পূবালী বাতাসে

প্রকাশ : ৩১ মে ২০২৩, ১৬:৪০

শহীদুল হক বাদল
ছবি : ইন্টানেট থেকে সংগৃহিত

- কী গো গায়েন... মুখটা আইজ এমন ভোঁতা কইরা বইস্যা আছোও ক্যান? একটা কাঁটা- বিচ্ছেদের গানটান হুনাও না একটু।

- না রে বেয়াইন, মনডাও আইজ বেশী ভালা না আমার, বুঝলাইন। 

- ধুরু মিয়া... আমি আবার তোমার কোন জনমের বেয়াইন আছিলাম, কওছে দেহি। ভিতরে ভিতরে মতলবটাও যে কী তোমার, ভাঙ্গাইয়াই কও না? বুঝছি, ওই আগের বউটা তোমার মইরা যাওনের পর থাইক্যা দেহি আউলা চুলে কেমন জানি একটা বাউলা বাতাসেও ভর করছে তোমারে। 

(২) 
তয়, আমার উপরে কিন্তু তুমি নজর-টজর দিও না আবার। তা হইলে, জ্বইল্যা-পুঁইড়্যা এক্কেবারেই বেবাকটাই তোমার ছাই হইয়া যাইবা বুঝলানি? আর কিতা কইতাম, তুমি হইলা গিয়া নিষ্ঠা একটা বাদাইম্যাও। যতো আকামেরও একটা বেহুদা নিষ্কর্মা লোক। আর তোমার যেইখানেই রাইত, সেইখানেই তো কাইত, ঠিক কইছি কিনা আমি? 

- হ্যাঁ গো বেয়াইন... কথাডা অবশ্য ঠিকই কইছো। ঐ যে, হাতি লুদে বা কাদায় পড়লে ছামচিকারাও নাকি তার  মাথায় ঠাল্লোয়ায়। মানে হইলো চড়-থাপ্পরও মারে তাই না? তবে, তোমার মুখের ওই গালিটাও এখন আমার কাছে মধুর লাহানই মিঠা লাগেও। 

- তোমার মনে রঙের ঠেলায় যে আমিও আর বাঁচি নাগো গায়েন। শোনো মিয়া, আমার হাতের মাইরও কী মিডাই লাগবো তোমার তখন? লোকে বলেও যে, আমি হইলাম গিয়া ঐ সাত-ঘাটের জল খাওয়া এক কূলহারা কলঙ্কিনী মাইয়্যা- বুঝলানি? 

সেই যে, ছোট্টবেলা থাইক্যাই মাইনষের বাড়িতে লাত্তি-গুঁতা খাইয়্যাই বড়ও হইছি। তিন তালাকও এখন নিয়া দুইবার হইছে আমার, বুঝলানি গায়েন। হ্যাঁ, এবার বুঝি তোমার দেওয়া তালাকটাই পাওয়ার শুধু বাকী আছেও আমার এই জীবনে। তাই তো আমি ভাবতাছিলামও এখন  কী যে করিও। 

যাউক, বাদ দেও তো এইসব আজাইরা চিন্তা। আমার এই পূঁড়া গায়ে আর নুনের ছিটা দিওনা তুমিও। তা হইলে, তুমিও যে ঐ কংশ নদীর ভরা জলে ডুইব্বাও মরবা গো। ঐ বাইষ্যা মাসের ভরা গাঙের পানির এক্কেবারে তলায় গিয়াই ঠেকবা এই তুমিও দেইখো। 

সুখ-শান্তি এসব যে আমার এই চাইর আঙ্গুলের কপালে আর সয়ও না যে গায়েন। ওই অন্তর জ্বালার কাঁটা বিচ্ছেদের গানটাই একটু যুঁইত কইর‌্যা হুনাও না আইজ আমারেও একটু। দেখি, মোর এই পোঁড়া অন্তরটারে একটু জুড়ানোও যায় কীনা। 

- আচ্ছা রে বেয়াইন, কাইল সারারাইত ধইরাই তোমারে গান হুনাইয়াম নে, আমি আইজ পাকা কথাও দিলাম। কিন্তু, তোমারে দেখলেই যে আমার এই পূঁড়খাওয়া মনডার ভিতরে একটা উথাল- পাতাল ঢেউয়েও মোছুর মাইর‌্যা ওঠে। শোনো গো বেয়াইন… তুমি কী এর কিচ্ছুই বুঝোও না? নাকি মজা দেখো?

(৩) 
বাইরে-বাইরে ঐ দয়াল মুর্শীদ রে খুঁইজ্যাই হয়রাণ হইয়াও এখন আমার এই মনডা ঘরের ফিরনের লাইগ্যা খুব বেশীই টান মারে এই অন্তরের মাঝেমধ্যেই। এইডা কিন্তু সেই তোমার লাইগাই, বুঝলানি বেয়াইন? 

- থাউক, আর রস লাগাইয়া কইতে অইবো না আমারে। উ্ঐ বিয়া করলে নতুন বউয়েরে খাওয়াইবা কীবায় কও ছে হুনি? 

- এইডা কোনো সমস্যাই না। তোমার চা-বিড়ি আর নানান সদাই-পাতির এই দোকানটা আছে না। একলা আর কতোইবা তুমি খাটবা হুনি? ঐ দোকানে বইস্যাই আমিও গান গাইমু আর তার লগে-লগে বেঁচা-কিনাও করমু সব সদাইপাতিই। দেখবা নে, দু'জনের ভালা মতোই সংসার চইল্যা যাইবোও তখন। 

- বাহ, ভিতরে ভিতরে তুমিও এতোদূর ভাইব্যাও রাখছো দেহি। আবার মনে কোনো কুমতলব- টতলব নাই তো তোমার? আইজ থাক ওই কথা। শুনো তবে, তোমার লগে বিয়াশাদী অইলে আমি কিন্তু আর এই দোকানদারী করতামও না বুঝলানি। সবকিছু একলাই সামলাইবা তুমি। এইবার বুইঝাও দেখো কি করবাও এখন। 
এই আমি আলতা, স্নু  আর লিপষ্টিক দুই ঠোঁটে মাইখ্যাই জানালার ফাঁক দিয়া হগ্গল সময়ই তোমারে চাইয়া চাইয়া দেখবাম। তুমিও শুধু এই আমারেই দেখবা কইলাম কিন্তু। একটু ডাইন-বাম কিংবা তেরিবেড়ি করলে কিন্তু তোমার খবরও আছে। জানোই তো, আমার বাপ-দাদার সেই চৌদ্দপুরুষই নাকি ওরা ভয়ঙ্কর সব ডাকাইত আছিলো।  

(৪) 
তাই, আমিও হাতের কাছে এই রামদা'টা সবসময়ই রাখি। তবে, তোমার কোনো ভয়-ডরও নাই। কারন, তুমি তো আমার পিয়ারের মানুষ্। বুঝলানি, যেমন কুত্তা তার জন্য ঐরকম একটা মুগুর লাগেও- ঠিক কইছিও কিনা কওনা বেয়াই। একলা পাইয়া ওই বুঁড়া-জোয়ান হগ্গলেই তো বনের চাকভাঙা টাটকা মধু খাইবার চায়। ও গায়েন, আমি যে আর পারছিও না একলা পথ এতোদূরের পথ হাঁটবার। তুমি কী আমারে ওইসব শিয়াল-কুকুরের খাবলা থাইক্যা আগলাইয়া রাখবার পারবা না? এ্যাই গায়েন...কিছু একটা তো কও না। 

- পারুম রে বেয়াইন, তা খুবই পারুম। দেয়ালে পিঠ ঠেইক্যা গেলে তখন সবতাই পারন যায়ও। আমার গলায় যেইরকম একটা কাঁটা বিচ্ছেদী সুর আছে, তেমনি মনের ভিতরে অন্তরপুঁড়া বিষের কাঁটার একটা জ্বালাও আছে। তুমি আমারে কখনো ভুল না বুইঝা একটু বেশী কইরাই আদর-সোহাগও কইরো গো। 

আমিও এই যে, ছোট্টবেলায় মা- বাবারে হারাইয়া সেই যে জনমের লাহান এতিমের মতোই রাস্তায়-রাস্তায় ঘুরছিও কতোশত। এই জীবনডা বড্ডই কষ্ট রে... খালি কষ্টও। এই অন্তরটা এক্কেবারে জ্বইল্যা-পুঁইড়্যা অঙ্গার হইয়্যাও গেছে এখন আমার। 

(৫) 
কও না, পারবা নাগো তুমি…? মোর মনের ভিতরে আমার ঐ ছাইচাপা আগুনটারে নিভাইয়্যাও দিতে এক্কেবারেই। 

- পারুম গো গায়েন। আমিও সবই করবার পারুম। তোমার গানের সুরের যাদুর লাহান সেই মায়াকাড়া সুরের টানটা হুনলেই যে, আমার মনটাও খালি ছটফট করে। যেমন, ঐ হাওর-বাঁওড়ে পূবালী বাতাসে ভরা বাইস্যা মাসের সময় নাইওরীরে লইয়্যা কেরাইয়া নৌকাগুলো বাদাম তুইল্যাও যেভাবে হেইল্যা-দুইল্যাও যায়। আর সেও এমনতর  ঢেউয়ের বুকে আছড়াইয়্যা-অছরাইয়্যাই পড়ে। তা কেমন কইরা বুকের মাঝে হাহাকার তোলে, তা কী কক্ষনো দেখোও না তুমি?

- আহা বেয়াইন, কাইন্দো না তো আর। এইবার আমার চৌক্ষের দিকে তাকাইয়া একটু মুচকি হাসো তো। কদ্দিন ধইরা তোমার সেই চান্দের হাসিটা আমিও দেখি না, আহা রে। 

- আহা, কতোশতইনা ঢঙ দেখি ইদানিং বাড়ছেও বোধহয় তোমার। আমার হাতটা এখন ছাড়ো তো মিয়া, কেউ দেখলে কিন্তু মান-ইজ্জত সবটাই যাইবো এই আমারই বেশী। তাতে তোমার আর কী, কলঙ্কের বোঝাও তো আমার একলাই। যা কিনা গলায় কলঙ্কের হাড় হইয়াই ঝুলবো একদিন ফাঁসির দড়ির লাহানই। সেইদিন হয়তোবা আমিও এই ইহজগতে থাকতামনা গো গায়েন, আর থাকতাম না !

- নীলাকাশটাও তখন ঘনকালো মেঘে ঢেকে গেলো। কিছুক্ষণ পরই হয়তো ঝড়ো হাওয়ায় বৃষ্টি নামবে...

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত