ক্যাপ্টেন জেমস কুক

প্রকাশ : ২৭ অক্টোবর ২০১৮, ১০:৫৬

অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসীরা ছিল ম্যালেনেশিয়ান। তাদের হাজার হাজার বছরের ইতিহাসের সঙ্গে পাপুয়া নিউগিনি বা তাহিতির ইতিহাসের মিল আছে। ইউরোপিয়ানদের আগমনের আগে ওরা স্টোন এজ-এ বসবাস করত। এর প্রধান কারণ ছিল, সমুদ্রের মাঝখানে ওরা হাজার হাজার বছর সমগ্র পৃথিবী থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন ছিল। ১৭৭০ সালের ২৩ এপ্রিল ক্যাপ্টেন জেমস কুক 'এনডিভার' নামের জাহাজবহর নিয়ে অস্ট্রেলিয়া আবিষ্কার করেন। তিনি জাহাজগুলো নোঙর করে মাটিতে পা রেখেই দেখলেন, এক আদিবাসী নারী তার তিন সন্তান নিয়ে গাছের শুকনো ডাল কুড়াচ্ছে। ওদের পরনে একটুকরোও কাপড় নেই। তিনি হেঁটে গিয়ে খানিকটা দূরে দেখতে পান, চারটা ছোট নৌকায় আটজন আদিবাসী পুরুষ সমুদ্রের কিনার ধরে বর্শা দিয়ে মাছ ধরছে। তিনি তার সঙ্গে আসা তাহিতিয়ান সর্দার তোপিয়ার মাধ্যমে ওদের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করেন। কিন্তু ওরা ভীত হয়ে তৎক্ষণাৎ নৌকা নিয়ে পালিয়ে যায়। ক্যাপ্টেন কুক অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে যেখানে প্রথম পা রাখেন, সে স্থানটা এখন আধুনিক সিডনির বোটানি বে। সমুদ্রের দিকে হেলে পড়া অসংখ্য গাছ দেখে তিনি এই নামকরণ করেছিলেন।

ক্যাপ্টেন জেমস কুক ছিলেন অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রধান ইংরেজ অভিযাত্রী, নাবিক ও মানচিত্রবিদ। প্রশান্ত মহাসাগর, নিউজিল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়া ভ্রমণ করে তিনি প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের মানচিত্র তৈরি করেন, যা পশ্চিমাঞ্চলের ভৌগোলিক রহস্য উন্মোচন করে। জেমস কুকের জন্ম ১৭২৮ সালের ২৭ অক্টোবর ইংল্যান্ডের ইয়র্কশায়ারের মিডলস ব্রোর কাছাকাছি এক ছোট গ্রামে। তাঁর বাবা ছিলেন খামারকর্মী। কয়লা বহনকারী একটি জাহাজে কুক জাহাজ চালানো শেখেন। ১৭৫৫ সালে জেমস কুক ব্রিটিশ রয়েল নেভিতে যোগদান করেন। ১৭৬৮ সালে তিনি প্রশান্ত মহাসাগরে একটি বৈজ্ঞানিক গবেষণাকাজের কমান্ডার নিযুক্ত হন। ১৭৬৮ থেকে ১৭৭১ সালে তিনি জাহাজে করে পৃথিবী প্রদক্ষিণ করেন এবং নিউজিল্যান্ড ও পূর্ব অস্ট্রেলীয় উপকূলীয় অঞ্চল আবিষ্কার করেন। কুক তিন হাজার ২০০ কিলোমিটার অস্ট্রেলীয় উপকূল জরিপ করে অস্ট্রেলিয়া ও নিউগিনির মধ্যবর্তী জলপথের অস্তিত্ব সম্পর্কে নিশ্চিত হন। তিনিই প্রথম নিউজিল্যান্ড উপকূলের ম্যাপ তৈরি করেন। ১৭৭২ থেকে ১৭৭৫ সালে তিনি ‘রেজোল্যুশন’ ও ‘অ্যাডভেঞ্চার’ নামের দুটি জাহাজ নিয়ে দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগর ও নিউ হেব্রাইডিস ভ্রমণ করে নিউ ক্যালেডোনিয়া ও নরফোক আবিষ্কার করেন। সেই অভিযানে তিনি প্রশান্ত মহাসাগরের নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলে অ্যান্টার্কটিকা মহাদেশের অবস্থান সম্পর্কেও ধারণা লাভ করেন। ১৭৭৮ সালে ক্রিসমাস ও হাওয়াই দ্বীপ আবিষ্কার করেন তিনি। কুকই সমুদ্রযাত্রায় প্রথম বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতি প্রয়োগ ও উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করেন। জাহাজে যাত্রীদের স্কার্ভি রোগ প্রতিরোধে তিনি কার্যকর স্বাস্থ্যবিধি তৈরি করতে সক্ষম হয়েছিলেন।

১৭৭০ সালে অস্ট্রেলিয়ার দক্ষিণ-পূর্ব উপকূলে পৌঁছে ব্রিটিশ রাজার তরফে সেই অঞ্চলের দখল নেন ক্যাপ্টেন জেমস কুক। অবশ্য এর ১৬৪ বছর আগেই সেখানে পৌঁছে গেছিল ওলন্দাজরা। কুক আসার পরেই অস্ট্রেলিয়ায় উপনিবেশ স্থাপনের কাজ শুরু হয়। দেশজ মানুষদের জমি কেড়ে নেওয়া হয়, তাদের অনেকেরই প্রাণ যায়। ক্রমে ক্রমে তারা জমি, নাগরিকত্ব, সমান মর্যাদার অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়। নিউ সাউথ ওয়েলস বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্দেশিকায় তাদের ‘ইন্ডিজিনাস টারমনোলজি গাইড’ শিক্ষক ও ছাত্রছাত্রীদের ‘সেটেল্ড’ বা ‘ডিসকভার্ড’-এর বদলে ‘ইনভেডেড’ শব্দটা ব্যবহার করতে বলেছে। অর্থাৎ স্বীকার করা হচ্ছে ব্রিটিশরা অস্ট্রেলিয়া ‘আবিষ্কার’ করেনি, বা সেখানে গিয়ে ‘বসতি স্থাপনও করেনি’, স্রেফ অস্ট্রেলিয়া ‘আক্রমণ করেছিল’। এখানেই শেষ নয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্দেশিকায় আদি বাসিন্দাদের ‘অ্যাবোরিজিনস’ বা ‘আদিম অধিবাসী’ না বলে ‘ইন্ডিজিনাস অস্ট্রেলিয়ান পিপল্‌’ বা ‘দেশজ অস্ট্রেলীয় মানুষ’ বলার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

নির্দেশিকায় ব্যাখ্যা করে বলা হয়েছে, ক্যাপ্টেন জেমস কুক অস্ট্রেলিয়া ‘আবিষ্কার’ করেছিলেন, এ কথা বলা ‘আপত্তিকর’। ‘বসতি’ বললে দেশজ মানুষদের জমি যে ‘চুরি’ করা হয়েছিল সেই ব্যাপারটি অগ্রাহ্য করা হয়। নির্দেশিকায় পরিষ্কার বলা হয়েছে, “অস্ট্রেলিয়ায় শান্তিপূর্ণ ভাবে বসতি স্থাপন করা হয়নি, সে দেশ আক্রমণ করা হয়েছিল, দখল করা হয়েছিল এবং উপনিবেশ স্থাপন করা হয়েছিল। ইউরোপীয়দের আগমনকে যদি ‘বসতি স্থাপন’ হিসাবে বর্ণনা করা হয়, তবে তা হল অস্ট্রেলিয়ার ইতিহাসকে ইংল্যান্ডের তট থেকে দেখার চেষ্টা, অস্ট্রেলিয়ার তট থেকে নয়।"

১৭৭২ সালে জেমস কুক দ্বিতীয় সমুদ্রযাত্রায় বেরিয়ে এন্টার্কটিকা অঞ্চল ভ্রমণ করেন। আবিষ্কার করেন ক্যালিডোনিয়া। ১৭৭৬ সালে তিনি তাঁর জীবনের তৃতীয় ও শেষ সমুদ্রযাত্রা শুরু করেন। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল ইংল্যান্ড থেকে প্রশান্ত মহাসাগরের উত্তর-পশ্চিম বরাবর একটি সমুদ্রপথ আবিষ্কার করা। ওয়াইমিয়া অধিবাসীদের কাছ থেকে কুক উষ্ণ অভ্যর্থনা পান। ইউরোপিয়ানদের জাহাজ, বেশভূষা আর ধাতব জিনিসপত্রের ব্যবহার তাদের অসম্ভব রকম প্রভাবিত করে। ক্যাপ্টেন কুক দ্বীপবাসীদের সাথে ব্যবসায়িক সম্পর্ক শুরু করেন। ফসল ও মাছের বিনিময়ে লোহা ও ধাতব বস্তু বিক্রয় করেন। এভাবে বছর খানেক যাওয়ার পর, চুরির উৎপাত বেড়ে যায়। ফলে জাহাজ দু'টি নিয়ে ক্যাপ্টেন কুক ওয়াইমিয়া থেকে কিয়ালাকেকুয়ার উপকূলে স্থানান্তরিত হন। তখন কিয়ালাকেকুয়ায় চলছে ঐতিহ্যবাহী ফসলি উৎসব 'মাকাহিকি'। দেবতা 'লোনো'- এর সন্তুষ্টির জন্য পূজা-অর্চনা ও বিভিন্ন খেলায় মেতে আছে দ্বীপের সকল অধিবাসী। লোনো হচ্ছেন ফসল, উর্বরতা ও বৃষ্টির দেবতা। বিভিন্ন রূপ ধারণ করে তিনি দক্ষিণ বায়ুপ্রবাহের সাথে প্রতিবছর আসেন এই পৃথিবীতে। দ্বীপের অধিবাসীরা হঠাৎ একদিন দেখলো একটি বজরায় করে একদল শ্বেতকায় মানুষ তীরে ফিরছে, তাদের সম্মুখে দেব-প্রতিম এক মুখ। সকলের ভেতর আনন্দের বন্যা বয়ে গেলো - লোনোর আবির্ভাব ঘটেছে তাদের মাঝে। খবর রটে গেলো - লোনো তার দেবদূতদের সাথে করে কিয়ালাকেকুয়ায় ফিরে এসেছে। তাদের সুখ ও সমৃদ্ধির দিন ফিরে আসছে। দেবতা হিসেবে সবাই যাকে সাদরে গ্রহণ করলো, তিনি আর কেউ নন, ক্যাপ্টেন জেমস কুক। এভাবে ভালোই দিন যাচ্ছিলো কুকদের, সহজ ব্যবসা ও জনগণের ভালবাসা, আদর-আপ্যায়নের ভেতর দিয়ে। তবে এর ভেতর একদিন ক্যাপ্টেনের এক ক্রু মারা যায়। এই বিষয়টি কিয়ালাকেকুয়াদের মনে নাড়া দেয়। কারণ, দেবতারা অমর, তাদের মৃত্যু- অসুখ ছুঁতেপারে না। তার মানে, এতদিন যাদের দেবতুল্য বলে ভেবে এসেছে, তারা খুবই সাধারণ মানুষ। এরপর থেকে ক্যাপ্টেনদের সাথে কিয়ালাকেকুয়াবাসীদের সম্পর্ক শীতল হয়ে আসতে লাগলো।

কিয়ালাকেকুয়া থেকে জেমস কুক নোঙর তুললেন ১৪ ফেব্রুয়ারি, ১৭৭৯ সালে। কিন্তু বৈরী আবহাওয়া ও সামুদ্রিক ঝড়ের তাণ্ডবে 'রেজোল্যুশন' জাহাজের অনেক ক্ষতি সাধিত হলো। অবস্থা বেগতিক দেখে হপ্তা-খানেকের ভেতর আবার কিয়ালাকেকুয়ায় তারা ফিরে এলেন। এবার কিয়ালাকেকুয়াবাসীদের ভেতর একটা অসন্তোষ দেখা দিলো। কিছুদিনের ভেতর জাহাজে চুরির পরিমাণ গেলো বেড়ে। একদিন জাহাজ থেকে তীরে আসার জন্য বজরাটি চুরি হয়ে গেলো। জেমস কুক পড়লেন মহাবিপাকে। তিনি কিয়ালাকেকুয়া প্রধানের সাথে অতিসত্বর আলোচনায় বসলেন। সেদিন কোনো কিছুতেই সমস্যা মিটলো না। সভার মধ্যে পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে উঠলে ক্যাপ্টেনের এক ক্রু এক হাওয়াইয়ানকে দুম করে গুলি করে বসে। অমনি একটা বিশাল হট্টগোল বেঁধে যায় তাদেরকে ঘিরে। এই হট্টগোলের ভেতর কোনো একজনের ছোঁড়া পাথরের আঘাতে ভীষণভাবে আহত হন জেমস কুক। তখন ব্রিটিশ ও হাওয়াইয়ানদের ভেতর যুদ্ধ শুরু হয়ে যায় বলতে গেলে। মাস্কেট আর গাদাবন্দুকের বিরুদ্ধে বল্লম ও পাথর বৃষ্টি। এর ভেতরই মারা যান ক্যাপ্টেন কুক, যিনি দিন-কয়েক আগেও ছিলেন একজন দেবতা। জেমস কুকের শবদেহ উদ্ধার করে পরে কিয়ালাকুয়াতেই সমাধিস্থ করা হয়। এরপর রেজোল্যুশন ও ডিসকভার ফিরে আসে ইংল্যান্ডে। ক্যাপ্টেন কুক নিহত হয়েছিলেন ১৭৭৯ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারিতে, তখন তার বয়স মাত্র ৫০ বছর।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত