প্রয়াণ দিনের শ্রদ্ধাঞ্জলি

সৈয়দ মোস্তফা আলী

প্রকাশ : ০৮ আগস্ট ২০১৯, ১৬:২৭

১.
আমাদের শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির ঋদ্ধ, আলোকিত পরিবারের কৃতি ব্যক্তিত্ব সৈয়দ মোস্তফা আলী। বিদগ্ধ ব্যক্তিত্ব সৈয়দ মোস্তফা আলী ১৯৭৭ সালের ৭ আগস্ট মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর স্মৃতির প্রতি জানাই বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি। তিনি সাহিত্য অন্ত:প্রাণ ছিলেন, জীবনে-মননে সংস্কৃতির একান্ত সাধক ছিলেন। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের প্রতি তাঁর অনুরাগ স্বজন মহলে সমাদৃত ছিলো বলেই জানা যায়। আসাম সিভিল সার্ভিসের উর্দ্ধতন কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন, সকল ক্ষেত্রে পরিচয় দিয়েছেন সততার, আর সেই সাথে আপন জীবনাদর্শের আলো জ্বালিয়ে কাজের মাঝে রেখেছেন দক্ষতা ও যোগ্যতার প্রমাণ। জনারণ্যে সুপরিচিত ব্যক্তিত্ব না হয়েও লিখেছেন জীবনকে জাগ্রত করা আলোচিত স্মৃতিকাহিনি, ইতিহাসের জন্য আকর গ্রন্থ ‘আত্মকথা’। অনন্য সাধারণ এক আত্মজৈবনিক গ্রন্থটি আগ্রহীদের পাঠ করার সবিনয় অনুরোধ জানাতে কোন দ্বিধা নেই আমার।

২.
তাঁর জন্ম হবিগঞ্জে। তাঁদের পৈতৃক নিবাস ছিলো বর্তমান হবিগঞ্জ জেলার বাহুবল উপজেলার করঙ্গী নদীর পারে উত্তরসুর গ্রামে। তাঁর পিতা খানবাহাদুর সিকান্দার আলী ( জন্ম : - প্রয়াণ : ২৬ নভেম্বর, ১৯৩৯) ছিলেন সাব-রেজিস্ট্রার। তাঁর আম্মা আমতুল মন্নান খাতুন (১৮৭৯-১৯৪২) ছিলেন জমিদার কন্যা। বৃহত্তর সিলেটের ঐতিহ্যবাহী এবং সম্ভান্ত মুসলিম পরিবারের কৃতি সন্তান সাহিত্যিক সৈয়দ মোস্তফা আলীকে জানলেই কাজ চলে না, জানতে হয় তাঁদের পরিবারের অন্যান্যদের সম্পর্কেও। মনীষী আবুল ফজলের ভাষায় বলতে হয়, ‘এ পরিবারের সাংস্কৃতিক চেতনা যে পুরোপুরি বাংলাদেশমুখী ছিল তা সহজেই অনুমান করা যায়।’ বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের অন্যতম শক্তিমান কথাশিল্পী সৈয়দ মুজতবা আলি ছিলেন তাঁর ছোটভাই। তাঁর আরেক ভাই লেখক, প্রশাসক হিসেবে খ্যাতিমান মানুষ, আলোকিত ব্যক্তিত্ব সৈয়দ মুর্তাজা আলী। তাঁর বোনদের নাম : হিফজুন্নেসা খানম, নজিবুন্নেসা খাতুন, জেবুন্নেসা খাতুন এবং লুৎফুন্নেসা।

৩.
তাঁর বড় সন্তান প্রয়াত এস. এম আলী (সৈয়দ মোহাম্মদ আলী) ছিলেন এদেশের স্বনামধন্য সাংবাদিক। উল্লেখ্য, বহুল প্রচারিত ইংরেজি দৈনিক ‘ডেইলি স্টার’-এর প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ছিলেন এস.এম আলী। তাঁর আরেক সন্তান প্রাক্তন পররাষ্ট্র সচিব এবং বর্তমানে দিল্লীতে নিযুক্ত বাংলাদেশের হাইকমিশনার সৈয়দ মোয়াজ্জেম আলী, যিনি মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় ১৯৭১ সালে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে দায়িত্ব পালনকালে সকল প্রকার ঝুঁকি গ্রহণ করে দেশপ্রেমে জাগ্রত হয়ে পাকিস্তানের পক্ষ ত্যাগ করে মুজিবনগর সরকারের প্রতি আস্থা জানাতে এবং স্বাধীনতার সপক্ষে নিরলস কাজ করতে দ্বিধা করেননি। সৈয়দ মোস্তফা আলীর ছোট ছেলে সৈয়দ রুহুল আমিনও (Syed Ruhul Amin ) একজন স্বনামধন্য ব্যাংকার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।

৪.
তাঁর রচিত গ্রন্থ ‘আত্মকথা’র ভূমিকায় (‘পরিচিতি’)আবুল ফজল লিখেছেন, ‘নিজের বিকাশের ক্ষেত্র সংকুচিত করে সৈয়দ মোস্তফা আলীও কনিষ্ঠদের বিকাশের সুযোগ আর ক্ষেত্র রচনা করে দিয়েছেন।’ দৃঢ়কণ্ঠে এই মনীষী আরো জানাচ্ছেন, ‘সৈয়দ মোস্তফা আলী লিখেছেন। লেখার প্রেরণা জুগিয়েছে তাঁকে তাঁর সুদীর্ঘ অভিজ্ঞতা আর সহায়তা করেছে তাঁর প্রখর স্মৃতি-শক্তি। এ ধরনের লেখার প্রধান শর্ত, শুধু চর্মচক্ষুকে নয়, মনের চক্ষুকেও খোলা রাখা আর নিজের দেখাকে লেখায় রূপান্তরিত করার শৈল্পিক ক্ষমতা। শৈশব থেকে পরিণত বয়স পর্যন্ত সৈয়দ মোস্তফা আলী নিজের বাইরের আর ভিতরের চোখ সবসময় খোলা রেখেছেন আর প্রকাশের ভাষা আর আঙ্গিক যে তাঁর করায়াত্ত সে বিষয়ে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। তাই তাঁর আত্মকথা সুখপাঠ্য আর আকর্ষনীয় হয়েছে।’ মনীষী আবুল ফজলের ভাষায়, ‘এ ধরনের আত্মকথার মূল্য ঐতিহাসিক। … বইটি পড়ে আমি উপকৃত হয়েছি, সঙ্গে সঙ্গে পেয়েছি প্রচুর আনন্দও। আমার বিশ্বাস অন্য পাঠকরাও পাবেন।’

৫.
তাঁর কৃতি সন্তান সৈয়দ মোয়াজ্জেম আলী (Syed Muazzem Ali‎ ) পিতৃস্মৃতিচারণ করে লিখেছেন, ‘On this day in 1977, my father Syed Mustafa Ali had passed away. May Allah rest his soul in peace, Amin. He was a brilliant student and had graduated in the first batch of Honours in English literature from Dhaka University. Unfortunately, only months before his MA examination, he had to abandon his studies to join Assam Civil Service to support his father Khan Bahadur Syed Sikander Ali who had retired from service. At that time, his immediate younger brother Syed Murtaza Ali had just passed his intermediate and was about to go to Presidency College for BSc (Hon) in Physics while his youngest brother Syed Mujtoba Ali who had walked out of Sylhet Govt School, in protest, and was planning to go to Shantineketon. It was my father who made his brothers and sisters interested in literature but he himself could not pursue his literary interest. Such sacrifices by elder sons were not uncommon in struggling middle class Muslim families at that time. First my father and then uncle Murtaza as soon as he completed his BSc Hons, left studies, joined Assam Civil Service and helped their father to uplift their family. With their combined efforts, our Dada transformed our family from a family of "Pirs" to a distinguished literary family all within one generation. My homage to them. I am indeed privileged to be born in this family. Alhamdulliah.’ (৭.৮.২০১৮)

৬.
সৈয়দ মোস্তফা আলীর ‘আত্মকথা’ পাঠের মাধ্যমে জানতে পারি অবিভক্ত ভারতের আসাম-সিলেট (শ্রীহট্ট) অঞ্চলের আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক অজানা নানা কাহিনি এবং সেই সাথে বৃটিশ ভারতের প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনার নানান চিত্রকেও খুঁজে পাই। আবার কোন রকম কঠোরতা অবলম্বন না করেও অত্যন্ত দক্ষ শিক্ষক ‘দুলাল মাস্টার মহাশয়’-এরও পরিচয় পাই রচনায়। ‘অধ্যাপকগণ বড় বড় স্কলার ছিলেন’ স্বীকার করেছেন কৃতজ্ঞতাসহকারে। সেই সব গুণি শিক্ষকের পরম সান্নিধ্যের আলোকিত স্মৃতিচারণ করে তাঁর সাহিত্যপ্রীতির বিষয়েও লিখছেন, ‘শিক্ষালয়ে সাহিত্যানুরাগ ক্রমশ অনুকূল পরিবেশ বৃদ্ধি পেতে থাকে।’ ফলে ঝুঁকে পড়েন স্বদেশী আন্দোলনেও। পিতার চাকুরির সুবাদে সুনামগঞ্জের শৈশবকালে তিনি দেখা পান ‘তৎকালীন মুকুটহীন রাজা’ দেওয়ান হাসন রাজা’র। স্মৃতিচারণ করে লিখেছেন, ‘আমি যখন তাঁকে দেখি- তখন তাঁর কেশে সামান্য পাক ধরেছে মাত্র।’ ১৯১৯ সালের রবীন্দ্রনাথের সিলেট ভ্রমণকালের স্মৃতিচারণ করে ‘তাঁর বাংলা বক্তৃতা শ্রীহট্টিয়ারা বুঝবেন কি না’ মন্তব্য তুলে ধরে লিখেছেন, ‘সে যুগে মাইক ছিলো না- রবীন্দ্রনাথও খুব উঁচু গলায় বক্তৃতা করেননি- কিন্তু তাঁর প্রত্যেকটি কথাই আমরা শুনতে পেয়েছিলাম।’

৭.
লেখক Muhit Hasan Digonta জানাচ্ছেন, তাঁর "আত্মকথা" অত্যন্ত স্বাদু রচনা। তাঁর সম্পর্কে অনুজ সৈয়দ মুজতবা আলী সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে লেখা এক চিঠিতে যা বলেছিলেন তা মনে হয় এখানে প্রাসঙ্গিক: "এই বড়দাটি আমার(৫ বছরের বড়) বড় সরল সাধাসিধে প্রকৃতির। একটু খানিক ছেলেমানুষও বটেন। এই তাঁর প্রথম বই এবং আমি শপথ করতে পারি, এই তাঁর শেষ।...দাদা চিরটাকাল আমাদের মধ্যে স্কুল-কলেজেও, সর্বশ্রেষ্ঠ স্পর্শকাতরতা দিয়ে নীরস পুস্তকেও সদগুণ আবিষ্কার করতে পারতো। এম এ পাশের প্রাক্কালে বাবা পেনশন নিলেন; দাদাকে বাধ্য হয়ে চাকরি নিয়ে ছোট দুই ভাইকে খর্চা পাঠাতে হতো, পর পর চারটে বোনের বিয়ে সামলানো।...আমার বউকে স্নেহ করে সে, ভাই, অবর্ণনীয়।...অত্যুত্তম ইংরিজি জানে বলে ভাইপো দুটোর ইংরিজি চেক করবে...আরো কত কি বলবে...আমি সত্যি বলছি, দাদার যে প্রচণ্ড আত্মসংযম, ‘সবকিছু’ না বলার বিধিদত্ত রূপ, সেটা থাকলে আমি বর্তে যেতুম।..."(২ এপ্রিল ১৯৭৩, সূত্র: সুনীলকে লেখা চিঠি/পৃ ১৬২)। সেই চিঠিতে তাঁর কৃতি সন্তান সৈয়দ মোয়াজ্জেম আলীর কথাও আছে: "তাঁর দুই নম্বর ছেলে সে ম্যুঅজ্জম আলীও ওয়াশিংটন-এ পাক অ্যাম্বেসি থেকে বেরিয়ে বাঙলাদেশের আনুগত্য স্বীকারে করে। ইয়েহিয়ার পিচেশরা বেরল ৬৫(তখন) বছরের বুড়োকে খতম করার তরে। তাঁর প্রিয় বাস্তভিটা ত্যাগ করে, ঢাকা এসে সাতমাস অজ্ঞাতবাসের ঠ্যালা সামলালে। ওদিকে আবার দুঃসাহসে পয়লা নম্বরী। খামোখা গোলাগুলির মধ্যে যত্রতত্র ঘুরে বেড়াত।" (বানান অপরিবর্তিত)

৮.
আরো বিস্তারিত রচনার আশা রেখে বিদগ্ধ ব্যক্তিত্ব সৈয়দ মোস্তফা আলীর প্রয়াণ দিনে আবারো তাঁর স্মৃতির প্রতি জানাই বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি।
(তথ্যসূত্র: আত্মকথা)

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত