শ্রীহীন হয়ে পড়েছে সাগরকন্যা

সমুদ্রের বিলীন হচ্ছে কুয়াকাটার দৃষ্টিনন্দন দর্শনীয় স্থান

প্রকাশ : ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১৮:৫২

কলাপাড়া(পটুয়াখালী)প্রতিনিধি
ছবি: সাহস

দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম সমুদ্র সৈকত কুয়াকাটা। এখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে ভ্রমণ পিয়াসীরা এর নাম দিয়েছে সাগরকন্যা। সূর্যোদয় সূর্যাস্তের মত বিরল দৃশ্য উপভোগ করতে এখানে আসেন হাজারো মানুষ। পদ্মা সেতু উদ্বোধনের পর কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকতে পর্যটক সমাগম বাড়লেও সৈকত রক্ষায় উদাসীন কর্তৃপক্ষ। বৈরি প্রকৃতি আর সমুদ্রের করাল গ্রাসে সৈকত যেন ক্রমশই অস্তিত্ব হারাচ্ছে। প্রতিনিয়ত জোয়ারের তান্ডবে বালু ক্ষয়ে ধুয়ে মুছে যাচ্ছে দৃষ্টিনন্দন সব দর্শনীয় স্থান। এর ফলে জৌলুস হারিয়ে শ্রীহীন হয়ে পড়েছে সাগরকন্যা। প্রতি বছর ১৫ থেকে ২০ মিটার প্রশস্ততা হারাচ্ছে। এভাবেই ছোট হয়ে আসছে সৈকতের মানচিত্র। ভাঙন ঠেকাতে দ্রুত সময়ের মধ্যে স্থায়ী বাঁধ নির্মাণের দাবি পর্যটক সংশ্লিষ্টসহ স্থানীয়দের।

কুয়াকাটা ঝাউবন সংলগ্ন বাসিন্দা ষাটোর্ধ্ব চাঁন মিয়া। সে পেশায় জেলে। তার ভাষ্যমতে, প্রায় ২০ বছর আগেও সৈকতের প্রস্থ ছিল ৫ কিলোমিটার। মূল বেড়িবাঁধের পর সৈকতের বিশাল এলাকাজুড়ে ছিল ফয়েজ মিয়ার নারিকেল বাগান, তাল বাগান, শাল বন, ঝাউবন ও জাতীয় উদ্যানসহ বহু স্থাপনা। কিন্তু সমুদ্রের উত্তাল ঢেউয়ের তান্ডবে এসব বাগান বিলীন হয়ে গেছে। বর্তমানে সৈকতের প্রস্থ এসে দাঁড়িয়েছে মাত্র ১ কিলোমিটার। ভাঙনের ঝুঁকিতে রয়েছে সৈকতের জিরো পয়েন্টের মসজিদ, মন্দির ও ট্যুরিজম পার্কসহ পর্যটন সংশ্লিষ্ট দোকানপাট। 

অপর এক বাসিন্দা ইয়াছাক হাওলাদার বলেন, ইতোমধ্যে বিলীন হয়ে গেছে রাজস্ব বোর্ডের বাংলো, এলজিইডির বায়োগ্যাস প্লান্ট, পাবলিক টয়লেট, ক্ষুদ্র ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, বাড়িঘরসহ হাজার হাজার একর ফসলি জমি। 

সৈকত এলাকার আর এক বাসিন্দা দেলোয়ার মিয়া তার জীবন যৌবন সমুদ্রের পাড়েই কেটেছে। তিনি বলেন, ফয়েজ মিয়ার বাগান পেরিয়ে খাল, নালা, রিজার্ভ ফরেস্ট তারপর ছিল সমুদ্র। বাড়ি থেকে সমুদ্রের পাড়ে যেতে ৪-৫ ঘন্টা সময় লাগতো। ভাঙ্গতে ভাঙ্গতে এখন সমুদ্রের ঢেউ এসে তার ঘরের সামনে গড়াচ্ছে।

শুধু দেলোয়ার মিয়া নয়,এমন কথা জানিয়েছেন কুয়াকাটার বেশ কয়েকজন স্থানীয় বাসিন্দা। তাদের মতে গত তিন দশকে বনাঞ্চলসহ প্রায় তিন কিলোমিটার সৈকত সমুদ্রে গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। সৈকতের ভূমি ক্ষয় বা ভাঙ্গন রোধে দ্রুত ব্যবস্থা না নিলে অচিরেই কুয়াকাটা সৈকতের ভূ-ভাগের চিত্র পাল্টে গিয়ে ভূতুরে সৈকতে পরিনত হবে। তাই প্রাকৃতিক সৌন্দর্য বজায় রেখে ভাঙ্গন রোধে প্রকল্প প্রস্তাবণা গ্রহন করে তা বাস্তাবায়নের দাবী বিনিয়োগকারী ও স্থানীয় বাসিন্দাদের।

পর্যটক আহসান বলেন, গত ৫ বছর আগের কুয়াকাটার সাথে এখন মিলছেনা। সেই সময় দেখেছি সৈকত লাগোয়া সাড়ি সাড়ি নারিকেল বাগান ও ঝাউ বন। পরিবেশটা ছিলো বেশ ভালো। কিন্ত এখন দেখছি সৈকতের বিভিন্ন স্থানে ফাটাছেড়া জিও ব্যাগ। বড় বড় গাছ কাঁত হয়ে পড়ে আছে। 

পর্যটক জুয়েল বলেন, অপরিকল্পিতভাবে বালু ভর্তি জিও টিউব ও জিও ব্যাগ সৈকতের সৌন্দর্য হারিয়েছে। এটা শুধু মাত্র অর্থ অপচয়। এতে প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনার শঙ্কাও রয়েছে। তিনি আরও বলেন, পদ্মা সেতু উদ্বোধনের পর থেকেই কুয়াকাটায় দেশ-বিদেশের প্রচুর সংখ্যক পর্যটক আসতে শুরু করেছে। তাই সৈকত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা উচিৎ বলে এমটাই মনে করেন এই পর্যটক।

তবে বাপাউবো’র তথ্যমতে প্রতিবছর বর্ষা মৌসুমে সৈকত ঢেউয়ের ঝাপটায় বিলীন হয়ে সমুদ্র গর্ভে চলে যাচ্ছে।

খোজ নিয়ে জানা গেছে, ২০১৮ সাল থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত কুয়াকাটা সৈকতের জিরো পয়েন্টের দুই দিকে দেড় কিলোমিটার সৈকত রক্ষায় চার দফায় ৮ কোটি টাকার অস্থায়ী প্রকল্প গ্রহন করলেও তা তেমন একটা কাজে আসেনি। সৈকতের পশ্চিমে ১০ কিলোমিটার বেরীবাধেঁর উপর ব্লক বসানো হলেও পুর্বদিকে অদ্য পর্যন্ত কোন প্রকল্প গ্রহন না করায় ঝুঁকিতে রয়েছে বনভূমি, আবাসিক হোটেল মোটেল ও বাড়িঘর।

এদিকে অনেকেই সৈকতে গোসলে নামতে অনীহা প্রকাশ করছেন। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ দ্রুত পদক্ষেপ না নিলে দেশি-বিদেশি পর্যটকরা মুখ ফিরিয়ে নিতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করছেন পর্যটন ব্যবসায়ীরা।

বনবিভাগের মহিপুর রেঞ্জ কর্মকর্তা আবুল কালাম জানান, কুয়াকাটা জাতীয় উদ্যান ২০১০ সালে ঘোষণা করা হয়েছে। এরপর এ উদ্যানে বিভিন্ন প্রজাতির বৃক্ষরোপন ও স্থাপনা নির্মাণ করা হয়। এর বেশিরভাগ অংশই বারবার ঘূর্নিঝড়, জলোচ্ছ্বাস ও সমুদ্রের ঢেউয়ের তান্ডবে ধ্বংস হয়ে গেছে। 

পানি উন্নয়ন বোর্ডের কলাপাড়া নির্বাহী প্রকৌশলী খালেদ বিন অলীদ জানান, ২০১৯ সাল থেকে কুয়াকাটা সৈকত রক্ষায় প্রতিনিয়ত কাজ করছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। ইতোমধ্যে একটি প্রকল্প অনুমোদনের জন্য পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। এটি অনুমোদন পেলে ভাঙন রক্ষায় কাজ শুরু করা যাবে বলে তিনি সাংবাদিকদের জানান।

 

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত