অত্যাচারের বিরুদ্ধে এখনো উচ্চকিত হয় সুকান্ত’র কণ্ঠ

প্রকাশ : ১৩ মে ২০২২, ১৩:৪৮

সাহস ডেস্ক

অবাক পৃথিবী! অবাক করলে তুমি/জন্মেই দেখি ক্ষুব্ধ স্বদেশভূমি।/অবাক পৃথিবী! আমরা যে পরাধীন।/অবাক, কী দ্রুত জমে ক্রোধ দিন দিন;/অবাক পৃথিবী! অবাক করলে আরো–/দেখি এই দেশে অন্ন নেইকো কারো।/অবাক পৃথিবী! অবাক যে বারবার/দেখি এই দেশে মৃত্যুরই কারবার।/হিসেবের খাতা যখনি নিয়েছি হাতে/দেখেছি লিখিত–’রক্ত খরচ’ তাতে।/দেশে জন্মে পদাঘাতই শুধু পেলাম,/অবাক পৃথিবী! সেলাম, তোমাকে সেলাম...!

নিপীড়কদের ভিত কাঁপিয়ে তোলা এমন বহু কালজয়ী কবিতার রচয়িতা সুকান্ত ভট্টাচার্যের প্রয়াণ দিবস আজ ১৩ মে। তিনি অপরিণত বয়সে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ার আগপর্যন্ত সাধারণ মানুষের জীবন-সংগ্রাম, যন্ত্রণা ও বিক্ষোভ নিয়ে লিখে গেছেন অসাধারণ সব কবিতা। জীবনের শেষদিন পর্যন্ত গণমানুষের মুক্তি ও নতুন সমাজ গড়ার জন্যে লড়াই করেছেন। বাংলা সাহিত্যের ‘ক্ষণজন্মা এই কবি’ দূরারোগ্য ক্ষয়রোগে আক্রান্ত হয়ে ১৯৪৭ সালের ১৩ মে ‘না ফেরার দেশে’ পাড়ি জমান। কবির জন্ম ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কোলকাতা শহরে হলেও তাঁর পৈতৃকনিবাস বাংলাদেশের গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়া উপজেলার অন্তর্গত ঊনশিয়া গ্রামে। তাঁর বাবা নিবারণ ভট্টাচার্য ও মা সুনীতি দেবী। ১৯২৬ সালের ১৫ আগস্ট তিনি তাঁর মাতামহের বাড়ি কলকা তাঁর কালীঘাটের ৪৩ মহিম হালদার স্ট্রীটের বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন।

সুকান্তের বাল্যবন্ধু ছিলেন কবি অরুনাচল বসু। সুকান্ত সমগ্রতে লেখা সুকান্তের চিঠিগুলোর বেশিরভাগই অরুনাচল বসুকে লেখা। অরুনাচল বসুর মাতা কবি সরলা বসু সুকান্তকে পুত্রস্নেহে দেখতেন। সুকান্তের ছেলেবেলায় মাতৃহারা হলেও সরলা বসু তাকে সেই অভাব কিছুটা পূরণ করে দিতেন। কবির জীবনের বেশিরভাগ সময় কেটেছিল কলকা তাঁর বেলেঘাটার ৩৪ হরমোহন ঘোষ লেনের বাড়িতে। সেই বাড়িটি এখনো অক্ষত রয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য সুকান্তের নিজের ভাতিজা। মাত্র ৯ বছর বয়সে তাঁর কাব্য পরিচয় পাওয়া যায়। কিশোর বয়সেই সাম্যবাদের দিকে ঝুঁকে পড়েন এবং ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির সক্রিয় সদস্য হন ১৯৪৪ সালে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, তেতাল্লিশের মম্বন্তর, ফ্যাসিবাদী আগ্রাসন, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা প্রভৃতির বিরুদ্ধে তিনি কলম ধরেন। সেই বছর আকাল নামক একটি সংকলনগ্রন্থ তাঁর সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়।

সুকান্ত কমিউনিস্ট পার্টির পত্রিকা দৈনিক স্বাধীন তাঁর (১৯৪৫) ‘কিশোর সভা’ বিভাগ সম্পাদনা করতেন। মার্কসবাদী চেতনায় আস্থাশীল কবি হিসেবে সুকান্ত কবিতা লিখে বাংলা সাহিত্যে স্বতন্ত্র স্থান করে নেন। তাঁর রচনাবলির মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হলো: ছাড়পত্র (১৯৪৭), পূর্বাভাস (১৯৫০), মিঠেকড়া (১৯৫১), অভিযান (১৯৫৩), ঘুম নেই (১৯৫৪), হরতাল (১৯৬২), গীতিগুচ্ছ (১৯৬৫) প্রভৃতি। পরবর্তীকালে দুই বাংলা থেকেই সুকান্ত সমগ্র নামে তাঁর রচনাবলি প্রকাশিত হয়। সুকান্ত ফ্যাসিবাদবিরোধী লেখক ও শিল্পীসঙ্ঘের পক্ষে আকাল (১৯৪৪) নামে একটি কাব্যগ্রন্থ সম্পাদনা করেন। সুকান্তের সাহিত্য-সাধনার মূল ক্ষেত্র ছিল কবিতা। সাধারণ মানুষের জীবনসংগ্রাম, যন্ত্রণা ও বিক্ষোভ তাঁর কবি তাঁর প্রধান বিষয়বস্তু। তাঁর রচনাকর্মে গণমানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার বাণীসহ শোষণহীন এক নতুন সমাজ গড়ার অঙ্গীকার উচ্চারিত হয়েছে।

রবীন্দ্রোত্তর বাংলা কবি তাঁর বৈপ্লবিক ভাবধারাটি যাঁদের সৃষ্টিশীল রচনায় সমৃদ্ধ হয়েছে, সুকান্ত তাঁদের অন্যতম। তাঁর কবি তাঁর ছন্দ, ভাষা, রচনাশৈলী এত স্বচ্ছন্দ, বলিষ্ঠ ও নিখুঁত যে, তাঁর বয়সের বিবেচনায় এরূপ রচনা বিস্ময়কর ও অসাধারণ বলে মনে হয়। সুকান্ত ভট্টাচার্য সমাজসেবার ব্রত নিয়ে যখন কাজ করছিলেন, তখন তাঁর নিকটাত্মীয় অন্নদাশংকর ভট্টাচার্য কিশোরবাহিনী গঠন করেছিলেন। ক্রমেই সেই কিশোরবাহিনী পরিচালনার ভার এসে পরে সুকান্তের ওপর। তাঁরপর থেকে সুকান্ত আর কিশোরবাহিনী দু’টি নাম একাকার হয়ে যায়। বেলেঘাটা দেশবন্ধু স্কুল থেকে ১৯৪৫ সালে প্রবেশিকা পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে অকৃতকার্য হন। এ সময় ছাত্র আন্দোলন ও বামপন্থী রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত হওয়ায় তাঁর আনুষ্ঠানিক শিক্ষার সমাপ্তি ঘটে।

১৯৪১ সালে সুকান্ত কলকাতা রেডিওর গল্পদাদুর আসরের যোগদান করেন। সেখানে প্রথমে তিনি রবীন্দ্রনাথের কবিতা আবৃত্তি করেন। রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর পর সেই আসরেই নিজের লেখা কবিতা পাঠ করে তাঁকে শ্রদ্ধা জানান। গল্পদাদুর আসরের জন্য সেই বয়সেই তাঁর লেখা গান মনোনীত হয়েছিল। আর তাঁর সেই গান সুর দিয়ে গেয়েছিলেন সেকালের অন্যতম সেরা গায়ক পঙ্কজ মল্লিক। সুকান্তকে আমরা কবি হিসেবেই জানি। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ যেমন কেবল মাত্র কবি ছিলেন না, সাহিত্যের সকল ক্ষেত্রে তাঁর ছিলো অবাধ বিচরণ। তেমনি সুকান্তও ঐ বয়সেই লিখেছিলেন কবিতা ছাড়াও, গান, গল্প, নাটক এবং প্রবন্ধ। তাঁর ‘ছন্দ ও আবৃত্তি’ প্রবন্ধটি পাঠেই বেশ বোঝা যায় ঐ বয়সেই তিনি বাংলা ছন্দের প্রায়োগিক দিকটিই শুধু আয়ত্বে আনেন নি, সে নিয়ে ভালো তাত্ত্বিক দক্ষতাও অর্জন করেছিলেন।

আট-নয় বছর বয়স থেকেই সুকান্ত লিখতে শুরু করেন। স্কুলের হাতে লেখা পত্রিকা ‘সঞ্চয়ে’ একটি ছোট্ট হাসির গল্প লিখে আত্মপ্রকাশ করেন। তাঁর দিনকতক পরে বিজন গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘শিখা’ কাগজে প্রথম ছাপার মুখ দেখে তাঁর লেখা বিবেকান্দের জীবনী। মাত্র এগার বছর বয়সে ‘রাখাল ছেলে’ নামে একটি গীতি নাট্য রচনা করেন। এটি পরে তাঁর ‘হরতাল’ বইতে সংকলিত হয়। বলে রাখা ভালো, পাঠশালাতে পড়বার কালেই ‘ধ্রুব’ নাটিকার নাম ভূমিকাতে অভিনয় করেছিলেন সুকান্ত। সপ্তম শ্রেণিতে পড়ার সময় বাল্য বন্ধু লেখক অরুণাচল বসুর সঙ্গে মিলে আরেকটি হাতে লেখা কাগজ ‘সপ্তমিকা’ সম্পাদনা করেন। অরুণাচল তাঁর আমৃত্যু বন্ধু ছিলেন।

সুকান্ত ফ্যাসিবাদবিরোধী লেখক ও শিল্পীসংঘের পক্ষে আকাল (১৯৪৪) নামে একটি কাব্যগ্রন্থ সম্পাদনা করেন। সুকান্তের কবিতা বিষয়বৈচিত্র্যে ও লৈখিক দক্ষতায় অনন্য। সাধারণ বস্তুকেও সুকান্ত কবি তাঁর বিষয় করেছেন। বাড়ির রেলিং ভাঙা সিঁড়ি উঠে এসেছে তাঁর কবিতায়। সুকান্তের কবিতা সব ধরনের বাধা-বিপত্তিকে জয় করতে শেখায়। যাপিত জীবনের দুঃখ-যন্ত্রণাকে মোকাবেলা করার সাহস সুকান্তের কবিতা থেকে পাওয়া যায়। তাঁরুণ্যের শক্তি দিয়ে উন্নত শিরে মানুষের মর্যাদার জন্য মানুষকে প্রস্তুত হওয়ার আহ্বান সুকান্তের কবিতায় লক্ষণীয়। সুকান্তের কবিতা সাহসী করে, উদ্দীপ্ত করে। তাঁর বক্তব্যপ্রধান সাম্যবাদী রচনা মানুষকে জীবনের সন্ধান বলে দেয়। স্বল্প সময়ের জীবনে তিনি বাংলা সাহিত্যকে অনেক কিছু দিয়ে গেছেন। রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, জীবনানন্দ দাশসহ সে সময়ের বড় বড় কবির ভিড়ে তিনি হারিয়ে যাননি। নিজের যোগ্য তাঁর স্বাক্ষর রেখে গেছেন নিজ প্রতিভা, মেধা ও মননে। সুকান্ত তাঁর বয়সিক সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করেছেন তাঁর পরিণত ভাবনায়। ভাবনাগত দিকে সুকান্ত তাঁর বয়স থেকে অনেক বেশি এগিয়ে ছিলেন।

একাধারে বিপ্লবী ও স্বাধীন তাঁর আপোসহীন সংগ্রামী কবি সুকান্ত ছিলেন কমিউনিস্ট পার্টির সার্বক্ষণিক কর্মী। পার্টি ও সংগঠনের কাজে অত্যধিক পরিশ্রমের ফলে নিজের শরীরের উপর যে অত্যাচারটুকু তিনি করলেন তাতে তাঁর শরীরে প্রথম ম্যালেরিয়া ও পরে দুরারোগ্য ক্ষয়রোগে আক্রান্ত হয়ে ১৯৪৭ সালের ১৩ই মে মাত্র ২১ বছর বয়সে কলিকা তাঁর ১১৯ লাউডট স্ট্রিটের রেড এড কিওর হোমে মৃত্যুবরণ করেন। সুকান্ত ভট্টাচার্যের জীবন মাত্র ২১ বছরের আর লেখালেখি করেন মাত্র ৬/৭ বছর। সামান্য এই সময়ে নিজেকে মানুষের কবি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে গেছেন। তাঁর রচনা পরিসরের দিক থেকে স্বল্প অথচ তা ব্যাপ্তির দিক থেকে সুদূরপ্রসারী। ফরিদপুরের কোঠালিপাড়ায় সুকান্তের পৈতৃক বাড়ি অধিগ্রহণ করে ৬৪ লাখ টাকা ব্যয়ে সংস্কার করা হয়েছে। ভারতে সুকান্তের নিজ হাতে গড়া ‘কিশোরবাহিনী’ এখনো কাজ করে যাচ্ছে ছোটদের নিয়ে। বাংলাদেশে আছে ‘সুকান্ত সংসদ’। আজ প্রয়াণ দিবসে বিনম্র শ্রদ্ধায় স্মরণ করি তাঁকে। অমর সৃষ্টির মধ্যে অনন্তকাল বেঁচে থাকবেন দেশমাতৃকার সূর্যসন্তান সুকান্ত ভট্টাচার্য।

সাহস২৪.কম/এসএ.

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত