ভিত্তোরিও দে সিকা

প্রকাশ : ০৮ জুলাই ২০১৮, ১২:২০

গত শতাব্দির চল্লিশের দশকে ইতালিতে এক নব্য ধারার সৃষ্টি হয় চলচ্চিত্রে। নব্য-বাস্তববাদ বা নিও রিয়েলিজম নামে আখ্যাপ্রাপ্ত এ ধারায় পরবর্তীতে প্রভাবিত হন আকিরা কুরোসাওয়া, আব্বাস কিয়ারোস্তামি ও সত্যজিত রায়সহ বিশ্ববিখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতাগণ। নিও রিয়েলিজম ধারার গোড়াপত্তন হয় ইতালীয় চলচ্চিত্র 'লাদ্রি দি বিচিক্লেত্তে' বা 'দ্যা বাইসাইকেল থিফ' নির্মাণের মধ্য দিয়ে। ভিত্তোরিও দে সিকা ১৯৪৮ সালে চলচ্চিত্রটি নির্মাণ করেন। নব্য-বাস্তববাদ চলচ্চিত্রের এ ধারার প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো - দরিদ্র, কর্মজীবি শ্রেণির বিভিন্ন মানবিক দিক নিয়ে এর কাহিনী আবর্তিত হবে। নব্য-বাস্তববাদ চলচ্চিত্রের চিত্রধারণ হবে সংশ্লিষ্ট কর্মজীবি চরিত্রসমূহের বাস্তব লোকেশনে। এ ধারা অনুযায়ী 'বাইসাইকেল থিফ' একটি নব্য-বাস্তববাদী চলচ্চিত্র। চলচ্চিত্রটিকে নব্য-বাস্তববাদী সিনেমার পথপ্রদর্শকও বলা হয়ে থাকে। চলচ্চিত্রটি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী ইতালির সামাজিক-অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে নির্মিত। এ চলচ্চিত্রে পুঁজিবাদী সমাজ বাস্তবতায় একটি বৈষম্যমূলক আর্থ-সামাজিক চিত্র ফুটে ওঠে একটি পরিবারের কাহিনির মধ্য দিয়ে। বার্তোলিনির উপন্যাস অবলম্বনে এ চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্য রচনা করেন সিসারে জাভাত্তিনি। ১৯৪৮ সালের ২৪ নভেম্বর ইতালিতে এবং ১৯৪৯ সালের ১২ ডিসেম্বর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মুক্তি পায় চলচ্চিত্রটি। ১৯৫০ সালে অস্কার অর্জন করে চলচ্চিত্রটি।

বিখ্যাত ইতালীয় চলচ্চিত্র পরিচালক, অভিনেতা এবং নিও রিয়ালিস্ট আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃত ভিত্তোরিও দে সিকা ১৯০১ সালের ৭ই জুলাই ইটালির লাজিওর সোরাতে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পরিচালিত চারটি চলচ্চিত্র অ্যাকাডেমি পুরস্কার লাভ করে। তাদের মধ্যে 'সুশাইন' (সিউসসিআ) এবং 'বাইসাইকেল থিভস' (লাদ্রি দি বিচিক্লেত্তে)। এই দুটি চলচ্চিত্রকে বিশেষ অস্কার পুরস্কার দিয়ে সম্মান জানানো হয় এবং 'ইয়েস্টারডে, টুডে এণ্ড টুমরো' (ইয়েরি, ওসগ্গি, ডোমানি) ও 'দ্য গার্ডেন অফ দ্য ফিনজি-কন্টিনিস' (ইল গিয়ারডিনো ডাই ফিনজি-কনটিনি) ছবি দুটি অর্জন করে শ্রেষ্ঠ বিদেশি ভাষার চলচ্চিত্র বিভাগের অস্কার।

ভিত্তোরিও দে সিকা ছিলেন নিয়মিত মঞ্চের সার্থক কমেডিয়ান। মঞ্চাভিনয়ে তিনি ছিলেন নারী সমাজের প্রিয় তারকা, ম্যাটিনি আইডল। তারপর চলচ্চিত্র পরিচালনায় হাতেখড়ি হল ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দে। কিন্তু তাঁর চলচ্চিত্রে অভিনয় শুরু হয় নির্বাক যুগ থেকে। প্রথম অভিনয় করেন ১৯১৭ সালে। তিনি ১৫০টিরও বেশি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন। পরিচালক ও অভিনেতার বাইরে তিনি একজন চিত্রনাট্যকার ও প্রযোজক। তিনি প্রায় ২৫টি ছবির চিত্রনাট্য তৈরি ও ৫টির মতো ছবি প্রযোজনা করেন। তবে তিনি খ্যাতি পেয়েছেন পরিচালনায় এবং বিশ্ব চলচ্চিত্র ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে আছেন, থাকবেন পরিচালক হিসেবেই। চলচ্চিত্রকার হিসেবে আত্মপ্রকাশের বছর দেড়েক পর ঘনিষ্ঠতা এবং বন্ধুত্ব তৈরি হয় বিখ্যাত চিত্রনাট্যকার জাভাত্তিনির সঙ্গে। এ ঘনিষ্ঠতা আর বন্ধুত্ব দে সিকার জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। জাভাত্তিনির সান্নিধ্যের ছোঁয়া দে সিকাকে বদলে দেয়। জাত্তাভিনির চিত্রনাট্য সৃষ্টিতে ছুঁয়ে যায় মানবতা আর রাজনৈতিক চেতনার গভীর স্পন্দন। দে সিকা মুখ ফিরিয়ে নেন সস্তা সেন্টিমেন্টের বানানো গল্প থেকে। তাঁর জন্য চিত্রনাট্য লিখতে বসেন জাভাত্তিনি। ছবির নাম ‘দ্য চিলড্রেন আর ওয়াচিং আস’ (১৯৪৪)। কিন্তু মুক্তি পেল না চলচ্চিত্রটি। আপত্তি জানাল সরকার। শেষ পর্যন্ত ১৯৪৪ সালে করা চলচ্চিত্রটি মুক্তি পেয়েছিল ১৯৪৮ সালে। তাও স্বদেশে নয়, ফ্রান্সে।

ভিত্তোরিও দে সিকার ক্যারিয়ার ছিল বিচিত্র। সাফল্যের সাথে সাথে তিনি পেয়েছেন বিস্ময়কর ব্যর্থতা। বাইসাইকেল থিফের কথা হিসেবের বাইরে রাখাই ভালো। বেশ কিছু চলচ্চিত্রে দে সিকা যে সাফল্য পেয়েছেন, তা নিয়ে তিনি তেমন উচ্ছসিত ছিলেন না। এমনকি তাঁর নাকি বিশেষ আশাবাদও ছিল না সেগুলো নিয়ে। এ চলচ্চিত্রগুলোর বিষয়ে তেমন কথাও তিনি বলেন নি। এগুলোর মধ্যে 'দ্য গোল্ড অব নেপলস' (১৯৫৪), 'টু উওমেন' (১৯৬১), 'ফিলুমেনা মারতুরানো'র (১৯৬৪) প্রসঙ্গ আসতে পারে। এগুলোর মধ্যে বিশেষভাবে বলা যেতে পারে টু উওম্যানের কথা। আলবার্তো মোরাভিয়ার বিখ্যাত উপন্যাস থেকে নির্মিত এই চলচ্চিত্র অস্কার পর্যন্ত জিতে নিয়েছিল। অথচ তাঁর নিজের পছন্দের চলচ্চিত্রের কথা বললে 'উমবার্তো ডি' (১৯৫২) ছিল একদমই ব্যর্থ, পুরোপুরি ফ্লপ। দ্য গোল্ড অব নেপলসের কয়েক বছর পর নিজের বিনিয়োগে দুটো চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছিলেন দে সিকা। 'দ্য রুফ' (১৯৫৬), 'আনা অব ব্রুকলিন' (১৯৫৮)। ছবিগুলো দে সিকার পছন্দের এবং অনেক ভালোবাসার হলেও সেগুলো ব্যবসায়িক সাফল্য পায়নি। সত্যি বলতে 'টু উওমেন' না হলে স্বরুপে প্রত্যাবর্তন করা অসম্ভব ছিল তাঁর। 'ফিলুমেনা মারতুরানো' (১৯৬৪) নিয়ে যখন দে সিকা অাবির্ভূত হলেন তত দিনে ইতালীয় চলচ্চিত্রে নব্য-বাস্তববাদের ধারা মোটামুটি অদৃশ্য হয়ে গেছে। এমন সময় সেই দে সিকাই বাজালেন পুরনো সুর। হয়তো ব্যর্থই হতেন কিন্তু হতে দেননি মার্শেল্লো মাস্ত্রোয়ানি-সোফিয়া লোরেন জুটির অসামান্য অভিনয়। দে সিকার জন্য 'অপ্রত্যাশিত' হলেও দারুণ সফল হল এই চলচ্চিত্র।

সাফল্য-ব্যর্থতার হিসেব যেমনই হোক, দে সিকা কখনোই আরেকটি বাইসাইকেল থিফ তৈরি করতে চাননি। নিও রিয়ালিস্ট তত্ত্বের ওপর ভর করে থাকেননি আজীবন। একইসাথে, শিল্পের জন্য কখনো সামান্যতম সমঝোতা করেননি তিনি। কিংবা কপটতাও ছিল না তাঁর। সোজাসাপ্টা স্বীকারোক্তি করেছেন নিজের চলচ্চিত্র বিষয়ে। যাচাই করেছেন নিজের বিখ্যাত সব চলচ্চিত্রকে ‘সামান্য’ হিসেবে। আবার যে চলচ্চিত্রগুলোকে নিয়ে কোনো কথাই হয় না, সেগুলোকে নিজের ‘সেরা কাজ’ হিসেবে সাব্যস্ত করেছেন। যুদ্ধ-পরবর্তী ইতালির অসহায় মানুষদের দুর্দশা দেখতে তিনি সরাসরি ঘুরে বেরিয়েছেন পথে পথে। চলচ্চিত্র নির্মাণে তাঁর বোধ-অনুভূতি হয়তো অনেকাংশে ফিল্ম-টেকনিকের চেয়েও অধিকতর কার্যকরী হাতিয়ার ছিল।

ভিত্তোরিও দে সিকা পরিচালনা করেছেন ৩৫টি চলচ্চিত্র। অভিনেতা হিসেবে তাঁর কাজের সংখ্যা ১৫৮। ১৯৭৪ সালের ১৩ নভেম্বর তিনি মৃত্যুবরণ করেন।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত