায়। তাদের মূল লক্ষ্য ছিল প্রশাসন ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের কারিকুলামে যে কোন ধরনের জাতীয়তাবাদী আদর্শের অণুপ্রবেশ বন্ধ করা। তাদের আরও চেষ্টা ছিল স্বদেশী বুদ্ধিজীবী কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত বিভিন্ন কলেজ সমূহকে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে অন্তর্ভুক্ত হতে না দেওয়া। ১৯০৪ সালের বিশ্ববিদ্যালয় আইন ও ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ জাতীয়তাবাদী চেতনাকে দারুণভানে উজ্জীবিত করে তোলে।

ঠিক এসময়ে সরকারের প্রয়োজন ছিল আশুতোষ মুখার্জীর মতো একজন ব্যক্তিত্ব। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মপ্রচেষ্টাকে আশুতোষ সমর্থন করেন নি। তার মতে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় একটি একাডেমিক ঐতিহ্য স্থাপন করেছে যা আমাদের রক্ষা করতে হবে এবং বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক প্রদত্ত পাশ্চাত্য শিক্ষাকেও জাতীয় স্বার্থে ব্যবহার করা সম্ভব। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কার চেয়েছিলেন, বিপ্লব চান নি। সরকার অণুভব করেছিল যে, আশুতোষ মুখার্জীর তত্ত্বাবধানে বিশ্ববিদ্যালয় নিরাপদ থাকবে, রাজনৈতিক যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হবে না।

তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের অবকাঠামোর মধ্যে থেকেই প্রায় সব জাতীয়তাবাদমূলক বিষয়কে কার্যকর করেছিলেন। তিনি কলেজ স্ট্রীট ও রাজাবাজার ক্যাম্পাসে কলা ও বিজ্ঞান শাখার জন্য নতুন বিভাগসমূহ স্থাপন করেন এবং 'দেশী ভাষা' ও 'প্রাচীন ভারতের ইতিহাস' বিভাগ দুটি চালু করেন। বিদেশী ও ভারতীয় বহু খ্যাতনামা শিক্ষাবিদ প্রফেসর হিসেবে বিভিন্ন বিভাগে নিযুক্ত হন। তিনি নিজে ব্যক্তিগতভাবে সমস্ত বিভাগের সিলেবাস প্রণয়নে তত্ত্বাবধান করেন। তিনি ছাত্রদের কল্যাণের জন্য যেমন উদ্বিগ্ন থাকতেন, তেমনি শিক্ষা ও পরীক্ষার ব্যাপারেও তিনি তাদের আগ্রহ সৃষ্টিতে অণুপ্রেরণা দিতেন।

তিনি ১৯২১ থেকে ১৯২৩ সালের মধ্যে দ্বিতীয়বারের মতো ভাইস-চ্যান্সেলর পদে অধিষ্ঠিত হন। এ সময়েই তিনি কলা ও বিজ্ঞান শাখার পি.জি. কাউন্সিলের প্রেসিডেন্ট হন। ১৮৮৯ সাল থেকেই তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট ও সিন্ডিকেটের সবচেয়ে প্রভাবশালী সদস্য ছিলেন। তিনি ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের চলমান অণুপ্রেরণা। রাজনীতির সাথে জড়িত না হয়েই তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পাশ্চাত্য ও জাতীয় শিক্ষার সুফলগুলি অত্যন্ত সফলতার সাথে সংযু্‌ক্ত করেন। এভাবে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে এক রেনেসাঁস ঘটিয়ে ফেলেন।

জাতীয় শিক্ষা কাউন্সিল কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রমে জাতীয়তাবাদী চেতনার বহিঃপ্রকাশ স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হলেও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় জাতীয় অভিষ্ঠ লক্ষ্যে তাদের কাজকর্মে কোন অংশেই পিছিয়ে ছিলনা। তবে কারিগরি ও প্রযুক্তিবিদ্যায় জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় অবদান বেশি রাখছিল। তখন পর্যন্ত ঔপনিবেশিক প্রভাব থাকার কারণে আশুতোষ মুখার্জী কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের চরিত্রে সম্পূর্ণ পরিবর্তন সূচিত করতে পারে নি।

আশুতোষ ছিলেন বাস্তব বুদ্ধি সম্পন্ন এক বিরল ব্যক্তিত্বের মানুষ। অন্যের প্রতিভা চেনার অদ্ভূত এক ক্ষমতা ছিল তার। ব্যক্তিগত জীবনে গোঁড়া ব্রাহ্মণ এই মানুষটির কোনো প্রকার জটিলতা পছন্দ ছিল না। তিনি ছিলেন নিরামিষাশী। চা, এমনকী পানও খেতেন না। তবে সন্দেশ ছিল তাঁর প্রিয় মিষ্টি।

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিষ্ঠার পর হতে এম.এ. ক্লাস না চললেও আশুতোষ মুখোপাধ্যায় তা চালু করেন। তখন এম.এ. ক্লাস শুধু মাত্র কলেজ গুলোতে হত। তাই কলেজ কর্তৃপক্ষ এর বিরোধীতা শুরু করে। কিন্তু আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের যুক্তির কাছে কেউ ধোপে টিকে থাকতে পারলো না। ফলে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে শুরু হলো ক্লাস। তার অনুরোধে দেশ বিদেশের খ্যাতনামা সব পণ্ডিতেরা পাঠদান করার জন্য ভিড় জমাতে শুরু করেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে। আশুতোষ মুখোপাধ্যায় ছিলেন খুবই ছাত্রদরদী। তিনি চাইতেন, প্রশ্নপত্র এমন ভাবে তৈরী হোক তাতে যেনো মাঝারি মেধার ছাত্ররাও ভালো করতে পারে। অধ্যাপকদের তিনি বলে দিলেন যে, পরীক্ষার প্রশ্নপত্র অধ্যাপকদের বিদ্যে জাহির করার জায়গা নয়, প্রশ্নপত্র যেন মাঝারি মানের ছাত্রছাত্রীদের কথা মাথায় রেখে করা হয়। আর সমস্ত প্রশ্নপত্রই আগে স্ক্রুটিনি করবেন তিনি, তারপর তা ছাপা হবে।

সেসময়, একদিন গণিতের পণ্ডিত অধ্যাপক গৌরীশঙ্কর দে পরীক্ষার প্রশ্নপত্র তৈরি করে নিয়ে গেলেন আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের বাড়ি। গৌরীশঙ্কর দে তার কাছে গিয়ে বললেন, 'স্যার, অঙ্ক পরীক্ষার প্রশ্নপত্র তৈরি, যদি একটু দেখে দেন।' আশুতোষ তার হাত থেকে কাগজটা নিয়ে চোখ বুলিয়ে একটু গম্ভীর হলেন। তারপর মুখে 'হুম' শব্দ করে বললেন, গৌরীবাবু আপনার হাতে ঘন্টা আড়াই সময় আছে? গৌরীশঙ্কর দে কিছু না বুঝেই বললেন, 'আজ্ঞে তা আছে, কেন স্যার?' আশুতোষ মুখোপাধ্যায় তখন গৌরীশঙ্কর দে'র জন্য কাগজ-কলমের ব্যবস্থা করে দেন। তখন আশুতোষ মুখোপাধ্যায় গৌরীশঙ্কর দে'কে বললেন, 'আমি স্নানটা সেরে আসি বুঝলেন, আপনি ততক্ষণে যে প্রশ্নপত্রটি তৈরি করেছেন তার অঙ্কগুলো বরং কষে ফেলুন। তারপরই আশুতোষ কাঁধে গামছা ফেলে চলে গেলেন স্নানে।' কথা শুনে গৌরীশঙ্কর দে'ও অঙ্ক কষতে বসে গেলেন।

ঝাড়া আড়াই ঘন্টা বাদে তার সামনে এলেন আশুতোষ মুখোপাধ্যায়। তখন পরীক্ষা হত আড়াইঘন্টার। আশুতোষ মুখোপাধ্যায় তাকে বললেন, আড়াই ঘন্টা কিন্তু ওভার গৌরীবাবু। আপনার প্রশ্নপত্রের সব অঙ্ক কষে ফেলেছেন তো? গৌরীশঙ্কর দে বললেন, 'না স্যার, দু'তিনটে এখনো বাকি আছে।' এবার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় হেসে বললেন, 'তাহলেই বুঝুন, নিজের তৈরি প্রশ্নপত্র আপনার মতো পণ্ডিত মানুষের যদি আড়াই ঘন্টা পার হয়ে যায়, অল্পমেধার ছাত্রছাত্রীরা পারবে কেমন করে? যান, বাড়ি গিয়ে ঠাণ্ডা মাথায় তাদের কথা মাথায় রেখে নতুন করে একখানা প্রশ্নপত্র তৈরি করুন।'

আশুতোষ মুখার্জী ১৯২৩ সালে কলকাতা হাইকোর্ট ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অবসর গ্রহণ করেন। ১৯২৪ সালের ২৫ মে পাটনায় তিনি মৃত্যুবরণ করেন।

সূত্র: উইকিপিডিয়া, আনন্দবাজার পত্রিকা, ডেইলিহান্ট
সাহস২৪.কম/জয়

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত