জুল ভার্ন

প্রকাশ : ০৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ১২:৫০

যুগ যুগ ধরে সুররিয়ালিস্ট এবং সায়েন্স ফিকশন ধারাকে দাপটের সাথে প্রভাবিত করে চলা কল্পবিজ্ঞান সাহিত্যের মুকুটহীন সম্রাট জুল ভার্নের জন্মদিবস আজ। উড়োজাহাজ, রকেট কিংবা সাবমেরিনের বাস্তবিক ও ব্যবহারিক প্রয়োগের অনেক পূর্বেই তিনি মহাকাশ ভ্রমণ ও সমুদ্রের তলদেশে ভ্রমণের কল্পকাহিনি লিখেছিলেন। পৃথিবীতে আগাথা ক্রিস্টির পরেই তাঁর লেখা সবচেয়ে বেশী বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়েছে। তাঁর লেখা বেশ কিছু কাহিনী নিয়ে চলচ্চিত্র ও নাটকও নির্মিত হয়েছে।

পুরো নাম জুল গাব্রিয়েল ভার্ন। জুল ভার্নের জন্ম ১৮২৮ সালে ফ্রান্সের পশ্চিমে বিস্কে উপসাগরের তীরে অবস্থিত নঁত নামের বন্দর শহরে। তাঁর বাবা পিয়েরে ভার্ন, এবং মা সোফি অ্যালো দে লা ফুয়। তাঁর শৈশবকাল কাটে এখানকার বিদ্যালয়ে পড়াশুনা করে। তাঁরা গ্রীষ্মকাল কাটাতেন নঁতের কাছেই ব্রে শহরে। সেখানে ভার্ন ও তাঁর ভাই পল প্রায়ই এক ফ্রাঁ দিয়ে এক দিনের জন্য নৌকা ভাড়া নিতেন। ভার্নের মতে, নদীতে জলযানসমূহের চলাচলের দৃশ্য তাঁর কল্পনাশক্তির স্ফুরণ ঘটায়। ১২ বছর বয়সে জাহাজের কেবিনবয় হিসেবে কাজ নিয়ে বাড়ী থেকে পালাতে গিয়ে ধরা পড়েন। তখন মায়ের কাছে প্রতিজ্ঞা করেন এখন থেকে নিজের মনের মধ্যেই ঘুরে বেড়াবেন। বাবার ইচ্ছায় আইন বিষয়ে উচ্চতর পড়াশুনা করে আইনজীবী হিসেবে কর্মজীবন শুরু করে তিনি বেশ সুনাম অর্জন করেন। কিন্তু অভিযানপ্রিয় জুল ভার্ন এ পেশার প্রতি অল্প সময়ের ব্যবধানে বিরক্ত হয়ে ওঠেন। আইন ব্যবসা ছেড়ে ছুড়ে ১৮৬৭ সালে পাড়ি জমালেন আমেরিকাতে।

সাহিত্যাঙ্গনে ভার্নের প্রবেশ ঘটে মঞ্চনাটক লেখার মাধ্যমে। তাঁর লেখা মঞ্চনাটক বেশ জনপ্রিয়তা পায়। তাঁর লেখা প্রথম বই 'বেলুনে পাঁচ সপ্তাহ' অত্যন্ত অবাস্তব বলে কোন প্রকাশক ছাপতে রাজী না হওয়ায় তিনি রেগে গিয়ে এর পাণ্ডুলিপি আগুনে পুড়িয়ে ফেলার সময় তাঁর স্ত্রীর হস্তক্ষেপে তা রক্ষা পায়। পরে এ বইটি প্রকাশিত হলে রাতারাতি প্রচণ্ড জনপ্রিয়তা পায়। ব্যক্তিগত জীবনে প্রচণ্ড ঘরকুনো এই লেখক তার বাড়ির চিলেকোঠায় বসেই লিখে গেছেন বিশ্বমাতানো সব কল্পবিজ্ঞান কাহিনী। তাঁর সৃষ্ট চরিত্রগুলির মধ্যে ফিলিয়াস ফগ্‌, ক্যাপ্টেন নিমো, রোবার ও ক্যাপ্টেন হ্যাটেরাস উল্লেখযোগ্য। ১৮৫৭ সালের সিপাহী যুদ্ধ ও নানা সাহেবের ইতিহাস আশ্রিত তাঁর উপন্যাস 'টাইগার্স এন্ড ট্রেটস'-এ অবিভক্ত ভারতবর্ষ ও বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের নিখুঁত বর্ণনা পাওয়া যায়।

তাঁর উল্লেখযোগ্য রচনাবলি 'টুয়েন্টি থাউজ্যান্ড লীগস আন্ডার দ্য সী', 'এ জার্নি টু দ্য সেন্টার অব দ্য আর্থ', 'অ্যারাউন্ড দ্য ওয়ার্ল্ড ইন এইটি ডেইজ', 'দ্য মিস্ট্রিয়াস আইল্যান্ড', ডিক স্যান্ড, 'এ ক্যাপ্টেইন অ্যাট ফিফটিন'। জুল ভার্ন ছিলেন একজন খাঁটি বিজ্ঞানী, অভিযাত্রী আর পর্যটক। আর্থার সি ক্লার্ক, এইচ জি ওয়েলস, আইজ্যাক আসিমভের মত মহান সাহিত্যিকগণের মতে, “তিনি এমন একজন শক্তিশালী লেখক যার অবদান বিশ্ব সাহিত্যে অপরিসীম”। তাঁর জাদুকরি লেখা জয় করেছে ভৌগোলিক সীমারেখার সকল সীমাবদ্ধতা।

বিজ্ঞানমনস্কতা জুল ভার্নের লেখার মূল উপজীব্য। সাবমেরিন, হেলিকপ্টার, বিমান, রকেট প্রভৃতি যুগান্তকারি আবিষ্কারের মূল প্রেরণা জুল ভার্নের রচনা। পরবর্তী বহু বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের পশ্চাতে রয়েছে জুল ভার্নের সায়েন্স ফিকশনের অবদান। উনবিংশ শতাব্দীতে যখন এমন যন্ত্রের কথা মানুষ ভাবতেও পারেনি তখন কিভাবে তিনি এসবের কথা লিপিবদ্ধ করেছেন ভাবতে অবাক লাগে। বিজ্ঞানীরাও তাই সঙ্গত কারনেই অপরিসীম শ্রদ্ধার চোখেই বিবেচনা করেন এই মহান সাহিত্যিককে। সাহিত্যের পরিসীমা অতিক্রম করে তাঁর রচনাবলী যেন পথ নির্দেশ করে আধুনিক বিজ্ঞানকে। বিজ্ঞান কল্পকাহিনীর খ্যাতিমান ফরাসি লেখক জুল ভার্নের ‘মিষ্টিরিয়াস আইল্যান্ডের’ ক্যাপ্টেন সাইরাস হার্ডিং এর উদ্ভাবনী শক্তির কারনে প্রত্যেক পাঠককেই প্রচন্ড ভাবে আকৃষ্ট করবে। বিজ্ঞান কল্পকাহিনীর এই লেখক ১৯০৫ সালের ২৪ মার্চ আমেরিকাতে মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিলো ৭৭ বছর।

সাহিত্যে উল্লেখযোগ্য অবদানের জন্য ফ্রান্স সাহিত্য অ্যাকাডেমি তাঁকে 'অর্ডার অব মেরিট' সম্মানে ভূষিত হন এবং ইংল্যান্ড রয়াল অ্যাকাডেমির সম্মানসূচক সদস্যপদ লাভ করেন। টাইম ম্যাগাজিন ১৯৯৬ সালে তাঁকে সর্বকালের সেরা সায়েন্স ফিকশন লেখক হিসেবে ঘোষণা দেয়।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত