কুসিক নির্বাচন: বিএনপির বহিস্কৃত প্রার্থীকে ৩৪৩ ভোটে হারিয়ে বিজয়ী আ’লীগ প্রার্থী

প্রকাশ : ১৬ জুন ২০২২, ০৩:২২

সাহস ডেস্ক
আরফানুল হক রিফাত ও মনিরুল হক সাক্কু

কুমিল্লা সিটি করপোরেশন (কুসিক) নির্বাচনে মেয়র পদে নৌকার প্রার্থী আরফানুল হক রিফাত নির্বাচিত হয়েছেন। বুধবার (১৫ জুন) শহরের শিল্পকলা একাডেমি মিলনায়তনে অনেক নাটকীয়তার পর রাত সাড়ে ৯টার দিকে রিটার্নিং কর্মকর্তা শাহেদুন্নবী চৌধুরী বেসরকারিভাবে নৌকার প্রার্থী রিফাতকে মেয়র পদে বিজয়ী ঘোষণা করেন।

তবে ফল ঘোষণার শেষ সময়ে এসে চরম উত্তেজনা তৈরি হয়। আওয়ামী লীগের প্রার্থী রিফাত এবং স্বতন্ত্র প্রার্থী মনিরুল হক সাক্কুর কর্মী-সমর্থকেরা মুখোমুখি হয়ে পড়েন। এক সময় সাক্কুর দিকে তেড়ে আসে আওয়ামী লীগের কর্মী সমর্থকেরা। হইচই, হট্টগোল ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে তারা। এসময় রিটার্নিং কর্মকর্তা সবাইকে শ্লোগান বন্ধ ও শান্ত হওয়ার জন্য বলেন। কিন্তু তাতে কোনো কাজ হয়নি। একপর্যায়ে দুই পক্ষের সমর্থকদের মধ্যে তীব্র উত্তেজনার সৃষ্টি হলে লাঠিচার্জ করে সবাইকে হল থেকে বের করে দেন পুলিশের সদস্যরা। মিলনায়তনের পরিস্থিতি থমথমে হয়ে পড়ে। সেসময় পুলিশ সাক্কুকেও সেখান থেকে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে। তবে তিনি ভোটের ফল না নিয়ে সেখান থেকে চলে যেতে অস্বীকৃতি জানান। এর পরের ১০ মিনিট চলে পুলিশের অ্যাকশন। পরিস্থিতি শান্ত হলে রাত সাড়ে ৯টার দিকে ফল ঘোষণা করেন রিটার্নিং কর্মকর্তা।

মনিরুল হক সাক্কুর দিকে তেড়ে আসে আওয়ামী লীগের কর্মী-সমর্থকেরা।

মোট ১০৫ কেন্দ্রের মধ্যে ১০১ কেন্দ্রের ভোট গণনা করা হয়। এসময় রিটার্নিং কর্মকর্তা মাইকে ঘোষণা করেন, ‘চারটি কেন্দ্রের ফল ঘোষণা বাকি আছে।’ ১০১ কেন্দ্রের ভোটের ফলাফলে রিটার্নিং কর্মকর্তার বিজয়ী ঘোষিত আওয়ামী লীগ প্রার্থী রিফাত পেয়েছেন ৫০ হাজার ৩১০ ভোট। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপি থেকে বহিষ্কৃত স্বতন্ত্র মেয়রপ্রার্থী মনিরুল হক সাক্কু পেয়েছেন ৪৯ হাজার ৯৬৭ ভোট। ফলে মাত্র ৩৪৩ ভোটে সাক্কুকে হারিয়ে বিজয়ী হয়েছেন রিফাত। পরপর দুবার মেয়র পদে নির্বাচিত সাক্কুর আর হ্যাটট্রিক করা হলো না। সাক্কুর প্রতীক ছিল টেবিলঘড়ি। ফল ঘোষণার সময় সাক্কু সেখানে উপস্থিত ছিলেন। ঘোষণা শেষে সাক্কু সাংবাদিকের বলেন, ‘আমাকে পরিকল্পিতভাবে হারানো হয়েছে।’

মনিরুল হক সাক্কুর দাবি, তাকে পরিকল্পিতভাবে হারানো হয়েছে।

আগে কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশনে টানা দুইবার মেয়র পদে নেতৃত্ব দিয়েছেন মনিরুল হক সাক্কু। ২০১২ সালে প্রথম বিজয়ী হন তিনি। সেবার আওয়ামী লীগের প্রবীণ নেতা আফজল খানকে ২৯ হাজার ১০৬ ভোটে হারিয়ে মেয়র হন সাক্কু। পরের বার আফজল খানের মেয়ে আঞ্জুম সুলতানাকে ১১ হাজার ৮৫ ভোটে হারিয়ে নির্বাচিত হন। তবে পরাপর বাপ-মেয়েকে হারালেও পারলেন না আরফানুল হক রিফাতের সঙ্গে। ফল ঘোষণার পর মেয়র পদে বিজয়ী রিফাত সাংবাদিকদের বলেন, এই বিজয় কুমিল্লাবাসীর। কুমিল্লার মানুষ পরিবর্তনের পক্ষে রায় দিয়েছে, দুর্নীতির বিরুদ্ধে রায় দিয়েছে। এ বিজয় কুমিল্লার উন্নয়নে ভূমিকা রাখবে।

তবে সাক্কুর হেরে যাওয়ার আরও একটা কারণ, বিএনপির বহিস্কৃত আরেকজন স্বতন্ত্র প্রার্থী। কুমিল্লা জেলা স্বেচ্ছাসেবক দলের সভাপতি মো. নিজামউদ্দিন কায়সার, লড়েছেন ঘোড়া প্রতীকে। তিনি ভোট পেয়েছেন ২৯ হাজার ৯৯। কুমিল্লা মহানগরে বিএনপি দৃশ্যত দুই ভাগে বিভক্ত। এক অংশের নেতৃত্ব দেন সাক্কু, আর তার প্রতিদ্বন্দ্বী সাবেক সংসদ সদস্য আমিনুর রশীদ ইয়াসিন। এই ইয়াসিনের শ্যালক হলেন কায়সার। একই দলের প্রার্থী কায়সার এই নির্বাচনে সাক্কুর জীবনের প্রথম পরাজয়ের কারণ হতে পারে বলে শুরু থেকেই আলোচনায় ছিল। অনেকে ‘ঘরের শত্রু বিভীষণ’ বলেও মন্তব্য করছেন সোশ্যাল মিডিয়ায়। দলের সিদ্ধান্ত অমান্য করে নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ায় দুজনকেই বহিষ্কার করেছে বিএনপি। এমনকি নেতা-কর্মীদেরকে সাক্কুর সংস্রব এড়িয়ে চলারও পরামর্শ দেওয়া হয়। তবে নির্বাচনে দুজনেরই ভোটের উত্স ছিল বিএনপির নেতা-কর্মী-সমর্থকদের ভোট। দুজন মিলে ভোট পেয়েছেন ৭৯ হাজার ৬৬ ভোট, যা আওয়ামী লীগের বিজয়ী প্রার্থীর চেয়ে ২৮ হাজার ৭৫৬ ভোট বেশি। ভোট হয়েছে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএম)। মোট ২ লাখ ২৯ হাজার ৯২০ ভোটারের মধ্যে ১ লাখ ৩৫ হাজার ৯৪ জন ভোট দিয়েছেন। ৩১৯ ভোট বাতিল হয়েছে। ভোট পড়ার হার ৫৮ দশমিক ৭৪ শতাংশ।

এর আগে সরেজমিনে প্রতিনিধিদের পাঠানো তথ্যে জানা যায়, সকাল ৮টা থেকে শুরু হওয়া নির্বাচনের ভোট গ্রহণ চলছিল শান্তিপূর্ণভাবেই। তবে নির্বাচন পরিস্থিতি অস্থিতিশীল করার অভিযোগে একই দিন ১০ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দিয়েছে স্থানীয় প্রশাসন। সন্ধ্যা ৬টার দিকে এ প্রতিবেদনটি লেখা পর্যন্ত কোনো সহিংসতার খবর পাওয়া যায়নি।

হাড্ডাহাড্ডি লড়াই: নির্বাচনে প্রাথমিক ফলাফলে আওয়ামী লীগের প্রার্থী আরফানুল হক রিফাত ও গত দুইবারের মেয়র বিএনপি থেকে বহিষ্কৃত নেতা মনিরুল হক সাক্কুর মধ্যে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই চলছিল বলে জানা যায়। তবে কিছু কেন্দ্রে নৌকা এগিয়ে থাকার তথ্যও পাওয়া যায়। সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত ঘোষিত ফলাফলে নৌকা প্রতীক নিয়ে রিফাত এগিয়ে রয়েছেন। প্রথম ১০টি কেন্দ্রের ফলাফলে সাতটিতে জয় এনেছেন তিনি। দুটিতে জিতেছেন সাক্কু। একটিতে স্বেচ্ছাসেবক দলের পদত্যাগী নেতা নিজামউদ্দিন কায়সার। সাক্কু ও কায়সারের ভোট যোগ করলে নৌকার চেয়ে বেশি হয়। ১১ কেন্দ্রে নৌকায় ভোট পড়েছে ৪ হাজার ১৩০টি। সাক্কুর ঘড়িতে পড়েছে ৩ হাজার ৩৩৪টি। কায়সারের ঘোড়ায় ভোট পড়েছে ১ হাজার ৭৬৪টি। এই নির্বাচনে আরও দুই জন প্রার্থী আছেন। তাদের ভোটের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য নয়।

৬০ শতাংশের ভোট- সিইসি: কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ৬০ শতাংশের মতো ভোট পড়েছে বলে জানিয়েছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিব আউয়াল। আওয়ামী লীগ দলীয় সংসদ সদস্য আ ক ম বাহার উদ্দীন বাহারকে এলাকা ছাড়ার কথা বলে সমালোচনার মুখে পড়া সিইসি এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। তিনি বলেন, ‘এ বিষয় পাস্ট অ্যান্ড ক্লোজড।’

প্রার্থীদের কথা: নির্বাচনের সার্বিক পরিবেশে সন্তুষ্ট আওয়ামী লীগের প্রার্থী আরফানুল হক রিফাত। নিজের জয়ের বিষয়ে আশাবাদী তিনি। সকাল সোয়া ৯টার দিকে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজিয়েট হাইস্কুলে ভোট দেন আরফানুল রিফাত। একই ভোটকেন্দ্রে ভোট দেন স্বতন্ত্র প্রার্থী মোহাম্মদ নিজাম উদ্দিন কায়সার ও স্থানীয় সংসদ সদস্য আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহার। সকালে বৃষ্টির মধ্যেও বিপুল সংখ্যক ভোটারকে ভোট দিতে দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেছে। সকাল ৮টায় ভোটগ্রহণ শুরু হয়ে বিরতি ছাড়াই চলে বিকাল ৪টা পর্যন্ত।

১০ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড: নির্বাচনের সময় বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি সৃষ্টির চেষ্টায় জড়িত থাকায় তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে বলে জানান প্রশাসক কামরুল হাসান। ২৩নং ওয়ার্ডে দিদার হোসেনকে সাত দিনের, সদর দক্ষিণ উপজেলার একজনকে তিন দিনের, ৩নং ওয়ার্ডে দুজনকে তিন দিনের, ১০নং ওয়ার্ডে তিনজনকে তিন দিনের, বড়পুকুর এলাকায় দুজনকে ৭ দিনের এবং হোচ্ছামিয়া বালিকা বিদ্যালয়ে আরেকজনকে ৭ দিনের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে।

গোপন কক্ষে কর্মকর্তাদের উঁকি ও অন্যান্য সমস্যা: ইভিএমে নেওয়া এই ভোটে ধীরগতি নিয়ে শুরু থেকেই চলছিল আলোচনা সমালোচনা। ভোটারদের অনভ্যস্ততা ছাড়াও কোথাও কোথাও মেশিনে ত্রুটির কারণে বেগ পেতে হয়। একটি কেন্দ্রে গোপন কক্ষে বাইরের মানুষের উপস্থিতি এবং একটিতে গোপন কক্ষে পোলিং কর্মকর্তার উঁকি দেওয়ার বিষয়টি গণমাধ্যমে এসেছে। বেলা ৪টায় ভোট শেষ হওয়ার কথা থাকলেও কোনো কোনো কেন্দ্রে ভোট চলেছে ৫টা পর্যন্ত। পৌনে ছয়টার দিকে রিটার্নিং কর্মকর্তা একে একে ফল ঘোষণা করতে থাকেন। এদিকে ভোট দেওয়ার সময় ইভিএমের শব্দ শুনে ভয় পেয়ে কেন্দ্র থেকে বের হয়ে গেলেন এক নারী ভোটার। কেউ কেউ আবার ব্যালটে চাপ দিতে গিয়ে তা নিচেও ফেলে দিচ্ছেন। ৬ নম্বর ওয়ার্ডের আলিয়া মাদ্রাসার নারী ভোটার কেন্দ্রে ভোট দেওয়া নিয়ে এ ধরনের ঘটনা ঘটে।

কেন্দ্রের প্রিসাইডিং কর্মকর্তা মো. নাইমুর রহমান জানান, সকালে এক ভোটার গোপন কক্ষে গিয়ে ব্যালটে চাপ দেওয়ার পর শব্দ শুনে তিনি ভয় পেয়ে বের হয়ে যান। তার ভোট অসম্পূর্ণ থাকায় অন্য ভোটও নেওয়া যাচ্ছিল না। তাকে বুঝিয়ে ফের ভোট দিতে গোপন কক্ষে পাঠানো হয়। এ ছাড়া দুই ভোটার ইভিএমের ইলেকট্রিক ব্যালটে চাপ দিতে গিয়ে নিচে ফেলে দেন। বয়স্ক নারীদের ভোট দিতে তুলনামূলক বেশি সময় লেগেছে। ভোটাররা ইভিএমে প্রথমবার ভোট দেওয়ায় এ ধরনের সমস্যায় পড়েছে বলেও জানান তিনি।

ভোট উৎসবে বৃষ্টির বাগড়া: একপাশে নারী, অন্যপাশে পুরুষ ভোটার। প্রতিটি ভোটকেন্দ্রের একই চিত্র। প্রতিনিধি বলেছেন, সকাল ৯টার পর হঠাৎ করেই বাগড়া দেয় বৃষ্টি। এর মধ্যেই কিছুসংখ্যক ভোটার নিরাপদ আশ্রয়ে ছুটেছেন বৃষ্টি থেকে বাঁচতে। ঝুম বৃষ্টিতেও অনেকে লাইনে দাঁড়িয়ে ছিলেন গায়ে গা ঘেঁষে। লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা ভোটার জাহানারা বেগম কাক ভেজা হয়েও সকাল থেকে দাঁড়িয়ে ছিলেন লাইনে। ১০টা বেজে গেলেও ভোট দিতে পারেননি তিনি। বৃষ্টির কারণে লাইন ভেঙে কোনো জায়গায় আশ্রয় নিলে আরেক বিপদ। নতুন করে সিরিয়াল পেতে লাগবে আরও একই পরিমাণ সময়। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক প্রিসাইডিং কর্মকর্তা বলেছেন, ভোটারদের জন্য বৃষ্টি থেকে রক্ষার তেমন কোনো ব্যবস্থা নেই। যতটুকু আয়োজন আছে এ নিয়েই তাদের কাজ করতে হবে।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত