বঙ্গীয় মুসলিম তরুণ সম্মেলনে জাতীয় কবি যা বলেছিলেন

প্রকাশ : ২৭ আগস্ট ২০১৯, ১৪:৫৯

সাহস ডেস্ক

১৯৩২ খ্রিস্টাব্দের ৫ ও ৬ নভেম্বর সিরাজগঞ্জের নাট্যভবনে অনুষ্ঠিত বঙ্গীয় মুসলিম তরুণ সম্মেলনের সভাপতিরূপে কবি নজরুল ইসলাম এই অভিভাষণ প্রদান করেন। সেই বক্তব্যের পূর্ণরূপ :

আমার প্রিয় তরুণ ভ্রাতৃগণ!

আপনারা কি ভাবিয়া আমার ন্যায় ক্ষুদ্র ব্যক্তিকে আপনাদের সভাপতি নির্বাচন করিয়াছেন, জানি না। দেশের জাতির ঘনঘোর-ঘেরা দুর্দিনে দেশের জাতির শক্তিমজ্জা-প্রাণস্বরূপ তরুণদের যাত্রা-পথের দিশারী হইবার স্পর্ধা বা যোগ্যতা আমার কোনদিন র্ছিল না, আজও নাই। আমি দেশকর্মী-দেশনেতা নই, যদিও দেশের প্রতি আমার মমত্ববোধ কোন স্বদেশপ্রেমিকের অপেক্ষা কম নয়। রাজ-লাঞ্ছনা ও ত্যাগ স্বীকারের মাপকাঠি দিয়ে মাপিলে হয়ত আমি তাঁহাদের কাছে খর্ব চরমসু বলিয়া অনুমিত হইব। তবু দেশের জন্য অন্তত এইটুকু ত্যাগ স্বীকার করিয়াছি যে, দেশের মঙ্গল করিতে না পারিলেও অমঙ্গল-চিন্তা কোনদিন করি নাই, যাহারা দেশের কাজ করেন তাঁহাদের পথে প্রতিবন্ধক হইয়া দাঁড়াই নাই। রাজ-লাঞ্ছনার চন্দন-তিলক কোনদিন আমারও ললাটে ধারণ করিবার সৌভাগ্য হইয়াছিল, কিন্তু তাহা আজ মুছিয়া গিয়াছে। আজ তাহা লইয়া গৌরব করিবার অধিকার আমার নাই।

আমার বলিতে দ্বিধা নাই যে, আমি আজ তাহাদেরই দলে যাহারা কর্মী নন ধ্যানী। যাহারা মানব জাতির কল্যাণসাধন করেন সেবা দিয়া, কর্ম দিয়া তাহারা মহৎ; কিন্তু সেই মহৎ হইবার প্রেরণা যাহারা জোগান, তাহারা মহৎ যদি না-ই হন অন্তত ক্ষুদ্র নন। ইহারা থাকেন শক্তির পেছনে রুধির-ধারার মত গোপন, ফুলের মাঝে মাটির মমতা-রসের মত অলক্ষ্যে। আমি কবি। বনের পাখির মত স্বভাব আমার গান করায়। কাহারও ভালো লাগিলেও গাই, ভালো না লাগিলেও গাহিয়া যাই। বায়স-ফিঙ্গে যখন বেচারা গানের পাখিকে তাড়া করে, তীক্ষè চঞ্চু দ্বারা আঘাত করে, তখনও সে এক গাছ হইতে উড়িয়া আর এক গাছে গিয়া গান ধরে। তাহার হাসিতে গান, তাহার কান্নায় গান। সে গান করে আপনার মনের আনন্দে, যদি তাহাতে কাহারও অলস-তন্দ্রা মোহ-নিদ্রা টুটিয়া যায়, তাহা একান্ত দৈব। যৌবনের সীমা পরিক্রমণ আজও আমার শেষ হয় নাই, কাজেই আমি যে গান গাই তাহা যৌবনের গান। তারুণ্যের ভরা-ভাদরে যদি আমার গান জোয়ার আনিয়া থাকে তাহা আমার অগোচরে। যে চাঁদ সাগরে জোয়ার জাগায় সে হয়ত তাহার শক্তির সম্বন্ধে আজও না-ওয়াকিফ।

আমি বক্তাও নহি। আমি কম-বক্তার দলে। বক্তৃতায় যাহারা বখতিয়ার খিলজি, তাহাদের বাক্যের সৈন্য-সামন্ত অত দ্রুত বেগে কোথা হইতে কেমন করিয়া আসে বলিতে পারি না। তাহা দেখিয়া লক্ষণসেন অপেক্ষাও আমরা বেশি অভিভূত হইয়া পড়ি। তাঁহাদের বাণী আসে বৃষ্টিধারার মত অবিরল ধারায়। আমাদের কবিদের বাণী বহে ক্ষীণ ঝর্ণাধারার মত। ছন্দের দু’কূল প্রাণপণে আঁকড়িয়া ধরিয়া সে সঙ্গীতগুঞ্জন করিতে বহিয়া যায়। পদ্মা-ভাগীরথীর মত খরস্রোতা যাহাদের বাণী আমি তাহাদের বহু পশ্চাতে।

আমার একমাত্র সম্বল, আপনাদের-তরুণদের প্রতি আমার অপরিসীম ভালোবাসা, প্রাণের টান তারুণ্যকে-যৌবনকে-আমি যেদিন হইতে গান গাহিতে শিখিয়াছি সেই দিন হইতে বারে বারে সালাম করিয়াছি, তাজিম করিয়াছি, সশ্রদ্ধ নমস্কার নিবেদন করিয়াছি। গানে কবিতায় আমার সকল শক্তি দিয়া তাহারই জয় ঘোষণা করিয়াছি, স্তব রচনা করিয়াছি। জবাকুসুমসঙ্কাশ তরুণ অরুণকে দেখিয়া প্রথম মানব যেমন করিয়া সশ্রদ্ধ নমস্কার করিযাছিলেন, আমার প্রথম জাগরণ প্রভাতে তেমনি সশ্রদ্ধ বিস্ময় লইয়া যৌবনকে অন্তরের শ্রদ্ধা নিবেদন করিয়াছি, তাহার স্তব-গান গাহিয়াছি। তরুণ-অরুণের মত যে তারুণ্য তিমিরবিদারী সে যে আলোর দেবতা। রঙের খেলা খেলিতে খেলিতে তাহার উদয়, রঙ ছড়াইতে ছড়াইতে তাহার অস্ত। যৌবন-সূর্য যথায় অস্তমিত দুঃখের তিমির-কুন্তলা নিশীথিনীর সেই ত লীলাভূমি।

আমি যৌবনের পূজারী কবি বলিয়াই যদি আমি আমায় আপনারা আপনাদের মালার মধ্যমণি করিয়া থাকেন, তাহা হইলে আমার অভিযোগ করিবার কিছুই নাই। আপনাদের এই মহাদান আমি সানন্দে শিরনত করিয়া গ্রহণ করিলাম। আপনাদের দলপতি হইয়া নয়। আপনাদের দলভুক্ত হইয়া, সহযাত্রী হইয়া। আমাদের দলে কেহ দলপতি নাই; আজ আমরা শত দিক হইতে শত শত তরুণ মিলিয়া তারুণ্যের শতদল ফুটাইয়া তুলিয়াছি। আমরা সকলে মিলিয়া এক সিদ্ধি এক ধ্যানের মৃণাল ধরিয়া বিকশিত হইতে চাই।

আজ সিরাজগঞ্জে আসিয়া সর্বপ্রধান অভাব অনুভব করিতেছি আমাদের মহানুভব নেতা  বাংলার তরুণ মুসলিমের সর্বপ্রথম অগ্রদূত তারুণ্যের নিশান-বর্দার মৌলানা সৈয়দ ইসমাইল হোসেন শিরাজী সাহেবের। সিরাজগঞ্জের শিরাজীর সাথে বাংলার শিরাজ বাংলার প্রদীপ নিভিয়া গিয়াছে। যাঁহার অনল-প্রবাহ-সম বাণীর গৈরিক নিঃস্রাব জ্বালাময়ী ধারা মেঘ-নীরন্ধ্র গগনে অপরিমাণ জ্যোতি সঞ্চার করিয়াছিল, নিদ্রাতুরা বঙ্গদেশ উন্মাদ আবেগ লইয়া মাতিয়া উঠিয়াছিল, ‘অনল প্রবাহের’ সেই অমর কবির কণ্ঠস্বর বাণকিুঞ্জে আর শুনিতে পাইব না। বেহেশতের বুলবুলি বেহেশতে উড়িয়ে গিয়াছে। জাতির কওমের দেশের যে মহা ক্ষতি হইয়াছে, আমি শুধু তাহার কথাই বলিতেছি না, আমি বলিতেছি আমার একার বেদনার ক্ষতির কাহিনী। আমি তখন প্রথম কাব্য-কাননে ভয়ে ভয়ে পা টিপিয়া টিপিয়া প্রবেশ করিয়াছি ফিঙে বায়স বাজপাখির ভয়ে ভীরু পাখির মত কণ্ঠ ছাড়িয়া গাহিবারও দুঃসাহস সঞ্চয় করিতে পারি নাই, নখচঞ্চুর আঘাতও যে না খাইয়াছি এমন নয় এমনি ভীতির দুর্দিনে মনি-অর্ডারে আমার নামে দশটি টাকা আসিয়া হাজির। কুপনে শিরাজী সাহেবের হাতে লেখা : ‘তোমার লেখা পড়িয়া খুশি হইয়া দশটি টাকা পাঠাইলাম। ফিরাইয়া দিও না ব্যথা পাইব। আমার থাকিলে দশ হাজার টাকা পাঠাইতাম।’ চোখের জলে স্নেহসুধা সিক্ত ঐ কয় পংক্তি লেখা বারে বারে পড়িলাম; টাকা দশটি লইয়া মাথায় ঠেকাইলাম। তখনো আমি তাহাকে দেখি নাই। কাঙ্গাল ভক্তের মত দূর হইতেই তাঁহার লেখা পড়িয়াছি, মুখস্থ করিয়াছি, শ্রদ্ধা নিবেদন করিয়াছি। সেইদিন প্রথম মানসনেত্রে কবির স্নেহ-উজ্জ্বল মূর্তি মনে মনে রচনা করিলাম, গলায় পায়ে ফুলের মালা পরাইলাম। তাহার পর ফরিদপুর বঙ্গীয় প্রাদেশিক কনফারেন্সে তাহার জ্যোতি বিম-িত মূর্তি দেখিলাম। দুই হাতে তাঁহার পায়ের তলার ধূলি কুড়াইয়া মাথায় মুখে মাখিলাম। তিনি আমায় একেবারে বুকের ভিতর টানিয়া লইলেন, নিজে হাতে করিয়া মিষ্টি খাওয়াইয়া দিতে লাগিলেন। যেন বহুকাল পরে পিতা তাহার হারানো পুত্রকে ফিরাইয়া পাইয়াছে। আজ সিরাজগঞ্জে আসিয়া বাঙ্গলার সেই অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি মনস্বী দেশ-প্রেমিকের কথাই বারে বারে মনে হইতেছে। এ যেন হজ্ব করিতে আসিয়া কাবা-শরিফ না দেখিয়া ফিরিয়া যাওয়া। তাঁহার রুহু মোবারক হয়ত আজ এই সভায় আমাদের ঘিরিয়া রহিয়াছে। তাহারই প্রেরণায় হয় আজ আমরা তরুণেরা এই যৌবনের আরাফাত ময়দানে আসিয়া মিলিত হইয়াছি। আজ তাঁহার উদ্দেশ্যে আমার অন্তরের অন্তরতম প্রদেশ হইতে শ্রদ্ধা তসলিম নিবেদন করিতেছি, তাহার দোওয়া ভিক্ষা করিতেছি।

আপনারা যে অপূর্ব অভিনন্দন আমায় দিয়েছেন, তাহার ভারে আমার শির নত হইয়া গিয়াছে। আমার অন্তরের ঘট আপনাদের প্রীতির সলিলে কানায় কানায় পুরিয়া উঠিয়াছে। সেই পূর্ণঘটে আর শ্রদ্ধা প্রতি-নিবেদনের ভাষা ফুটিতেছে না। আমার পরিপূর্ণ অন্তরে বাকহীন শ্রদ্ধা-প্রীতি সালাম আপনারা গ্রহণ করুন। আমি উপদেশের শিলাবৃষ্টি করিতে আসি নাই। প্রয়োজনের অনুরোধে যাহা না বলিলে নয়, শুধু সেইটুকু বলিয়াই আমি ক্ষান্ত হইব।

আমি সর্বপ্রথমে বলিতে চাই, আমাদের এই তরুণ মুসলিম সম্মেলনের কোন সার্থকতা নাই যদি আমরা আমাদের পরিপূর্ণ শক্তি লইয়া বার্ধক্যের বিরুদ্ধে, জরার বিরুদ্ধে অভিযান ঘোষণা করিতে না পারি। বার্ধক্য তাহাই যাহা পুরাতনকে, মিথ্যাকে, মৃতকে আঁকড়িয়া পড়িয়া থাকে। বৃদ্ধ তাহারাই যাহারা  শতাব্দীর নব-যাত্রীর চলার ছন্দে ছন্দে মিলাইয়া যাহারা কুচকাওয়াজ করিতে জানে না, পারে না। যাহারা জীব হইয়াও জড়। যাহারা অটল সংস্কারের পাষাণ স্তূপ আঁকড়িয়া পড়িয়া আছে। বৃদ্ধ তাহারই যাহারা নব অরুণোদয় দেখিয়া নিদ্রাভঙ্গের ভয়ে দ্বার রুদ্ধ করিয়া পড়িয়া থাকে। আলোক-পিয়াসী প্রাণ-চঞ্চল শিশুদের কলকোলাহলে যাহারা বিরক্ত হইয়া অভিসম্পাৎ করিতে থাকে, জীর্ণ পুঁথি চাপা পড়িয়া যাহাদের নাভিশ্বাস বহিতেছে, অতি জ্ঞানের অগ্নিমান্দ্যে যাহারা আজ কঙ্কালসার বৃদ্ধ তাহারাই। ইহাদের ধর্মই বার্ধক্য। বার্ধক্যকে সব সময় বয়সের ফ্রেমে বাঁধা যায় না। বহু যুবককে দেখিয়াছি যাহাদের যৌবনের উর্দির নীচে বার্ধক্যের কঙ্কালমূর্তি। আবার বহু বৃদ্ধকে দেখিয়াছি যাহাদের বার্ধক্যের জীর্ণাবরণের তলে মেঘ-লুপ্ত সূর্যের মত প্রদীপ্ত যৌবন। তরুণ নামের জয়-মুকুট শুধু তাহার যাহার শক্তি অপরিমাণ, গতিবেগ ঝঞ্ঝার ন্যায়, তেজ নির্মেঘ আষাঢ়-মধ্যাহ্নের মার্ত–প্রায়, বিপুল যাহার আশা, ক্লান্তিহীন যাহার উৎসাহ, বিরাট যাহার ঔদার্য, অফুরন্ত যাহার প্রাণ, অতল যাহার সাধনা, মৃত্যু যাহার মুঠিতলে। তারুণ্য দেখিয়াছি আরবের বেদুইনের মাঝে, তারুণ্য দেখিয়াছি মহাসমরের সৈনিকের মুখে, কালাপাহাড়ের অসিতে, কামাল-করিম-জগলুল-সানইয়াৎ-লেনিনের শক্তিতে। যৌবন দেখিয়াছি তাহাদের মাঝে যাহারা বৈমানিক-রূপে অনন্ত আকাশের সীমা খুঁজিতে গিয়া প্রাণ হারায়, আবিষ্কারক-রূপে নব পৃথিবীর সন্ধানে গিয়া আর ফিরে না, গৌরশৃঙ্গ কাঞ্চনজঙ্ঘার শীর্ষদেশ অধিকার করিতে গিয়া যাহারা তুষার ঢাকা পড়ে, অতল সমুদ্রের নীল মঞ্জুষার মণি আহরণ করিতে গিয়া সলিল-সমাধি লাভ করে, মঙ্গলগ্রহে চন্দ্রলোকে যাইবার পথ আবিষ্কার করিতে গিয়া নিরুদ্দেশ হইয়া যায়, পবন গতিকে পশ্চাতে ফেলিয়া যাহারা উড়িয়া যাইতে চায়, নব নবগ্রহ নক্ষত্রের সন্ধান করিতে করিতে যাহাদের নয়ন-মণি নিভাইয়া যায়  যৌবন দেখিয়াছি দুরন্তদের মাঝে। যৌবনের মাতৃরূপ দেখিয়াছি  শব বহন করিয়া যখন সে যায় শ্মশান-ঘাটে, গোরস্থানে, অনাহারে থাকিয়া যখন সে অন্ন পরিবেশন করে দুর্ভিক্ষ-বন্যা-পীড়িতদের মুখে, বন্ধুহীন রোগীর শয্যাপার্শ্বে যখন রাত্রির পর রাত্রি জাগিয়া পরিচর্যা করে, যখন সে পথে পথে গান গাহিয়া, ভিখারি সাজিয়া দুর্দশাগ্রস্তদের জন্য ভিক্ষা করে, যখন সে দুর্বলের পাশে বল হইয়া দাঁড়ায়, হতাশার বুকে আশা জাগায়।

ইহাই যৌবন,  এই ধর্ম যাহাদের তাহারাই তরুণ। আমাদের দেশ নাই, জাতি নাই, অন্য ধর্ম নাই। দেশ-কাল-জাতি-ধর্মের সীমার ঊর্ধ্বে ইহাদের সেনানিবাস। আজ আমরা মুসলিম তরুণেরা যেন অকুণ্ঠিতচিত্তে মুক্তকণ্ঠে বলিতে পারি : ধর্ম আমাদের ইসলাম কিন্তু প্রাণের ধর্ম আমাদের তারুণ্য, যৌবন। আমরা সকল দেশের, সকল জাতির, সকল ধর্মের, সকল কালের। আমরা মুরিদ যৌবনের। এই জাতি-ধর্ম-কালকে অতিক্রম করিতে পারিয়াছে যাহাদের যৌবন, তাঁহারাই আজ মহামানব, মহাত্মা, মহাবীর। তাঁহাদিগকে সকল দেশের, সকল ধর্মের সকল লোক সমান শ্রদ্ধা করে।

পথ-পার্শ্বের যে অট্টালিকা আজ পড় পড় হইয়াছে, তাহাকে ভাঙ্গিয়া ফেলিয়া দেওয়াই আমাদের ধর্ম; এই জীর্ণ অট্টালিকা চাপা পড়িয়া বহু মানবের মৃত্যুর কারণ হইতে পারে।

যে ঘর আমাদের আশ্রয় দান করিয়াছে তাহা যদি সংস্কারাতীত হইয়া আমাদেরই মাথায় পড়িবার উপক্রম করে, তাহাকে ভাঙ্গিয়া নতুন করিয়া গড়িবার দুঃসাহস আছে একা তরুণেরই। দোর দেওয়া এই পৃথিবীর নিয়ামত হইতে যে নিজেকে বঞ্চিত রাখিল, সে যত মুনাজাতই করুক, খোদা তাহা কবুল করিবেন না। খোদা হাত দিয়েছেন বেহেশত ও বেহেশ্তি চীজ অর্জন করিয়া লইবার জন্য, ভিখারির মত হাত তুলিয়া ভিক্ষা করিবার জন্য নয়। আমাদের পৃথিবী আমরা আমাদের মনের মত করিয়া গড়িয়া লইব, ইহাই হউক তরুণের সাধনা।

আমাদের বাঙ্গালি মুসলিমদের মধ্যে যে গোঁড়ামি, যে কুসংস্কার, তাহা পৃথিবীর আর কোন দেশে, কোন মুসলমানের মধ্যে নাই বলিলে বোধ হয় অত্যুক্তি হইবে না। আমাদের সমাজের কল্যাণকামী যে সব মৌলানা সাহেবান খাল কাটিয়া বেনোজল আনিয়াছিলেন, তাঁহারা যদি ভবিষ্যৎদর্শী হইতেন, তাহা হইলে দেখিতে পাইতেন বেনোজলের সাথে সাথে ঘরের পুকুরের জলও সব বাহির হইয়া গিয়াছে। উপরন্তু সেই খাল বাহিয়া কুসংস্কারের অজস্র কুমির আসিয়া ভিড় করিয়াছে। মৌলানা মৌলবী সাহেবকে সওয়া যায়, মোল্লা ও চক্ষুকর্ণ বুজিয়া সহিতে পারি, কিন্তু কাঠমোল্লার অত্যাচার অসহ্য হইয়া উঠিয়াছে। ইসলামের কল্যাণের নামে ইহারা যে কওমের জাতির ধর্মের কি অনিষ্ট করিতেছেন তাহা বুঝিবার মতো জ্ঞান নাই বলিয়া ইহদের ক্ষমা করা যায়। ইহারা প্রায়ই প্রত্যেকেই ‘মনে মনে শাহ ফরীদ, বগল-মে ইট।’ ইহাদের নীতি ‘মুর্দা দোজখ-মে যায় য়্যা বেহেশ্ত-মে যায়, মেরা হালুয়া রুটি-সে কাম।’

‘দুষ্ট গরুর চেয়ে শূন্য গোয়াল ভাল।’ নীতি অনুসরণ না করিলে সভ্য জগতের কাছে আমাদের ধর্ম, জাতি আরো লাঞ্ছিত ও হাস্যাস্পদ হইবে। ইহাদের ফতুয়া-ভরা ফতোয়া। বিবি তালাক ও কুফরির ফতোয়া তো ইহাদের জাম্বিল হাতড়াইলে দুই দশ খানা পাওয়া যাইবে। এই ফতুয়াধারী ফতোয়াবাজদের হাত হইতে গরীবদের বাঁচাইতে যদি কেহ পারে তো সে তরুণ। ইহাদের হাতের ‘আষা’ বা ষষ্টি মাঝে মাঝে আজদাহা রূপ পরিগ্রহ করিয়া তরুণ মুসলিমদের গ্রাস করিতে আসিবে সত্য, কিন্তু এই ‘আষা’ দেখিয়া নিরাশ হইয়া ফিরিলে চলিবে না। এই ঘরো যুদ্ধ ভাই-র সহিত আত্মীয়ের সহিত যুদ্ধই সর্বাপেক্ষা বেদনাদায়ক। তবু উপায় নাই। যত বড় আত্মীয়ই হোক, তাহার যক্ষ্মা বা কুষ্ঠ হইলে তাহাকে অন্যত্র না সরাইয়া উপায় নাই। যে হাত বাঘে চিবাইয়া খাইয়াছে তাহাকে কাটিয়া ফেলিয়া দেওয়া ছাড়া প্রাণ রক্ষার উপায় নাই। অন্তরে অত্যন্ত পীড়া অনুভব করিয়াই এসব কথা বলিতেছি। চোগা-চাপকান দাড়ি-টুপি দিয়া মুসলমান মাপিবার দিন চলিয়া গিয়াছে। পৃথিবীর আর সব দেশের মুসলমানদের কাছে আজ আমরা অন্তত পাঁচ শতাব্দি পেছনে পড়িয়া রহিয়াছি। যাহারা বলেন, ‘দিন ত চলিয়া যাইতেছে, পথ তো চলিতেছি,’ তাহাদের বলি ট্রেন-মোটর-এরোপ্লেনের যুগে গরুর গাড়িতে শুইয়া দুই ঘণ্টায় এক মাইল হিসাবে গদাই-লস্করি চালে চলিবার দিন আর নাই। যাহারা আগে চলিয়া গিয়াছে তাহাদের সঙ্গ লইবার জন্য আমাদের একটু অতিমাত্রায় দৌড়াইতে হয় এবং তাহার জন্য পায়জামা হাঁটুর কাছে তুলিতে হয়, তাই না হয় তুলিলাম। ঐ টুকুতেই কি আমার ঈমান বরবাদ হইয়া গেল? ইসলামই যদি গেল, মুসলিম যদি গেল, তবে ঈমান থাকিবে কাহাকে আশ্রয় করিয়া? যাক আর শত্রু বৃদ্ধি করিয়া লাভ নাই। তবে ভরসা এই যে, বিবি তালাকের ফতোয়া শুনিয়াও কাহারও বিবি অন্তত বাপের বাড়িও চলিয়া যায় নাই এবং কুফরি ফতোয়া সত্ত্বেও কেহ ‘শুদ্ধি’ হইয়া যান নাই।

আমাদের পথে মোল্লারা যদি হন বিন্ধ্যাচল, তাহা হইলে অবরোধ প্রথা হইতেছে হিমাচল। আমাদের দুয়ারের সামনের এই ছেঁড়া চট যে কবে উঠিবে খোদা জানেন। আমাদের বাংলাদেশের স্বল্পশিক্ষিত মুসলমানদের যে অবরোধ, তাহাকে অবরোধ বলিলে অন্যায় হইবে, তাহাকে একেবারে শ্বাসরোধ বলা যাইতে পারে। এই জুজুবুড়ির বালাই শুধু পুরুষদের নয়, মেয়েদেরও যেভাবে পাইয়া বসিয়াছে, তাহাতে ইহাকে তাড়াইতে বহু সরিষা-পোড়া ও ধোঁয়ার দরকার হইবে। আমাদের অধিকাংশ শিক্ষিত বা অর্ধ-শিক্ষিত লোকই চাকুরে, কাজেই খরচের সঙ্গে জমার তাল সামলাইয়া চলিতে পারে না। অথচ ইহাদের পর্দার ফখর সর্বাপেক্ষা বেশি। আর ইহাদের বাড়িতে শতকরা আশিজন মেয়ে যক্ষ্মায় ভুগিয়া মরিতেছে। আলো-বায়ুর অভাবে। এই সব যক্ষ্মা রোগগ্রস্ত জননীর পেটে স্বাস্থ্য-সুন্দর প্রতিভাদীপ্ত বীর সন্তান জন্মগ্রহণ করিবে কেমন করিয়া! ফাঁসির কয়েদিরও এইসব হতভাগিনীদের অপেক্ষা অধিক স্বাধীনতা আছে। আমরা ইসলামী সেই অনুশাসনগুলির প্রতিই জোর দিয়া থাকি, যাহাতে পয়সা খরচ হইবার ভয় নাই।

কন্যাকে পুত্রের মতই শিক্ষা দেওয়া যে আমাদের ধর্মের আদেশ তাহা মনেও করিতে পারি না। আমাদের কন্যা-জায়া-জননীদের শুধু অবরোধের অন্ধকারে রাখিয়াই ক্ষান্ত হই নাই, অশিক্ষার গভীরতর কূপে ফেলিয়া হতভাগিনীদের চির-বন্দিনী করিয়া রাখিয়াছি। আমাদের শত শত বর্ষের এই অত্যাচারে ইহাদের দেহ-মন এমনি পঙ্গু হইয়া গিয়াছে যে, ছাড়িয়া দিলে ইহারাই সর্বপ্রথম বাহিরে আসিতে আপত্তি করিবে। ইহাদের কি দুঃখ কিসের যে অভাব তাহা চিন্তা করিবার শক্তি পর্যন্ত ইহাদের উঠিয়া গিয়াছে। আমরা মুসলমান বলিয়া ফখর করি, অথচ জানি না  সর্বপ্রথম মুসলমান নর নহে-নারী।

বৃদ্ধদের আয়ুর পুঁজি তো ফুরাইয়া আসিল, এখন আমাদের তরুণদের সাধনা হউক আমাদের এই চির-বন্দিনী মাতা-ভগ্নিদের উদ্ধার সাধন। জন্ম হইতে দাঁড়ে বসিয়া যে পাখি দুধছোলা খাইয়াছে, সে ভুলিয়া গিয়াছে যে, সেও উড়িতে পারে। বাহিরে তাহারই স্বজাতি পাখিকে উড়িতে দেখিয়া অন্য কোন জীব বলিয়া ভ্রম হয়। এই পিঞ্জরের পাখির দ্বার মুক্ত করিয়া দিতে হইবে। খোদার দান এই আলো-বাতাস হইতে তাহাদিগকে বঞ্চিত করিবার অধিকার কাহারও নাই। খোদার রাজ্যে পুরুষ আজ জালিম, নারী আজ মজলুম। ইহাদেরই ফরিয়াদে আমাদের এই দুর্দশা, আমাদের মত হীনবীর্য় সন্তানের জন্ম। শুধু কি ইহাই? আমাদের সম্মুখে কত প্রশ্ন, কত সমস্যা তাহার উত্তর দিতে পারে তরুণ, সমাধান করিতে পারে তরুণ। সে বলিষ্ঠ মন ও রাহু আছে একা তরুণের। আমাদের পর্বত-প্রমাণ বাধা, নিরাশার মরুভূমি, বিধি-নিষেধের দুস্তর পাথার; এইসব লঙ্ঘন করিয়া অতিক্রম করিয়া যাইবার দুঃসাহসকিতা যাহাদের  তাহারা তরুণ।

ইহাদের জন্য চাই আমাদের একাগ্রতা, একনিষ্ঠ সাধনা, চাই সঙ্ঘ। আজ আমরা বাংলার মুসলিম তরুণেরা যূথভ্রষ্ট। আমাদের সঙ্ঘ নাই, সাধনা নাই, তাই সিদ্ধিও নাই। আমাদেরই চারিপাশে আমাদের প্রতিবেশি হিন্দু যুবকদের দেখিতেছি কি অপূর্ব তাহাদের ঐক্য, ত্যাগ, সাধনা। তাহারা সকলে যেন এক দেহ, এক প্রাণ। সকল বৈষম্য বিরোধের ঊর্ধ্বে তাহারা তাহাদের যে সঙ্ঘ গড়িয়া তুলিয়াছে, তাহার তুলনা নাই। জগতের যে কোন যুব-আন্দোলনের সঙ্গে তাহারা আজ চ্যালেঞ্জ করিতে পারে। এই সঙ্ঘ প্রতিষ্ঠার ভিত্তিমূলে কত বিপুল ত্যাগ স্বীকার করিয়াছে তাহা হয়ত আমরা অনেকেই জানি না। ইহারা পিতা-মাতার স্নেহ ভাই-ভগ্নি প্রীতি, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধবের ভালোবাসা, প্রিয়ার বাহু বন্ধন, গৃহের সুখ-শান্তি, ঐশ্বর্যের বিলাস, উজ্জ্বল ভবিষ্যতের মোহ, সমস্ত ত্যাগ করিয়াছে জাতির জন্য, দেশের জন্য, মানবের কল্যাণের জন্য। এই তরুণ বীর সন্ন্যাসীর দল আছে বলিয়াই আজও আমরা দিনের আলোকে মুখ দেখিতে পাইতেছি। মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়াইয়া ইহারা নচিকেতার মত প্রশ্ন করে, মৃত্যুর বজ্রমুষ্টি হইতে জীবনের সঞ্চয় ছিনাইয়া আনে। এই বনচারী বীরাচারীর দলই দেশের যৌবনে ঘুণ ধরিতে দেয় নাই। … আমাদের মত ইহাদের স্কন্ধে চাকরির দৈন্য সিন্দবাদের মত চাপিয়ে বসে নাই। ইহারাই সত্যকার আজাদ, বাঁধনহারা। সকল বন্ধন সকল মায়াকে অস্বীকার করিয়া তবে আজ ইহারা এত বড় হইয়া উঠিয়াছে। ইউনিভার্সিটির কত উজ্জ্বলতম রতœ  যাহারা আজ অনায়াসে জজ ম্যাজিস্ট্রেট ব্যারিস্টার প্রফেসর হইয়া নির্ঝঞ্ঝাট জীবনযাপন করিত, তাহারা রাস্তায় প্রাণ ফিরি করিয়া ফিরিতেছে। ইহারা আছে বলিয়াই তো মেরুদ-হীন বাঙ্গালি জাতি আজও টিকিয়া আছে। দীপ-শলাকার মত ইহারা নিজেদের আয়ু ক্ষয় করিয়া গ্রামে গ্রামে ঘরে ঘরে প্রাণ প্রদীপ জ্বলাইয়া তুলিতেছে।… আমাদের মুসলমান তরুণরা লেখাপড়া করে, জ্ঞান অর্জনের জন্য নয় চাকরি অর্জনের জন্য। গাধার ‘ফিউচার প্রসপেক্টের’ মতো আমরা ঐ চাকরির দিকে তীর্থের কাকের মত হা করিয়া চাহিয়া আছি। বিএ, এমএ পাশ করিয়া কিছু যদি না হই অন্তত সাবরেজিস্ট্রার বা দারোগা হইবই হইব, এই যাহাদের লক্ষ্য এত স্বল্প যাহাদের আশা, এত নিম্নে যাহাদের গতি তাহাদের কি আর মুক্তি আছে? এই ভূত ছাড়িয়া না গেলে আমরা যে তিমিরে সে তিমিরেই থাকিয়া যাইব। এই ভূতকে ছাড়াইবার ওঝা আপনারা যুবকদের দল। আমাদেরই প্রতিবেশি তরুণ শহীদদের আদর্শ যদি আমরা গ্রহণ করতে না পারি, তা হইলে আমাদের স্থান সভ্য জগতের কোথাও নাই। চাকরির মোহ, পদবির নেশা, টাইটেলের বা টাই ও টেলের মায়া যদি বিসর্জন না করিতে পারি, তবে আমাদের সঙ্ঘ প্রতিষ্ঠার আশা সুদূরপরাহত। কোথায় আছে সেই শহীদদের দল? বাহির হইয়া আইস আজ এই মুক্ত আলোকে, উদার আকাশে নীল চন্দ্রাতপতলে। তোমাদের অস্থি-মজ্জা, প্রাণ-দেহ, তোমাদের সঞ্চিত জ্ঞান, অর্জিত ধন-রতেœর উপর প্রতিষ্ঠা হইবে আমাদের সঙ্ঘের তরুণ সঙ্ঘের। সকল লাভ লোভ যশ খ্যাতিকে পদদলিত করিয়া মুসাফিরের বেশে ভিক্ষুকের ঝুলি লইয়া যে বাহির হইয়া আসিতে পারিবে  এ সাধনা তাহারই, এ শহীদি দরজা শুধু তাহারই।

আমাদের লক্ষ্য হইবে এক, কিন্তু পথ হইবে বহুমুখী। যে দুর্ধর্ষ, সে কালবৈশাখীর কেতন উড়াইয়া অসম্ভবের অভিযানে যাত্রা করুক; যে বীর তাহার জন্য রহিয়াছে সংগ্রামক্ষেত্র; যে কর্মী তাহার জন্য পড়িয়া রহিয়াছে কর্মের বিপুল উপত্যকা; কিন্তু যে ধ্যানী সে সুন্দরের পূজারি, সে কল্প-পাখায় ভর করিয়া উড়িয়া যাক স্বপ্নলোকে, উদার নিঃসীম নীল নভে। সেই স্বপ্নপুরী হইতে সে যে স্বপ্ন-কুমারীকে রূপ-কুমারীকে জয় করিয়া আনিবে তাহার লাবণীতে আমাদের কর্মক্লান্ত ক্ষণগুলি স্নিগ্ধ হইয়া উঠিবে। যে গাহিতে জানে, গানের পাখি যে, তাহাকে ছড়িয়া দিব দূর-বিথার বনানীর কোলে  আমাদেরই আশপাশে থাকিয়া আমাদের অবসাদক্লিষ্ট মুহূর্তকে সে গানে গানে ভরিয়া তুলিবে, প্রাণে নব প্রেরণার সঞ্চার করিবে। ইহারা আমাদের সুন্দর সাথী। বাড়ির উঠানের ফুলে ফুলে ফুল্ল লতাটির পানে চাহিয়া যেমন রৌদ্রদগ্ধ চক্ষু জুড়াইয়া লই, তেমনি করিয়া ইহাদের কবিতায় গানে ছবিতে আমরা আমাদের বুভুক্ষু অন্তরের তৃষ্ণা মিটাইব, অবসাদ ভুলিব।

বিধি-নিষেধের বাধা আমরা মানিব না। গান গাওয়াই যাহার স্বভাব, সেই গানের পাখিকে কোন অধিকারে গলা টিপিয়া মারিতে যাইবে? সুন্দরের সৃষ্টির শক্তি লইয়া জন্মগ্রহণ করিয়াছে যে, কে তাহার সৃষ্টি হেরিয়া কুফরির ফতোয়া দিবে?

এই খোদার উপর খোদকারী আর যারা করুক, আমরা করিব না।

পৃথিবীর অন্যান্য মুসলমান প্রধান দেশের কথা না হয় ছাড়িয়াই দিলাম, এই ভারতেরই সকল প্রদেশের আজও সর্বশ্রেষ্ঠ হল কি কণ্ঠসঙ্গীতে কি যন্ত্রসঙ্গীতে তাহাদের প্রায় সকলেই মুসলমান।

অথচ সে দেশের মৌলভী মৌলানা সাহেবান আমাদের দেশের মৌলভী সাহেবানদের অপেক্ষাও জবরদস্ত। তাহারা ঐসব গুণীদের অপমান বা সমাজচ্যুত করিয়াছেন বলিয়া জানি না। বরং তাহাদের যথেষ্ট সম্মান করেন বলিয়াও জানি। সঙ্গীত শিল্পের বিরুদ্ধে মোল্লাদের সৃষ্ট এই লোকমতকে বদলাইতে তরুণদের আপ্রাণ চেষ্টা করিতে হইবে। তাহাদিগকে শিখাইতে হইবে যাহা সুন্দর তাহাতে পাপ নাই সকল বিধিনিষেধের উপর মানুষের প্রাণের ধর্ম বড়।

আজ বাঙ্গালি মুসলমানদের মধ্যে একজনও চিত্র-শিল্পী নাই, ভাস্কর নাই, সঙ্গীতজ্ঞ নাই, বৈজ্ঞানিক নাই, ইহা অপেক্ষা লজ্জার আর কি আছে? এই সবে যাহারা জন্মগত প্রেরণা লইয়া আসিয়াছিল, আমাদের গোঁড়া সমাজ তাহাদের টুটি টিপিয়া মারিয়া ফেলিয়াছে ও ফেলিতেছে। এই অত্যাচারের বিরুদ্ধে আমাদের সমস্ত শক্তি লইয়া বুঝিতে হইবে। নতুবা আর্টে বাঙ্গালি মুসলমানদের দান বলিয়া কোনো কিছু থাকিবে না। পশুর মত সংখ্যাগরিষ্ঠ হইয়া বাঁচিয়া আমাদের লাভ কি, যদি আমাদের গৌরব করিবার কিছুই না থাকে। ভিতরের দিকে আমরা যত মরিতেছি, বাহিরের দিকে তত সংখ্যায় বাড়িয়া চলিতেছি। এক মাঠ আগাছা অপেক্ষা একটি মহীরুহ অনেক বড়।

আমার অভিভাষণ হয়ত অতিভাষণ হইতে চলিল। আমাদের শেষ কথা  আমরা যৌবনের পূজারি, নব-নব সম্ভাবনার অগ্রদূত, নব নবীনের নিশানবর্দার। আমরা বিশ্বের সর্বাগ্রে চলমান জাতির সহিত পা মিলাইয়া চলিব। ইহার প্রতিবন্ধক হইয়া দাঁড়াইবে যে বিরোধ আমাদের শুধু তাহার সাথেই। ঝঞ্ঝার নূপুর পরিয়া নৃত্যায়মান তুফানের মত আমরা বহিয়া যাইব। যাহা থাকবার তাহা থাকিবে, যাহা ভাঙ্গিবার তাহা আমাদের চরণঘাতে ভাঙ্গিয়া পড়িবেই। দুর্যোগ রাত্রের নীরন্ধ্র অন্ধকার ভেদ করিয়া বিচ্ছুরিত হউক আমাদের প্রাণ-প্রদীপ্তি! সকল বাধা-নিষেধের শিখর-দেশে স্থাপিত আমাদের উদ্ধত বিজয় পতাকা। প্রাণের প্রাচুর্যের আমরা যেন সকল সঙ্কীর্ণতাকে পায়ে দলিয়া চলিয়া যাইতে পারি।

আমরা চাই সিদ্দিকের সাচ্চাই, ওমরের শৌর্য ও মহানুভবতা, আলির জুলফিকার, হাসান-হোসেনের ত্যাগ ও সহনশীলতা। আমরা চাই খালেদ-মুসা-তারেকের তরবারি, বেলালের প্রেম। এইসব গুণ যদি আমরা অর্জন করিতে পারি, তবে জগতে যাহারা আজ অপরাজেয় তাহাদের সহিত আমাদের নামও সসম্মানে উচ্চারিত হইবে।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত