জন্মদিনের শ্রদ্ধাঞ্জলি

কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য

প্রকাশ : ১৪ আগস্ট ২০১৮, ১১:৫৭

১.
সুকান্ত ভট্টাচার্য, ক্ষণজন্মা বিপ্লবী কবির মহান প্রতিকৃতি। বাংলার ইতিহাসের আলোচিত দুর্গনগরী গোপালগঞ্জের কোটালিপাড়ার সন্তান কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য ১৯২৬ সালের ১৪ আগস্ট জন্মগ্রহণ করেন। অকাল প্রয়াত শক্তিমান এই কবির স্মৃতির প্রতি জানাই বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি। উল্লেখ্য যে, সুকান্ত ভট্টাচার্য ১৯৪৭ সালের ১৩ মে প্রয়াত হন। সুকান্তের সাহিত্য-সাধনার মূল ক্ষেত্র ছিল কবিতা। সাধারণ মানুষের জীবনসংগ্রাম, যন্ত্রণা ও বিক্ষোভ তাঁর কবিতার প্রধান বিষয়বস্তু। তাঁর রচনাকর্মে গণমানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার বাণীসহ শোষণহীন এক নতুন সমাজ গড়ার অঙ্গীকার উচ্চারিত হয়েছে। রবীন্দ্রোত্তর বাংলা কবিতার বৈপ্লবিক ভাবধারাটি যাঁদের সৃষ্টিশীল রচনায় সমৃদ্ধ হয়েছে, সুকান্ত তাঁদের অন্যতম। তাঁর কবিতার ছন্দ, ভাষা, রচনাশৈলী এত স্বচ্ছন্দ, বলিষ্ঠ ও নিখুঁত যে, তাঁর বয়সের বিবেচনায় এরূপ রচনা বিস্ময়কর ও অসাধারণ বলে মনে হয়।
 
১.২
(ইতিকথার আগের কথা : ২০১৫ সালে সুকান্ত ভট্টাচার্যের প্রয়াণ দিনে আমার লেখাটির ভূমিকাটিও উল্লেখ করার লোভ সামলাতে পারছি না বলে সবিনয়ে ক্ষমাপ্রার্থৃনাসহ তুলে ধরছি।- ধান ভানতে শীবের গীত গাইতে হচ্ছে বলে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি অগ্রিম। কারণ মার্কসবাদী ভাবধারায় বিশ্বাসী এবং প্রগতিশীল চেতনার অধিকারী তরুণ কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের প্রয়াণ দিবসে কেন আমি এই কবিকে নিয়ে ভাব-অনুভবে লিখিনি তার জবাবদিহি চাইলো আমার একজন ছাত্র টেলিফোন করে কিছুক্ষণ আগেই। যেহেতু আমি তাদের ক্লাসে সুশাসন, স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা পড়িয়েই বিনিময়ে বেতন গ্রহণ করে অন্ন-বস্ত্র ইত্যাদি সংস্থান করে বেঁচে থাকি, তাই আমিও জবাবদিহিতার বাইরের কেউ নই বলে মোটেই মনক্ষুন্ন হইনি এই কঠিন প্রশ্নটি শুনেও। আমি তাকে কথা দিলাম, সুকান্তকে নিয়ে আমার ভাব-অনুভবের খসড়া লেখা তৈরি থাকলেও সেটি নানা কারণে যথাসময়ে চূড়ান্ত করতে পারিনি বলে ফেসবুকে পোস্ট করতে অক্ষম হলেও আজ সব কাজ ফেলে লেখাটি শেষ করে পোস্ট দেবো। প্রয়াণদিনে যথাযথ সম্মান জানাতে আমার অনিচ্ছাকৃত অবহেলার জন্য আমি ক্ষমা পেতেই পারি, নাকি ? আমার মনে পড়েছিলো স্বনামখ্যাত গবেষক অধ্যাপক গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাকের মূল্যবান একটি কথা, তিনি জোর দিয়ে বলেছিলেন, ‘আমি মাইনে নিয়ে পড়াই তাই আমি ছাত্রের ভৃত্য’। আমিও সেরকমই ছাত্রের ভৃত্য হিসেবেই নিজেকে মনে করে অবশ্যই গর্বিত বোধ করি, কোন হীনমন্যতায় ভুগি না।তাই সন্তানসম ছাত্রের প্রতি দায়িত্ব পালনে আমারও প্রিয় কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের প্রয়াণ দিবস পেরিয়ে গেলেও লিখতে বসলাম।)

২.
আমাদের নেত্রকোনার কন্যা সুখ্যাত গবেষক, অধ্যাপক গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক একাধারে লেখক, তাত্ত্বিক এবং দার্শনিক। তিনিই প্রথম এশিয়ান নারী যিনি কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসরের পদে আসীন হয়েছেন। কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনামূলক সাহিত্য এবং সমাজবিষয়ক ইন্সটিটিউটের প্রতিষ্ঠাতা স্পিভাক ব্রাউন ইউনিভার্সিটি, স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটি, ইউনিভার্সিটি অব টেক্সাস, অস্টিন, ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া, সান্তা ক্রুজ এবং দিল্লির জওহরলাল ইউনিভার্সিটিতে শিক্ষকতা করেন। তিনি শিক্ষা ও শিক্ষকতা নিয়ে আরো অনেক সুন্দর সত্য কথা বলেছেন। যেমন, ‘আমরা খুব ভালো পরীক্ষা দিতে জানি কিন্তু স্বাধীন চিন্তা করতে শিখি না।’ আবার বলছেন, ‘আমার বাবা বলতেন, ‘যুক্তিযুক্ত আদেশ না হলে মানবে না সেটা’ । আর তাই আমিও মনে করি প্রতিটি শিক্ষার্থীরও উচিত শিক্ষকের অযৌক্তিক আদেশ, মতাদর্শ এড়িয়ে চলা, না মানার চেষ্টা করা। আমার এই বক্তব্যের কারণে হয়তবা আমার অনেক প্রিয় সহকর্মী শিক্ষক ক্ষুদ্ধ হতে পারেন কিন্ত সত্যকে তো আর তাই বলে অস্বীকার করা যাবে না, ফেলেও দেয়া অসম্ভব। এবার সুকান্তে ফেরা যাক।

৩.
বলা হয়ে থাকে, মানবিক চেতনায় উদ্বুদ্ধ কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য বাংলা কাব্যধারার প্রচলিত প্রেক্ষাপট আমূল বদলে দিয়েছিলেন। সেই জনমানুষের কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য ১৯২৬ সালের ১৫ আগস্ট কলকাতায় মাতুলালয়ে জন্মগ্রহণ করেন। সুকান্ত ভট্টাচার্যের পৈতৃক নিবাস ছিল ফরিদপুর জেলার বর্তমান গোপালগঞ্জ জেলার কোটালীপাড়া উপজেলার উনশিয়া গ্রামে। বাবা নিবারণচন্দ্র ভট্টাচার্য এবং মা-সুনীতি দেবী। তাঁর পিতা কলকাতায় পুস্তক ব্যবসা করতেন। সুকান্ত ভট্টাচার্য বেঁচেছিলেন মাত্র ২১ বছর (জন্ম : ১৪ আগস্ট, ১৯২৬ – মৃত্যু : ১৩ মে, ১৯৪৭)। লেখালেখি করেন মাত্র ৬/৭ বছর। সামান্য এই সময়ে নিজেকে মানুষের কবি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে গেছেন। তাঁর রচনা পরিসরের দিক থেকে স্বল্প অথচ তা ব্যাপ্তির দিক থেকে সুদূরপ্রসারী।সেই সুকান্তের বাল্যশিক্ষা শুরু হয় কলকাতার কমলা বিদ্যামন্দিরে; পরে তিনি বেলেঘাটা দেশবন্ধু হাইস্কুলে ভর্তি হন এবং ১৯৪৫ সালে প্রবেশিকা পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে অকৃতকার্য হন। এ সময় ছাত্র আন্দোলন ও বামপন্থী রাজনৈতিক কর্মকান্ডে যুক্ত হওয়ায় তাঁর আনুষ্ঠানিক শিক্ষার সমাপ্তি ঘটে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, তেতাল্লিশের মন্বন্তর, ফ্যাসিবাদী আগ্রাসন, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা প্রভৃতির বিরুদ্ধে তিনি কলম ধরেন। ১৯৪৪ সালে তিনি কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যপদ লাভ করেন। এ বছর ‘আকাল’ নামক একটি সংকলনগ্রন্থ তাঁর সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়। 

৪. 
বাংলা সাহিত্যে একটি অতিপরিচিত ও সুপ্রতিষ্ঠিত বিপ্লবী নাম সুকান্ত ভট্টাচার্য। মার্কসবাদী ভাবধারায় বিশ্বাসী এবং প্রগতিশীল চেতনার অধিকারী তরুণ কবি; যার কবিতায় দরিদ্র, নির্যাতিত মানুষের প্রতিবাদের ভাষা ফুটে উঠে। তিনি ‘যুবক নজরুল’ এবং ‘কিশোর বিদ্রোহী কবি’ নামেও বিশেষ পরিচিত। হাজার বছরেরও অধিক সময়ের পরাধীন বাংলাকে স্বাধীন করার স্বপ্ন দেখেছিলেন, সংগ্রাম করেছিলেন। তাঁর এই সংগ্রামী জীবনের চিন্তা চেতনার ধারাবাহিকতার ফসল আজকের এই স্বাধীন বাংলাদেশ। যার বহিঃপ্রকাশ বাংলাদেশকে নিয়ে তাঁর প্রথম ‘দুর্মর’ কবিতাটি, যা তিনি বাংলাদেশের জন্মের ৩৪ বছর আগে রচনা করেছিলেন।-
‘হিমালয় থেকে সুন্দরবন, হঠাৎ বাংলাদেশ
কেঁপে কেঁপে উঠে পদ্মার উচ্ছ্বাসে,
সে কোলাহলের রুদ্ধস্বরের আমি পাই উদ্দেশ
জলে ও মাটিতে ভাঙ্গনের বেগ আসে।
হঠাৎ নিরীহ মাটিতে কখন,
জন্ম নিয়েছে সচেতনতার ধান,
গত আকালের মৃত্যুকে মুছে
আবার এসেছে বাংলাদেশের প্রাণ।’
বাংলাদেশ নিয়ে লেখা কোনো কবির কবিতা সম্ভবত আর পাওয়া যায়নি। ক্রমশই কালের আবর্তে কী এক অদৃষ্ট কারণে তাঁরা বহুদূরে সরে যাচ্ছেন আমাদের মাঝ থেকে। নীরবে নিভৃতে দায়সারা গোছের দু একটি সভায় স্মরণ করি তাঁকে। তার এই ক্ষুদ্র ২১ বছরের জীবনকালে বাংলা সাহিত্যে যে অপরিসীম অবদান, তা বোধহয় অন্য সাহিত্যিকদের বেলায় ঘটেনি।

৫.
সুকান্ত ভট্টাচার্য কাব্য সাধনার শুরু থেকেই বাংলা সাহিত্যের মার্কসবাদী ভাবধারায় বিশ্বাসী এবং প্রগতিশীল চেতনার অধিকারী কবি হিসেবে পরিচিত লাভ করেন। রবীন্দ্রোত্তর বাংলা কবিতার বৈপ্লবিক ভাবধারা যাদের সৃষ্টিশীল রচনায় সমৃদ্ধ হয়েছে, সুকান্ত তাদের অন্যতম। তাঁর কবিতার ছন্দ, ভাষা, রচনাশৈলী স্বচ্ছন্দ, বলিষ্ঠ ও নিখুঁত। তিনি মাত্র ছয়/সাত বছর লেখালেখির সঙ্গে ছিলেন। এই অল্প সময়েই তিনি নিজেকে মানুষের কবি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন। তাঁর রচনা পরিসরের দিক থেকে স্বল্প অথচ তা ব্যাপ্তির দিক থেকে সুদূরপ্রসারী। ছেলেবেলা থেকেই সাহিত্য-সৃষ্টির প্রতি ছিল সুকান্তের ভীষণ আগ্রহ। নয়-দশ বছর বয়সে প্রচুর ছড়া লিখে প্রশংসা কুড়িয়েছেন স্থানীয় মানুষ ও আত্মীয়-স্বজনের। ১৯৪১ সালে সুকান্ত বেতারে গল্পদাদুর আসরে রবীন্দ্রকবিতা আবৃত্তি করে প্রশংসা পেয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথের প্রয়াণকালে গল্পদাদুর আসরে পঠিত হয় সুকান্তের নিজের লেখা কবিতা। ১৯৪১-৪২ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষাপট সারাদেশে জন্ম দিয়েছিল মার্কসবাদী চিন্তাধারার। সেই চিন্তাধারায় উদ্বুদ্ধ সুকান্তের তখনই ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির কর্মী হিসাবে রাজনীতিতে যোগদান হয়। আর তাই তিরিশের দশকে সুকান্তের পূর্বসূরী কবিরা কাব্য-পরিমন্ডলে যে নেতিবাচক দর্শনের সৃষ্টি করেছিলেন, সুকান্ত এর বিপরীতে দাঁড়িয়ে চল্লিশের দশকে যাত্রা করেছিলেন ইতিবাচক জীবন-দর্শনের পথে। সারা বিশ্বে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের তান্ডব, ফ্যাসিস্ট শক্তির বিরুদ্ধে মুক্তিকামী জনতার সংগ্রাম, সাম্রাজ্যবাদী শাসনের বিরুদ্ধে স্বদেশে গণ-অভ্যুত্থান, দূ্র্ভিক্ষপীড়িত বাংলা-এ সবকিছুই ছিল প্রগতিশীল চেতনার অধিকারী তরুণ সুকান্তের রচনার প্রেরণা।

৬.
নজরুলের মতো তিনিও কমিউনিস্ট আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির তিনি কনিষ্ঠ সদস্য ছিলেন। রাত জেগে জেগে তিনি কমিউনিস্ট পার্টির কাজ করতেন এবং গণমানুষের জন্য কবিতা লিখতেন। কমরেড মুজফ্ফর আহমদ, এস এ ডাঙ্গে ছিলেন তার আদর্শিক নেতা। রুশ বিপ্লবের নেতৃত্বদানকারী ভস্নাদিমির ইলিচ লেনিন তাকে বিপ্লবের জন্য এতই প্রণোদিত করেছিলেন যে তিনি তাঁর কবিতায় বলতে বাধ্য হয়েছেন, 'বিপ্লব স্পন্দিত বুকে মনে হয় / যেন আমিই লেনিন'। সুকান্ত কমিউনিস্ট পার্টির পত্রিকা দৈনিক ‘স্বাধীনতা’র (১৯৪৫) ‘কিশোর সভা’ বিভাগ সম্পাদনা করতেন। মার্কসবাদী চেতনায় আস্থাশীল কবি হিসেবে সুকান্ত কবিতা লিখে বাংলা সাহিত্যে স্বতন্ত্র স্থান করে নেন। তাঁর রচনাবলির মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য: ছাড়পত্র (১৯৪৭), পূর্বাভাস (১৯৫০), মিঠেকড়া (১৯৫১), অভিযান (১৯৫৩), ঘুম নেই (১৯৫৪), হরতাল (১৯৬২), গীতিগুচ্ছ (১৯৬৫) প্রভৃতি। পরবর্তীকালে উভয় বাংলা থেকে সুকান্ত সমগ্র নামে তাঁর রচনাবলি প্রকাশিত হয়। সুকান্ত ফ্যাসিবাদবিরোধী লেখক ও শিল্পীসঙ্ঘের পক্ষে আকাল (১৯৪৪) নামে একটি কাব্যগ্রন্থ সম্পাদনা করেন। 

৭.
বাংলা কবিতায় তিনি সমাজতান্ত্রিক ধারার পথিকৃৎ। শিল্পের জন্য শিল্প-কাব্যধারায় তিনি বিশ্বাসী ছিলেন না। তিনি সাম্যবাদের কবি। কবিতার মধ্যদিয়ে তিনি সমাজতান্ত্রিক সমাজ বিনির্মাণে এবং সমাজ বদলে ভূমিকা রাখতে চেয়েছিলেন। প্রথার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে নতুন সমাজ ও বাসযোগ্য পৃথিবী গড়াই ছিল তার অন্বিষ্ট। ‘আমার দিন পঞ্জিকায় আসন্ন হোক / বিস্ফোরণের চরম, পবিত্র তিথি’, তাঁর বিদ্রোহ সকল মানুষের জন্য, জীবনের জন্য- ‘হে সূর্য।/ তুমি আমাদের স্যাঁতসেতে ভিজে ঘরে/ উত্তাপ আর আলো দিও, / আর উত্তাপ দিও / রাস্তার ধারের ঐ উলঙ্গ ছেলেটাকে’। আগুন-ঝরানো কলমে এভাবেই ফুটে ওঠেছিল বিদ্রোহের গান। কেননা জন্মলগ্ন থেকেই তিনি বেড়ে ওঠনে দ্রোহের আগুনে। পৃথিবী তখন দুই ভাগে বিভক্ত ছিল- শোষক আর শোষিত। আবশ্যিকভাবেই তাঁর অবস্থান হয়েছিল শোষতিরে দলে। কিশোর বয়সেই ‘ক্ষুধার’ মতো ভয়াবহ শব্দের সঙ্গে পরচিতি হয়েছেন তিনি। সে সময় তাঁর বন্ধুত্ব হয় ক্ষুর্ধাত, নিষ্পেষিত মানুষের সাথে। সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী কমিউনিস্ট আন্দোলনে সুকান্ত ভট্টাচার্য তখন তুঙ্গে। রবীন্দ্রোত্তর বাংলা সাহিত্যে এমন পরিচয় বহন করে সুকান্ত ভট্টাচার্যের লেখনী। সুকান্তের সাহিত্য-সাধনার মূল ক্ষেত্র ছিল কবিতা। সাধারণ মানুষের জীবনসংগ্রাম, যন্ত্রণা ও বিক্ষোভ তাঁর কবিতার প্রধান বিষয়বস্ত্ত। তাঁর রচনাকর্মে গণমানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার বাণীসহ শোষণহীন এক নতুন সমাজ গড়ার অঙ্গীকার উচ্চারিত হয়েছে। রবীন্দ্রোত্তর বাংলা কবিতার বৈপ্লবিক ভাবধারাটি যাঁদের সৃষ্টিশীল রচনায় সমৃদ্ধ হয়েছে, সুকান্ত তাঁদের অন্যতম। তাঁর কবিতার ছন্দ, ভাষা, রচনাশৈলী এত স্বচ্ছন্দ, বলিষ্ঠ ও নিখুঁত যে, তাঁর বয়সের বিবেচনায় এরূপ রচনা বিস্ময়কর ও অসাধারণ বলে মনে হয়। তিনি কলম ধরেছিলেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, তেতাল্লিশের মম্বন্তর, ফ্যাসিবাদী আগ্রাসন, সাম্প্র্রদায়িক দাঙ্গা প্রভৃতির বিরুদ্ধে। সুকান্তের সাহিত্য-সাধনার মূল ক্ষেত্র ছিল কবিতা। সাধারণ মানুষের জীবনসংগ্রাম, যন্ত্রণা ও বিক্ষোভ তার কবিতার প্রধান বিষয়। তার লেখায় উঠে এসেছে শ্রেণী সংগ্রাম, গণমানুষের আশা-আকাংখার বাণীসহ শোষণহীন এক নতুন সমাজ গড়ার অঙ্গীকার। পার্টি ও সংগঠনের কাজে অত্যধিক পরিশ্রমে দুরারোগ্য ক্ষয়রোগে (যক্ষ্মা) আক্রান্ত হয়ে কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য মৃত্যুবরণ করেন।

৮.
ব্যক্তিগত জীবনে অন্তর্মুখী লাজুক সুকান্ত ভট্টাচার্য কঠোর বাস্তবের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে সমাজকে বিশ্লেষণ করেছেন সমসাময়িক রাজনীতির তত্ত্ব ও তথ্যের সাহায্যে। তিনি ছিলেন শোষিত বঞ্চিতদের পক্ষে। সমাজতান্ত্রিক ভাবধারায়, সাম্যবাদী তত্ত্বের নিরিখে মানুষে মানুষে ব্যবধান ঘুচিয়ে দেয়ার মহত্তম আদর্শে অনুপ্রাণিত সুকান্ত ভট্টাচার্য জীবদ্দশায় ভারতের স্বাধীনতা দেখে যেতে পারেননি। অসুস্থ অবস্থায় দুর্বল শরীর নিয়ে তিনি লিখে গেছেন জীবনের দিনপঞ্জি। সুকান্ত রাজনৈতিক স্লোগানধর্মী কবিতা রচনা করলেও এসব কবিতাও সুকান্তের অনন্যসাধারণ কবিপ্রতিভার জাদুস্পর্শে শিল্পমণ্ডিত হয়ে উঠেছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, দিজেন্দ্রলাল রায়, জীবনানন্দ দাশসহ সে সময়ের বড় বড় কবির ভিড়ে তিনি হারিয়ে যাননি। নিজের যোগ্যতার স্বাক্ষর রেখে গেছেন নিজ প্রতিভা, মেধা ও মননে। কবি সুকান্তের সাহসী কলমে যুক্ত হতে পারতো বয়সের পূর্ণতা ও অভিজ্ঞতা। বাংলা সাহিত্যের জগৎ বৃহৎ ক্ষেত্রে পূর্ণতা পেতে পারতো। তা সত্ত্বেও ১৯৪৭ সালে মাত্র ২১ বছরের অপরিণত যৌবনেও যা লিখে গেছেন তা ছিল সুপরিণত। এভাবেই সকল রচনার মাধ্যমেই চিরস্মরনীয় হয়ে থাকবেন তিনি। তারুণ্যদীপ্ত কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য স্বপ্ন দেখেছিলেন নতুন জীবনের, নতুন নতুন অগ্রগতি সাধনের। চারপাশের অন্যায়-অত্যাচার, শোষণ-পীড়ন, সামাজিক বৈষম্য ও ভেদাভেদ-হানাহানি দেখ তিনি ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছেন। দেশ-জাতি ও মানবতার জন্য তিনি এগিয়ে এসেছেন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে। জনগণের মুক্তি ও কল্যাণের সংগ্রামে হয়েছেন ব্রত। অনুভূতির তীব্রতা ও সুগভীর সংবেদনশীলতায় কাপুরুষতা ও ভীরুতা ত্যাগ করে অবিশ্রান্ত লিখেছেন গণমানুষের জন্য কবিতা ও গান। লিখেছেন 'আঠারো বছর বয়স কী দুঃসহ/স্পর্ধায় নেয় মাথা তোলবার ঝুঁকি/আঠারো বছর বয়সেই অহরহ/বিরাট দুঃসাহসেরা দেয় যে উঁকি।' এ আঠারো বছর পেরিয়ে এর মাত্র তিন বছর পরই ২১ বছর বয়সে ১৯৪৭ সালে ১৩ মে কলকাতায় যৌবনের প্রতিভাবান এ কবির মৃত্যু হয়। তাঁর অকালমৃত্যু আমাদের অপূর্ণতায় রেখে গেছে। শূন্যতায় ভরে আছে মন। 'এ পৃথিবী বাসযোগ্য করে যাবো আমি', তার এ দৃঢ় উচ্চারণ ও অঙ্গীকার এখনো পূরণ হয়নি। পৃথিবী বাসযোগ্য হয়ে উঠুক, মানবতার মুক্তি ঘটুক- এই আমাদের প্রত্যাশা ও প্রত্যয়। ১৩ মে ছিল কবি সুকান্তের মৃত্যুবার্ষিকী। তাঁর মৃত্যুবার্ষিকীতে গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলি। 

৯.
'ছাড়পত্র' খ্যাত সুকান্ত ভট্টাচার্য রবীন্দ্র-নজরুলোত্তর যুগের তরুণ কবি। যিনি বিপ্লবী কবি এবং গণজাগরণের কবি। যিনি সমাজতন্ত্রের আদর্শের কবি। যিনি চে গুয়েভারার মতো বিপ্লবের স্বপ্ন দেখতেন। সমাজ বদলের স্বপ্ন দেখতেন। যিনি নজরুলের মতোই তার কাব্যে উচ্চারণ করে গেছেন অন্যায়-অবিচার, শোষণ-বঞ্চনার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ও সংগ্রামের শব্দমালা। যিনি বিপ্লব ও গণমানুষের মুক্তির পক্ষের সংগ্রামে একাত্মতা ঘোষণা করেছেন বারবার। লড়াকু সৈনিকের মতো কাজ করেছেন প্রলেতারিয়েত জনগোষ্ঠীর ও কৃষক-শ্রমিকের অর্থনৈতিক মুক্তির লক্ষ্যে। এ পৃথিবীকে বাসযোগ্য করে যাওয়ার প্রত্যয়ে তিনি ছিলেন দৃঢ়চেতা কবি। বন্দিত্ব মোচনের লক্ষ্যে তিনি ছিলেন অগ্নিরথের সারথি, উদ্দীপ্ত যৌবনের অগ্রপথিক কারণ মার্কস ও লেনিন ছিলেন তাঁর স্বপ্নপুরুষ। কৈশোরেই বিশ্বব্যাপী দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের ধ্বংস ও তান্ডবলীলা, দুর্ভিক্ষের করাল গ্রাসে মানুষের মৃত্যু ও হাহাকার দেখে তিনি আলোড়িত হয়ে ওঠেন। সামাজিক অনাচার-অত্যাচার এবং শ্রেণিবৈষম্য দেখে তাঁর বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হয়ে ওঠেন। নির্যাতিত মানুষের পাশে এসে দাঁড়ান। ভুখানাঙ্গা মানুষের কষ্ট লাঘবে এগিয়ে আসেন। ফলে গণমানুষের প্রতি গভীর মমতা তার কবিতায় বাণীরূপ পায়। অল্প বয়সে তিনি মৃত্যুবরণ করেন বলে তাকে কিশোর কবিও বলা হয়।

১০.
যতদূর জানা যায়, সুকান্তের পৈতৃক নিবাস কোটালীপাড়া হলেও তিনি কখনো কোটালীপাড়ায় আসেননি। তবে তাঁর পিতামাতার কাছে কোটালীপাড়ার গল্প শুনেছেন। কোটাল দুর্গের কথা শুনেছেন। চন্দ্রভার্মা ফোর্টের কথা জেনেছেন। বৌদ্ধ শাসনামলে কোটালীপাড়া একসময় বঙ্গের রাজধানী ছিল এবং রাজা ধর্মাদিত্য, শীলভদ্র ও সমাচার দেব নামে (৬২৫-৬৫৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত) তিনজন রাজা রাজত্ব করেছেন- তার ইতিহাস জেনেছেন। সংস্কৃত কবি কৃষ্ণনাথ সার্বভৌম ও তার স্ত্রী সরস্বতী সার্বভৌমের কথা শুনেছেন। কবি সুকান্ত জন্মের পর কলকাতাতেই বেড়ে উঠেছেন, লেখাপড়া শিখেছেন, মহানগরী কলকাতার শ্রমজীবী মানুষ আর মধ্যবিত্ত জীবন চেতনায় লালিত হয়েছেন। তিনি কলকাতার নাগরিক হলেও কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকতায় বিশ্বাসী ছিলেন। নিবারণ ভট্টাচার্য কলকাতায় যাওয়ার সময় উনাশিয়া গ্রামের বসতবাড়ি ফেলে রেখে যান। প্রায় ৫০০ বছরের ঐতিহ্যবাহী এ বাড়িটির গৌরব ও পরিচিতি ছিল এলাকায়। সুকান্তের পিতৃব্য ও পিতার ফেলে যাওয়া এ বাড়িটি বংশের সর্বশেষ পুরুষ দেবেন ভট্টাচার্য কিছু দিন আগলে রাখেন। পরে এ বাড়িটি অবৈধ দখলদারদের হাতে চলে যায়। এক পর্যায়ে বিভিন্ন সংবাদপত্রে ওই বাড়ির অবৈধ দখলদারে থাকার খবর প্রকাশিত এবং এলাকার জনগণ ওই বাড়ি থেকে অবৈধ দখলদারিত্ব উচ্ছেদে সোচ্চার হওয়ায় গোপালগঞ্জের জেলা প্রশাসন প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করে। পরে সরকার বাড়িটি সংরক্ষণের জন্য সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে প্রথমে বাংলা একাডেমিকে এবং পরে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগকে অনুরোধ জানালেও তারা তাতে রাজি হয়নি। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর বাড়িটির ঐতিহাসিক মূল্য বিচারে এখানে সুকান্তের স্মৃতি রক্ষার্থে 'সুকান্ত স্মৃতি-পাঠাগার ও অডিটরিয়াম' প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেয়া হয়। প্রায় ৫৮ লাখ টাকা ব্যয়ে এটির নির্মাণ কাজ শেষে ২০১২ সালে এর শুভ উদ্বোধন করা হয়।সুকান্তের পৈতৃক নিবাস এখন সাহিত্যপ্রেমিকদের এক আকর্ষণীয় ও দর্শনীয় স্থান। প্রতিদিনই দূরদূরান্ত থেকে সুকান্তভক্তরা এসে এ বাড়িটি দেখে যান এবং সুকান্তের প্রতি শ্রদ্ধা জানান।

(তথ্যসূত্র : বাংলাপিডিয়া, ইন্টারনেট)

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত