শহীদ মুন্সী কবির উদ্দিন আহমেদ

প্রকাশ : ২২ জুলাই ২০১৮, ১২:০০

ছবি: লেখক

কুমিল্লা জেলার পুলিশ সুপার মহোদয়ের আমন্ত্রণে সাড়া দিয়ে গিয়েছিলাম তাঁর কার্যালয়ে৷ ইতিহাস প্রসিদ্ধ জলাশয় ধর্মসাগরের কোল ঘেষা মনোরম প্রকৃতির মাঝে অবস্থিত প্রতিষ্ঠানটিতে ঢুকতেই এর উঠানে স্থাপিত একটি মর্মর প্রতিকৃতির দিকে দৃষ্টি গেল৷ কাছে গেলাম, শ্রদ্ধা জানালাম শহীদ পুলিশ সুপার মুন্সী কবির উদ্দিন আহমেদের পূণ্য স্মৃতির উদ্দেশ্যে৷

১৯৭১ সালে কুমিল্লা জেলার এসপি হিসেবে কর্মরত ছিলেন মুন্সী কবির উদ্দিন আহমেদ। ১৯৭১ সালে ২৫ মার্চ রাত্র ১২টায় পাকিস্তানি হানাদার সেনাবাহিনী কুমিল্লা পুলিশ লাইন আক্রমণ করে। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর মেজর ইফতেখার হায়দার শাহের নেতৃত্বে পুলিশ লাইনে হামলা শুরু হয়। রাত ১২টায় গুলিবর্ষণ করতে করতে পাকিস্তানি সৈন্যরা পৈশাচিক উল্লাসে পুলিশ লাইনে ঢুকে পড়ে। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী পুলিশ লাইনে ঢুকেই পুলিশ বাহিনীর উপর অতর্কিত আক্রমণ করে। পুলিশ লাইনে তখন নতুন যোগ দেয়া শতাধিক সদস্য দোতলায় অবস্থান নেয়। তাঁদের হত্যা করে পাকিস্তানি সৈন্যরা। পুলিশ সুপার মুন্সী কবিরউদ্দিন আহমেদের অনুপ্রেরণায় ঐক্যবদ্ধ সশস্ত্র পুলিশ সদস্যরা সারারাত প্রাণপণ লড়াই করেন এবং বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধ চালিয়ে যান তাঁদের সাধারণ অস্ত্র দিয়ে। কিস্তু আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে শেষতক মোকাবেলা করা সম্ভব হয়নি। ভোরের দিকে পাকিস্তানি সৈন্যরা পুলিশ লাইন নিজেদের দখলে নিয়ে নেয়। এ যুদ্ধে ৩১ জন পুলিশ সদস্য ও কর্মকর্তা শহীদ হন। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বেশ কিছু সৈন্য হতাহত হয়। তারপর ২৬শে মার্চ সকাল ৭টায় পুলিশ সুপার মুন্সী কবির উদ্দিন আহমদকে বাসা থেকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী গ্রেপ্তার করে ময়নামতি সেনানিবাসে নিয়ে যায়৷ পরবর্তীতে সেনানিবাসেই তাঁকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়।

শহীদ পুলিশ সুপার মুন্সী কবিরউদ্দিন আহমেদের স্ত্রী মাকছুদা কবির তাঁর স্মৃতি কথায় লিখেছেন : "আমার স্বামী শহীদ মুন্সী কবির আহমেদ ১৯৭১ সনে কুমিল্লার পুলিশ সুপার থাকাকালীন স্বাধীনতা যুদ্ধে ২৬শে মার্চ তারিখে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর হাতে শহীদ হন। ব্যক্তি জীবনে তিনি ছিলেন খুবই সৎ ও ধার্মিক মানুষ। একাত্তরের সেই উত্তাল দিনে দেশের সমস্ত মানুষ যখন স্বাধীনতার জন্য আন্দোলন করছে তখন তিনি সবসময় ভাবতেন কি করে হানাদার পাকিস্তানিদের বিতাড়ন করে এদেশকে মুক্ত করা যায়। ১৯৭১ সনের ২৩শে মার্চ তারিখে তিনি গোপন সূত্রে খবর পেলেন যে, সেই রাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট থেকে এসে পুলিশ লাইন আক্রমণ করবে। তখন তিনি প্রতিজ্ঞা করলেন জীবন গেলেও পুলিশ লাইনের অস্ত্রশস্ত্র গোলাবারুদ পাকিস্তানিদের নিয়ে যেতে দেবেন না। তখন তিনি পুলিশ লাইনে যেয়ে নিজে অস্ত্র নিয়ে পুলিশ বাহিনীসহ যুদ্ধাবস্থায় থেকে রাত কাটালেন কিন্তু সেই রাতে আর ওরা এল না। পরদিন ২৪শে মার্চ হতে তিনি সার্কিট হাউজে কনট্রোল রুম স্থাপন করে ডিসি সাহেবের সাথে বিভিন্ন বিষয়ে খোঁজ খবর ও পরামর্শ করতেন এবং পুলিশ লাইনে পুলিশ বাহিনীকে যুদ্ধের জন্য পূর্ণ সতর্ক অবস্থায় থাকার নির্দেশ দেন। এরপর এল সেই ভয়াল বিভীষিকাময় কালরাত। ২৫শে মার্চ রাত ১২টায় পাকিস্তানী সেনাবাহিনী অতর্কিতে পুলিশ লাইন আক্রমণ করে। পুলিশ বাহিনীও বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধ চালিয়ে যায় পুলিশের সাধারণ অস্ত্র দিয়ে। কিন্তু আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত পাকিস্তানী সেনাবাহিনীকে মোকাবেলা করা সম্ভব হয় নি, ভোরের দিকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী পুলিশ লাইন দখল করে নেয় এবং অসংখ্য পুলিশ হত্যা করে। এরপর ২৬শে মার্চ সকাল ৭টায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী বাসা থেকে আমার স্বামীকে ধরে ডিসি সাহেবের সাথে কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে যায় এবং সেখানেই তাঁদের কে হত্যা করে। এরপর আর তাঁর লাশ পাওয়া যায় নি"।

মুন্সি কবির উদ্দিন আহমেদ ১৯১৮ সালে সিরাজগঞ্জ জেলায় জন্ম গ্রহণ করেন। তার পিতা মুন্সি রইস উদ্দিন আহমেদ, মাতা সৈয়দা সৈয়দন নেসা। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিগ্রী লাভ করেন। মুন্সী কবির উদ্দিন আহমেদ পেশাগত জীবনে সাহসিকতাপূর্ণ কাজের জন্য ১৯৬৭ সালে পুলিশ গোল্ড মেডেল (পিপিএম) লাভ করেন। বাংলাদেশ ও বাঙ্গালী জাতির স্বার্থে তিনি নিজের জীবন উৎসর্গ করে মৃত্যুকে হাসিমুখে আলিঙ্গন করেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অসাধারণ অবদানের স্বীকৃতি স্বরুপ শহীদ মুন্সী কবির উদ্দিন আহমেদকে স্বাধীনতা পুরষ্কার-২০১৪(মরণোত্তর) প্রদান করে রাষ্ট্র ৷

তথ্য সূত্রঃ 
অপারেশন কিল এন্ড বার্ন, যুদ্ধাপরাধ কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, চাঁদপুর, দলিল পত্র, পৃষ্ঠা ১৮-১৯,
কুমিল্লার কাগজ প্রকাশনী, ২৬ মার্চ, ২০১৫।
স্মৃতি ১৯৭১ ষষ্ঠ খণ্ড- বাংলা একাডেমি, ঢাকা৷

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত