শ্রদ্ধা-ভালোবাসায় স্ত্রীর পাশে সমাহিত আবদুল গাফফার চৌধুরী

প্রকাশ : ২৮ মে ২০২২, ২১:১৩

আহমেদ মনির
সর্বস্তরের মানুষের শ্রদ্ধা আর ভালবাসায় সিক্ত একজন আব্দুল গাফফার চৌধুরী।

সর্বস্তরের মানুষের শ্রদ্ধা আর ভালবাসায় সিক্ত একজন আব্দুল গাফফার চৌধুরী। ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’ গানের রচয়িতা দেশবরেণ্য সাংবাদিক, লেখক ও কলামিস্ট তিনি। গত ১৯ মে এই কিংবদন্তি ইংল্যান্ডের একটি হাসপাতালে মৃত্যু বরণ করেন। মৃত্যুর নয় দিন পর ফ্রিজিং কফিনে ইংল্যান্ডের আনুষ্ঠানিকতা শেষে তাঁর মৃতদেহ আসে জন্মভূমির মাটিতে। শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে শনিবার (২৮ মে) বিকাল পৌনে ৬টায় রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দেশের বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে তাঁকে দাফন করা হয়। তাঁর শেষ ইচ্ছায় স্ত্রীর কবরের পাশেই তাঁকে সমাহিত করা হয়েছে।

কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে শেষ শ্রদ্ধা নিবেদন করেছেন সর্বস্তরের মানুষ।

১৯৭৪ সালে স্ত্রীর উন্নত চিকিৎসার জন্য লন্ডনে যান আবদুল গাফফার চৌধুরী। জীবনের বাকী সময়টুকু কাটান সেখানেই। হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে সেখানকার একটি হাসপাতালে ১৯ মে ভোরে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন প্রবীণ এই সাংবাদিক। মৃত্যুর সময় তাঁর বয়স ছিল ৮৮ বছর। ১৯৩৪ সালের ১২ ডিসেম্বর বরিশাল জেলার উলানিয়া গ্রামের চৌধুরী বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন আবদুল গাফফার চৌধুরী। তার বাবা হাজি ওয়াহিদ রেজা চৌধুরী ও মা জহুরা খাতুন। তিন ভাই, পাঁচ বোনের মধ্যে বড় ভাই হোসেন রেজা চৌধুরী ও ছোট ভাই আলী রেজা চৌধুরী। বোনেরা হলেন মানিক বিবি, লাইলী খাতুন, সালেহা খাতুন, ফজিলা বেগম ও মাসুমা বেগম। স্বাধীনতাযুদ্ধে মুজিবনগর সরকারের মাধ্যমে নিবন্ধিত স্বাধীন বাংলার প্রথম পত্রিকা সাপ্তাহিক 'জয় বাংলা' র প্রতিষ্ঠাতা ও সম্পাদক ছিলেন তিনি। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় দেশকে স্বাধীন করতে তিনি তাঁর লেখনীর মাধ্যমে অসামান্য অবদান রেখেছেন।

রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর শোক
আবদুল গাফফার চৌধুরীর মৃত্যুতে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী শোক প্রকাশ করেছেন। রাষ্ট্রপতি বলেন, আবদুল গাফফার চৌধুরীর মৃত্যুতে বাংলাদেশ প্রগতিশীল, সৃজনশীল ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী একজন অগ্রপথিককে হারালো। তার একুশের অমর সেই গান বাঙালি জাতিকে ভাষা আন্দোলন ও মুক্তির আন্দোলনে অসীম সাহস ও প্রেরণা যুগিয়েছিল। তার মৃত্যু দেশের সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনের জন্য এক অপূরণীয় ক্ষতি। মরহুম আবদুল গাফফার চৌধুরী তাঁর কালজয়ী গান ও লেখনীর মাধ্যমে প্রতিটি বাঙালির হৃদয়ে চির অম্লান হয়ে থাকবেন।

অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‌আব্দুল গাফফার চৌধুরী, তার মেধা-কর্ম ও লেখনীতে এ দেশের মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে সমুন্নত রেখেছেন ও বাঙালির অসাম্প্রদায়িক মননকে ধারণ করে জাতির পিতার স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়কে সমর্থন করে জাতির সামনে সঠিক ইতিহাস তুলে ধরতে আমৃত্যু কাজ করে গেছেন। তিনি মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশ সরকার নিবন্ধিত সাপ্তাহিক জয় বাংলা পত্রিকায় বিভিন্ন লেখালেখির মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধাদের অনুপ্রাণিত করেছেন। পরবর্তীতে তিনি প্রবাসে থেকেও তার লেখনীর মাধ্যমে বাঙালির মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ দেশি-বিদেশি গণমাধ্যমে তুলে ধরেছেন। “আব্দুল গাফফার চৌধুরীর সঙ্গে আমার বহু স্মৃতি। অনেক পরামর্শ পেয়েছি। একজন বিজ্ঞ ও পুরোধা ব্যক্তিত্বকে হারালাম যিনি তার লেখা ও গবেষণায় আমাদের বাঙালির ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে সমৃদ্ধ করেছেন,” বলেন তিনি।

লন্ডনের আলতাব আলী পার্কের শহীদ মিনারে আব্দুল গাফফার চৌধুরীর প্রতি প্রবাসী বাঙালিদের শ্রদ্ধা নিবেদন।

লন্ডনে আনুষ্ঠানিক জানাজা
মৃত্যুর পরের দিন শুক্রবার (২০ মে) বাদ জুম'আ পূর্ব লন্ডনের ব্রিকলেন জামে মসজিদে নামাজে জানাজা শেষে আলতাব আলী পার্কের শহীদ মিনারে যুক্তরাজ্য প্রবাসী বাঙালিদের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় সিক্ত হয়েছেন তিনি। স্থানীয় সময় বেলা ১.৩০ মিনিটে ব্রিকলেন মসজিদের ইমামের নেতৃত্বে নামাজে জানাজা সম্পন্ন হয়। এ সময় ব্রিকলেন সড়কটি অনেকটা গাড়ী চলাচলের অনুপোযোগী হয়ে পড়ে। গাফফার চৌধুরীর মরদেহ সরাসরি নিয়ে রাখা হয় আলতাব আলী পার্কের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার বেদীতে। শেষবারের মত তাঁকে দেখতে সমবেত লোকজন অনেকটা বিশৃঙ্খল হয়ে উঠেন। প্রাইভেট সিকিওরিটিও যখন শৃংঙ্খলা রক্ষা করতে ব্যর্থ হচ্ছিলো, তখন একপর্যায়ে লন্ডন পুলিশকে এসে তা নিয়ন্ত্রণ করতে হয়। এসময় একে একে যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগ, একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি, জাসদ, সিপিবি, উদীচী শিল্পীগোষ্ঠিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, সামাজিক ও কমিউনিটি সংগঠনের নেতৃবৃন্দরা গাফফার চৌধুরীর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।

আব্দুল গফফার চৌধুরীকে শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে সমাহিত করা হয়। 

সর্বস্তরের মানুষের শ্রদ্ধায় শেষকৃত্য
মৃতদেহ দেশে আনার সব প্রক্রিয়া শেষে শনিবার (২৮ মে) বেলা ১১টা ০৫ মিনিটে গাফফার চৌধুরীর মৃতদেহ বহনকারী বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের একটি ফ্লাইট হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌঁছায়। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বিমান বন্দরে তাঁর মৃতদেহ গ্রহণ করেন। সেখান থেকে দুপুর ১টার দিকে তাঁর মৃতদেহ কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে নেওয়া হয়। সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের আয়োজনে আবদুল গাফফার চৌধুরীর কফিনে শ্রদ্ধা জানান সর্বস্তরের মানুষ। গার্ড অব অনারের সময় বিউগলে যখন করুণ সুর বেজে উঠে, তখন কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে তৈরি হয় শোকাবহ পরিবেশ। পরে ঢাকা জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে গার্ড অব অনার দেওয়া হয়। সেখানে মন্ত্রিপরিষদ সদস্যদের পাশাপাশি শিক্ষাবিদ, সংস্কৃতিকর্মীসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ উপস্থিত ছিলেন। শুরুতে রাষ্ট্রপতির পক্ষে আবদুল গাফফার চৌধুরীর কফিনে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন মেজর জেনারেল এস এম সালাহউদ্দিন ইসলাম। প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন তার সামরিক সচিব ব্রিগেডিয়ার জেনারেল কবীর আহাম্মদ। এরপর স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরীর পক্ষে শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়। আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে শ্রদ্ধা জানান দলটির সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে শ্রদ্ধা জানান উপাচার্য অধ্যাপক মো. আখতারুজ্জামান। দুপুর ১টা থেকে ৩টা পর্যন্ত তাঁর মৃতদেহ শহীদ মিনারে রাখা হয়। বিকাল সাড়ে ৩ টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদে তাঁর জানাজার নামাজ অনুষ্ঠিত হয়। এরপর বিকাল ৪টায় সাংবাদিকদের শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য মৃতদেহ গাফফার চৌধুরী প্রিয় কর্মস্থল জাতীয় প্রেসক্লাবে নিয়ে যাওয়া হয়। প্রেসক্লাবে শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে বিকেল পৌনে ৬টায় শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী মিরপুরের শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে স্ত্রীর কবরের পাশে দাফন করা হয় তাঁকে।

সাহস২৪.কম/এসটি/এসকে.

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত