জন্মদিনের শ্রদ্ধাঞ্জলি

বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়

প্রকাশ : ১২ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ১৩:০৮

১.
গ্রামীণ জীবনের অসামান্য রূপকার, নিম্নবর্গের কথাশিল্পী বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়। আদি প্রাণের আধুনিক বন্দনাকার বিভূতিভূষণ নাকি নিসর্গ চেতনার বাতিঘর বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়- এরকম নানাভাবে, বিভিন্ন অভিধায় তাকে অভিহিত করা যায়, যেতে পারে। কোনটাই অতিকথন বা অতিমূল্যায়ণ দোষে দুষ্ট হবে না হয়ত। বাংলা ভাষার সেই মহান কথাসাহিত্যিক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় ১৮৯৪ খ্রিস্টাব্দের ১২ সেপ্টম্বর পশ্চিমবঙ্গের চবিবশ পরগনা জেলার কাঁচরাপাড়ার নিকটবর্তী ঘোষপাড়া-মুরারিপুর গ্রামে মাতুলালয়ে জন্মগ্রহণ করেন। মানুষের মহান কথাকারের স্মৃতির প্রতি জানাই বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি। উল্লেখ্য যে, তিনি ১৯৫০ সালের ১ নভেম্বর তিনি মৃত্যুবরণ করেন। আমার একজন প্রিয় লেখক বিভূতিভূষণ সম্পর্কে আরেকজন প্রিয় কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হকের আলোকিত বচন মনে পড়ছে, তিনি বলছেন,‘তুচ্ছের মধ্যে অমৃতের সন্ধান করে গেছেন বিভূতিভূষণ। কীভাবে তা মিলতে পারে অমৃতের স্বাদ নিতে নিতেই আমাদের তা জানিয়ে গেছেন। আমাদের নিজেদের অমৃত মিলুক আর না মিলুক, তাঁর লেখা পড়েই বুঝতে পারি সমস্ত জীবনে তাঁর এ বস্তুর গরমিল হয়নি।

২.
সাহিত্য সমালোচকগণ বলছেন, বিভূতিভূষণ যে মানবজগৎ সৃষ্টি করেছিলেন তা সারল্যে অসাধারণ। সনাতন গ্রামবাংলার জনজীবনের চিরায়ত ছবি তিনি এঁকেছেন নিপুণ, দক্ষ শিল্পকুশলতায়। গভীর মমতায়, শ্রমে তিনি এই কীর্তি স্থাপন করে গেছেন। কথাশিল্পী হিসেবে আশ্চর্যরকম সফল তিনি। গ্রামীণ জীবনের শান্ত, সরল, স্নিগ্ধ ও বিশ্বস্ত ছবি ফুটে ওঠে তাঁর নিরাসক্ত কথকতা ও বয়ানে, চুম্বকের মতো টেনে নেয় পাঠককে। মুগ্ধ করে, বিস্মিত করে। অথচ পথের পাঁচালী, অপরাজিত, আরণ্যক, ইছামতির মতো অসামান্য সব উপন্যাসের রচয়িতা বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখালেখির জীবন ছিল স্বল্প। মাত্র আঠাশ বছর। এই লেখকের আয়ু ছিল মাত্র ৫৬ বছর। তাঁর রচনাসম্ভারের মধ্যে রয়েছে ১৫টি উপন্যাস, সাতখানা কিশোর উপন্যাস, দুইশ’র বেশি ছোটগল্প। পনেরোটি উপন্যাসের মধ্যে একটি ছিল অসমাপ্ত। শিশু-কিশোর উপন্যাসের মধ্যে তিনটি হলো বয়স্কপাঠ্য উপন্যাসের কিশোর সংস্করণ। এসবের বাইরে অন্যান্য বিষয়েও তিনি লিখে গেছেন। সেগুলোর সংখ্যা নিতান্ত কম নয়। তার মধ্যে রয়েছে ভ্রমণকাহিনী, ডায়েরি, প্রবন্ধ, অনুবাদ। ব্যাকরণ বইও তিনি লিখেছেন। উপন্যাস ও ছোটগল্প, ভ্রমণ-দিনলিপি এবং কিশোরদের উপযোগী রচনা-গদ্য সাহিত্যে এ চারটি কীর্তিস্তম্ভের ওপর বিভূতিভূষণের সাহিত্যিক কৃতিত্ব। এ চারটি কিন্তু একে অপরের থেকে কোনো অর্থেই ভিন্ন নয়। সুরে, বিষয়-নির্বাচনে, প্রশান্ত চিত্তের সহৃদয়তায় এগুলো যেমন সরস তেমনি জীবনরসে পূর্ণ। বিভূতিভূষণের অস্তিত্ব জুড়ে আমৃত্যু-প্রথম আবির্ভাবের পর থেকে শ্রীমান অপু বিরাজিত। তার বিস্ময়ভরা দৃষ্টি দিয়ে বিভূতিভূষণ চারপাশের মানুষকে, প্রকৃতিকে দেখছেন এবং আনন্দিত হয়েছেন। সুখে দুঃখে তার সমান আনন্দ, কারণ বালকের মন সহজে দুঃখের স্মৃতি ভুলে যায়। অভাব-অভিযোগের মধ্যেও একটা সুখের কল্পরাজ্য তৈরি করে নেয়। আবার, বিভূতিভূষণের শিল্পী ব্যক্তিত্বের পরিচয় নিতে গেলে আরো একটি দিকে লক্ষ্য না করে পারা যায় না। একদিকে একান্ত লৌকিক জীবন অতিসাধারণ ও প্রাত্যহিক, পরিচিত প্রকৃতি, বাস্তব অরণ্য-যার ভূগোল আছে, অন্যদিকে আছে অলৌকিক, অতি প্রাকৃতের প্রতি আকর্ষণ। তিনি একালের শিল্পী হয়েও ধর্মে আস্থাবান ছিলেন এবং পরলোক, জ্যোতিষবিদ্যা, মৃত্যুর পরবর্তী অস্তিত্ব এবং অন্যান্য বিবিধ অতিপ্রাকৃতে বিশ্বাস করতেন। এর কারণ হিসেবে তার জীবনী থেকে জানা যায়, যখন ছাত্র ছিলেন, তখন তেইশ বছর বয়সে বিয়ে করেন। বিয়ের বছরখানেক বাদে স্ত্রী গৌরী মারা গেলেন নিউমোনিয়ায়। এর কিছুদিনের মধ্যেই ছোট বোন মণির মৃত্যু ঘটে সন্তান প্রসব করতে গিয়ে। এই দু’টি মর্মান্তিক ঘটনায় তিনি মারাত্মক আঘাত পেলেন মনে। ধারণা করা হয়, তাঁর পরলোকে বিশ্বাস, পরলোকতত্ত্ব বিষয়ে পড়াশোনা এবং চর্চার কারণ ওই দু’টি বিয়োগান্তক ঘটনা। প্রথমা স্ত্রীর মৃত্যুর দীর্ঘ ২২ বছর পরে আবার বিয়ে করেন বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়।

৩.
ইংরেজ শাসনের অব্যবহিত ফল হিসেবে বাংলাদেশে যে সাহিত্যের জন্ম, রামমোহন থেকে রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত যার বিস্তার। তাকে বাংলা সাহিত্যের ‘স্বর্ণযুগ’ বলা যাক বা না যাক, মার্কসীয় পদ্ধতিতে তার বিচার করতে গেলে আমাদের মনে রাখতে হবে, মার্কসবাদী-লেনিনবাদী সাহিত্যবিচারের মূল সূত্র : সাহিত্য হচ্ছে সামাজিক বাস্তবের প্রতিফলন, সমাজের স্তরে স্তরে শ্রেণী সংঘর্ষের প্রভাবে নিত্য যে আলোড়ন চলছে, বিভিন্ন ব্যক্তি বা গোষ্ঠী বিভিন্নভাবে তাতে সাড়া দেয়। এই শ্রেণীদ্বন্দ্বের ভেতর দিয়ে নির্বাচিত হয় সমাজের বিন্যাস কীভাবে পরিবর্তিত হয়, এ সমাজের গতি যাবে কোন দিকে। সাহিত্য এই শ্রেণীচেতনা হতে সৃষ্ট হয়ে সামাজিক পরিবেশের ওপর প্রতিঘাত করে। ‘লেখকমাত্রই মেধাবী’ কথাটি নিয়ে যথেষ্ট বিতর্ক রয়েছে সাহিত্য বোদ্ধামহলে। তবে একজন লেখক যে প্রখর আত্মমর্যাদাবোধসম্পন্ন হবেন তা নিয়ে সন্দেহ থাকার কথা নয়। একজন বড় সাহিত্যিকের ‘টোটাল’ পরিচয় নিহিত থাকে তার সাহিত্যকর্মের ব্যাপ্তি ও বহুমুখীনতায়। বহুবিধ সংযোগ ও লিখন প্রতিভার গুণে একজন সৎ সাহিত্যিক নিজের জন্য পাঠক-বোদ্ধামহলে স্থায়ী আসন করে নিতে সম। এ ক্ষেত্রে লেখক তার চারিত অভিজ্ঞানের বিস্তৃতি ঘটান তার সৃষ্টিকর্মে। সমাজ, রাষ্ট্র, পরিবেশ, প্রতিবেশ, অর্থনীতি থেকে শুরু করে সমাজের প্রতিটি স্তরের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিষয়াবলী তাকে পরিমার্জিত শৈলীতে উপস্থাপন করতে হয় তার সাহিত্যে। যাপনের এমন কোনো বিষয়-আশয় নেই যা একজন সাহিত্যিক স্পর্শ করতে অম। যে কারণে সৎ সাহিত্যিকের হাতে রচিত সাহিত্যকর্ম যুগ যুগ ধরে পাঠক তার অন্তঃস্থলে ধরে রাখে। অনেক সময় দেখা যায়, আপাতসরল দৃষ্টিতে সমাজ সম্পর্কে উদাসীন সাহিত্যিকের রচনাতেও গভীরভাবে উঠে আসে তৎকালীন সমাজ ব্যবস্থার অনুপুঙ্খ বাস্তবতা। এক্ষেত্রে সাহিত্যিক অনেকটা অজ্ঞাতসারেই তার লক্ষ্যে পৌঁছাতে সম হন। এরূপ রচনা পাঠে আলোচকরা প্রথমদিকে রচনাটির শিল্পমূল্য নিয়ে সংশয় প্রকাশ করলেও সেটির নিবিড় পাঠ ও পর্যালোচনায় আবিস্কৃত হয় অপরিমেয় শিল্পমূল্য এবং সমাজ মূল্য। এ ধরণের সাহিত্য পাঠে সাহিত্যিকের এক ধরণের নিরীক্ষাপ্রবণ মানসিকতার সঙ্গে পাঠকের পরিচয় ঘটে। উন্মেষ ঘটে লেখকের শ্রেণীসচেতনতার। লিখনীতে মানব-সংসারের বিচিত্রতা তেমনভাবে ফুটে ওঠেনি এমন অভিঘাতে জর্জরিত হতে হয় ‘পথের পাঁচালী’র অমর রূপকার বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়কে। তাহলে প্রশ্ন জাগে- বিভূতিভূষণ কি শ্রেণীচেতন ছিলেন না? মানুষের জীবন-যাপনের প্রতিমুহূর্তের বিবর্তিত অবস্থা, সংঘাত জানতেন না তিনি? প্রকৃতার্থে বিভূতিভূষণ রচিত উপন্যাস কিংবা ছোটগল্পের চরিত্র স্থান, কাল, পাত্র সমন্বয়িত হতে দেখা যায় সুষম বিন্যাসে। উপন্যাসিক হিসাবে বিভূতিভূষণের খ্যাতি বেশি হলেও তার গল্পগুলোতে আবেগঘন পরিস্থিতির প্রাধান্য থাকায় সমকালীন অনেক সমালোচক তার ব্যাপারে ঔদাসীন্য দেখিয়েছেন। সমাজতন্ত্রবাদী লেখক ও সমালোচকরাও তাকে এড়িয়ে গেছেন। অথচ তার ‘মেঘ মল্লার’ (১৯৩১), ‘মৌরীফুল’ (১৯৩২), ‘জন্ম ও মৃত্যু’ (১৯৩৮), ‘নবাগত’ (১৯৪৪) গ্রন্থের গল্পগুলো শ্রেণীচেতন বিভায় সমুজ্বল। বিভূতিভূষণের রচনাতে একদিকে যেমন ফুটে ওঠে শ্রেণী-বৈষম্য তেমনি রয়েছে নর-নারীর শ্বাশত রোমান্টিকতা। রয়েছে প্রকৃতি অবলোকনের অপূর্ব দর্শন। ইউরোপ-আমেরিকার নবজীবন-চেতনার প্রবাহ এবং প্রথম বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তীকালে সামাজিক ও নৈতিক অবস্থার পরিবর্তনের প্রবল হাওয়ায় তৎকালীন ভারতের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে নাগরিক জীবনের আলোড়ন, আক্ষেপ, হতাশা নানামুখী বৈশিষ্ট্য নিয়ে তার রচনাশৈলীতে স্পষ্টভাবেই মুদ্রিত।
 
৪.
বাংলা উপন্যাসে জনপ্রিয়তার শীর্ষবিন্দু স্পর্শকারীদের মধ্যে ঔপন্যাসিক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় (জন্ম সেপ্টেম্বর, ১৮৯৪- মৃত্যু. ১ নভেম্বর, ১৯৫০) অন্যতম। বঙ্কিম-রবীন্দ্রনাথ-শরৎচন্দ্রের পর বাংলা উপন্যাসের প্রবহমান ধারায় তিনি যুক্ত হন বিশ শতকের তিনের দশক শুরুর প্রাকলগ্নে। 'পথের পাঁচালী' (১৯২৯) নিয়ে উপন্যাসের ভুবনে তার প্রথম আত্মপ্রকাশ ঘটে। এরপর তাকে আর ফিরে ডাকাতে হয়নি। বাংলা শ্রেষ্ঠ উপন্যাসগুলোর তালিকায় স্থান করে নেয় 'পথের পাঁচালী'। এরপর তিনি রচনা করেন আরো ১৩টি উপন্যাস। ফলে তার মোট উপন্যাসের সংখ্যা দাঁড়ায় ১৪টিতে। এগুলো হলো- 'অপরাজিত' (প্রথম ও দ্বিতীয় খণ্ড, ১৯৩২),' দৃষ্টিপ্রদীপ' (১৯৩৫), 'আরণ্যক' (১৯৩৯), 'আদর্শ হিন্দু হোটেল' (১৯৪০), 'বিপিনের সংসার' (১৯৪১), 'দুই বাড়ি' (১৯৪১), 'অনুবর্তন' (১৯৪২), 'দেবযান' (১৯৪৪), 'কেদার রাজা' (১৯৪৫), 'অথৈ জল' (১৯৪৭), 'ইছামতী' (১৯৫০), 'দম্পতি' (১৯৫২) ও 'অশনি সঙ্কেত' (১৯৫৯)। তার সমকালে আর দুজন দাপুটে ঔপন্যাসিক ছিলেন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় (১৯ মে, ১৯০৮-৩ ডিসেম্বর, ১৯৫৬) ও তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় (২৪ জুলাই, ১৮৯৮-১৪ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১)।কিন্তু নিভৃতচারী এই কথাশিল্পীই রচনায় পল্লীর জীবন ও নিসর্গ রূপায়ণে বাংলার আবহমানকালের চালচিত্র ও মানবজীবনের অন্তর্লীন সত্তা প্রকাশিত হয়েছে। তাঁর রচনায় প্রকৃতি কেবল প্রকৃতিরূপেই আবির্ভূত হয়নি, বরং প্রকৃতি ও মানবজীবন একীভূত হয়ে অভিনব রসমূর্তি ধারণ করেছে। মানুষ যে প্রকৃতিরই সন্তান এ সত্য তাঁর বিভিন্ন রচনায় প্রতিফলিত হয়েছে। প্রকৃতির লতাপাতা, ঘাস, পোকামাকড় সবকিছুই গুরুত্বের সঙ্গে স্বস্বভাবে তাঁর রচনায় স্থান পেয়েছে। প্রকৃতির অনুপুঙ্খ বর্ণনার মধ্য দিয়ে বিভূতিভূষণ গভীর জীবনদৃষ্টিকেও তুলে ধরেছেন। তবে তাঁর রচনায় নিম্ন মধ্যবিত্ত বাঙালির জীনবচিত্র ও সমকালের আর্থসামাজিক বাস্তবতাও সমভাবে উন্মোচিত হয়েছে। তাই বাংলা কথাসাহিত্যে শরৎচন্দ্রের পরে বিভূতিভূষণই সর্বাপেক্ষা জনপ্রিয় সাহিত্যিকের মর্যাদা পেয়েছেন।

৫.
মানুষের মতোই প্রকৃতিও রহস্যময় এবং বৈচিত্র্যময়। এই রহস্যময়ী মানুষ ও প্রকৃতিকে পৃথক স্বাধীন মাত্রা দিয়েছেন বিভূতিভূষণ। প্রকৃতির নিগূঢ় সত্তাকে উন্মোচিত করেছেন শৈল্পিক দৃষ্টিভঙ্গিতে। তার শিল্পজগৎ প্রকৃতির বিচিত্র রূপ-রস অনুভূতির আনন্দে বিহ্বল। তিনি অধিকাংশ নিসর্গ কবিদের মতো প্রকৃতির জড়-সৌন্দর্য শুধু নয় জৈবিক মানবজীবনকেও এঁকেছেন একই ক্যানভাসে। প্রকৃতি সম্পর্কে এই ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি তার একান্ত নিজস্ব মৌলিকতা। বিভূতিভূষণের কাছে কোনো নীতি, তত্ত্ব বা মূল্যবোধের কোনো বিচ্ছিন্ন অর্থ ছিল না, যদি না সেসব নীতি, তত্ত্ব বা মূল্যবোধ মানুষকে আশ্রয় দিতে না পারে। সুতরাং এ কথা বলা মোটেও অসঙ্গত নয় যে, গ্রামীণ জীবনের নীতিবোধ ও মূল্যবোধের রক্ষণশীলতা বিভূতভূষণ সমর্থন করেননি। তিনি শ্রেণী বিদ্বেষীও নন কিংবা ব্যক্তিগতভাবেও কাউকে ঘৃণার চোখে দেখেননি। যে কারণে তার অধিকাংশ ছোটগল্পই গ্রামীণ জীবনের শান্তি ও পারস্পরিক নিশ্চিন্ততা নিয়ে বেড়ে ওঠে। তিনি নিজে বলেছেন, ‘সাহিত্য আমাদের কল্পনা ও অনুভব-বৃত্তিকে উজ্জীবিত করে।... কবি, সাহিত্যিক ও শিল্পী যত কথা বলেন, তার মর্ম এই যে আমাদের ধরণী ভারী সুন্দর- একে বিচিত্র বললেই বা এর কতটুকু বোঝান হলো! আমাদের এ দৃষ্টিটি বারে বারে ঝাপসা হয়ে আসে, প্রকৃতির বাইরেকার কাঠামোটাকে দেখে আমরা বারে বারে তাকে ‘রিয়ালিটি’ বলে ভুল করি, জীবন-নদীতে অন্ধ গতানুগতিকতার শেওলাদাম জমে, তখন আর স্রোত চলে না; তাই তো কবিকে, রসস্রষ্টাকে আমাদের বারবার দরকার- শুকনো মিথ্যা-বাস্তবের পাঁক থেকে আমাদের উদ্ধার করতে।’ 

৬.
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় প্রকৃতির রূপকার, আর এই প্রকৃতিকে আশ্রয় করে তার আড়ালে তিনি আমাদের শোনান নিম্নবর্গের মানুষের জীবনকথা, তাঁর সাহিত্যের একটা বিরাট অংশজুড়ে রয়েছে অবহেলিত, নির্যাতিত মানুষের জীবনভাষ্য; তিনি চেয়েছিলেন যেসব জীবন অখ্যাতির আড়ালে আত্মগোপন করে আছে, তাদের সুখ-দুঃখকে সাহিত্যে রূপায়ণ করতে, তাই তাঁর সাহিত্য ক্যানভাসে সাধারণ মানুষের, নিম্নবর্গের মানুষের ভিড়/ মিছিল লক্ষণীয়; যে মানুষগুলো সমাজের প্রান্তে বাস করার সঙ্গে সঙ্গে এমন এক পেশাকে অবলম্বন করে জীবনকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যায়, যা পায় না সমাজে উচ্চ মর্যাদা বা স্বীকৃতি, তাই তাদের পেশা হয়ে থাকে ভিক্ষুক, ফকির, ফেরিওয়ালা, জুয়া খেলুড়ে, বাড়ির পাচক, দরিদ্র স্কুল শিক্ষক, মুহুরি, ওষুধ বিক্রেতা, টিউবওয়েলের ব্যবসাদার, মুচি, পটল ব্যবসায়ী, ঘুণ ব্যবসাদার, কুলিগিরি, স্টেশনের সিগন্যাল ক্লার্ক, পতিতা প্রভৃতি। আর এসব পেশাকে অবলম্বন করে বিভূতিভূষণের গল্পের নিম্নবর্গরা পোকামাকড়ের মতো জীবনকে টেনে এগোতে থাকে সামনের দিকে, পার করতে থাকে দিনগুলো। আর তাদের অর্থনীতি ভীষণ ভঙ্গুর ‘নুন আনতে পান্তা ফুরানোর’ মতো, একটা জোটে তো আরেকটা জোটে না, দারিদ্র্য নির্মাণ করে চারপাশের পরিবেশ।

৭.
বিভূতিভূষণ আপাদমস্তক একজন প্রকৃতিপ্রেমিক। তিনি অরণ্য-জঙ্গল-ঝোপঝাড়ের গাছ-গাছালির মধুর সৌন্দর্য শুধু নিজেই বিমুগ্ধ হয়ে উপভোগ করেননি, পাঠকদের কাছেও সেই সুন্দর মনোহর রূপটি তুলে ধরেছেন। তার উপন্যাস পড়ার পর পাঠক এতটাই অভিভূত ও তৃপ্ত হন যে বিভূতিভূষণের বর্ণিত অপরূপ ছবি নিজের চোখে না দেখলেও তা জীবন্ত হয়ে তাদের মনের পর্দায় ভেসে থাকে। এ কথা যেমন 'পথের পাঁচালী'র বেলায় সত্য তেমনি সত্য 'আরণ্যক' বা 'ইছামতী'র বেলায়ও। ‘পথের পাঁচালী’ বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের অনন্য কীর্তি। বিশ্বনন্দিত চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায় এটির চলচ্চিত্রায়ন করেন। ফলে এই উপন্যাসের খ্যাতির পরিধি বহির্বিশ্বেও ছড়িয়ে পড়ে। বিভূতিভূষণ সাহিত্য অঙ্গনে প্রবেশ করেন এই উপন্যাসটির মধ্য দিয়েই। এটিই তাঁর প্রথম উপন্যাস, একই সঙ্গে প্রথম প্রকাশিত গ্রন্থও। পথের পাঁচালী প্রথমে ধারাবাহিকভাবে বের হয়েছিল মাসিকপত্র ‘বিচিত্রা’য়। এক বছরেরও বেশি সময় লেগেছিল এতে। বই আকারে এটি বের হয় ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দে, ১৩৩৬ বঙ্গাব্দের আশ্বিন মাসে। এ বই বেরুবার আগে সাময়িকপত্রে এই লেখকের কয়েকটি ছোটগল্প প্রকাশিত হয়। লেখক হিসেবে সামান্য পরিচিতি ছিল তখন। সেই সময় এ বিশাল আয়তন উপন্যাসের প্রকাশক জোগাড় করার কাজটি সহজ ছিল না। ঝুঁকি নিয়ে এ দায়িত্ব কাঁধে নিয়েছিলেন সজনীকান্ত দাস। তার নিজস্ব কোনো প্রকাশনা সংস্থা ছিল না। শুধু এ বইটা বের করার জন্যই তিনি ‘রঞ্জন প্রকাশালয়’ প্রতিষ্ঠা করেন। ‘পথের পাঁচালী’ বই হিসেবে বেরুবার আগেই বিচিত্রা পত্রিকায় এর বিজ্ঞাপন প্রকাশিত হতে থাকে। সেই বিজ্ঞাপনে বলা হয়, বইটির দাম রাখা হবে তিন টাকা। বিজ্ঞাপন ছিল এরকম : “শ্রীবিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় প্রণীত বাঙলা ভাষায় সম্পূর্ণ নূতন ধরনের উপন্যাস। শিশুমনের দুর্জ্ঞেয় রহস্য ইতিপূর্বে আর কেহ এদেশে এরূপভাবে উদ্ঘাটিত করেন নাই; অন্য দেশেও কেহ করিয়াছেন কি না আমাদের জানা নাই। উপন্যাসখানি ‘বিচিত্রা’য় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হইতেছে। ইতিমধ্যেই সাহিত্য-রসিক মহলে ইহার সম্বন্ধে বিস্তর আলোচনা হইয়াছে।”রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘পথের পাঁচালী’ উপন্যাস সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন যে, ‘বইখানা দাঁড়িয়ে আছে আপন সত্যের জোরে।’

৮.
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘আরণ্যক’ আমার আরেকটি প্রিয় উপন্যাস। যখন জঙ্গলমহালের কর্মরত ছিলেন, তখনই ভেবেছিলেন অরণ্যজীবনসংশ্লিষ্ট কাহিনী লেখার কথা। অনেকে মনে করেন, ‘আরণ্যক’ হচ্ছে তাঁর শ্রেষ্ঠ লেখা। ‘স্মৃতির রেখা’ নামের দিনলিপিতে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেনও সেকথা।বিভূতিভূষণ জানতেন মানুষ একসময় অরণ্য থেকে বহুদূরে চলে যাবে তাদের নগরায়ণের নামে এক ধ্বংসলীলার দিকে। তাদের সেই ভবিষ্যৎ জীবনের কথা ভেবে তিনি রচনা করে গেছেন প্রকৃতির অকৃত্রিম উপাদান ‘আরণ্যক’ উপন্যাসটি। যেখানে মানুষ খুঁজে পাবে তার আসল গন্তব্য এবং সত্যিকারের আশ্রয়ের ঠিকানা। কারণ মানুষ প্রকৃতি ছাড়া বেঁচে থাকতে পারে না। প্রকৃতিই তার আসল সঙ্গী। জল যেমন যেতে চায় জলের কাছে তেমনই মানুষও যেতে চায় প্রকৃতির মাঝে। নিজের অস্তিত্ব খুঁজে পায় সে। প্রকৃতি আর মানুষের মধ্যে এভাবেই তো গড়ে উঠেছে আদিম প্রেম এবং যৌথ জীবনের সংসার। ‘আরণ্যক’ উপন্যাসে মানুষ আর প্রকৃতির নিজস্ব নিঃসঙ্গতাও ফুটে উঠেছে। যেখানে শরীরের প্রয়োজনে শরীর নেই কিন্তু মনের প্রয়োজনে মন আছে। সত্যিকথা বলতে বিভূতি সবসময় তার একটি ব্যক্তিগত জগৎ-কে তৈরি করতে চেয়েছেন। যেখানে সব কিছুই সুন্দর, আবার সব কিছুই অসুন্দর। যেখানে প্রেম আছে আবার তীব্র ঘৃণা আছে। সব মিলে একটা ব্যক্তিগত পুরাণ ভেসে ওঠে তার চিত্রকল্পে। প্রকৃতির গভীর ভালোবাসাকে সে গ্রহণ করতে চেয়েছেন নিজস্ব কৌশলে। যার কিছুটা স্বাদ পাঠকও লাভ করে উপন্যাসটি পড়ে। কিন্তু মানুষ দিনে দিনে যান্ত্রিক হয়ে উঠছে। গ্রাম হয়ে উঠছে আধুনিক শহর। বন উজাড় করে তৈরি হচ্ছে ফসলের মাঠ। যতো সময় যাচ্ছে আমরা আমাদের মনের মতো প্রকৃতির সবুজকেও হারাচ্ছি। বন্য পশুপাখি হারাচ্ছে তাদের নিরাপদ আশ্রয়। সবমিলে আমরা যাচ্ছি কেথায়? ধ্বংসের দিকে! বিভূতি যদিও তার উপন্যাসে এই সত্যের প্রকাশ এতো পরিষ্কারভাবে করেননি। তিনি প্রকৃতির প্রেম, প্রকৃতির নিজস্বতা, প্রকৃতির সাথে মানুষের সম্পর্ককে বেশি প্রাধান্য দিয়েছেন। আসলে শিল্পের রস শিল্পেই থাকে। তাকে গ্রহণ করতে হয় শৈল্পিকভাবে।

৯.
বোধকরি জীবনের মূলধারাকেই বিভূতিভূষণ তার রচনাকর্মের আধার হিসাবে বিবেচনা করেছেন। যে কারণে বিশ্বব্যাপী কার্ল মার্কসের বৈপ্লবিক সাম্যনীতি গ্রহণ-বর্জনের দ্বন্দ্বের ভেতর দিয়েও নগরকে পাশ কাটিয়ে গ্রামকেই সাহিত্য চর্চার কেন্দ্রে প্রতিষ্ঠিত করেন। চরিত্র সৃষ্টিতে প্রাধান্য পায় গ্রামের খেটে খাওয়া, অবহেলিত সাধারণ মানুষ। কাহিনীতে ফুটে ওঠে আমাদের চেনা-জানা মানুষের স্বাভাবিক জীবন প্রবাহ। প্রকৃতির সৌন্দর্য এবং গ্রামবাংলার সাধারণ মানুষের জীবনাচরণের সজীব ও নিখুঁত চিত্র তার কথাশিল্পে পাওয়া যায়। বাংলা সাহিত্যের গতানুগতিক ডামাডোলে বিভূতিভূষণের সৃষ্টিকর্মের মৌলিকত্ব সমকালীন আলোচকদের কাছে প্রশ্নশীল হলেও তার প্রখর জীবনবোধ ও শিল্পবোধ জারিত রচনাগুলো বাংলা সাহিত্যের এক অনবদ্য স্বর্ণফসল। উত্তরকালে তার রচনার পাঠকপ্রিয়তা এটাই প্রমাণ করে যে, দূরাশ্রয়ী অন্তর্দৃষ্টির মিশেলে রচিত উপন্যাসের পাশাপাশি বিভূতিভূষণের ছোটগল্পগুলোও পাঠককে মহাকালাশ্রয়ী চৈতন্যে টেনে নিতে সক্ষম। আর এখানেই সৃষ্টির প্রকৃত সার্থকতা নিহিত।

১০.
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় ১৮৯৪ খ্রিষ্টাব্দের ১১ সেপ্টেম্বর (২৮ ভাদ্র, ১৩০১ বঙ্গাব্দ), বুধবার বেলা সাড়ে দশটার সময়, ভারতের পশ্চিমবঙ্গের উত্তর ২৪ পরগণা জেলার কাঁচড়াপাড়ার নিকটবর্তী মুরাতিপুর গ্রামে (মামাবাড়ি) জন্মগ্রহণ করেন। উল্লেখ্য তাঁর পৈতৃক নিবাস ছিল যশোহর জেলার বনগ্রাম মহকুমার বারাকপুর গ্রামে। ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে ভারত বিভাগের সময় বনগ্রাম মহকুমা পুনর্গঠিত হয়ে ২৪ পরগণা জেলার অন্তর্ভুক্ত হয়। তাঁর পিতামহ তারিণীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় যৌবনে কবিরাজি করার জন্য ২৪ পরগণা জেলার বসিরহাট মহকুমার পানিতর গ্রাম থেকে বারাকপুরে আসেন এবং বারাকপুরের স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। তারিণীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের পুত্র মহানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন প্রখ্যাত সংস্কৃত পণ্ডিত। পাণ্ডিত্য এবং কথকতার জন্য তিনি শাস্ত্রী উপাধিতে ভূষিত হয়েছিলেন। মহানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায় প্রথম বিবাহ করেন রাণাঘাটের হেমাঙ্গিনী দেবীকে। কিন্তু হেমাঙ্গিনী দেবী সন্তানের জন্ম দিতে ব্যর্থ হলে, তিনি নিজ উদ্যোগে স্বামীকে বর্ধমান জেলার খোসবাগ-নিবাসী গুরুচরণ চট্টোপাধ্যায়ের দ্বাদশ বর্ষীয়া জ্যেষ্ঠা কন্যা মৃণালিনী দেবীর সাথে বিবাহ দেন।

১১.
পিতামাতার পাঁচ সন্তানের মধ্যে বিভূতিভূষণ ছিলেন সবার বড়। তাঁর অন্যান্য ভাইবোনেরা ছিলেন— ইন্দুভূষণ (১৮ ভাদ্র ১৩০৪), জাহ্নবী দেবী (৬ চৈত্র ১৩০৫), সরস্বতী দেবী (১১ আশ্বিন ১৩০৮), বটুবিহারী (৮ শ্রাবণ ১৩১২)। ১৯০৭ খ্রিষ্টাব্দের ১৭ ফেব্রুয়ারি (৫ ফাল্গুন ১৩১৩ বঙ্গাব্দ), রবিবার পঞ্চমী তিথিতে বারাকপুরে তাঁর উপনয়ন হয়। পিতার কাছে বিভূতিভূষণের পড়ালেখার পাঠ শুরু হয়। কথিত আছে, বিভূতিভূষণের জন্য তাঁর পিতা একটি করে বর্ণপরিচয় কিনে দিতেন এবং দিনশেষ সে বইয়ের কিছু থাকতো না। এই কারণে তাঁর পিতা তাঁর জন্য ১ পয়সা মূল্যের বর্ণপরিচয় এক মাসের জন্য কিনতেন। এর জন্য প্রতিও মাসে সাড়ে সাত আনা খরচ হতো।এরপর তিনি গ্রামের হরি রায়ের পাঠশালায় ভর্তি হন। এরপর হুগলি জেলার সাগঞ্জ-কেওটায় এবং পিতার কর্মস্থল কলকাতার বৌবাজার আরপুলি লেনের পাঠশালায় প্রাথমিক শিক্ষালাভ করেন। একই সময় তিনি পিতার কাছে সংস্কৃত ভাষা শেখা শুরু করেন। এই সময় তিনি মুগ্ধবোধ ব্যাকরণ পাঠ করেন। তাঁর পিতা তাঁর শিক্ষার জন্য অত্যন্ত যতœবান হলেও সংসারের অভাবের জন্য প্রাথমিক শিক্ষাকাল বেশ কষ্টে কেটেছে। কারণ, তাঁর পিতা ছিলেন ভবঘুরে। সংসারে তিনি খুব কম সময় কাটাতেন। ফলে আর্থিক অনটন তাঁদের সংসারে লেগেই ছিল। একসময় তিনি বনগ্রাম উচ্চ ইংরাজী বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। স্কুলে ভর্তি হতে গিয়ে প্রথম দুই দিন ভয়ে স্কুলে প্রবেশ করতে পারেন নি। তৃতীয় দিনে তিনি স্কুলের প্রধান শিক্ষক চারুচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের নজরে পরেন। তিন বিভূতিভূষণের কাছে সিঁদুর-মাখানো টাকা দেখে, জিজ্ঞাসাবাদ করে সংসারের অনটনের কথা জানতে পারেন। পরে তিনি বিভূতিভূষণকে অবৈতনিক শিক্ষার্থী হিসেবে ভর্তি করে নেন। অষ্টম শ্রেণীতে পড়ার সময় তাঁর পিতা মারা যান।

১২.
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় ১৯১৪ খ্রিষ্টাব্দে বনগ্রাম উচ্চ ইংরাজী বিদ্যালয় থেকে প্রথম বিভাগে প্রবেশিকা পরীক্ষায় পাশ করেন। এর তিনি কলকাতার রিপন কলেজে (বর্তমানে সুরেন্দ্রনাথ কলেজ) ভর্তি হন এবং ১৯১৬ খ্রিষ্টাব্দে এই কলেজ থেকে থেকে প্রথম বিভাগে আইএ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ১৯১৮ খ্রিষ্টাব্দে এই কলেজ থেকে বিএ পরীক্ষায়ও ডিস্টিংশনসহ পাশ করেন। এরপর তিনি কিছুদিন এম.এ এবং ল-ক্লাসে লেখাপড়া করেন। উল্লেখ্য, তিনি তাঁর তৃতীয় বার্ষিক পরীক্ষার সময় বসিরহাটের মোক্তার কালীভূষণ মুখোপাধ্যায়ের কন্যা গৌরী দেবীকে বিবাহ করেন। কিছুদিন পর এই স্ত্রী কলেরা রোগে মৃত্যুবরণ করেন। স্ত্রীর শোকে তিনি কিছুদিন প্রায় সন্ন্যাসীর মতো জীবনযাপন করেন। এরপর তাঁর লেখাপড়ার সমাপ্তি ঘটে। এই সময় তিনি হুগলি জেলার জাঙ্গীপাড়ায় মাইনর স্কুলে শিক্ষাকতা শুরু করেন। কিন্তু সেখানে তিনি অস্থিরতায় কাতর হয়ে, সোনারপুর হরিণাভিতে শিক্ষকতার চাকরি নিয়ে যান। এখানে থাকতেই তিন প্রথম 'উপেক্ষিতা' নামক গল্প রচনা করেন। এবং গল্পের সূত্রে তাঁর সাহিত্যিক জীবনের শুরু হয়। গল্পটি প্রবাসী পত্রিকার ১৩২৮ বঙ্গাব্দের মাঘ সংখ্যায়(১৯২১ খ্রিষ্টাব্দ) প্রকাশিত হয়েছিল। এরপর তিনি খেলাতচন্দ্র মেমোরিয়াল স্কুলে শিক্ষকতা করেন। এই সময় স্ত্রীর শোকে গভীরভাবে পরলোকতত্ত্ব চর্চা শুরু করেন।
 
১৩.
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় ১৯৪০ খ্রিষ্টাব্দের ৩ ডিসেম্বর (১৭ অগ্রহায়ণ, ১৩৪৭ বঙ্গাব্দ), ফরিদপুর জেলার ছয়গাঁও নিবাসী ষোড়শীকান্ত চট্টোপাধ্যায়ের দ্বিতীয়া কন্যা রমা দেবীকে (ডাক নাম কল্যাণী) বিবাহ করেন। ১৯৪২ খ্রিষ্টাব্দে দ্বিতীয় যুদ্ধের সময় তিনি খেলাতচন্দ্র মেমোরিয়াল স্কুল ছেড়ে দেশে ফিরে আসেন এবং এখানকার গোপালনগর স্কুলে শিক্ষক হিসাবে যোগদান করেন। এই সময় তিনি পৈতৃক ভিটার কাছে একটি পুরানো বাড়ি কেনেন এবং এই বাড়ি মেরামত করে সস্ত্রীক বসবাস শুরু করেন। বিয়ের পর তাঁর দুটি মৃত কন্যা সন্তান জন্মগ্রহণ করে। এরপর পুত্র তারাদাস বন্দোপাধ্যায় (ডাকনাম বাবলু) জন্মগ্রহণ করেন। সংসার জীবনে তিনি তাঁর পিতার মতোই কিছুটা ভবঘুরে জীবনযাপন করেন। ১৯৪২-৪৩ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত, তিনি বন্ধু এবং বিহার সরকারের বন বিভাগের উচ্চপদস্থ কর্মচরী যোগেন্দ্রনাথ সিন্হার সাথে ছোটনাগপুর বিভাগের সিংভূম, হাজারীবাগ এবং রাঁচী ও মানভূম জেলার অরণ্য ভ্রমণ করেন। এছাড়া দুই-একবার তিনি সারান্দা বনের নিভৃত অরণ্যে বাস করেন।

১৪.
নানা ধরনের চাকরি করেছেন তিনি। তবে, সময়ের হিসেবে শিক্ষকতাই করেছেন বেশি। হুগলি জেলার জাঙ্গিপাড়া দ্বারকানাথ হাইস্কুলে শিক্ষক হিসেবে চাকরি নেন। সেটাই প্রথম চাকরি। পদ : সহকারী প্রধান শিক্ষক। ‘গো রক্ষিণী সভা’র প্রচারক হিসেবেও চাকরি করেছেন। দেশে গো সম্পদ সুরক্ষা করার কাজটি যে কতটা দরকারি, সে বিষয়ে জনমত সৃষ্টি ছিল এই প্রচারকের লক্ষ্য। খুব বেশিদিন এই চাকরিতে থাকেননি। কিন্তু অল্প সময়ের মধ্যেই পূর্ব বঙ্গ, ত্রিপুরা এবং মিয়ানমারের অনেকটা অঞ্চল ঘুরে বেড়ানো হয়ে যায়। তার পরের চাকরিও ভিন্নরকম। এবারে চাকরি নেন খেলাতচন্দ্র ঘোষ এস্টেটে। পাথুরিয়াঘাটার জমিদার ছিলেন এই খেলাতচন্দ্র। তার পৌত্র সিদ্ধেশ্বর ঘোষের আমল চলছিল তখন। বিভূতিভূষণ ওই বাড়িতে প্রবেশ করেন গৃহশিক্ষকের কাজ নিয়ে। এই জমিদারদের তালুক ছিল বিহারের ভাগলপুরে। সেখানকার জঙ্গলমহালের অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার হিসেবে কাজ করেন। পরে কলকাতার ধর্মতলায় খেলাতচন্দ্র ক্যালকাটা ইনস্টিটিউশন বিদ্যায়তনের শিক্ষকতা করেন। বিভিন্নভাবে এদের সঙ্গে বিভূতিভূষণ যুক্ত ছিলেন অনেক দিন পর্যন্ত-১৯২৩ থেকে ১৯৪১ খ্রিস্টাব্দ। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পর্কে অন্নদাশঙ্কর রায়ের ‘বিভূতিভূষণকে যেমন দেখেছি’ শিরোনামের লেখাটি মুদ্রিত হয়েছে বিভূতি রচনাবলী দ্বাদশ খণ্ডে। কলকাতার মিত্র ও ঘোষ পাবলিশার্স থেকে এই রচনাবলী প্রকাশিত হয় ১৩৮৭ বঙ্গাব্দে। অন্নদাশঙ্কর রায় লিখেছেন,“এমন প্রকৃতি-পাগল সাহিত্যিক বাংলা সাহিত্যে বিরল। প্রকৃতিকে চোখে দেখে ভালো লাগে না কার কিন্তু তাকে ভালোবেসে তার গভীরে অবগাহন করা অন্য জিনিস। বিভূতিকে সেই জন্যে বছরে কয়েকমাস অরণ্যবাস করতে হতো। আর কয়েক মাস পল্লীর কোলে কাটাতে হতো। ইছামতী নদীর কূলে। তাঁর জীবনের যুগল মেরু ছিল অরণ্য ও দক্ষিণায়ন। শহরে থাকলেও তিনি শহুরে ছিলেন না। কোনোদিন হতে চাননি। নাগরিক সভ্যতা তাকে বশ করতে পারেনি। তার পোশাকে-আশাকে নাগরিকতার লেশ ছিল না। বৈঠকখানায় তিনি বেমানান। চিড়িয়াখানায় যেমন চিড়িয়া।”

১৫.
বিভূতিভূষণের উপন্যাসগুলির মধ্যে অনুবর্তন তাঁর সবচেয়ে প্রিয়, এমনই কথা এক সময়ে বলেছিলেন শঙ্খ ঘোষ এবং সে নিয়ে সংকলন-সম্পাদক নানা প্রশ্ন তুলেছেন একটি সাক্ষাৎকারে। উত্তরে শুনি কী ভাবে তাঁরই একটা সত্তা হয়ে উঠেছিল অনুবর্তন-এর স্কুল, ‘তার চেষ্টায় তার ব্যর্থতায়, শিক্ষকদের দীনতায় ক্ষুদ্রতায়, আবার সেই সঙ্গে স্নেহকাতরতায়, যথার্থ শিক্ষাদানের অতন্দ্র উন্মুখতায়’। কৈশোরের সেই অনুভব যুক্তিতে বোঝেন পরে এবং এবং তখন আরও দুটি মাত্রা যোগ হয় সে পাঠে। এর প্রথমটি হল বিভূতিভূষণের তিরিশের দশক জোড়া স্কুল-অভিজ্ঞতার ছায়াপাত আছে গল্পে এবং ‘কমপক্ষে আট-ন’বছর জোড়া একটা সময় এর মধ্যে গোটানো আছে’। ‘শিক্ষক’লেখকের যে শিক্ষাকেন্দ্রের কাহিনি আলোড়িত করেছিল এক কিশোরকে ব্যক্তি-অভিজ্ঞতার প্রতিরূপে, সেটাই আবার ব্যক্তি অতিক্রান্ত সর্বজনীনে প্রকাশ পায় পরবর্তী পর্বে। তখন ক্লার্কওয়েল সহ সব মাস্টারমশাইয়ের লাঞ্ছিত দশার ভবিতব্যটাকে সময়ের লাঞ্ছনা বলে অনেক নির্দিষ্টে বুঝতে পারেন।

১৬.
সাহিত্যচর্চার পাশাপাশি বিভূতিভূষণ সম্পাদনার দায়িত্বও পালন করেন। তিনি চিত্রলেখা (১৯৩০) নামে একটি সিনেমা পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন। তাছাড়া হেমন্তকুমার গুপ্তের সঙ্গে যৌথভাবে তিনি দীপক (১৯৩২) পত্রিকা সম্পাদনা করেন। ইছামতী উপন্যাসের জন্য বিভূতিভূষণ মরণোত্তর ‘রবীন্দ্র-পুরস্কার’ (১৯৫১) লাভ করেন। 

১৭.
মহান কথাসাহিত্যিক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় ১৯৫০ সালের ১ নভেম্বর (১৫ কার্তিক ১৩৫৭) বুধবার, রাত্রি ৮টা ১৫ মিনিটে বিহারের (বর্তমানে ঝাড়খণ্ড) ঘাটশিলায় মৃত্যুবরণ করেন।

(অকৃপণ ঋণ / তথ্যসূত্র : উইকিপিডিয়া, কালি ও কলম, দেশ, বইয়ের দেশ, দৈনিক সমকাল, দৈনিক সংবাদ, দৈনিক আনন্দবাজার পত্রিকা, দৈনিক প্রথম আলো, দৈনিক আলোকিত বাংলাদেশ, ইন্টারনেট )

লেখক: আবদুল্লাহ আল মোহন 
সহকারী অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, ভাসানটেক সরকারি কলেজ, ঢাকা

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত