লক্ষ্মীপুরে অবৈধ বালু উত্তোলনে ধ্বংস হচ্ছে চরাঞ্চল

প্রকাশ : ০৩ জুন ২০২২, ১১:২৭

লক্ষ্মীপুর জেলার বিভিন্ন এলাকায় চলছে ডেজার (শ্যালো মেশিন) দিয়ে অবৈধ বালু উত্তোলন। পুকুর, ছোট নদী, ডোবা-খাল থেকে শুরু করে ফসলি জমি থেকেও অবাধে বালু উত্তোললের ফলে ক্ষতিগস্ত হচ্ছে স্থানীয় জনজীবন, কৃষি এবং প্রাণ-প্রকৃতি। স্থানীয় প্রভাবশালীদের অবৈধ উপায়ে বালু ও মাটি উত্তোলনের ফলে বিস্তৃর্ণ অঞ্চলে বাড়ছে ভূমিক্ষয়।

মাটি কেটে জমি ভরাটের চাইতে তুলনামূলক খরচ অনেক কম হওয়ায় বালু দিয়ে জমি ভরাটে উৎসাহী হচ্ছে স্থানীয়রা। অন্যত্র থেকে বালু কিনতে গেলে প্রতি ফিট বালুর দাম পড়ে ৮-১০ টাকা, আর ডেজার দিয়ে উত্তোলন করা বালু পাওয়া যাচ্ছে ৫-৬ টাকায়। অনেকে নিজ পুকুর কিংবা ছোট ডোবা থেকে ডেজার ভাড়ায় এনে নিচু জমি ভরাট করে উঁচু করছেন। এতে তাদের খরচ পড়ছে ২.৫০ পয়সা থেকে ৩ টাকা।

লক্ষ্মীপুরের রায়পুর উপজেলায় চলছে ডেজার দিয়ে বালু উত্তোলনের প্রতিযোগিতা। মেইন সড়ক থেকে সংযোগ সড়কে ডুকলেই চোখে পড়ে এমন অনেক দৃশ্য। জমি ভরাটের চুক্তি নিয়ে নদী অথবা সংযোগ খাল থেকে বালু উঠিয়ে দিয়ে রীতিমত আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হচ্ছে ডেজার মালিকদের। অধিকতর মুনাফা হওয়ায় স্থানীয় নেতারা ঝুকছেন এই পেশায়। এছাড়াও অবৈধ বালু উত্তোলনে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সমর্থন রয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে এতোদিন পুকুর, ডোবা, নদী, খাল থেকে বালু উত্তোলন করলেও বর্তমানে ডেজার মালিকেরা নতুন কৌশল অবলম্বন করছে। অভিনব পদ্ধতির মাধ্যমে ফসলি জমির মাঝে ছোট একটি গর্ত করে বিপুল পরিমান বালু উত্তোলন করা হচ্ছে। উপরের ভূমি ঠিক থাকলেও ভূমির নিচের অংশে সৃষ্টি হচ্ছে শূন্যতা। বালু উত্তোলনের গর্তের আশপাশের এলাকায় ভূমিধ্বসের ঘটনা ঘটছে। ফসলি জমিতে দেখা দিয়েছে পানির অভাব। বসতভিটা হারানোর হুমকির মধ্যেও পড়েছেন অনেক স্থানীয় বাসিন্দা।

সরজমিন গিয়ে দেখা যায়, বালু উত্তোলনের এই অভিনব পদ্ধতির মাধ্যমে  ২নং উত্তর চর বংশী ইউনিয়নের ২নং ওয়ার্ড চর ইন্দুরিয়ায় বিল্লালের বাড়ির পাশে চলছে বালু উত্তোলনের কর্মযজ্ঞ। সয়াবিন ক্ষেতে পা দিতেই কানে আসে শ্যলো মেশিনের আওয়াজ। ক্ষেত পার হতেই দেখা মিলল সেই শ্যালো মেশিনের। ২নং চরবংশী ইউনিয়নের ২নং ওয়ার্ডের বাসিন্দা বিল্লাল করিরাজ, মিজান বেপারী, সহেল হোসেন, জাকির সহ আরো অনেকেই এই পদ্ধতিতে ডেজারের মাধ্যমে বালু উত্তোলন করছেন। উত্তোলিত বালু পাইপের সাহায্যে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে ৮ থেকে ১০ কিলোমিটার দূরে। দেখা যায়, এক স্থান থেকে বালু উত্তোলনের জন্য ৩টি শ্যলো মেশিন ব্যবহার করছেন তারা।

এই অভিনব পদ্ধতিতে প্রথমে নির্ধারিত স্থানে একটি গর্ত করে নদী অথবা শাখা নদী থেকে একটি মেশিনের সাহায্যে পাইপের মাধ্যমে পানি এনে গর্তে ফেলা হয়। অন্য আরেকটি মেশিন দিয়ে ওই পানিতে ঘূর্ণায়ন / স্রোতের সৃষ্টি করা হয়। এরপর বড় আরেকটি শ্যালো মেশিন দিয়ে শুরু হয় বালু উত্তোলন। ধীরে ধীরে ছোট্ট গর্তটির পাড় ভাঙ্গতে ভাঙ্গতে বড় পুকুর জলাশয়ের রুপ ধারণ করে। দেখে মনে হবে এ যেন নদীর পাড় ভাঙ্গার দৃশ্য। এভাবে ভাঙ্গতে ভাঙ্গতে বিলীন হয়ে যাচ্ছে চর অঞ্চলের ফসলি জমি। বালু উত্তোলনের এই কর্মযজ্ঞ চলতে থাকলে বাংলাদেশের সয়াবিনের রাজধানীখ্যাত লক্ষ্মীপুরের ‘সয়াল্যান্ড’ ব্যান্ডিং হারিয়ে যেতে বেশি সময় লাগবে না।

স্থানীয়দের অভিযোগ, প্রভাবশালীদের সহযোগিতায় একটি চক্র বিভিন্ন ফসলি জমি থেকে ড্রেজার মেশিন বসিয়ে পাইপের মাধ্যমে অবাধে বালু উত্তোলন করছে। প্রতিবাদ করতে গেলেই তারা তেড়ে আসে হুমকি দেয়। প্রশাসনিকভাবে নিষেধ থাকলেও আইন অমান্য করে তারা সর্বত্র এ কাজ করছে। এলাকাবাসী জানান, এর সঙ্গে জড়িত বড় ধরনের সিন্ডিকেট। বালুদস্যুরা  বিপণনের উদ্দেশ্যে বালু উত্তোলন করায় একদিকে যেমন পরিবেশ বিপন্ন হচ্ছে, অন্যদিকে রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার। উপজেলা প্রশাসন বালু উত্তোলনকারীদের ড্রেজার মেশিন আটক, যন্ত্রাংশ ধ্বংস, ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে আসছে। এর পরও বালুদস্যুরা বিভিন্ন অপকৌশল অবলম্বনের মাধ্যমে এ অবৈধ ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। জমির দামের চাইতে বেশি টাকার বালু বিক্রী করা যায় তাই জমির মালিকেরা বালু বিক্রি করছে। এক একর জমির বর্তমান মূল্য ৫ লক্ষ টাকা আর এই জমি থেকেই তারা ৭/৮ লক্ষ টাকার বালু বিক্রি করছে।  এতে করে ফসলি জমি হচ্ছে জলাশয়। এই ইউনিয়নের ৭৩ শতাংশ মানুষ কৃষি কাজ করেই জীবিকা নির্বাহ করে, ফসলি জমি কমে গেলে বিরুপ প্রভাব পড়বে বলে মনে করেন স্থানীয়রা।

বালু উত্তোলনকৃত স্থানে বসবাস করা রানিয়া বেগম বলেন, আমি ২২ বছর যাবত এখানে বসবাস করছি। আমার তিন মেয়ে দুই ছেলেকে নিয়ে এখানে আমি এসে অনেক কষ্ট করে প্রায় ২৬ শতাংশ জমির মধ্যে বাড়ি সাজিয়েছি। আমি এই জমির রায়ত (রক্ষিতা)  কিন্তু জমির মালিক জমি থেকে বালু বিক্রি করছে। বিল্লাল কবিরাজ আমার বসত ঘর ভেঙ্গে দিয়ে সেখান থেকে বালু উত্তোলন করছে। বালু শ্রমিক মাইন উদ্দিন জানান, এই ডেজার মেশিন বিল্লাল কবিরাজের। এর আগে তাকে একই মেশিন চালানোর দায়ে রায়পুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আটক করে। পরবর্তীতে ‘আর এই কাজ না করার’ শর্তে ছেড়ে দিয়েছিলো এবং তখন এই মেশিন জব্দ করা হয়েছিলো। 

অবৈধ বালু উত্তোলনকারী মোঃ বিল্লাল কবিরাজ বলেন, নদী থেকে বালু উত্তোলন করা অবৈধ কিন্তু মালিকানা জমি থেকে বালু উত্তোলন করলে কোন সমস্যা নাই। তিনি আরো বলেন, ডিসি অফিস (জেলা প্রশাসক কার্যালয়), এসপি অফিস (পুলিশ সুপারের কার্যালয়) থেকে বলেছে মালিকানা জমি থেকে বালু উত্তোলনের ব্যাপারে তাদের কোন আপত্তি নাই। কে বলেছে এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ এর সাধারণ সম্পাদক মফিজ উদ্দিন এবং লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার চেয়ারম্যান এ কে এম সালাউদ্দিন টিপু সহ ইউএনও’র কাছে গেলে তিনিও মালিকানা জমি নিয়ে তাদের কোন আপত্তি নাই বলে জানান। এক একর জায়গা থেকে কত টাকার বালু উত্তোলন করে বিক্রি করা যায় এই প্রশ্ন করা হলে বিল্লাল কবিরাজ জানায়, এক একর থেকে প্রায় ৭/৮ লক্ষ টাকার বালু উত্তোলন করা যায়। আমরা ১ টাকা করে ফুট কিনে কোথাও ৪/৫ টাকা আবার কোথাও ৭/৮ টাকা বিক্রি করি। বিল্লাল কবিরাজ নিজেকে রায়পুর উপজেলার ২নং উত্তর চরবংশী ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সদস্য এবং ২নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি বলে জানান। এছাড়াও তিনি নিজেকে কমিউনিটি পুলিশ বলে দাবি করেন।

২নং উত্তর চরবংশী ইউনিয়ন পরিষদের ২নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য মোঃ সোলেমান মোল্যা বলেন, বিল্লাল কবিরাজ, মিজান, সহেল সহ বালু উত্তোলন যারা করছে এরা কারো কথা শুনে না। প্রশাসন বহুবার অভিযান চালিয়ে এদের মেশিন জব্দ করেছে, জরিমানা করেছে কিন্তু তারপরেও তারা এই কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। রাস্তার নিচ দিয়ে গর্ত করে পাইপ নেওয়ার ফলে রাস্তা নষ্ট হচ্ছে। ২নং উত্তর চরবংশী ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক (বর্তমানে আহ্বায়ক কমিটি) এবং ইউপি সদস্য মফিজ উদ্দিন বলেন, বিল্লাল কবিরাজ যা বলেছে তা সম্পূর্ণ  মিথ্যা। আমি তার সাথে কোথাও যাইনি। এর আগেও  অবৈধ বালু উত্তোলনের কারণে তার ডেজার মেশিন জব্দ করা হয়েছিলো। তখন সে আমাকে বলেছিলো লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলা চেয়ারম্যান এ কে এম সালাউদ্দিন টিপুকে দিয়ে ছাড়িয়ে দিতে। আমি তা করিনি, এমনকি আমাকে তার সাথে যেতেও বলেছিলো আমি যাইনি। এ বিষয়ে জানতে চাইলে (মুঠোফোনে) রায়পুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) অনজন দাশ বলেন, বালু উত্তোলনের বিষয়টি আমার জানা নেই, খোঁজ নিয়ে প্রয়োজনীয় আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

বাংলাদেশের ২০১০ সালের বালুমহাল আইনে বলা আছে, বিপণনের উদ্দেশ্যে কোনো উন্মুক্ত স্থান, চা-বাগানের ছড়া বা নদীর তলদেশ থেকে বালু বা মাটি উত্তোলন করা যাবে না। এ ছাড়া সেতু, কালভার্ট, ড্যাম, ব্যারাজ, বাঁধ, সড়ক, মহাসড়ক, বন, রেললাইন ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ সরকারি-বেসরকারি স্থাপনা অথবা আবাসিক এলাকা থেকে বালু ও মাটি উত্তোলন নিষিদ্ধ। নদীর তলদেশ হতে বালু বা মাটি উত্তোলনের ক্ষেত্রে যথাযথ ঢাল সংরক্ষণ সাপেক্ষে, সুইং করে নদীর তলদেশ সুষম স্তরে (River Bed Uniform Level) খনন করা যায় এইরূপ ড্রেজার ব্যবহার করতে হবে। এবং ড্রেজিং কার্যক্রমে বাল্কহেড বা প্রচলিত বলগেট ড্রেজার ব্যবহার করা যাবে না। দেশের যে কোন চর এলাকা অথবা যে কোন স্থলভাগ হতে বালু বা মাটি উত্তোলন বা বিপণনের প্রয়োজন দেখা দিলে উক্ত বিপণনের জন্য একক কর্তৃপক্ষ হবে ভূমি মন্ত্রণালয়। কিন্তু বাংলাদেশে বাড়ি, রাস্তা, ব্রিজসহ যেকোনো ধরনের কংক্রিট নির্মাণসংক্রান্ত অবকাঠামো সম্পূর্ণ বৈধ বালু দিয়ে করা হয়েছে বলে কেউ দাবি করতে পারবে না। ভারতের উত্তরাখন্ড রাজ্যের হাইকোর্ট এক যুগান্তকারী রায়ে গঙ্গা ও যমুনা নদীসহ বাস্তুতন্ত্রকে জীবন্ত মানুষের মর্যাদা দিয়েছেন। ফলে মানুষের যেসব আইনি অধিকার রয়েছে, এসব নদীরও তেমনি আইনি অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। অবৈধ বালু উত্তোলনসহ অন্যান্য দূষণ থেকে নদীকে বাঁচাতে এ রায় দেওয়া হয়।

অবৈধ বালু উত্তোলন নিয়ে সংবাদমাধ্যমে অনেক খবর দেখা যায়। অবৈধ বালু উত্তোলন ক্ষতিকর-এ ব্যাপারে মোটামুটি সবাই একমত। কিন্তু তা কতটা ক্ষতিকর বা এর প্রভাব আমাদের প্রাকৃতিক পরিবেশে কতটা পড়ছে, তা নিয়ে আরও গুরুতর ভাবনা জরুরি হয়ে পড়েছে। বালু উত্তোলনে সৃষ্ট বায়ুদূষণে মানুষের স্বাস্থ্যঝুঁকি বেড়ে যাচ্ছে। উদ্ভিদ ও প্রাণিকুলের মধ্যে পরিবর্তন ঘটার ফলে তাদের আবাসস্থল যেমন ধ্বংস হচ্ছে, তেমনি তাদের খাদ্যের উৎসও ধ্বংস হচ্ছে। ফলে মৎস্য প্রজনন-প্রক্রিয়া পাল্টে যাওয়ার পাশাপাশি চাষাবাদের জমিও নষ্ট হচ্ছে। পানিদূষণসহ নদীগর্ভের গঠনপ্রক্রিয়া বদলে যাচ্ছে এবং নদী ভাঙছে। পুরো হাইড্রোলজিক্যাল কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। বালু উত্তোলনের কাছাকাছি মাটির ক্ষয় যেমন ঘটছে, তেমনি মাটির গুণাগুণও নষ্ট হচ্ছে। গবেষণায় দেখা যায়, ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নেমে যাওয়ায় মাটির উর্বরতা নষ্ট হয়ে যায়। এ ছাড়া নলকূপে পানি পাওয়াটাও কষ্টকর হয়। এমন কী উপকূলীয় অঞ্চলের পানির লবণাক্ততা বাড়িয়ে তুলছে। বালু উত্তোলনের কারণে নদীর চ্যানেলের পলিমাটির স্তর কমে তলদেশের গাছপালার সংখ্যা কমিয়ে দিচ্ছে, যা নদীর তলদেশের বাস্তুতন্ত্রে সমস্যার সৃষ্টি করছে। বালু উত্তোলনের কারণে নদীভাঙন ও বন্যার ফলে অনেক লোকজন বসতভিটা হারিয়ে অভ্যন্তরীণ শরণার্থী হয়ে অন্যত্র আশ্রয় নিচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনেও এই বালু উত্তোলনের প্রভাব রয়েছে। উত্তোলন-প্রক্রিয়া ও বালু পরিবহন জলবায়ু পরিবর্তনে সরাসরি ভূমিকা রাখে।

সাহস২৪/রকি/রাজ

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত