আজ শহীদ আসাদ দিবস

প্রকাশ | ২০ জানুয়ারি ২০২৩, ১৪:৩০ | আপডেট: ২০ জানুয়ারি ২০২৩, ১৯:১৩

মো: মুহাইমিনুল ইসলাম

আমানুল্লাহ মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান (জুন ১০-১৯৪২, জানুয়ারি ২০-১৯৬৯) ইতিহাসের পাতায় এক অবিস্মরণীয় নাম, তবে সর্বসমক্ষে তিনি শহীদ আসাদ নামেই অধিক পরিচিত। ১৯৪২ সালের ১০ জুন নরসিংদী জেলার শিবপুর উপজেলার ধানুয়া গ্রামের হাতিরদিয়ায় এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। পিতা আলহাজ্ব মাওলানা মোহাম্মদ আবু তাহের এবং মাতা মতি জাহান খাদিজা খাতুনের ছয় পুত্র ও দুই কন্যার মধ্যে আসাদ ছিলেন চতুর্থ।

আসাদ শিবপুর উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ১৯৬০ সালে মাধ্যমিক শিক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে উচ্চ শিক্ষার্থে জগন্নাথ কলেজ (বর্তমান জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়) ও এমসি কলেজে পড়াশোনা করেন। ১৯৬৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক শ্রেণীতে ভর্তি হয়ে ১৯৬৬ সালে বি.এ এবং ১৯৬৭ সালে এম.এ ডিগ্রী অর্জন করেন। এই বৎসরেই আসাদ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) এবং কৃষক সমিতির সভাপতি মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাষাণী’র নির্দেশনায় কৃষক সমিতিকে সংগঠিত করার লক্ষ্যে শিবপুর, মনোহরদী, রায়পুরা এবং নরসিংদী এলাকায় নিজেকে সম্পৃক্ত রাখেন।

ঢাকা’র সিটি ল কলেজে তিনি ১৯৬৮ সালে আরও ভালো ফলাফলের জন্যে দ্বিতীয়বারের মতো এম.এ বা স্নাতকোত্তর ডিগ্রী অর্জনের জন্য চেষ্টা করছিলেন। ১৯৬৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগে এম.এ শেষ বর্ষের ছাত্র ছিলেন তিনি। আসাদ তৎকালীন ঢাকা হল (বতর্মান শহীদুল্লাহ হল) শাখার পূর্ব-পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি হিসেবে এবং পূর্ব-পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন (ইপসু-মেনন গ্রুপ), ঢাকা শাখার সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে নিবেদিত প্রাণ আসাদুজ্জামান গরিব ও অসহায় ছাত্রদের শিক্ষার অধিকারের বিষয়ে সর্বদাই সজাগ ছিলেন। তিনি শিবপুর নৈশ বিদ্যালয় নামে একটি নৈশ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন এবং শিবপুর কলেজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে স্থানীয় শিক্ষানুরাগী ব্যক্তিদেরকে সাথে নিয়ে আর্থিক তহবিল গড়ে তোলেন।

তৎকালীন সময়ে শেখ মুজিবুর রহমানের ৬ দফা দাবীর স্বপক্ষে এবং আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় শেখ মুজিব সহ অন্যান্য আসামীদের মুক্তির দাবীতে ফুঁসছিল গোটা দেশ। ৪ জানুয়ারি, ১৯৬৯ইং তারিখে ছাত্রদের ১১ দফা এবং বঙ্গবন্ধুর ৬ দফা দাবীর সাথে একাত্মতা পোষণ করে ছাত্র সংগঠনের নেতৃবৃন্দ, যাতে প্রধান ভূমিকা রাখেন আসাদুজ্জামান। ১৭ জানুয়ারি, ১৯৬৯ইং সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত বৈঠকে ছাত্ররা দেশব্যাপী সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধের ডাক দেয়। ফলে গভর্নর হিসেবে মোনেম খান ১৪৪ ধারা আইন জারী করেন যাতে করে চার জনের বেশি লোক একত্রিত হতে না পারে।

পূর্ব পরিকল্পনা অনুসারে ১৯৬৯ সালের ২০ জানুয়ারি দুপুরে ছাত্রদেরকে নিয়ে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের পার্শ্বে চাঁন খাঁ’র পুল এলাকায় মিছিল নিয়ে অগ্রসর হচ্ছিলেন আসাদুজ্জামান। পুলিশ তাদেরকে চাঁন খাঁ’র ব্রীজে বাঁধা দেয় ও চলে যেতে বলে। কিন্তু বিক্ষোভকারী ছাত্ররা সেখানে প্রায় এক ঘণ্টা অবস্থান নেয় এবং আসাদ ও তার সহযোগীরা স্বৈরাচারী সরকারের বিরুদ্ধে স্লোগান দিতে থাকে। ঐ অবস্থায় খুব কাছ থেকে আসাদকে লক্ষ্য করে এক পুলিশ অফিসার গুলিবর্ষণ করে। তৎক্ষণাৎ গুরুতর আহত অবস্থায় আসাদকে হাসপাতালে নেওয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত বলে ঘোষণা করেন।

আন্দোলনে আসাদের মৃত্যু পরিবেশকে আরও ঘোলাটে করে তোলে ও গুরুত্বপূর্ণ ঘটনায় রূপান্তরিত করে। ফলত হাজারো ছাত্র-জনতা আসাদের মৃত্যুতে একত্রিত হয়ে পুনরায় মিছিল বের করে এবং শহীদ মিনারের পাদদেশে জমায়েত হয়। আসাদ হত্যার প্রতিবাদে তৎকালীন সর্বদলীয় ছাত্রসংগ্রাম পরিষদ ২২ ও ২৩ জানুয়ারি শোক দিবস এবং ২৪ তারিখে হরতাল পালন করে। কর্মসূচির শেষ দিনটি আইয়ুব খানের একনায়ক শাসন ব্যবস্থার বিরুদ্ধে একটি স্বতঃস্ফূর্ত গণ-অভ্যুত্থানে রূপান্তরিত হয়। ফলে মাত্র দু’মাসের মধ্যে আইয়ুব ও তার সরকারের পতন ঘটে। আইয়ুবের পতনের প্রতীক হিসেবে দেশের বিভিন্ন স্থানে জনতা আইয়ুবের নামফলক নামিয়ে আসাদের নাম সংযোজন করে। ঢাকার আইয়ুব গেট হয়ে যায় আসাদ গেট, আইয়ুব এভিনিউ হয়ে যায় আসাদ এভিনিউ।

১৯৭০ সালের ১৫ জানুয়ারির সিদ্ধান্ত মোতাবেক ২০ জানুয়ারি ‘শহীদ আসাদ দিবস’ হিসেবে পালনের জন্য পূর্ব বাংলা বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়ন ঐদিন পূর্ণ দিবস হরতাল আহ্বান করে। সেই থেকে ১৯৬৯ সালের গণ-আন্দোলনের পথিকৃৎ আসাদুজ্জামানের স্মরণে প্রতি বছরই জানুয়ারির ২০ তারিখে দেশমাতৃকার মুক্তি এবং স্বাধীনতার লক্ষ্যে তার মহান আত্মত্যাগ ও অবদানকে বাঙ্গালী জাতি অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে গভীর শ্রদ্ধায় ‘শহীদ আসাদ দিবস’ হিসেবে পালন করে থাকে।

সাহস২৪.কম/এমআই/এএম.