বার্ট্রান্ড আর্থার উইলিয়াম রাসেল

প্রকাশ : ০৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ১৩:০১

বার্ট্রান্ড আর্থার উইলিয়াম রাসেল ১৯৫০ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার অর্জন করেন। এই পুরস্কার ছিল তার বহুবিধ গুরুত্বপূর্ণ রচনার স্বীকৃতিস্বরূপ। তিনি সারাজীবন মানবতার আদর্শ ও চিন্তার মুক্তিকে ওপরে তুলে ধরেছেন। তিনি ছিলেন একজন ব্রিটিশ দার্শনিক, যুক্তিবিদ, গণিতবিদ, ইতিহাসবেত্তা, সমাজকর্মী, অহিংসাবাদী, এবং সমাজ সমালোচক। জীবনের অধিকাংশ সময় ইংল্যান্ডে কাটালেও তাঁর জন্মস্থান ওয়েলস। সেখানেই তিনি ৯৭ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। রাসেল ১৯০০ সালের শুরুতে ব্রিটিশদের আদর্শবাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহে নেতৃত্ব প্রদান করেন। তাকে বিশ্লেষণী দর্শনের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা বিবেচনা করা হয়। এই দর্শনের অন্যান্য প্রতিষ্ঠাতারা ছিলেন তার শিষ্য ভিটগেনস্টেইন এবং পূর্বসূরি ফ্রেগে এবং তাকে ২০ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠতম যুক্তিবিদদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়।। তিনি জ্ঞানতত্ত্ব, নীতিবিদ্যা, যুক্তিবিজ্ঞান, অধিবিদ্যা, দর্শনের ইতিহাস, ভাষাদর্শন, ধর্মদর্শন, গণিতের দর্শন ও বিজ্ঞানের দর্শনসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে কাজ করেন।

বারট্রাণ্ড রাসেল সারাজীবন পরমেশ্বরের শ্রেষ্ঠত্বের ধারণাকে প্রত্যাখ্যান করে গেছেন। বলা হয়ে থাকে যে, শুধুমাত্র একারণেই গোঁড়া ধর্মবিশ্বাসী লোকেরা চিরকাল তাঁর প্রতি ক্ষুব্ধ ছিলেন। একটু পেছনের ইতিহাস টানলে আমরা স্পষ্ট দেখতে পাই, রাসেলের পিতা-মাতা লর্ড অ্যামবারলে ও লেডি অ্যাম্বারলে ছিলেন সেকালের প্রগতিশীল মানুষ। এই দম্পতির প্রগতিশীল চিন্তাকে সেকালের ভিক্টোরিয়ান সোসাইটি নীতি বিগর্হিত বলে নিন্দা করতো। অ্যাম্বারলে দম্পতি তরুণ বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুর পূর্বে তাঁরা বারট্রাণ্ড রাসেল ও তাঁর জ্যেষ্ঠ সহোদরের অভিভাবক হিসেবে দুজন নিরীশ্বরবাদী বন্ধুকে মনোনীত করে গেলেও আদালতে সেই উইলটিকে বাতিল ঘোষনা করা হয়। তারপর দুই নাবালককে তাদের ঠাকুরদা-ঠাকুরমার কাছে হস্তান্তর করা হয়।

শৈশবের বাড়ন্ত বয়সের সেই দিনগুলোর স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে রাসেল লিখেছেন : "আমার ঠাকুরদা ছিলেন কূটনীতিজ্ঞ পুরুষ। তিনি ১৮৭৮ সালে মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর মৃত্যুর পর আমার ঠাকুরমা-ই আমাদের শিক্ষার ধরণ কেমন হবে সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেন। তিনি ছিলেন স্কটল্যাণ্ডের প্রেজবেটেরিয়ান চার্চের মতবাদে বিশ্বাসী। ক্রমে তিনি একত্ববাদে বিশ্বাসী হয়ে উঠেছিলেন। আমাকে পালাক্রমে প্রতি রবিবারে কাউন্টির অন্তর্গত পারিশ চার্চ ও প্রেজবেটেরিয়ান চার্চে নিয়ে যাওয়া হতে লাগলো। একই সময়ে বাড়িতে আমাকে একত্ববাদের মতবাদসমূহ শিক্ষা দেয়া হচ্ছিল। বাইবেলের আক্ষরিক সত্যতা এবং চিরন্তন শাস্তির ভয়- এদুটোর কোনোটাই আমার অন্তরে প্রোথিত করা সম্ভব হয় নি। পাছে গৃহকর্মীরা সাজা পাবে এই ভয়ে রবিবার এলে কোনো অজুহাত দেখতাম না।"

শেষ পর্যন্ত রাসেলের ঠাকুরমা'র ইচ্ছানুযায়ী ফলাফল আসে নি। শৈশবে এরকম কঠোর শাসন ও নিয়মের মধ্যে থাকার ফলে বারট্রাণ্ড রাসেলের দৃষ্টিভঙ্গিও তাঁর পিতার মতোই ভিন্নরকমে গড়ে উঠেছিল। পনের বছর বয়সে রাসেল "গ্রীক এক্সারসাইজ" শিরোনামে গ্রীক ভাষায় তাঁর ধর্মবিষয়ক সন্দেহগুলো লিখে রেখেছিলেন। আসলে শনাক্তকরণ এড়াতেই তিনি গ্রীক ভাষার সাহায্য নিয়েছিলেন। আঠারো বছর বয়সে কেমব্রিজে যাবার কিছুকাল আগেই তিনি সকল অনিশ্চিত বস্তুকে পরিত্যাগ করেন এবং নিরীশ্বরবাদী হয়ে ওঠেন।

প্রাথমিক শিক্ষা শেষে ১৮৯০ সালে ক্যামব্রিজের ট্রিনিটি কলেজে ভর্তি হন বার্ট্রান্ড রাসেল। ১৮৯৩ সালে গণিতে প্রথম শ্রেণীতে বিএ পাস করেন। তিনি রাজনৈতিকভাবে হিটলার, সোভিয়েত সর্বাত্মকবাদ ও ভিয়েতনাম যুদ্ধে আমেরিকাবিরোধী ছিলেন। যুদ্ধ ও পরমাণু অস্ত্রের বিরুদ্ধে ছিলেন সদা সোচ্চার। ১৯১৬ সালে যুদ্ধবিরোধী ভূমিকার জন্য ট্রিনিটি কলেজ থেকে বহিষ্কৃত ও ১১০ পাউন্ড জরিমানার শিকার হন। ১৯১৮ সালে যুদ্ধবিরোধী মিছিলে অংশ নেওয়ায় ৫ মাসের কারাদণ্ড ভোগ করেন। ১৯৫০ সালে পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণ আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন বার্ট্রান্ড রাসেল। ১৯৫২ সালে ব্রিটেন প্রথমবারের মতো আণবিক বোমার বিস্ফোরণ ঘটালে রাসেল বিক্ষোভ মিছিলের আয়োজন করেন৷ সরকার তাঁকে ও তাঁর স্ত্রীকে দুই মাসের কারাদণ্ড দেয়৷ ১৯৫৬ সালে ব্রিটেনের সুয়েজ আক্রমণের প্রতিবাদ করেও কারাবরণ করেন৷ ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময় নুরেমবার্গ স্টাইলের ট্রাইবুন্যাল গঠন করে গণহত্যার অভিযোগে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জনসনের বিচার করে যুদ্ধাপরাধী ঘোষণা করেন৷ ১৯৫৮ সালে পরমাণু অস্ত্রবিরোধী আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি হন। ১৯৬১ সালে পরমাণুবিরোধী বিক্ষোভের কারণে এক সপ্তাহ কারাবাস করেন। ষাটের দশকে কিউবা ইস্যুতে আমেরিকা ও সোভিয়েত ইউনিয়নকে যুদ্ধ থেকে নিবৃত্ত করেন৷

ব্রিটেনে রাসেলের পরিবার ছিল একটা রাজনৈতিক পরিবার৷ তার দাদা ছিলেন ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী জন রাসেল৷ রাসেলও কয়েকবার ব্রিটেনের সাধারণ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। কিন্তু জিততে পারেননি৷ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পর্যন্ত ব্রিটেনে নারীদের ভোটাধিকার ছিল না৷ রাসেল তাদের ভোটাধিকারের জন্য সংগ্রাম করে জয়ী হন৷

দর্শন ও গণিতে তার অসাধারণ ভূমিকা রয়েছে। তাকে বিশ্লেষণী দর্শনের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা বিবেচনা করা হয়। তিনি ব্রিটিশ ভাববাদের কড়া সমালোচক ছিলেন। তিনি আকারী যুক্তিবিদ্যা ও বিজ্ঞানকে দর্শনের প্রধান হাতিয়ার মনে করতেন। হোয়াইটহেডের সঙ্গে লেখা প্রিন্সিপিয়া ম্যাথমেটিকা গ্রন্থে তাঁরা গণিতকে যুক্তির ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেন। তাঁর দার্শনিক নিবন্ধ 'অন ডিনোটিং' দর্শনশাস্ত্রে মডেল হিসেবে বিবেচিত হয়। দুটো গ্রন্থই যুক্তি, গণিত, সেট তত্ত্ব, ভাষাতত্ত্ব এবং দর্শনকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে। তিনি ছিলেন একজন প্রখ্যাত যুদ্ধবিরোধী ব্যক্তিত্ব। রাসেল বিশ্বের জাতিসমূহের মধ্যে মুক্ত বাণিজ্যে বিশ্বাস করতেন। তিনি ছিলেন সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী। তিনি তাঁর অহিংস মতবাদ প্রচারের জন্যে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় কারাবন্দী হন। তিনি হিটলারের বিরুদ্ধে প্রচারণা চালান। বারট্রাণ্ড রাসেল সোভিয়েত টোটালিটারিয়ানিজম এবং ভিয়েতনাম যুদ্ধে আমেরিকার অংশগ্রহণের সমালোচনা করেন এবং পরমাণু নিরস্ত্রীকরণের পক্ষে তিনি ছিলেন সর্বদা সোচ্চার। আরেকটি উল্লেখযোগ্য বই 'ইনট্রোডাকশন টু ম্যাথমেটিক্যাল ফিলোসফি'। বারট্রাণ্ড রাসেল প্যারাডক্স নামের বিখ্যাত একটি গাণিতিক ধাঁধা আবিষ্কার করেন।

তার লেখা উল্লেখযোগ্য বই হলো- এ্যান এসে অন দ্য ফাউন্ডেশনস অব জিওমেট্রি (১৮৯৭), দ্য প্রিন্সিপলস অব ম্যাথমেটিকস (১৯০৩), অন ডেনোটিং (১৯০৫), আলফ্রেড নর্থ হোয়াইটহেডের সঙ্গে প্রিন্সিপিয়া ম্যাথমেটিকা (১৯১০-১৯১৩), দ্য প্রব্লেমস অব ফিলোসফি (১৯১২), আওয়ার নলেজ অব দ্য এক্সাটার্নাল ওয়ার্ল্ড এ্যাজ আ ফিল্ড ফর সায়েন্টিফিক মেথড ইন ফিলোসফি (১৯১৪), পলিটিক্যাল আইডিয়ালস (১৯১৭), ইনট্রোডাকশন টু ম্যাথমেটিক্যাল ফিলোসফি (১৯১৯), দ্য এ্যানালাইসিস অব মাইন্ড (১৯২১), পাওয়ার : আ নিউ স্যোশাল অ্যানালাইসি (১৯৩৮), আ হিস্ট্রি অব ওয়েস্টার্ন ফিলোসফি (১৯৪৫) ও দ্য অটোবায়োগ্রাফি অব বারট্রাণ্ড রাসেল (১৯৫১-১৯৬৯)।

তিনি জীবদ্দশায় অনেক সম্মাননায় ভূষিত হন। উল্লেখযোগ্য হলো- রয়েল সোসাইটির সদস্য (১৯০৮), অর্ডার অব মেরিট (১৯৪৯) ও সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার (১৯৫০)।

রাসেল ১৯৭০ সালের ২ ফেব্রুয়ারি মৃত্যুবরণ করেন।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত