লোকে আজকাল চোরেদের প্রণাম করেঃ শক্তি চট্টোপাধ্যায়
প্রকাশ : ২৫ নভেম্বর ২০২০, ১৬:২৭
শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের ওপরে একজন আছেন, তাঁর নাম শক্তি চট্টোপাধ্যায়, নীচে একজন আছেন তাঁর নামও শক্তি চট্টোপাধ্যায়। একেই বলে মিথ। মিথ একজনকে নিয়ে তৈরি হয়, কিন্তু তার পরম্পরা ছড়িয়ে পড়ে তিনজন চারজন পাঁচজনকে নিয়ে। পাঁচজন মধ্যরাতে কলকাতা শাসন করে পুনরায় পাইপগানের মধ্যে ঢুকে একজন হয়ে ঘুমিয়ে পড়ে।
কবিতা লিখে খ্যাতি পাওয়া যায়, গুচ্ছের পুরস্কার পাওয়া যায়, কিন্তু কিংবদন্তি হওয়া অত সহজ নয়। শক্তি এখনও ডুয়ার্সের জঙ্গলে হেঁটে চলেছেন। শক্তি এখনও চাইবাসা দিয়ে ‘ওই কপালে কী পরেছ’ বলতে বলতে দৌড়ে চলেছেন, তাঁর জলদগম্ভীর গলা শোনা যাচ্ছে, ‘রাতের কল্লোল শুধু বলে যায় আমি স্বেচ্ছাচারী।’ এই উপ মহাদেশে সৈয়দ মির্জা গালিবের পর এরকম মিথ আর হয়নি। কবিতার সংখ্যায় তিনি গালিবকে হারিয়েছেন, তবে পেয়ালায় কে কাকে হারিয়েছেন, জানি না।
শক্তির কবিতা আগুন, শক্তির মদ গরল, শক্তির জীবন স্বেচ্ছাচারী। লোকের মনে আঘাত দিতে পটু। এক বার লিখলেন, ‘এত কবি কেন’। ‘এই পান কিনে আসছি’ বলে ভুটান চলে গিয়েছিলেন।
পরবর্তী সময়ে কবিদের সম্পর্কে লিখেছিলেন, ‘এরা মধ্যবিত্ত। ঝোলা কাঁধে বৌ ছেলে নিয়ে সুখে থেকে কবিতা লেখা যায় না।’ কথাটা নিষ্ঠুর, কিন্তু সত্যি। তাই বলে এটা তো আর হয় না সব কবির বৌ ছেলেমেয়ে মরে যাবে আর বাংলা কবিতা সোনার ফসলে ভরে উঠবে।
তিনি অসহিষ্ণু, স্বেচ্ছাচারী, এই সব শুনে এসেছি সারা জীবন। আমি এক বার শক্তিদাকে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করতেই বললেন, প্রণাম করছ কেন? আমি কি চোর? লোকে আজকাল চোরেদের প্রণাম করে।
আমি বললাম, যিনি লেখেন, ‘আমাকে তুই আনলি কেন, ফিরিয়ে নে’ (জরাসন্ধ), ‘মানুষ বড় কাঁদছে’, ‘তুমি তাহার পাশে এসে দাঁড়াও’, যিনি লেখেন ‘যেতে পারি কিন্তু কেন যাব’, যিনি লেখেন, ‘ওঁ চিরপ্রণম্য অগ্নি’, আমি তাঁকে প্রণাম করলাম। কিন্তু যে সহিষ্ণুতার পরিচয় তিনি দিয়েছিলেন, এখনকার কোনও কবি তা ভাবতেও পারবেন না।
তাঁকে টুকে কবিতা লেখেননি এ রকম তরুণ কবি আজও জন্মায়নি। তাঁর মতো করে অনেকেই মদ খেয়েছেন, কিন্তু কবিতাটা হয়নি। এটা ঠিক তিনি অনেক সম্মান পেতে পারতেন, পাননি তিনি মদ খেতেন বলে।
লেখক- কবি সুবোধ সরকার