মাক্সিম গোর্কি

প্রকাশ : ২০ জুন ২০১৮, ১১:২০

'গোর্কি' অর্থাৎ 'তেতো'। জগদ্বিখ্যাত এই রুশ সাহিত্যিক নিজেই তাঁর সাহিত্যিক ছদ্মনাম হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন 'গোর্কি' নামটিকে। পুরো নাম আলেক্সেই ম্যাক্সিমোভিচ পেশকভ বা মাক্সিম গোর্কি। জন্মেছিলেন ১৮৬৮ সালের ২৮ মার্চ। মৃত্যুবরণ করেন ১৯৩৬ সালের ১৮ জুন। রাশিয়ার নিঝনি নভগোরোদে জন্ম নেয়া চিরবিপ্লবী গোর্কি ছিলেন পিতা-মাতার প্রথম সন্তান। তাঁর ব্যক্তিগত জীবন ছিল বিস্ময়কর ও নানা তিক্ততায় ভরা। খুব ছোটবেলায় পিতা ম্যাক্সিম পেশকভের মৃত্যু। এরপর মামার বাড়িতে আশ্রয়। তাঁর বয়স যখন ১১ বছর, মা ভারভারা পেশকভা ক্ষয়রোগে মারা গেলেন। চিরতরে অনাথ হয়ে পড়লেন গোর্কি। ১২ বছর বয়সে গোর্কি নিরুদ্দেশ যাত্রা করেন। ১৯ বছর বয়সে নিজের বুকে গুলি করে আত্মহত্যার চেষ্টা করেন। ঘটনাচক্রে বেঁচেও যান।

বিশ্বে তখন চলছিল চরম অস্থির এক সময়। রাশিয়ায় চলছিল জারের শাসন। শাসনের নামে অাসলে চলছিল শোষণ অার অত্যাচার। এমন এক সময়ে গোর্কি যুক্ত হলেন বিপ্লবী দলের সঙ্গে। তাঁর পরিচয় হল কার্ল মার্ক্সের রচনাবলির সঙ্গে। অর্থনীতি, ইতিহাস, সমাজনীতি, দর্শনসহ নানা বিষয়ে পাঠ নিতে শুরু করেন। দারিদ্র্যকে সঙ্গী করেই বিস্তৃত ও বেগবান হয়েছিল তাঁর জীবন-জীবিকা, গ্রন্থপাঠ, বিপ্লব এবং সাহিত্য চর্চা।

দারিদ্র্য ছিল গোর্কির সার্বক্ষণিক সহচর। কিছুদিন পর একটি রুটির দোকানে কাজ নিলেন। সন্ধ্যে থেকে পরদিন দুপুর অবধি একটানা কাজ করতে হয়। তারই ফাঁকে যেটুকু সময় গোর্কি তখন বই পড়েন। বাস্তমুখর জীবনের পরতে পরতে তিনি কষ্টকে, পরিশ্রমকে অাপন সঙ্গীরুপে দেখেছেন। তাঁর এই সময়কার জীবনে অভিজ্ঞতার কাহিনি অবলম্বনে পরবর্তীকালে লিখেছিলেন বিখ্যাত গল্প 'ছাবিবশজন লোক আর একটি রুটি'। কারখানায় কাজ করার সময় পুলিশের সন্দেহের কুনজর পড়েছিল তাঁর ওপর। সুকৌশলে নিজেকে বাঁচিয়ে চলতেন গোর্কি।

এক বৃদ্ধ বিপ্লবী মাঝে মাঝে রুটির কারখানায় আসতেন। সুস্থ হয়ে উঠতেই গোর্কিকে নিয়ে গেলেন নিজের গ্রামের বাড়িতে। ঘুরতে ঘুরতে এলেন নিজের ক্যাসপিয়ান সাগরের তীরে এক ছোট্ট শহরে। কোথাও বেশিদিন থাকতে মন চায় না। রেলে পাহারাদারির কাজ নিয়ে এলেন নিজের পুরনো শহর নিজনি নভগোরদে। এই সময়ে তিনি কিছু কবিতা রচনা করেছিলেন। নাম দেন 'পুরনো ওকের গান'। দুজন বিপ্লবীর সাথে পরিচয় ছিল। সেইজন্য পুলিশ তাঁকে বন্দী করল। কিন্তু প্রমাণের অভাবে কিছুদিন পর তিনি মুক্তি পেলেন। এরপর প্রায় দুবছর সেখানে রয়ে গেলেন গোর্কি।

পরবর্তীতে কুলঝানি নামক এক ভদ্রলোক তাঁকে নিয়ে গেলেন স্থানীয় পত্রিকা অফিসে। নিজের নাম সই করার সময় ’আলেক্সই পেশকভ’ এর পরিবর্তে লেখলেন ম্যাক্সিম গোর্কি। গল্পটি প্রকাশিত হল ১৮৯২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে। এই গল্পে বাস্তবতার চেয়ে রোমান্টিকতার প্রভাবই বেশি ছিল। 'চেলকাশ’ গল্প যখন কাগজে বেরুল তখন গোর্কি সাংবাদিকতার চাকরির প্রস্তাব পেলেন। সামারার একটি বড় কাগজে চাকরি, মাস গেলে ১০০ রুবল আসবে। গোর্কিও সানন্দে রাজি হয়ে গেলেন। তিফলিস শহর থেকে প্রকাশিত ‘কাফকাজ’ (অর্থাৎ ককেশাস) দৈনিক সংবাদপত্রে ১৮৯২-এর ১২ই সেপ্টেম্বর শনিবার একটি গল্প ছাপা হল 'মাকার্ চুদ্রা'। লেখকের নাম ম. গোর্কি। এরপর অনেক পত্রিকায় ক্রমে ক্রমে লেখা ছাপা হতে থাকল। ভোলগা সংবাদপত্র, দৈনিক সামারা, ওদেসা সংবাদ, নিঝেগরোদ পত্র ইত্যাদি।

এ সময় এক নারীর প্রেমে পড়েন গোর্কি। ১৮৯৬ খ্রিষ্টাব্দে বিবাহ। মাত্র আট বছরের দাম্পত্য জীবন, ১৯০৪ পর্যন্ত। আইনত বিবাহ বিচ্ছেদ না হলেও তারা আর একত্রে জীবনযাপন করেননি। এরই মাঝে নতুন করে অাবার প্রেমে জড়িয়ে পড়েন গোর্কি। প্রেমিকা বহুভাষাবিদ ও মস্কো আর্ট থিয়েটারের অভিনেত্রী এবং বলশেভিক পার্টির সদস্য মারিয়া ফিওদরনা আন্দ্রেইয়েভার। একপর্যায়ে অবশ্য মারিয়ার সাথেও বিচ্ছেদ হয়ে যায় গোর্কির। বিচ্ছেদ হলেও স্ত্রী একাতেরিনা ও প্রেমিকা মারিয়া উভয়েই গোর্কির খোঁজ খবর রেখেছেন।

১৮৯৮ খ্রিষ্টাব্দে পিটাসবুর্গ থেকে তাঁর প্রথম গ্রন্থ ‘ওচের্কি ই রাস্কাজি’ (নকশা ও গল্পাবলী) দুই খণ্ডে প্রকাশিত হয়। এর আগেই পত্র-পত্রিকায় অনেক গল্প প্রকাশ হয়। এর মধ্যে ‘পেসনিয়া আ সোকলে’ ও ‘পেসনিয়া আ বুরেভিয়েনিকে’ (যথাক্রমে বাজপাখির গান ও ঝড়ো পাখির গান) নামে দুটি কবিতা তাঁকে খ্যাতির শীর্ষে পৌঁছে দিয়েছিল। ১৮৯৫ সালে তাঁর বিখ্যাত ‘চেলকাশ’ গল্পটি এক দৈনিকে প্রকাশ হবার পর আলোড়ন পড়ে যায়। সেই সুবাদে সামারার এক বড় পত্রিকায় চাকরির সুযোগ পেয়ে যান। তখন তিনি ঠিক করেন, চাকরি করবেন এবং পাশাপাশি লেখা চালিয়ে যাবেন। ম্যাক্সিম গোর্কি অবশ্য পরবর্তীতে ১৯১৫–এ ‘লিয়েতপিস্’ (কড়চা) পত্রিকা প্রকাশ করেন। এর ছয় বছর পর ১৯২১ থেকে তার সম্পাদনায় সোভিয়েত সাহিত্য পত্রিকা ‘ক্রাস্নায়া নোফ্’ (রক্তিম জমি) প্রকাশিত হতে থাকে।

শোষন নিপীড়নের আগুনে দগ্ধ হওয়া গোর্কি রাজনীতির সাথে যোগাযোগ সবসময়ই রেখেছেন। যার ফলশ্রুতিতে জার শাসিত রাশিয়াতে যেমন তাঁকে নিগৃহিত হতে হয়েছে, তেমনি ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দের বলশেভিক বিপ্লব পরের সোভিয়েত যুগেও কষ্ট সহ্য করতে হয়েছে। ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে আনুষ্ঠানিকভাবে তিনি যোগ দেন বলশেভিক পার্টিতে। সে বছরই জারের বিরুদ্ধে সংঘটিত হয় প্রথম বিপ্লব, যা ইতিহাসে ‘রক্তাক্ত রবিবার’ বলে পরিচিত। এর পরের বছরই গোর্কিকে দেশ ছাড়তে হয়। এরপর প্রায় সাত বছর তাঁকে বিভিন্ন জায়গায় অন্তরীণ থাকতে হয়। এ দীর্ঘ সময়কালের মধ্যে তিনি সবচেয়ে বেশি সময় অবস্থান করেন ইতালির কাপ্রি দ্বীপে। অন্যায়ের বিরুদ্ধে চিরবিদ্রোহী গোর্কি সেখানেও পরিচালনা করেছেন রাজনৈতিক পঠন পাঠনের বিদ্যালয়। দেশে ফিরে অাসেন ১৯১৩ সালে। এর মাত্র চার বছর পর ১৯১৭ খ্রিষ্টাব্দে রাশিয়াতে সংঘটিত হয় ইতিহাসের সর্বপ্রথম সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব। পতন হয় জারতন্ত্রের, প্রতিষ্ঠিত হয় শ্রমিক-কৃষকের শাসন। বিপ্লব পরবর্তী সোভিয়েত রাশিয়াতে তিনি দেশ গড়ার কাজে মনোনিবেশ করেন। কিন্তু নতুন দেশে নতুনভাবে তিনি আর পার্টির সদস্য হননি। শতভাগ মনোনিবেশ করেন লেখালেখিতে। জীবদ্দশায় সোভিয়েত রাশিয়ায় তিনি ছিলেন সাহিত্যের মুকুটহীন সম্রাট। ‘মা’ উপন্যাস তাঁকে সোভিয়েত রাশিয়ার সীমানা ছাড়িয়ে পৃথিবীতে উচ্চতম মর্যাদার আসনে নিয়ে যায়। বলা হয়ে থাকে, অাজ অব্দি এটি পৃথিবীর সর্বাধিক পঠিত এবং সর্বাধিক সংখ্যক ভাষায় অনুদিত একটি গ্রন্থ।

১৯২১ সালে গোর্কির শরীরে যক্ষা রোগ ধরা পড়ে। উন্নত চিকিৎসার জন্য লেনিন তাঁকে বিশেষ ব্যবস্থাপনায় জার্মানিতে প্রেরণ করেন। বছর দুই চিকিৎসার পর সেখান থেকে ফিরে আসেন তাঁর প্রিয় ইতালি কাপ্রিতে। সেখানে আরও চার বছর অবস্থান করে সাহিত্য সাধনায় নিজেকে নিমগ্ন রাখেন। এরপর ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দে তিন দেশে ফিরে অাসেন। মরনব্যাধি ঠিক মত সারলো না। চিকিৎসারত অবস্থায় ১৯৩৬ খ্রিষ্টাব্দের ১৮ জুন ৬৮ বছর বয়সে আকস্মিকভাবে মৃত্যুবরণ করেন ম্যাক্সিম গোর্কি। তখন সোভিয়েত সরকারের প্রেসিডেন্ট জোসেফ স্তালিন। তাঁর সরকার বিষ প্রয়োগের অভিযোগে গোর্কির চিকিৎসকদের বিচারের মুখোমুখি করে এবং শাস্তি দেয়। একই সাথে একই অভিযোগে কমিউনিস্ট পার্টির প্রথম সারির কয়েকজন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তির বিরুদ্ধে মৃত্যুদণ্ড ঘোষিত হয় এবং অবিলম্বে কার্যকরও করা হয়। গোর্কির আকস্মিক মৃত্যু রহস্য আজও অমীমাংসিত রয়ে গেছে। গোর্কি বহু বিষয়ে পার্টির সঙ্গে একমত হতে পারতেন না, সমালোচনা করতেন। সবচেয়ে বড় কথা তিনি তাঁর ব্যক্তিগত মতামত প্রকাশ করতে অকুণ্ঠ সাহসী ছিলেন। ঘটনার পরিকল্পনাকারী বা হোতা যিনিই হোন না কেন, গোর্কির মৃত্যু যে স্বাভাবিক ছিল না, এ বিষয়ে সকলেই সংশয়হীন। শেষকৃত্যানুষ্ঠানের শবযাত্রায় কফিন বাহকদের একজন হিসেবে জোসেফ স্তালিন অংশ নিয়েছিলেন। রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় তাঁর শেষকৃত্য সম্পন্ন করা হয়।

মাক্সিম গোর্কি'র রচনা সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে গেয়র্ক লুকাচ বলেন- "লেখক হিসেবে গোর্কি সর্বদাই তাঁর সমকালীন ঘটনাবলীর প্রতি বিশ্বস্ত থেকেছেন এবং নিজের রচনার মধ্যে এমন ভেদরেখা টেনে দেননি যাতে কতটুকু একজন সাহিত্যিকের লেখা আর কতটুকু এক বিপ্লবী সাংবাদিক ও প্রচারকর্মীর তা ধরা যায়। সত্য এর বিপরীতটাই। তাঁর মহত্তম সাহিত্যকীর্তি সর্বদা সাংবাদিকতাকে আশ্রয় করে উত্থিত হয়েছে।"

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত